জামায়াতের ফের সন্ত্রাসের চেষ্টা ॥ সাঁড়াশি অভিযান
জামায়াত-শিবির-জঙ্গী ও ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী হামলা মঙ্গলবারও অব্যাহত ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের কারণে অবশ্য তারা বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটাতে পারেনি।
পুলিশ ও র্যাবের কাঠোর অবস্থানের পরও হামলাকারীরা রাজধানীতে অন্তত ১৫টি যানবাহন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চালিয়েছে বোমা হামলা। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ টিয়ারশেল, রবার বুলেট, জলকামান থেকে পানি ছোড়ে। সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে জামায়াতের বিভিন্ন কার্যালয়ে। সংঘর্ষ এবং পুলিশের তল্লাশির সময় আটক করা হয়েছে ২৭ জামায়াত- শিবির কর্মীকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের উদ্দেশ্যে জামায়াত-শিবির সারা দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- শুরু করেছে। এদিকে সোমবারের ঘটনায় রাজধানীর ৫টি থানায় ৭৭ জন ছাড়াও অজ্ঞাত ৫/৬শ’ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীকে আসামি করে ৭টি পৃথক মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আসামিদের মধ্যে ৫৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। নাশকতামূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে পুরনো ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে পার্কিং করা একটি যাত্রীবাহী বাসের ওপর হামলা চালায় জামায়াত-শিবির। ভাংচুর শেষে সঙ্গে করে আনা পেট্রোল বাসে ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিমেষেই স্কাইলাইন পরিবহনের ২টি বাস পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ওই এলাকায় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে নির্মমভাবে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর পুরো এলাকায় হরতালে কেউ বিপদে পড়লেও প্রাণ ভয়ে কেউ এগিয়ে যায় না। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২টি ইউনিট আধাঘণ্টার মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
পুড়িয়ে দেয়া একটি বাসের চালক নাজির হোসেন বলছিলেন, সকালে গাজীপুর থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাট আসার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্কিং করে রাখি। ভেতরে যাই নাস্তা করতে। আচমকা প্রায় ২৫ যুবক বাসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। কেউ প্রতিরোধ করার চেষ্টা পর্যন্ত করতে সাহস পায়নি। হামলাকারীদের কাছে লাঠিসোটা, দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল বলে ধারণা। হামলাকারীরা তাদের পকেটে থাকা বাসের ভাড়া প্রায় ৮হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে তাকে মারধর করে পালিয়ে গেছে।
পুড়িয়ে দেয়া স্কাইলাইন বাসের অপর চালক করিম জানান, তিনি বাস ভাংচুর না করতে অনেক অনুরোধ করেছেন। কে শোনে কার কথা। উল্টো অনুরোধ করায় তাকে বেধড়ক মারধর করেছে। তার কাছে থাকা প্রায় ৩ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে হামলাকারীরা।
এদিকে রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেতে ছাত্রদল ও জামায়াত-শিবির ব্যাপক সন্ত্রাস চালিয়েছে। তারা অন্তত ১০টি যানবাহন ভাংচুর ও বোমা হামলা চালিয়েছে। আহত হয়েছেন কয়েকজন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, হামলাকারীদের সঙ্গে ছিল বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। হামলাকারীরা রাস্তা অবরোধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনের এলাকাসহ পুরো ক্যাম্পাস এলাকায় অন্তত ২৫টি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। বোমা বিস্ফোরণের ফলে বন্ধ হয়ে যায় সব ধরনের যানবাহন ও মানুষের চলাচল। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মানুষজন ভয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকে। পুরো এলাকায় সৃষ্টি হয় এক ভীতিকর পরিবেশ। অন্যদিকে মঙ্গলবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে দ্রুত মামলা তুলে নেয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করে বিএনপি। কর্মসূচীতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বক্তব্য দেন। তাঁরা অবিলম্বে দলীয় নেতাকর্র্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে মিথ্যা মামলা আখ্যায়িত করে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া এন্ড কমিউনিটি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার গাজী রবিউল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, সোমবারের সহিংসতায় রাজধানীর ৫টি থানায় মোট ৭টি মামলা হয়েছে। মামলায় ৮২ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। ৭ মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ১২শ’। দায়েরকৃত মামলার মধ্যে শাহবাগ থানায় ২টি মামলা হয়েছে। মামলায় ৫ জনকে ২ মামলায়ই এজাহারনামীয় আসামি করে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। সূত্রাপুর থানায় ১টি মামলা হয়েছে। মামলায় কোন এজাহারনামীয় আসামি নেই। আসামিরা অজ্ঞাত। মতিঝিল থানায় ২টি মামলা হয়েছে। ৫২ ও ৫৩ নম্বর মামলায় ৬০ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত ৫/৬শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ৩০ জনকে পৃথক ২টি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় পৃথক ২টি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ১৭ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত অন্তত আরও ৬শ’ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে আটককৃত ১৩ জনকে ২টি মামলায়ই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এদিকে সোমবারের ঘটনার পর রাজধানীতে জামায়াতের অন্তত ২০টি অফিসে হানা দিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঢাকা থেকে ২৭ জনকে আটক করা হয়েছে।
হামলার ঘটনায় নিন্দা প্রতিবাদ ॥ সোমবার জামায়াত-শিবিরের হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন মহল। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান যুক্ত বিবৃতিতে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকা-ে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। সিপিবির প্রেসিডিয়াম বৈঠকে আগামী পহেলা ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিসব পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এক পৃথক বিবৃতিতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা এর কঠোর সমালোচনা করে বলেন, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির সারাদেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করছে। অবিলম্বে তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। এমনকি যেসব রাজনৈতিক দল ও নেতা জামায়াত ইসলামীকে সহযোগিতা করছেন তাঁদের গ্রেফতারের দাবিও জানান তাঁরা। বিবৃতিদাতারা হচ্ছেন, ে সৈয়দ হাসান ইমাম, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, রাজ্জাক, আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, লিয়াকত আলী লাকী, তারানা হালিম এমপি, অভিনেতা আলমগীর, পারভীন সুলতানা দিতি, অভিনেত্রী শমী কায়সার, সঙ্গীতশিল্পী কনক চাঁপা, মমতাজ, অভিনেত্রী তানিয়া আহমেদ, মনিরা ইউসুফ মেমী, লাকী ইনাম প্রমুখ।
No comments