কৃষি খাতে সরকারের সাফল্য by এ এম এম শওকত আলী

র্তমান সরকারের তিন বছর পূর্তির পর এর ব্যর্থতা ও অর্জন নিয়ে মিডিয়ায় জনমত জরিপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি মহল থেকে কিছু প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করা হয়েছে। এতে সাফল্যের কথাই বলা হয়েছে। জনমত জরিপে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসকে অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেসব খাতে সরকারের সাফল্য দৃশ্যমান, তার অন্যতম হলো কৃষি। কিছুসংখ্যক অর্থনীতিবিদ এই খাতসহ বিদ্যুৎ খাত চিহ্নিত করেছেন।


যেকোনো সরকারের জন্য সব খাতে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। এটা আশা করাও বৃথা। তবে উন্নয়নের এক খাত অন্য খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যেমন_ ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব হয়। তবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই এ ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এমন কোনো কথা নেই। এ বিষয়টিই প্রমাণ করেছে সম্প্রতি সম্পাদিত খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি সংক্রান্ত একটি জাতীয় জরিপ। গত ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত এক সংবাদে এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। জরিপের মূল ফলাফল হলো, ক্ষুধার্ত মানুষ এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাই এতে আক্রান্ত হয়েছে। মোট শিশুর ৭৫ শতাংশ এর মধ্যে রয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অধিকতর। মূল বিষয়টি আক্রান্ত পরিবারের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। এটা শুধু চাল কেনার অক্ষমতাই নয়, বরং আমিষজাতীয় খাদ্যদ্রব্যসহ ভোজ্য তেল ও শাকসবজি। বিষয়টি অনেকটা গোলকধাঁধার মতো। তাই কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে_এ কথা বলা যাবে না।
অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ও বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালায়। অন্যথায় চালের দাম আরো বেড়ে যেত। খাদ্যমন্ত্রীর মতে, এ বছর তাঁরা ২২ লাখ টন চাল-গম বিতরণ করেছেন। সব ধরনের দরিদ্র পরিবারের জন্য বিনা বা স্বল্প মূল্যে চাল-গম দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায়, যারা এ ধরনের কাজে লিপ্ত, তাদের দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করতে পারলে পরিস্থিতি আরো ভালো হতো। পক্ষান্তরে এ কথাও বলা সম্ভব, অতীতেও খাদ্য নিরাপত্তাসহ পুষ্টিবিষয়ক গবেষণা করা হয়েছে। এতেও দেখা গেছে, সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তাসহ পুষ্টি নিরাপত্তার অভাব ছিল। প্রয়োজন সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর কার্যক্রম অধিকতর সুসংহত করা, এসব কার্যক্রমের দুর্নীতিসহ অপচয় রোধ করা। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি হলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে স্বভাবতই তারা ক্ষুব্ধ হয়। তাদের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
কৃষি খাতে ভর্তুকি দিলে কৃষকদের উৎপাদন খরচ হ্রাস পায়। এ বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ হলেও আশির দশকের শেষার্ধ থেকেই দাতাগোষ্ঠী বা উন্নয়ন সহযোগীরা কৃষি খাতে পর্যায়ক্রমে ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সরকারকে ক্রমাগত চাপ দেয়। শেষ পর্যন্ত তাদের এই প্রচেষ্টা সফলও হয়। নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধেই এ লক্ষ্য তারা অর্জন করে। ১৯৯৬-২০০১ সালে বর্তমান মহাজোট ক্ষমতাসীন হয়ে এ খাতে ভর্তুকির পুনঃপ্রবর্তন করেছিল। পরিমাণ প্রথম বছর ছিল সীমিত, যা পরবর্তীকালে বৃদ্ধি করা হয়। ২০০১ সালের পর যে দল ক্ষমতা গ্রহণ করে, সেই দলও একই নীতি অনুসরণ করে। ১৯৯৬-২০০১ সালের শেষ দিকে দেশে প্রলয়ংকরী বন্যা হয়। ওই সময় বিবিসিতে প্রচার করা হয়, কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ অনাহারে মারা যাবে। কিন্তু তা হয়নি। কারণ বন্যা-পরবর্তী সময়ে উৎপাদন আশাতীতভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি খাত বিদেশ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্যও আমদানি করা হয়েছিল। এটাও ছিল সাফল্যের অন্যতম কারণ।
ভর্তুকি সম্পর্কে বলা যায়, সব অঞ্চলে ঢালাওভাবে ভর্তুকি দেওয়া সমীচীন নয়। এমনই একটি মন্তব্য বা পরামর্শ দিয়েছেন একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। তাঁর দৃষ্টিতে বড় ও মাঝারি কৃষকরাও বর্তমানে ভর্তুকি পাচ্ছেন, যা কাম্য নয়। তিনি টার্গেট করে ভর্তুকি দেওয়ার কথা বলেছেন। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায়, বড় ও মাঝারি কৃষকের সংখ্যা কত? বলা যায়, মোট কৃষকের ৮০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি হলেই একটা হৈচৈ হয়। প্রচারে কিছুটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে আর কিছুটা রাজনৈতিক কারণেই এটা হয়। সব দেশেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বিশেষ পরিস্থিতির কারণে ওঠানামা করে। বর্তমানে ডিজেলসহ অন্যান্য জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার পেছনে যে যুক্তি, তা হলো_তা ভর্তুকি হ্রাসেরই চেষ্টামাত্র। এটা না করেও কোনো উপায় নেই। এর ভার সহনীয় করার জন্য প্রয়োজন কৃষকের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। যদি এটা সম্ভব হয়, তাহলেই কৃষকদের জন্য সহনীয় হবে। তাঁরা উৎপাদনে উৎসাহী হবেন। মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করার সময় প্রতিবাদীরা কৃষকদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি ভেবে দেখে না। সংসদেও কখনো এ বিষয়টি আলোচনা হয়নি। এ কারণেও অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। সংসদে আলোচনা না হওয়ার মূল কারণ বিরোধী দলের ক্রমাগত অনুপস্থিতি, যা সংঘাতময় রাজনীতির জন্যই হয়েছে। এ ছাড়া সংসদে কৃষকদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলার লোকের খুবই অভাব। তাঁদের কোনো লবিস্ট (Lobbyist) নেই।
এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, কৃষি খাতে সরকারি নীতি সফল হয়েছে। কিছুসংখ্যক সমালোচক হয়তো এ কথা সহজে মেনে নেবেন না। সেটা ভিন্ন কথা। এ বছর কৃষি খাতে সাফল্য অনেক। যা সত্য, তা স্বীকার করাই ভালো। নীতির বিষয়ে সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সারের মূল্যহ্রাস, যা সুষম সার ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করেছে। এ জন্য সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, অধিকতর চাল উৎপাদনের জন্য এর প্রয়োজন ছিল। এই পদক্ষেপ থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, উপকরণের সহনশীল মূল্য সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একটি ভালো হাতিয়ার, যা একমাত্র প্রচারণার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়। আর যারা এই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কথা স্বীকার করতে রাজি নয়, তাদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি আরো প্রসারিত করার প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের ভবিষ্যতের জন্য অনেক কিছু করার আছে, যা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিক্ষেত্রভুক্ত নয়। যেমন_১. পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম অধিকতর সুসংহত করা ২. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ৩. উন্নয়ন পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন।
কৃষিনীতির হালনাগাদ খসড়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে আরো মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। কৃষি প্রযুক্তির সংখ্যা অনেক। এর বেশির ভাগ উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বীজ। অথচ সমীক্ষায় দেখা গেছে, অতি অল্পসংখ্যক বীজই কৃষকের কাছে গ্রহণযোগ্য। কৃষি প্রযুক্তির সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে সময়সাপেক্ষ। তবে সম্প্রসারণ কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করলে গতি বৃদ্ধি সম্ভব। প্রায় দেড় কোটি কৃষকের কাছে পেঁৗছা সম্ভব নয়। এ জন্য ইতিমধ্যে গঠিত কৃষক সংগঠন, যেমন_আইপিএস/আইসিএম ক্লাবগুলোর দিকে অধিকতর দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। তাঁদের সদস্যরা সবাই কৃষক। তাঁদেরই সম্প্রসারণ কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। এ-সংক্রান্ত কিছু উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। যে বেসরকারি খাতকে উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে দাতা সংস্থাগুলো পরামর্শ দেয়, তারা ভুলে যায়, বেসরকারি খাতের বৃহত্তর অংশ কৃষক। কৃষি উপকরণ বিতরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতকেও কৃষি উন্নয়নে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা। সামাজিক দায়িত্ব পালনে কৃষি উপকরণসংক্রান্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিকতর দায়িত্বশীল হতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হবে সহায়ক ভূমিকাসহ মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে এসব বেসরকারি খাত দায়িত্বশীল না হলে তারা সরকার ও কৃষকদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে না।
কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ সাফল্যের চিহ্নিত হুমকিগুলো যথাসম্ভব দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ-সংক্রান্ত কিছু কাজ সরকার ইতিমধ্যেই হাতে নিয়েছে। যেমন_ উপকূলীয় ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন। অন্যদিকে কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। এ ব্যাপারে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কৃষিজমি সুরক্ষার জন্য একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ শেষ পর্যায়ে। বর্তমান সরকারই ২০০১ সালে ভূমি ব্যবহার নীতি প্রণয়ন করে। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটা ফাইলবন্দি ছিল। তবে আইন করেই সমস্যার আশু সমাধান হবে না। মেগা প্রকল্পের ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। কারণ এসব প্রকল্পের ফলে বহু পরিমাণ কৃষিজমি ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণের হুমকি। এ কারণেও কৃষিজমি হ্রাস পায়। সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত নগরায়ণে সচেষ্ট হলে কৃষিজমির হ্রাস অনেকাংশে রোধ করা যাবে। এ-সংক্রান্ত অন্য একটি হুমকি হলো, কৃষিজমির উর্বরতার সুরক্ষা এবং এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নিরূপণের জন্য সরকারের ভূমিসম্পদ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই সংখ্যা দুর্বল। এর প্রতি সরকারের অবহেলাও এ সমস্যাকে ঘনীভূত করেছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে প্রয়োজনীয় জনবলসহ সম্পদের জোগান দিলে ভবিষ্যতের জন্য এরা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে। এ বিষয়টি মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগ রোধের জন্যও অত্যন্ত জরুরি। মাত্রাতিরিক্ত সার প্রয়োগ রোধ করা গেলে সরকারেরও এ-সংক্রান্ত ব্যয় হ্রাস পাবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.