ফজল শাহাবুদ্দীনের কথা ও কবিতা- শিলাইদহ থেকে নিউইয়র্ক by ড. সরদার আবদুস সাত্তার
এক অর্থে প্রতিটি দিনই কবির জন্মদিন।
কেননা জগত সংসারের কাছে যিনি কবি হিসেবে পরিগণিত, তিনি তো প্রতিদিনই তাঁর
নিজের মধ্যে নিত্যনতুনভাবে জন্মগ্রহণ করেন।
এক-একটি নতুন
উপলব্ধির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন ভিন্ন ভিন্ন নতুন কবিতার জন্ম দেন, সেই
নবর্জিত উপলব্ধি এবং সদ্য সৃষ্ট কবিতাও তাঁকে দান করে একটি নতুন জন্মের
আস্বাদ। একে সেই জন্মের সবটুকুই তাঁর উপলব্ধি ও চেতনা প্রসূত জন্ম। আর এই
নব নব জন্ম থেকে জন্মান্তরের অবিরল প্রবাহে ভেসে চলেন বলেই তো তিনি কবি।
কিন্তু একই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবি সত্তার অনন্যতা প্রকাশ করতে গিয়ে
একবার লিখেছিলেনÑ“যে আমি স্বপনমূরতি গোপন করি/আপন গানের কাছেতে আপনি
হারি/সেই আমি কবি-কে পারে আমারে ধরিতে?” একই উপলব্ধিতে সমর্পিত হয়ে সৈয়দ
আলী আহসান লিখেছিলেন “আমাকে ধরা যায় না, তবে সত্তার নিভৃতে অতলীন হয়ে থাকা
কবিকে ধরতে পারা না গেলেও তাঁর বাহ্যিক কাঠামোতে অস্তিত্বময় মানুষটিকে ধরা
যায়। সাল-তারিখ, গজ-ফুট, কেজি-পাউন্ড ইত্যাদি নানা এককে তার একটি দৃশ্যমান
পরিচয় বা অবকাঠামোকেও দৃষ্টিগোচর করে তোলা যায়। এই পৃথিবীর মানুষ হিসেবে
সেই পরিচয়কে আমরা কেউই অগ্রাহ্য করতে পারি না। অতএব, ‘কবিকে ধরা যায় না’ এ
কথা স্বীকৃত সত্যের মর্যাদা পাবার পরও ভূ-পৃষ্ঠে জন্ম ও মৃত্যু গ্রহণ করার
একটা সুনির্দিষ্ট সাল তারিখের গণ্ডিতে ধরা থাকে তার ধরাধামের জীবনকাল। ধরা
থাকে জন্মের তারিখ, জন্মোৎসবের আলো-আঁধার এবং জন্মের সমুদয় দক্ষিণা।
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখছি, আর মাত্র দুদিন পর। ৪ ফেব্রুয়ারির প্রভাতে সূর্য যখন সারা পৃথিবীতে সকালের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দেবে। সেই আলোতে হেসে উঠবে আমার অতি প্রিয় কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ৭৭তম জন্মদিন। কবিতা যেহেতু আমাদের মনোলোকের অনেক অর্গলবদ্ধ দরজা-জালানা খুলে দেয়, তাই তার ভক্ত অনুরাগীরা জন্মদিনের সকালে শ্রদ্ধা শুভেচ্ছা ভালোবাসা জানাতে কার্পণ্য করে না। কার্পণ্য করে না ফুলের হাসি আর সুগন্ধের সমাবেশ ঘটাতেও। ৪ ফেব্রুয়ারির সকাল দুপুর, বিকেল এবং সন্ধ্যায় সুবাসিত ফুল আর সৌরভ ছড়ানো শুভেচ্ছা পারস্পরিক মেলবন্ধনে ফজল শাহাবুদ্দীনের চারপাশে যে আরেকটি নতুন কবিতার আবহ রচনা করবেÑদুই দিনের দূরত্বে বসে আমি শুধু তার রূপকলা, দৃশ্যকলা, শব্দকলা এবং গন্ধকলা-সব যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি আমার নিজের পাঠানো শুভেচ্ছার সাথে ফুটে ওঠা রংধনু রংয়ের বর্ণচ্ছটা।
আবার সামনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পেছনে অনেক পেছনে ২২ বছর পেছনে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি প্রাঙ্গণে অস্থায়ীভাবে নির্মিত তাঁর ১৩০তম জন্মজয়ন্তীর সুদৃশ্য অনুষ্ঠান মঞ্চটির দিকে তাকাচ্ছি, সেই দৃশ্যটি তার রূপ রস রং আলো শব্দ গন্ধ-সবকিছু নিয়েই আমার স্মৃতি সঞ্জীবিত দৃষ্টির সামনে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ১৩৯৭-এর ২৫ বৈশাখে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের সেই মূল মঞ্চে বসে আছেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। বসে আছেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং সৈয়দ আলী আহসান। সকলের মুখেই স্মিত হাসি। প্রশান্ত অভিব্যক্তি। আর সেদিক থেকে একটুখানি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেই দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই মহিমোজ্জ্বল কুঠিবাড়ি, যেখানে তিনি একাধিক্রমে ১০ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করে গেছেন এবং অবিরামভাবে লিখে গেছেন অজস্র কালজয়ী লেখা। আর সেই কুঠিবাড়ির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে সমবেত অগণিত শ্রোতা এবং দর্শক। এদের কেউ এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কেউ এসেছেন দেশের বাইরে থেকে এবং অন্যরা এসেছেন আশপাশের এলাকা থেকেÑযাদের কেউই এখানে এমন সমাবেশ এবং এমন আয়োজন এর আগে আর কখনোই দেখেনি। সকলের দৃষ্টিই মঞ্চের দিকে।
