সংসদীয় রীতিতেই ভোট ॥ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা- ০ তত্ত্বাবধায়ক নয়, এটা পরিষ্কার করলেন- ০ বিশ্বব্যাংককে জানুয়ারি মাসের মধ্যেই স্পষ্ট করতে হবে অর্থায়ন করবে কিনা- by ০ মুক্তিযুদ্ধে যারা সহায়তা করেছে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনলে দোষ হয় কেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বের
সকল সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশে একইভাবে
আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে জানুয়ারি
মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে এ নির্বাচন।
এ বিষয়ে বিরোধী
দলের কিছু বলার থাকলে সংসদে এসে বলতে পারে। একই সঙ্গে তিনি বর্তমান সরকারের
মেয়াদেই সেতু নির্মাণ কাজ শুরুর অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন, বিশ্বব্যাংকে
জানুয়ারি মাসের মধ্যে স্পষ্ট বলতে হবে তারা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে কী
না। না হলে বিকল্পপন্থায় সেতুটি নির্মিত হবে।
রাশিয়া সফল উপলক্ষে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়ার সহযোগিতায় চলতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় চুক্তি নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পলিসির কোন পরিবর্তন হয়নি। আমরা কোন পন্থী নই, আমরা বাংলাদেশপন্থী। যারা অস্ত্র চুক্তি নিয়ে সমালোচনা করেন তাঁরা কী চান না বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শক্তিশালী হোক? মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যারা সমর্থন করেছে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনলে অপরাধী, আর বিরোধিতাকারী দেশ থেকে কিনলে সাধুবাদ-এটা কেমন কথা? যারা এতোদিন সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছে, সামরিক বাহিনীর ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতা ভোগ করেছে-সেই সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে সমরাস্ত্র কিনলে তাদের এত বিরোধিতা কেন?
বুধবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের জনগণের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। কারণ আমরা জনগণের জন্য কাজ করি। তাই আগামী নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় যাব, নইলে যাব না। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। এ নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে এখনও চলছে। এ ব্যাপারে তিনি দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
সম্প্রতি রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেই প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রবীণ সাংবাদিক, সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের বিভিন্ন ইস্যুতে করা অসংখ্য প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দেন তিনি। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে ক’জন সিনিয়র সম্পাদক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটি মামলার রায় ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি মামলার রায় হয়েছে, ইনশাল্লাহ সকল যুদ্ধাপরাধীরই বিচার হবে। যখনই কোন যুদ্ধাপরাধী পাওয়া যাবে, তখনই তাদের বিচার করা হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনীতিতে আসার আভাস দিয়েছেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ। এদেশে যেকোন নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমি বিশ্বাস করি এবং কামনা করি ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে এ সময় তাঁর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহ হামলা-নির্যাতনের খবর একমাত্র জনকণ্ঠ সাহসের সঙ্গে জাতির সামনে তুলে ধরার বিষয়টি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তুলে ধরে বলেন, ওই সময় একমাত্র দৈনিক জনকণ্ঠই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। জনকণ্ঠ সাহসের সঙ্গে আমাদের পাশে না দাঁড়ালে আমরা শেষ হয়ে যেতাম। তখন অনেক পত্রিকাই সাহস নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্যাতনের কথা তুলে ধরতে পারেনি। ওই সময় জনকণ্ঠই সাহস করে সবকিছু দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছে। অনেকে ইচ্ছে করেই কিছু লেখেননি। আবার অনেকে লেখার সাহস পাননি। একমাত্র আমার সরকারের সময়ই সকল গণমাধ্যম সবকিছু বলতে পারে। গণমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, স্বাধীনতা ভাল, কিন্তু স্বাধীনতার পাশাপাশি সবারই সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিবেশ বহাল থাকুক এটা চান কীনা আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন।
জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ প্রশ্ন করেন, পৃথিবীর কোন দেশেই সামরিক বাহিনীর জন্য কী কী অস্ত্র কেনা হচ্ছে, কত পরিমাণ মজুদ আছে বা কী কী অস্ত্র আছে এটা প্রকাশ করে না। দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এসব রাষ্ট্রীয় গোপনীয় ব্যাপার। বাংলাদেশে এটা প্রকাশ করা হয় কেন? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক বাহিনীর অনেক কিছুই প্রকাশ করা উচিত নয়। সংবিধানেই রয়েছে প্রতিরক্ষাবাহিনীর অনেক কিছু গোপনীয় রাখার বিষয়ে। তিনি বলেন, ’৭৫-এর পর পরাজিত শত্রুদের পদলেহন করতে করতে আমাদের আজ এ অবস্থা হয়েছে। আমরা তা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। আমরা যে বীরের জাতি এ গর্ব সবাই করতে পারি না। তাই এই অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দল সংসদে আসবে কি না, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। বিরোধী দলে থাকতে আমি দুই মিনিটও কথা বলতে পারতাম না। বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী গত ৪ বছরে ৭/৮ বার মাত্র সংসদে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছেন। এত উদারভাবে কখনও সংসদ চলেনি। নির্দিষ্ট সময়েই আগামী নির্বাচন হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ চার বছরে ৫ হাজার ৫০৯টি বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে। একটি নির্বাচন নিয়েও গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা মারামারি, কাটাকাটি বা ভোট কারচুপির কথা লিখতে পারেননি। প্রতিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এরপরও কী বলবেন আমাদের দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়?
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলবাহিনী, প্রশাসনসহ সবকিছুই থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। নির্বাচন কমিশনই ইচ্ছা অনুযায়ী যে কাউকে বদলি করতে পারে। গত ৪ বছরে উপ-নির্বাচনসহ অনেক নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরে গেছে। আমরা জনগণের রায় মেনে নিয়েছি, কোথাও ভোট কেড়ে নেইনি। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই আগামী নির্বাচন হবে। পৃথিবীর যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, যেসব দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়Ñ বাংলাদেশেও আগামী নির্বাচন সেভাবেই হবে। এ নিয়ে বিরোধী দলের কোন কথা থাকলে তারা সংসদে এসে বলতে পারে।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাস সম্পর্কিত ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই কোন সরকার আসে, তখনই সরকারী পার্টিতে ঢুকে পড়ে সুযোগ সন্ধানীরা অপকর্ম করে। আমার কথা পরিষ্কার। দুুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল। যখনই যেখানে কোন ঘটনা ঘটছে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। গ্রেফতার করে মামলা দিয়ে শাস্তি দিচ্ছি। সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। সরকারের ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণœ করবে তাদের আমার দরকার নেই। যেই কোন অপকর্ম করুক সেই যেই হোক তাদের আমরা ছাড়ছি না, ছাড়বও না। আওয়ামী লীগ এত দুর্বল হয়ে যায়নি যে অপকর্মকারীদের দলে রাখতে হবে। প্রশাসনকে আমি কড়া নির্দেশ দিয়েছি- ছাত্রলীগ কেন যেই কোন অপরাধ করবে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নিয়ে একাত্তরের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে’ এই অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করেছে। ষড়যন্ত্র অবশ্যই হয়েছে। না হলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তকারী বিশেষজ্ঞ দল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে একটি রিপোর্ট পাঠাল। দুদকে পৌঁছানোর আগেই একটি পত্রিকা কীভাবে তা হুবহু ছাপিয়ে দিল। বিশ্বব্যাংকের তদন্তকারী দল ও দুদকের মধ্যে শর্ত রয়েছে বাইরে কোন কিছুই প্রকাশ করা হবে না। এর পেছনেও যে দুরভিসন্ধি রয়েছে কিনা তা দেশবাসীকেই বিচার করতে হবে। তবে পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে। বিকল্প ব্যবস্থাও আমাদের হাতে রয়েছে। সেতুর কাজ শুরু হয়েছে এবং চলছে। মূল কাজও আমরা শুরু করব এবং শেষও করব। জানুয়ারির মধ্যে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে চূড়ান্ত কথা জানতে চাই। তারা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে কী না। জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পেলে বিকল্পপন্থায় নিজস্ব অর্থায়নেই মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করব।
