ভারত থেকে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফেরত আনার সুযোগ সৃষ্টি- ঢাকা-দিল্লী বন্দী প্রত্যর্পণ ও ভিসা সহজীকরণ চুক্তি সই ॥ আনা যাবে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের
ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনীসহ দেশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ সন্ত্রাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ভারতে বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছর মেয়াদে একাধিকবার ভ্রমণের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সোমবার ভারতের সঙ্গে বন্দী বিনিময়ের লক্ষ্যে বহির্সমর্পণ চুক্তি এবং ভিসা সহজীকরণের জন্য সংশোধিত ভ্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশটির কাছ থেকে বাংলাদেশ এ সুবিধা পাবে। সোমবার রূপসী বাংলা হোটেলে বিকেল ৪টায় চুক্তি দুটি স্বাক্ষতির হয়। এতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং ভারতের পক্ষে সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারেক এ করিম ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ।এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে দু’দিনের সফরে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। বেলা আড়াইটায় দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়। আজ মঙ্গলবার সিন্ধে ঢাকা ছেড়ে যাবেন।
এদিকে চুক্তি স্বাক্ষরের পর পরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তাঁর বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফেরত চান। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দেন, লুকিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনীদের খুঁজে পাওয়া গেলে অবশ্যই ভারত বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে।
বহির্সমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, ভারত ও বাংলাদেশ ফৌজদারি মামলায় বিচারাধীন বা দ-প্রাপ্ত আসামি ও বন্দী বিনিময় করতে পারবে। এক বছরের বেশি মেয়াদের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও বন্দীদের বিনিময় করা যাবে। কারও বিরুদ্ধে মামলা, চার্জশীট, বিচার চলমান বা বিচার হয়ে শাস্তি হয়েছে তারা এর আওতায় পড়বে। তবে রাজনৈতিক আসামিদের ক্ষেত্রে এ চুক্তি প্রযোজ্য হবে না। বন্দী বিনিময়ের আবেদনের কতদিনের মধ্যে আসামিদের তুলে দেয়া হবে সে বিষয়ে চুক্তিতে সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। আর ভারত বা বাংলাদেশ কেউ-ই চুক্তিটি বাতিল করতে পারবে। তবে বাতিল করতে চাইলে ছয় মাসের নোটিস দিতে হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের কারাগারেই মোস্ট ওয়ান্টেড আসামিরা বন্দী থাকায় বহির্সমর্পণ চুক্তিটি দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ চুক্তির ফলে ভারত বাংলাদেশের কারাগারে আটক আসামের বিদ্রোহী সংগঠন উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পাবে। ১৯৯৭ সালে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে বাংলাদেশ তাকে আটক করে।
চুক্তির ফলে বাংলাদেশও সুব্রত বাইন ও সাজ্জাদ হোসেনদের মতো পলাতক সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনার সুযোগ পাবে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে সুব্রত বাইনকে গ্রেফতার করে ভারতীয় পুলিশ। আর ফাঁসির আসামি সাজ্জাদ গ্রেফতার হন অমৃতসরে। এছাড়া মহাজোট সরকারের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরে দাবি করে আসছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েক খুনী ভারতে পলাতক রয়েছে। তবে কোন কারাগারে আটক রয়েছে কি না সে বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোন তথ্য দেয়নি দলটি। সরকার আশা করছে, খুনীদের ভারত আটক করতে পারলেই এ চুক্তির আওতায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
চুক্তি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের যত সংখ্যক অপরাধী ভারতে পালিয়ে আছে, এর চেয়ে কম সংখ্যক ভারতীয় অপরাধী বাংলাদেশে পালিয়ে আছে। তাই সংখ্যাগত দিক দিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হবে। আর অনুপ চেটিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আদালতে রিট করেছেন অনুপ চেটিয়া। ওই রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত যেসব আসামি ভারতে পালিয়ে আছে, চুক্তির পর ভারত সরকার তাদের ধরিয়ে দিতে সহায়তা করবে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে মৃত্যুদ- দেয়া হয় ১২ জনকে। এর মধ্যে ৫ জন হলো সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বাকি ৭ জনের মধ্যে আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেমউদ্দিন ও আব্দুল মাজেদ বিদেশে পালিয়ে আছেন। তাদের মধ্যে দু’জন ভারতে পালিয়ে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হয়। দ-প্রাপ্ত আব্দুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান। পলাতক খুনিদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে।
এদিকে এ চুক্তির আওতায় ভারত প্রথম কাকে ফিরিয়ে নেবে জানতে চাইলে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, এই মুহূর্তে কোন নাম প্রকাশ করতে চাই না। যাদের এই চুক্তির আওতায় ফিরিয়ে নেয়া হবে, তাদের নাম সরকারী পর্যায়ে জানানো হবে। আমরা এখনই গণমাধ্যমে কিছু বলছি না।
এদিকে সংশোধিত ভ্রমণ চুক্তির ফলে বাংলাদেশী পর্যটকরা এক বছর মেয়াদে মাল্টিপল ভিসা পাবেন। এর আগে ভারত বাংলাদেশী পর্যটকদের সর্বোচ্চ ছয় মাসের ভিসা দিয়ে আসছিল। এ চুক্তির আওতায় ভারতে চিকিৎসার জন্য ভ্রমণের ক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে যেতে পারবেন তিন জন। অকূটনৈতিক ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে সময়সীমা আরোপ, ব্যবসায়ী জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি, বয়স্ক নাগরিক ও শিশুদের জন্য পৌঁছামাত্র ভিসা দেয়ার সুযোগ থাকছে। নতুন এ চুক্তির বাস্তবায়ন শুরু হবে আগামী এপ্রিল মাস থেকে।
সীমান্তে মানুষ হত্যার সমালোচনায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ॥ চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিএসএফের হাতে বাংলাদেশী হত্যাকা-ের প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার সিন্ধে বলেন, সীমান্তে মানুষ হত্যা উচিত নয়। বিএসএফের হাতে বাংলাদেশীদের নিহত হওয়ার ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি প্রক্রিয়াধীন। এ বিষয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টের অনুমোদন লাগবে।
No comments