ঘটনাক্রমে হুমায়ূন আহমেদ, ড. সিদ্দিক, আমি এবং ওয়ায়েদ ভাইসহ আমাদের আরও কয়েক বন্ধু সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। তাই মঞ্চের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা ঢাকা থেকে সদলবলে বাসে চেপে আগের দিন কুষ্টিয়ায় পৌঁছেছিলাম। পঁচিশে বৈশাখের সকালে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমাদেরকে শিলাইদহে পৌঁছে দিয়েছিলেন আর সেদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে সৈয়দ আলী আহসান এবং ফজল শাহাবুদ্দীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে হেলিকপ্টারে চড়ে গিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে, তাঁর কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গণের সেই মোহময় সকাল, আমাদের সকলের কাছেই আজও জীবন্ত হয়ে আছে। সকালের নরম আলোয় ছেয়ে যাওয়া আমার এক চিলতে দক্ষিণের বারান্দায় বসে আমি যখন সেই অবিস্মরণীয় সকালটির দিকে ফিরে তাকাইÑ এক আশ্চর্য শান্তি, স্বস্তি এবং প্রসন্নতার আলোছায়াকে সেখানে খেলা করে বেড়াতে দেখি। সেই সকালের আলো আনন্দ ধ্বনি গন্ধ আজও আমার মনের চারপাশে তাদের অমলিন আভা ছড়িয়ে যায়। বরুন ফুলের গন্ধে ভরা সেই বৈশাখ সকালের বাতাস আজও যেমন করে আমার নিঃশ্বাস ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিশে আছে। তেমনি সেদিনের সেই মঞ্চ থেকে উদ্ভাসিত কথা ও কবিতার মোহ জাগানো শব্দগুলো আজও আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে মূর্ছনাময় ধ্বনির তরঙ্গ ছড়িয়ে যায়। কী আশ্চর্য আবেশ ছড়ানো বক্তৃতাই না সেদিন ফজল শাহাবুদ্দীন, রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং সৈয়দ আলী আহসান ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে করেছিলেন। একজন কবি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলেন, তখন এমনিতেই কথা আর কবিতার দূরত্ব অনেকখানি কমে যায়। কিন্তু তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মননের দীপ্তি এবং পরিশীলিত আবেশ, তাহলে সেই কথাও যে হয়ে ওঠে অনবদ্য কবিতা ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিকণ্ঠে উচ্চারিত শব্দাবলি, সেদিন আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। পেলব এবং কবিতার সঙ্গে আমাদের মন ও মননের সম্পর্কসূত্র ধরেই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর কথা এবং অচিরেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কবিতার সম্রাট রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জন্মতিথির কাছে। বলেছিলেন, “কবিতা মানুষের অন্তর্নিহিত কোমল ও ধ্যানী এবং কলানিপুল সত্তার প্রতিচ্ছবি। হাজার হাজার স্বপ্নের ভেতরে অচিন্তনীয় পাখিদের যে অবিশ্বাস্য উড়াল। তার শব্দের মতো এক ধরনের নিস্তব্ধতার নামই হলো কবিতা। কবিতা যেমন আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভাব-তন্ময়তা সৃষ্টি করে, তেমনি আবার নানান সংক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত অনুভবেরও জন্ম দিয়ে যায় আজকের এই বৈশাখী সকালের স্নিগ্ধ-উজ্জ্বল রোদ সারা গায়ে মেখে নিয়ে দৃষ্টির সামনে একেবারে জীবন্ত হয়ে ঐ যে আশ্চর্য লাল বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে তার খোলা জানালার সামনে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিন-রাত ভরে একসময় লিখেছেন অজস্র কালজয়ী কবিতা। লিখেছেন গর্জনশীল পদ্মার বুকে ময়ূরপঙ্খীর মতো ভেসে চলা ‘পদ্মা বোটে’ বসেÑযেটিকে এখানে প্রদর্শনের জন্য তুলে রাখা হয়েছে এই কুঠিবাড়িতেই। সারা জীবনে লেখা কবিতাবলির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন আমাদের আত্মার আনন্দধ্বনি এবং আত্মাকে প্রতিধ্বনিত করে গেছেন। তেমনি দৃশ্যমান নিসর্গ জীবন সুন্দরতা পৃথিবীকেও নতুন এবং গভীরভাবে চিনতে শিখিয়েছেন। বাঙালীকে তিনি শুদ্ধ প্রেমের সন্ধান দিয়েছেন, সৌন্দর্য স্বদেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সৌন্দর্য ও আনন্দের আচ্ছাদনে তারা এক স্বপ্নের উপবনে তিনি আমাদের আবাস তৈরি করে দিয়েছেন। এই মর্ত্য এবং মর্ত্যবাসীর জন্য তাঁর বিশাল হৃদয়ের ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে আমাদের মনে চির আসীন হয়ে আছেন। আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিংড়ে নিয়েছেন। অথচ আমাদের এই পরম ভালোবাসার কবিকে গোটা পাকিস্তান আমলে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নানা ধরনের অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। কিন্তু আজ দিন বদলেছে। কবির শক্তির কাছে রাজা, রাজপুরুষ এমনকি রাষ্ট্রের শক্তিও যে নেহাত নগণ্য রবীন্দ্রনাথ তা প্রমাণ করেছেন। তাই তাঁরই ১৩০তম জন্মজয়ন্তীতে আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অর্ঘ্য দিতে তাঁর পুণ্য বাসস্থানে