সমরাস্ত্র ক্রয় নিয়ে কমিশন খেয়েছে’Ñ বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের এমন অভিযোগ সম্পর্কে প্রবীণ সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার টু সরকার এই চুক্তি হয়েছে। এখানে কমিশনের কোন সুযোগ নেই। যাদের কমিশন খাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁরাই একথা বলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের কমিশনের বিষয় জানা নেই, কমিশন খাওয়ার অভ্যাসও নেই। ব্যারিস্টার মওদুদের শুধু কমিশন খাওয়ারই অভ্যাস সেই, রাজনীতিতে ডিগবাজিতেও তিনি চ্যাম্পিয়ন। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত বানিয়ে বাড়ি আত্মসাত এবং একই স্বাক্ষরে বিশটি ভুয়া ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে মওদুদ আহমদের টাকা রাখার ঘটনাও দেশবাসীর অজানা নয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কৌতুকচ্ছলে বলেন, যাঁরা কমিশনের ভাগ খেতে চান তাদের ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
বৈশাখী টিভির প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের কোন নীতি পরিবর্তন হয়নি। আমাদের নীতিই হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয়। তিনি বলেন, রাশিয়া আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে রাশিয়া। আমরা কোন পন্থী নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে যে দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব দরকার তা করব। তিনি বলেন, আমাদের মন্ত্রিসভায় মস্কোপন্থী, মার্কিনপন্থী, চীনপন্থী, ভারতপন্থী সবাই আছেন। তবে আমি কোন পন্থী নই, আমি বাংলাদেশপন্থী।
এপির ফরিদ হোসেনের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, শতকরা সাড়ে ৪ ভাগ সুদে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। যার মধ্যে ৯০ ভাগ অর্থই দিচ্ছে রাশিয়া। আর এই সুদ এখন নয়, ২০১৮ সাল থেকে দিতে হবে। আর স্টেট ক্রেডিট নেয়া নতুন কিছু নয়। এর আগে চীন থেকে ঋণচুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র আনা হলেও সুদ দিতে হয়েছে পরদিন থেকেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এর আগে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র কেনা হয়েছে, তখন তো কোন কথা হয়নি। রাশিয়ার ক্ষেত্রে হচ্ছে কেন?
রাশিয়া সফর সবদিক থেকে সফল ॥ রাশিয়া সফর সবদিক থেকে সফল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যার সুফল জনগণ দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করবে। বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী রূপ নেবে। এতে উভয়দেশই লাভবান হবে। তিনি বলেন, রাশিয়া আমাদের পরম বন্ধু। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের আজীবন কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব নবায়ন করেছি। তিনি বলেন, রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের স্বার্থ বজায় রেখে আমরাও রাশিয়ার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
তিনি বলেন, ৪১ বছর আগে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের পরম বন্ধু লিওনিদ ব্রেজনেভের আমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন। ৪১ বছর পর বাংলাদেশের কোন প্রধানমন্ত্রীর এটাই রাশিয়াতে সরকারী সফর। তাই রাশিয়া সরকারও এ সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমাদের বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিলেন বলেই বিশ্বে মিত্র বাড়াতে পেরেছি। দেশের উন্নয়নে বিশ্বকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বর্তমানে সরকারের ওপরে আস্থা স্থাপন করেছে। বিশ্ব এখন বলছে, বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ১৮ জানুয়ারি রাশিয়া বিমানবন্দরে আমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। আমার সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন। পরদিন ক্রেমলিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মি. ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে আমার একান্ত বৈঠক হয়। তারপর আমাদের নেতৃত্বে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক আরও জোরদার করার ব্যাপারে আমরা একমত হই। আমরা বাংলাদেশ রাশিয়া যৌথ কমিশন গঠনেও একমত হই। এ কমিশন উভয় দেশের সহযোগিতার বিভিন্ন দিকনির্ধারণ করবে এবং এগুলোর বাস্তবায়ন সমন্বয় করবে। সফরকালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ারর মধ্যে তিনটি চুক্তি ও ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হয়েছে। এর একটি বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রস্তুতিমূলক কাজের অর্থায়নের জন্য ৫শ’ মিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি হয়। অপর চুক্তিটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পারমাণবিক শক্তিসংক্রান্ত একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে। এর মাধ্যমে জনগণকে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সম্পর্কে সচেতন করা হবে। নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হবে। সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। উভয় দেশ পারমাণবিক বিদ্যুতসংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করবে।
