বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম-আমাদের শিশুরা কী শিখছে?
বলা হয়ে থাকে, মা-বাবার পরই শিশুর কাছে শিক্ষক_ বাড়ির পরই বিদ্যায়তনের স্থান। মা-বাবার কাছে শিশু শিক্ষা পায় বটে কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি নিয়ে জগতের কর্মযজ্ঞে প্রবেশের মন্ত্র পায় শিক্ষকের কাছেই। ফলে শিক্ষক ও শিক্ষায়তনের দায়িত্ব অনেক বড় ও মহান।
কেউ যদি প্রশ্ন করেন, আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলো শিশুদের কী শিক্ষা দিচ্ছে তবে যে উত্তর মিলবে তাতে সচেতন নাগরিক মাত্রই হতাশ হবেন। দেশের গুটিকয়েক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে প্রত্যাশিত শিক্ষা মেলে। বাকি স্কুলগুলোর মধ্যে যেগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো সেগুলোতে বছর শেষে শিশুরা শুধু পরীক্ষা দিয়ে কৃতকার্য হওয়ার মতো বিদ্যা অর্জন করতে পারে। প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য যে সর্বব্যাপ্ত শিক্ষা কার্যক্রম তার দেখা ভালো বলে কথিত বিদ্যায়তনগুলোতেও অনেক সময় মেলে না। আর যেগুলো ভালো বিদ্যালয় নয় সেগুলোর অবস্থা শোচনীয়। এ পরিস্থিতি শহর ও গ্রামভেদে আলাদা। শহরের অপেক্ষাকৃত মন্দ বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকমণ্ডলী আছে, বিদ্যালয়ের অবকাঠামো এবং শিক্ষা উপকরণও আছে। কিন্তু শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের মন নেই। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের চেয়ে কোচিং বা প্রাইভেটে পাঠদানের ব্যাপারেই তাদের বিশেষ আগ্রহ। ফলে মন্দ বিদ্যালয়ে ভর্তির খেসারত দিয়ে অভিভাবকদের মোটা অঙ্কের খেসারত গুনে বিদ্যালয়ের বাইরে থেকে শিক্ষা কিনতে হয়। শিক্ষার্থীর বিদ্যা অর্জন তাতে হয় বটে, উচ্চতর শ্রেণীতে উত্তরণও ঘটে। কিন্তু অভিভাবকের স্বস্তি মেলে না। গ্রামের মন্দ স্কুল বললে আরও করুণ ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখানে আছে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব, শিক্ষা উপকরণ এবং অবকাঠামোর অভাবও। শিক্ষক যারা আছেন তারা একদিকে নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের বদলে ব্যক্তিগত কাজের ব্যাপারেই বেশি উৎসাহী, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কাজে তাদের অংশগ্রহণও অনেক সময় খেয়ে ফেলে। শুধু তাই নয়, রোল কল করতে ক্লাসের সময় শেষ হওয়ার মতো পরিস্থিতিও অনেক বিদ্যালয়ে আছে। ব্যক্তিগত, দাফতরিক, সরকারি-বেসরকারি দায়িত্ব পালনের পর শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময় কোথায়? এ অবস্থায় শিশুরা শিখছে খুব সামান্যই। ক্ষেত্রবিশেষে কিছুই শিখছে না। এর প্রভাব পড়ছে এসএসসি পর্যায়ের পরীক্ষায়। গ্রামের অনেক স্কুলে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাত্র পাস করছে। পরিস্থিতি যেমন তাতে ৫০ শতাংশ পাসের ঘটনাও বিস্ময়কর। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ঐকান্তিক চেষ্টা, বিদ্যালয়ের বাইরে কোচিং এবং প্রাইভেট টিউটরদের মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া এমন ফলও হয়তো মিলত না। সব মিলিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াকিবহাল মানুষ উদ্বিগ্ন। প্রশ্ন উঠছে, এমন শিক্ষা দিয়ে আমরা যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মাণ করছি তারা কেমন হবে? এ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আমাদের দেশকে একটি প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে নেতৃত্ব দিতে পারবে? সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। শিক্ষামন্ত্রীও শিক্ষার মান অর্জনের চ্যালেঞ্জ অনুভব করছেন। দীর্ঘদিন ধরে যে অশিক্ষার অচলায়তন বিদ্যালয়গুলোতে গড়ে উঠেছে তা থেকে রাতারাতি মুক্ত হওয়াও হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা হওয়া দরকার। সরকারের তরফে কার্যকর উদ্যোগ আসা দরকার। কেননা গুটিকয়েক ভালো স্কুলের বাইরে অধিকাংশ যদি নামকাওয়াস্তে পাঠদানে নিয়োজিত থাকে তবে শহরের শ্রেণীগুলোর মধ্যে যেমন, শহর এবং গ্রামের মধ্যেও তেমন ব্যবধান দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে। এটি কারও জন্যই কাম্য হতে পারে না।
No comments