এসেছেন। তবে একা আসেননি। সৈয়দ আলী আহসানের মতো অনন্য সাধারণ কবি, বাগ্মী ও প-িতকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, এসেছেন আমার মতো কবিতার প্রেমে আচ্ছন্ন এক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। আর সামনে যাঁরা বসে আছেন-দেশ বিদেশের শিল্পী সাহ্যিতিক প-িত দার্শনিক-তাঁরাও এসেছেন তাঁর আমন্ত্রণ এবং প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকর্ষণে। এ দেশের মাটি ও মানুষের কাছে যা তাঁর বহুদিনের প্রাপ্য ছিলÑআজই তা তিনি প্রথমবারের মতো পরিপূর্ণভাবে পেলেন। আজ তাই শুভদিন। আজকের আলো, আজকের বাতাস, আজকের গান, আজকের কথা। আজকের কবিতা কিংবা আজকের ফোটা ফুল সবই অন্যরকম। আর এই অন্যরকম দিনে, এই অন্যরকম পুণ্যভূমিতে সমবেত সকল রবীন্দ্রানুরাগীকে আমার অন্যরকম ভালোবাসা, অন্যরকম অভিনন্দন। সেই অভিনন্দন হৃদয় দিয়েই গ্রহণ করেছিলেন, সেদিনের অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে সমবেত সকল দর্শক-শ্রোতা। হাজার করতালিতে মুখর হয়ে উঠেছিল কুঠিবাড়ির আকাশ-বাতাস। অনুষ্ঠান শেষে সেই আকাশে ভেসে ভেসেই ফজল শাহাবুদ্দীন ফিরে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু আমি থেকে গিয়েছিলাম তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সমাপ্তিপূর্ণ পর্যন্ত। সেই তিন দিন এবং তার পরবর্তী অগণিত দিনরাতের সঙ্গে ওই পঁচিশে বৈশাখের সকালটি তার সবটুকু সৌরভ আর সজীবতা নিয়ে একাত্ম হয়ে মিশে আছে।
বহু বছর ধরে আমি ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা পড়ে আসছি। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের মতো তাঁর কোন কবিতাও আমার কাছে কখনো পুরনো মনে হয় না। একটা লাবণ্যময় সজীবতা অনুক্ষণ যেন তাকে স্পর্শ করে থাকে। এবং অনাস্বাদিত অনুভবের মায়াবী প্রদীপ হয়ে তা বুকের মধ্যে আলো ছড়াতে থাকেÑতা সে স্বদেশ অথবা নিসর্গ কিংবা প্রেমÑ যা নিয়েই লেখা হোক না কেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও তিনি লিখেছেন একাধিক অনবদ্য কবিতা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও মিশে আছেন তাঁর সত্তার সুরভীতে। মিশে আছেন আবেশের আলোকনায়। গত শতকের সেই ফেলে আসা ষাটের দশকে যখন রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রীয় মুর্খতা এবং ষড়যন্ত্রের শিকার তখন থেকেই সেই ভ্রান্তি ও অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার তাই কবিতীর্থ শিলাইদহের বর্ণাঢ্য রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান মঞ্চে তাঁকে হাসিমুখে বসে থাকতে এবং বকুলগন্ধে ভরা বাতাসে ছড়িয়ে পড়া তাঁর কথা শুনতে এত ভালো লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথকে তিনি তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়েই ভালোবেসেছেন। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে কখনোই পূজা পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিপন্ন করে ফেলেননি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি যখন রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা অধ্যায় নিয়ে তাঁর ব্যক্তি জীবনকেন্দ্রিক গল্প লেখার ঝুঁিকপূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তাই আমি তখন তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, হয়তো বা অর্বাচীনও। সেই সময় তিনি লেখাগুলো পড়ে পত্রিকা অফিস থেকে আমার টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমাকে একেবারে চমকে দিয়ে ফোনে বলেছিলেন, “আমার নাম ফজল শাহাবুদ্দীন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা তোমার গল্পগুলোর একজন অনুরাগী পাঠক। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে। কবে আসছ বল তো? সেদিন আমি তোমাকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াব।” টেলিফোন ছাড়ার পর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভেবেছিলাম প্রাণের বিপুল ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ না হলে কেউ কাউকে এমন করে কাছে টেনে নিতে পারে না। আলাপ পরিচয়ের পর যতদিন গেছে। ততই নিবিড়ভাবে অনুভব করেছি তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা।
নারী নিসর্গ ভালোবাসা স্বদেশ বিদেশ নদী সমুদ্র পাহাড় পৃথিবী রোদ বৃষ্টি আলো অন্ধকার ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে নানা আঙ্গিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক মায়া-জড়ানো আর নেশাধরানো আর ঘোরজাগানো কবিতা লিখেছেন ফজল শাহাবুদ্দীন। সেই কবিতাগুলোর কাছে তো বারবার আমাদের যেতেই হয়। এবং যেতেই হবে। তাঁর সৌন্দর্যসন্ধানী মায়াবী চোখ দিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে যেমন নানা রূপ ও মহিমার সংশ্লেষে অপরূপ হয়ে উঠতে দেখেছি, তেমনি দেখেছি পৃথিবীর অনেক আলোকোজ্জ্বল শহরের মধ্যরাত। এবং দেখেছি তাদের অলিগলি রাজপথ আর বিলাসী অট্টালিকাসমূহও। নাগরিক কবি তিনি। তাই পৃথিবীর সকল শহর ও শহরবাসীকে গিরেই রয়েছে তাঁর কৌতূহল ও ভালোবাসা। পৃথিবীর সব শহরেই তিনি পা রাখতে চান। এবং সেই উপলব্ধি-রাঙানো অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে চান একেকটি অধিনাশী কবিতা। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বলেই পৃথিবীর সমুদয় শহরকে তিনি ভাগ করেছেন তিনটি পর্যায়ে। প্রথম তালিকায় রয়েছে সেইসব পরিতুষ্টি দানকারী শহর যার কংক্রিটে পা রেখে তার রূপবতী রাতের এলোচুলের ঘ্রাণে ভরিয়ে তুলতে পেরেছেন সোনালি আল্পনা আঁকা কবিতার খাতা। দ্বিতীয় তালিকায় থাকা শহরগুলোর শরীর ছুঁয়েছেন তিনি দু’হাতে, কিন্তু তার হৃদয় গহনে লুকানো আলো- আঁধার আর রহস্য নিয়ে রচনা করতে পারেননি কোনো কাক্সিক্ষত কবিতা আর তৃতীয় তালিকার বিস্তৃত পরিসর জুড়ে নাম লেখা আছে সেইসব শহরের যেখানে আজও পৌঁছেনি তাঁর তৃষ্ণাতুর দৃষ্টির আলো। তবে ফজল শাহাবুদ্দীন এই তিনটি তালিকার পাশাপাশি আরও একটা ভিন্ন পর্যায়ের শহর তালিকা অনায়াসেই করতে পারতেন যে শহর অথবা শহরগুলো আজও তাঁর অপেক্ষাÑ কিন্তু তাকে আশ্রয় করেই হৃদয়ের উত্তাপ আর সন্তাপ ঢেলে লেখা হয়ে গেছে। মায়াজড়ানো অপূর্ব সব কবিতা যেমনÑ‘নিউইয়র্ক এবং একটি বাসী শুকনো গন্ধরাজ’।
অনেক আগে বুদ্ধদেব বসু রাজশাহীর একটি সাধারণ মেয়েকে তাঁর কবিতার কেন্দ্রে স্থাপন করে আপাতঃ অলোয় মোড়া অভিবাসী জীবনের অমোচনীয় একাকিত্বের বেদনাকে আমাদের সকলের কাছে হৃদয়গ্রাহ্য করে তুলেছিলেন। রাজশাহীর সেই মেয়েটিকে বুদ্ধদেব বসু অধ্যয়ন সূত্রে ইউরোপের একটি দেশে অভিবাসী করেছিলেন। রেনেসাঁ-উত্তরকাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপেই ছিল বিশ্বের সমৃদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান। ছিল পৃথিবীর উন্নত দেশ-মহাদেশের মডেল। কিন্তু ইতিহাসের নিয়মেই পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ অঞ্চলে সভ্যতা ও সমৃদ্ধি অচলা অবস্থানে দীর্ঘদিন স্থির হয়ে থাকে না? তা আবর্তিত হয় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। ফলে উত্থান-পতনের ছন্দে গাঁথা হয় সভ্যতার ইতিহাস। আর সে কারণেই এককালের সভ্যতা ও সমৃদ্ধিশালী ইউরোপ আজ আকাশচুম্বী অট্টালিকায় শোভিত আমেরিকার শহর জনপদগুলোর কাছে ‘সুবিস্তৃর্ণ গ্রাম মাত্র’। আমেরিকার অলোজ্বলা শহরগুলো দিনরাত যেন সুখ স্বপ্নের নেশায় উন্মাতাল হয়ে হঠাৎ মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর সেডাকে সাড়া দিয়ে আপন ভাগ্য ফেরাতে বদ্ধপরিকর মানুষেরা অভিবাসী হয়ে ছুটছে সেখানে। ছুটছে বাংলাদেশের নারী-পুরুষও। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোন কাম্য সুখের ছায়ায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই স্বপ্ন সাহসী মানুষগুলোর স্মৃতি-সত্তা, অত্যন্ত দরদ দিয়ে ফজল শাহাবুদ্দীন তার এই দীর্ঘ কবিতাটিতে তা তুলে ধরেছেন। চিঠির আঙ্গিকে লেখা এই কবিতাটিতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মাটির গন্ধ, বৃষ্টির শব্দ, শিশিরের জলকণা আকাশের রঙ কিংবা প্রান্তর দিয়ে বয়ে চলা নদীর গান মিশে আছে, তেমনি আছে নিউইয়র্কের শীত সাদা তুষার সাবওয়ে আর স্কাইক্রেপার্সের অহমিকাময় অস্তিত্ব। সেখানে অভিবাসী হয়ে চলে যাওয়া বাংলাদেশের একটি মেয়ে কিভাবে তার একলা থাকার মুহূর্তগুলোতে ছেড়ে যাওয়া স্বদেশকে আপন হৃদাস্পন্দনের মধ্যে অনুভব করছে; অতি কোমল আলোতে তার মমতা মাখানো ছবিটি এই কবিতায় দৃশ্যময় হয়ে উঠেছে। উঠেছে শিকড়ছেঁড়া মানুষের অনেকের অনুভূতি আর নিঃসঙ্গতার মর্মগ্রাহী পরিচয়। কিন্তু দেশত্যাগী অথবা দেশহারা মানুষের অন্তত একটি প্রজন্মের জন্য এই নিয়তি তো অবধারিত এবং অলঙ্ঘনীয়। তাই বুদ্ধদেব বসু এবং ফজল শাহাবুদ্দীন অভিবাসনের জন্য পশ্চিমের দুটি ভিন্ন মহাদেশ বেছে নিলেও তাঁদের দৃষ্টি, উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। তাই দুটি ক্ষেত্রের পরিণতিপর্বই এক এবং অভিন্ন। তবে ফজল শাহাবুদ্দীনের হাতে বেদনার বীণাটি বেজেছে আরও বিধুর সুরে, আরও অধিক ক্ষণ জুড়ে। ডলার-পাউন্ডের সমৃদ্ধিতে ভরা জীবনের সন্ধানে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া এক একাকী পরবাসীর নিঃসঙ্গ মৃত্যু পর্যন্ত তা প্রলম্বিত হয়েছে। আর সেই মৃত্যুর বেদনা নিউইয়র্কের কোন ঘাসের ডগায় একবিন্দু অশ্রুর মতো। শিশিরে কণা জমাতে না পারলেও ভিজিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের চোখের পাপড়ি। কেননা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও সে তো বাংলাদেশেরই সন্তান। আমাদের অনুভূতির তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে তখন দীর্ঘ দী-র্ঘ-ক্ষণ ধরে ঝংকার ছড়িয়ে চলে একটিমাত্র বিকশিত লয়ের সুরÑধন্য আমি জন্মেছি এই দেশে....।’ দেশ ও মানুষের জন্য এমন মমত্বময়, এমন আবেগময়, এমন গৌরবময় এবং এমন চিত্রময় কবিতা ফজল শাহাবুদ্দীন আরও বেশি বেশি করে লিখুন তাঁর ৭৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এটিই একান্ত প্রত্যাশা এবং প্রার্থনা।
ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখছি, আর মাত্র দুদিন পর। ৪ ফেব্রুয়ারির প্রভাতে সূর্য যখন সারা পৃথিবীতে সকালের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দেবে। সেই আলোতে হেসে উঠবে আমার অতি প্রিয় কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের ৭৭তম জন্মদিন। কবিতা যেহেতু আমাদের মনোলোকের অনেক অর্গলবদ্ধ দরজা-জালানা খুলে দেয়, তাই তার ভক্ত অনুরাগীরা জন্মদিনের সকালে শ্রদ্ধা শুভেচ্ছা ভালোবাসা জানাতে কার্পণ্য করে না। কার্পণ্য করে না ফুলের হাসি আর সুগন্ধের সমাবেশ ঘটাতেও। ৪ ফেব্রুয়ারির সকাল দুপুর, বিকেল এবং সন্ধ্যায় সুবাসিত ফুল আর সৌরভ ছড়ানো শুভেচ্ছা পারস্পরিক মেলবন্ধনে ফজল শাহাবুদ্দীনের চারপাশে যে আরেকটি নতুন কবিতার আবহ রচনা করবেÑদুই দিনের দূরত্বে বসে আমি শুধু তার রূপকলা, দৃশ্যকলা, শব্দকলা এবং গন্ধকলা-সব যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি আমার নিজের পাঠানো শুভেচ্ছার সাথে ফুটে ওঠা রংধনু রংয়ের বর্ণচ্ছটা।
আবার সামনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পেছনে অনেক পেছনে ২২ বছর পেছনে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি প্রাঙ্গণে অস্থায়ীভাবে নির্মিত তাঁর ১৩০তম জন্মজয়ন্তীর সুদৃশ্য অনুষ্ঠান মঞ্চটির দিকে তাকাচ্ছি, সেই দৃশ্যটি তার রূপ রস রং আলো শব্দ গন্ধ-সবকিছু নিয়েই আমার স্মৃতি সঞ্জীবিত দৃষ্টির সামনে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। ১৩৯৭-এর ২৫ বৈশাখে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালনের সেই মূল মঞ্চে বসে আছেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। বসে আছেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং সৈয়দ আলী আহসান। সকলের মুখেই স্মিত হাসি। প্রশান্ত অভিব্যক্তি। আর সেদিক থেকে একটুখানি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেই দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই মহিমোজ্জ্বল কুঠিবাড়ি, যেখানে তিনি একাধিক্রমে ১০ বছর স্থায়ীভাবে বসবাস করে গেছেন এবং অবিরামভাবে লিখে গেছেন অজস্র কালজয়ী লেখা। আর সেই কুঠিবাড়ির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে সমবেত অগণিত শ্রোতা এবং দর্শক। এদের কেউ এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। কেউ এসেছেন দেশের বাইরে থেকে এবং অন্যরা এসেছেন আশপাশের এলাকা থেকেÑযাদের কেউই এখানে এমন সমাবেশ এবং এমন আয়োজন এর আগে আর কখনোই দেখেনি। সকলের দৃষ্টিই মঞ্চের দিকে।
ঘটনাক্রমে হুমায়ূন আহমেদ, ড. সিদ্দিক, আমি এবং ওয়ায়েদ ভাইসহ আমাদের আরও কয়েক বন্ধু সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলাম। তাই মঞ্চের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা ঢাকা থেকে সদলবলে বাসে চেপে আগের দিন কুষ্টিয়ায় পৌঁছেছিলাম। পঁচিশে বৈশাখের সকালে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা আমাদেরকে শিলাইদহে পৌঁছে দিয়েছিলেন আর সেদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে সৈয়দ আলী আহসান এবং ফজল শাহাবুদ্দীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে হেলিকপ্টারে চড়ে গিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে, তাঁর কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গণের সেই মোহময় সকাল, আমাদের সকলের কাছেই আজও জীবন্ত হয়ে আছে। সকালের নরম আলোয় ছেয়ে যাওয়া আমার এক চিলতে দক্ষিণের বারান্দায় বসে আমি যখন সেই অবিস্মরণীয় সকালটির দিকে ফিরে তাকাইÑ এক আশ্চর্য শান্তি, স্বস্তি এবং প্রসন্নতার আলোছায়াকে সেখানে খেলা করে বেড়াতে দেখি। সেই সকালের আলো আনন্দ ধ্বনি গন্ধ আজও আমার মনের চারপাশে তাদের অমলিন আভা ছড়িয়ে যায়। বরুন ফুলের গন্ধে ভরা সেই বৈশাখ সকালের বাতাস আজও যেমন করে আমার নিঃশ্বাস ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের সঙ্গে মিশে আছে। তেমনি সেদিনের সেই মঞ্চ থেকে উদ্ভাসিত কথা ও কবিতার মোহ জাগানো শব্দগুলো আজও আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে মূর্ছনাময় ধ্বনির তরঙ্গ ছড়িয়ে যায়। কী আশ্চর্য আবেশ ছড়ানো বক্তৃতাই না সেদিন ফজল শাহাবুদ্দীন, রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং সৈয়দ আলী আহসান ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে করেছিলেন। একজন কবি যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলেন, তখন এমনিতেই কথা আর কবিতার দূরত্ব অনেকখানি কমে যায়। কিন্তু তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মননের দীপ্তি এবং পরিশীলিত আবেশ, তাহলে সেই কথাও যে হয়ে ওঠে অনবদ্য কবিতা ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিকণ্ঠে উচ্চারিত শব্দাবলি, সেদিন আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল। পেলব এবং কবিতার সঙ্গে আমাদের মন ও মননের সম্পর্কসূত্র ধরেই তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর কথা এবং অচিরেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কবিতার সম্রাট রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জন্মতিথির কাছে। বলেছিলেন, “কবিতা মানুষের অন্তর্নিহিত কোমল ও ধ্যানী এবং কলানিপুল সত্তার প্রতিচ্ছবি। হাজার হাজার স্বপ্নের ভেতরে অচিন্তনীয় পাখিদের যে অবিশ্বাস্য উড়াল। তার শব্দের মতো এক ধরনের নিস্তব্ধতার নামই হলো কবিতা। কবিতা যেমন আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভাব-তন্ময়তা সৃষ্টি করে, তেমনি আবার নানান সংক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত অনুভবেরও জন্ম দিয়ে যায় আজকের এই বৈশাখী সকালের স্নিগ্ধ-উজ্জ্বল রোদ সারা গায়ে মেখে নিয়ে দৃষ্টির সামনে একেবারে জীবন্ত হয়ে ঐ যে আশ্চর্য লাল বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে তার খোলা জানালার সামনে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিন-রাত ভরে একসময় লিখেছেন অজস্র কালজয়ী কবিতা। লিখেছেন গর্জনশীল পদ্মার বুকে ময়ূরপঙ্খীর মতো ভেসে চলা ‘পদ্মা বোটে’ বসেÑযেটিকে এখানে প্রদর্শনের জন্য তুলে রাখা হয়েছে এই কুঠিবাড়িতেই। সারা জীবনে লেখা কবিতাবলির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ একদিকে যেমন আমাদের আত্মার আনন্দধ্বনি এবং আত্মাকে প্রতিধ্বনিত করে গেছেন। তেমনি দৃশ্যমান নিসর্গ জীবন সুন্দরতা পৃথিবীকেও নতুন এবং গভীরভাবে চিনতে শিখিয়েছেন। বাঙালীকে তিনি শুদ্ধ প্রেমের সন্ধান দিয়েছেন, সৌন্দর্য স্বদেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সৌন্দর্য ও আনন্দের আচ্ছাদনে তারা এক স্বপ্নের উপবনে তিনি আমাদের আবাস তৈরি করে দিয়েছেন। এই মর্ত্য এবং মর্ত্যবাসীর জন্য তাঁর বিশাল হৃদয়ের ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে আমাদের মনে চির আসীন হয়ে আছেন। আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিংড়ে নিয়েছেন। অথচ আমাদের এই পরম ভালোবাসার কবিকে গোটা পাকিস্তান আমলে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার নানা ধরনের অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। কিন্তু আজ দিন বদলেছে। কবির শক্তির কাছে রাজা, রাজপুরুষ এমনকি রাষ্ট্রের শক্তিও যে নেহাত নগণ্য রবীন্দ্রনাথ তা প্রমাণ করেছেন। তাই তাঁরই ১৩০তম জন্মজয়ন্তীতে আজ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার অর্ঘ্য দিতে তাঁর পুণ্য বাসস্থানে এসেছেন। তবে একা আসেননি। সৈয়দ আলী আহসানের মতো অনন্য সাধারণ কবি, বাগ্মী ও প-িতকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, এসেছেন আমার মতো কবিতার প্রেমে আচ্ছন্ন এক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। আর সামনে যাঁরা বসে আছেন-দেশ বিদেশের শিল্পী সাহ্যিতিক প-িত দার্শনিক-তাঁরাও এসেছেন তাঁর আমন্ত্রণ এবং প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকর্ষণে। এ দেশের মাটি ও মানুষের কাছে যা তাঁর বহুদিনের প্রাপ্য ছিলÑআজই তা তিনি প্রথমবারের মতো পরিপূর্ণভাবে পেলেন। আজ তাই শুভদিন। আজকের আলো, আজকের বাতাস, আজকের গান, আজকের কথা। আজকের কবিতা কিংবা আজকের ফোটা ফুল সবই অন্যরকম। আর এই অন্যরকম দিনে, এই অন্যরকম পুণ্যভূমিতে সমবেত সকল রবীন্দ্রানুরাগীকে আমার অন্যরকম ভালোবাসা, অন্যরকম অভিনন্দন। সেই অভিনন্দন হৃদয় দিয়েই গ্রহণ করেছিলেন, সেদিনের অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে সমবেত সকল দর্শক-শ্রোতা। হাজার করতালিতে মুখর হয়ে উঠেছিল কুঠিবাড়ির আকাশ-বাতাস। অনুষ্ঠান শেষে সেই আকাশে ভেসে ভেসেই ফজল শাহাবুদ্দীন ফিরে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু আমি থেকে গিয়েছিলাম তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের সমাপ্তিপূর্ণ পর্যন্ত। সেই তিন দিন এবং তার পরবর্তী অগণিত দিনরাতের সঙ্গে ওই পঁচিশে বৈশাখের সকালটি তার সবটুকু সৌরভ আর সজীবতা নিয়ে একাত্ম হয়ে মিশে আছে।
বহু বছর ধরে আমি ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতা পড়ে আসছি। শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদের মতো তাঁর কোন কবিতাও আমার কাছে কখনো পুরনো মনে হয় না। একটা লাবণ্যময় সজীবতা অনুক্ষণ যেন তাকে স্পর্শ করে থাকে। এবং অনাস্বাদিত অনুভবের মায়াবী প্রদীপ হয়ে তা বুকের মধ্যে আলো ছড়াতে থাকেÑতা সে স্বদেশ অথবা নিসর্গ কিংবা প্রেমÑ যা নিয়েই লেখা হোক না কেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও তিনি লিখেছেন একাধিক অনবদ্য কবিতা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও মিশে আছেন তাঁর সত্তার সুরভীতে। মিশে আছেন আবেশের আলোকনায়। গত শতকের সেই ফেলে আসা ষাটের দশকে যখন রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রীয় মুর্খতা এবং ষড়যন্ত্রের শিকার তখন থেকেই সেই ভ্রান্তি ও অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার তাই কবিতীর্থ শিলাইদহের বর্ণাঢ্য রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান মঞ্চে তাঁকে হাসিমুখে বসে থাকতে এবং বকুলগন্ধে ভরা বাতাসে ছড়িয়ে পড়া তাঁর কথা শুনতে এত ভালো লেগেছিল। রবীন্দ্রনাথকে তিনি তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়েই ভালোবেসেছেন। কিন্তু সেই ভালোবাসাকে কখনোই পূজা পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে বিপন্ন করে ফেলেননি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি যখন রবীন্দ্রনাথের জীবনের নানা অধ্যায় নিয়ে তাঁর ব্যক্তি জীবনকেন্দ্রিক গল্প লেখার ঝুঁিকপূর্ণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ফজল শাহাবুদ্দীনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তাই আমি তখন তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত, হয়তো বা অর্বাচীনও। সেই সময় তিনি লেখাগুলো পড়ে পত্রিকা অফিস থেকে আমার টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করে আমাকে একেবারে চমকে দিয়ে ফোনে বলেছিলেন, “আমার নাম ফজল শাহাবুদ্দীন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা তোমার গল্পগুলোর একজন অনুরাগী পাঠক। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে দেখতে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে। কবে আসছ বল তো? সেদিন আমি তোমাকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াব।” টেলিফোন ছাড়ার পর বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভেবেছিলাম প্রাণের বিপুল ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ না হলে কেউ কাউকে এমন করে কাছে টেনে নিতে পারে না। আলাপ পরিচয়ের পর যতদিন গেছে। ততই নিবিড়ভাবে অনুভব করেছি তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা।
নারী নিসর্গ ভালোবাসা স্বদেশ বিদেশ নদী সমুদ্র পাহাড় পৃথিবী রোদ বৃষ্টি আলো অন্ধকার ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে নানা আঙ্গিকে পর্যাপ্ত সংখ্যক মায়া-জড়ানো আর নেশাধরানো আর ঘোরজাগানো কবিতা লিখেছেন ফজল শাহাবুদ্দীন। সেই কবিতাগুলোর কাছে তো বারবার আমাদের যেতেই হয়। এবং যেতেই হবে। তাঁর সৌন্দর্যসন্ধানী মায়াবী চোখ দিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে যেমন নানা রূপ ও মহিমার সংশ্লেষে অপরূপ হয়ে উঠতে দেখেছি, তেমনি দেখেছি পৃথিবীর অনেক আলোকোজ্জ্বল শহরের মধ্যরাত। এবং দেখেছি তাদের অলিগলি রাজপথ আর বিলাসী অট্টালিকাসমূহও। নাগরিক কবি তিনি। তাই পৃথিবীর সকল শহর ও শহরবাসীকে গিরেই রয়েছে তাঁর কৌতূহল ও ভালোবাসা। পৃথিবীর সব শহরেই তিনি পা রাখতে চান। এবং সেই উপলব্ধি-রাঙানো অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে চান একেকটি অধিনাশী কবিতা। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বলেই পৃথিবীর সমুদয় শহরকে তিনি ভাগ করেছেন তিনটি পর্যায়ে। প্রথম তালিকায় রয়েছে সেইসব পরিতুষ্টি দানকারী শহর যার কংক্রিটে পা রেখে তার রূপবতী রাতের এলোচুলের ঘ্রাণে ভরিয়ে তুলতে পেরেছেন সোনালি আল্পনা আঁকা কবিতার খাতা। দ্বিতীয় তালিকায় থাকা শহরগুলোর শরীর ছুঁয়েছেন তিনি দু’হাতে, কিন্তু তার হৃদয় গহনে লুকানো আলো- আঁধার আর রহস্য নিয়ে রচনা করতে পারেননি কোনো কাক্সিক্ষত কবিতা আর তৃতীয় তালিকার বিস্তৃত পরিসর জুড়ে নাম লেখা আছে সেইসব শহরের যেখানে আজও পৌঁছেনি তাঁর তৃষ্ণাতুর দৃষ্টির আলো। তবে ফজল শাহাবুদ্দীন এই তিনটি তালিকার পাশাপাশি আরও একটা ভিন্ন পর্যায়ের শহর তালিকা অনায়াসেই করতে পারতেন যে শহর অথবা শহরগুলো আজও তাঁর অপেক্ষাÑ কিন্তু তাকে আশ্রয় করেই হৃদয়ের উত্তাপ আর সন্তাপ ঢেলে লেখা হয়ে গেছে। মায়াজড়ানো অপূর্ব সব কবিতা যেমনÑ‘নিউইয়র্ক এবং একটি বাসী শুকনো গন্ধরাজ’।
অনেক আগে বুদ্ধদেব বসু রাজশাহীর একটি সাধারণ মেয়েকে তাঁর কবিতার কেন্দ্রে স্থাপন করে আপাতঃ অলোয় মোড়া অভিবাসী জীবনের অমোচনীয় একাকিত্বের বেদনাকে আমাদের সকলের কাছে হৃদয়গ্রাহ্য করে তুলেছিলেন। রাজশাহীর সেই মেয়েটিকে বুদ্ধদেব বসু অধ্যয়ন সূত্রে ইউরোপের একটি দেশে অভিবাসী করেছিলেন। রেনেসাঁ-উত্তরকাল থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ইউরোপেই ছিল বিশ্বের সমৃদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান। ছিল পৃথিবীর উন্নত দেশ-মহাদেশের মডেল। কিন্তু ইতিহাসের নিয়মেই পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট বা বিশেষ অঞ্চলে সভ্যতা ও সমৃদ্ধি অচলা অবস্থানে দীর্ঘদিন স্থির হয়ে থাকে না? তা আবর্তিত হয় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। ফলে উত্থান-পতনের ছন্দে গাঁথা হয় সভ্যতার ইতিহাস। আর সে কারণেই এককালের সভ্যতা ও সমৃদ্ধিশালী ইউরোপ আজ আকাশচুম্বী অট্টালিকায় শোভিত আমেরিকার শহর জনপদগুলোর কাছে ‘সুবিস্তৃর্ণ গ্রাম মাত্র’। আমেরিকার অলোজ্বলা শহরগুলো দিনরাত যেন সুখ স্বপ্নের নেশায় উন্মাতাল হয়ে হঠাৎ মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর সেডাকে সাড়া দিয়ে আপন ভাগ্য ফেরাতে বদ্ধপরিকর মানুষেরা অভিবাসী হয়ে ছুটছে সেখানে। ছুটছে বাংলাদেশের নারী-পুরুষও। কিন্তু শেষপর্যন্ত কোন কাম্য সুখের ছায়ায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই স্বপ্ন সাহসী মানুষগুলোর স্মৃতি-সত্তা, অত্যন্ত দরদ দিয়ে ফজল শাহাবুদ্দীন তার এই দীর্ঘ কবিতাটিতে তা তুলে ধরেছেন। চিঠির আঙ্গিকে লেখা এই কবিতাটিতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মাটির গন্ধ, বৃষ্টির শব্দ, শিশিরের জলকণা আকাশের রঙ কিংবা প্রান্তর দিয়ে বয়ে চলা নদীর গান মিশে আছে, তেমনি আছে নিউইয়র্কের শীত সাদা তুষার সাবওয়ে আর স্কাইক্রেপার্সের অহমিকাময় অস্তিত্ব। সেখানে অভিবাসী হয়ে চলে যাওয়া বাংলাদেশের একটি মেয়ে কিভাবে তার একলা থাকার মুহূর্তগুলোতে ছেড়ে যাওয়া স্বদেশকে আপন হৃদাস্পন্দনের মধ্যে অনুভব করছে; অতি কোমল আলোতে তার মমতা মাখানো ছবিটি এই কবিতায় দৃশ্যময় হয়ে উঠেছে। উঠেছে শিকড়ছেঁড়া মানুষের অনেকের অনুভূতি আর নিঃসঙ্গতার মর্মগ্রাহী পরিচয়। কিন্তু দেশত্যাগী অথবা দেশহারা মানুষের অন্তত একটি প্রজন্মের জন্য এই নিয়তি তো অবধারিত এবং অলঙ্ঘনীয়। তাই বুদ্ধদেব বসু এবং ফজল শাহাবুদ্দীন অভিবাসনের জন্য পশ্চিমের দুটি ভিন্ন মহাদেশ বেছে নিলেও তাঁদের দৃষ্টি, উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। তাই দুটি ক্ষেত্রের পরিণতিপর্বই এক এবং অভিন্ন। তবে ফজল শাহাবুদ্দীনের হাতে বেদনার বীণাটি বেজেছে আরও বিধুর সুরে, আরও অধিক ক্ষণ জুড়ে। ডলার-পাউন্ডের সমৃদ্ধিতে ভরা জীবনের সন্ধানে দীর্ঘপথ পাড়ি দেয়া এক একাকী পরবাসীর নিঃসঙ্গ মৃত্যু পর্যন্ত তা প্রলম্বিত হয়েছে। আর সেই মৃত্যুর বেদনা নিউইয়র্কের কোন ঘাসের ডগায় একবিন্দু অশ্রুর মতো। শিশিরে কণা জমাতে না পারলেও ভিজিয়ে তুলেছে বাংলাদেশের চোখের পাপড়ি। কেননা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেও সে তো বাংলাদেশেরই সন্তান। আমাদের অনুভূতির তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে তখন দীর্ঘ দী-র্ঘ-ক্ষণ ধরে ঝংকার ছড়িয়ে চলে একটিমাত্র বিকশিত লয়ের সুরÑধন্য আমি জন্মেছি এই দেশে....।’ দেশ ও মানুষের জন্য এমন মমত্বময়, এমন আবেগময়, এমন গৌরবময় এবং এমন চিত্রময় কবিতা ফজল শাহাবুদ্দীন আরও বেশি বেশি করে লিখুন তাঁর ৭৭তম জন্মদিনের প্রাক্কালে এটিই একান্ত প্রত্যাশা এবং প্রার্থনা।
No comments