বিদ্যুতকেন্দ্রটিতে এক হাজার মেগাওয়াটের দুটি রিয়েক্টর থাকবে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি জানি পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য জনগণের আকাক্সক্ষা আছে। আবার তাদের মধ্যে একটা অজানা ভয় কাজ করে। আমরা জনগণের এ উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়েছি। পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তার প্রতিটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চুল্লিতে ব্যবহৃত তেজস্ত্রিয় জ্বালানি বর্জ্য রাশিয়ায় ফিরিয়ে নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য রাশিয়া এক বিলিয়ন ডলার স্টেট ক্রেডিট হিসেবে দিচ্ছে। জাতির পিতার নির্দেশে ১৯৭৪ সালে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হয়। এ নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রণয়ন করা হয়। এর আওতায় সশস্ত্রবাহিনীকে পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আমরা রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করেছি। এতে আমাদের সামরিক বাহিনী উচ্চতর প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে রাশিয়া ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে ৮টি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করে। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে রাশিয়া-বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় সরঞ্জাম ক্রয়, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় জোরদার করা হয়। সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ স্বল্প মূল্যে রাশিয়া থেকে ক্রয় করা হয়। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলায় রাশিয়া সহযোগিতা করে। তখন বাংলাদেশের রিজার্ভ মানি ছিল না। রাশিয়ার সঙ্গে বার্টার সিস্টেমে বাণিজ্য করার সুযোগ করে দেয়। আমরা পাট, চাসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি করতাম। বিনিময়ে রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতাম। সামরিক সরঞ্জামও এ পণ্য সামগ্রীতে ছিল।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা যখনই শাান্তিরক্ষী পাঠিয়েছি, রাশিয়া থেকে এপিসিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয় করে থাকি। এ ব্যয় জাতিসংঘ পরে পরিশোধ করে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র জয়ের ফলে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই বিশাল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টিও আমলে নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে আমাদের এ প্রশংসনীয় অবস্থানটি ধরে রাখা সহজ হবে। এর ফলে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার পূরণের পাশাপাশি দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কৃষি, উচ্চশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞান, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক, সংস্কৃতি, সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় দেশের মন্ত্রী ও সচিবগণ এগুলো স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে এক যৌথ প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে পুতিন বাংলাদেশ-রাশিয়া সামরিক প্রযুক্তি সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথা বলেন। বাংলাদেশে প্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, এতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং ঋণ দু’টোই নিশ্চিত করা হয়েছে। সফরকালে রাশিয়ার যোগাযোগ ও গণমাধ্যমবিষয়কমন্ত্রী নিকোলাই নিকিফোরভ, ফেডারেল কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন ভ্যালেন্টিনা আই মোতভিয়েনকো এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন ‘রোসাটম’-এর মহাপরিচালক সার্গেই কিরিয়েনকো আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
গণমাধ্যমবিষয়কমন্ত্রী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা আরও বিস্তৃত করতে ও স্পিড বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারে বাংলাদেশে একটি বিপ্লব সাধিত হয়েছে। তারা আইসিটির বিভিন্ন খাতেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ফেডারেল কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন ভ্যালেন্টিনা আই মোতভিয়েনকো দু’দেশের এমপিদের মধ্যে আরও যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ, ভারত ও রাশিয়ার কর্মকা-ের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে রাশিয়া বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ‘রোসাটম’ এ বছরের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের মূল নির্মাণ কাজ শুরু করার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য বাংলাদেশকে মার্চের মধ্যে একটি আইনী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। মে মাসের মধ্যে ডিজাইন সম্পন্ন হবে। আগস্টের মধ্যে নির্মাণ এলাকার প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এ কাজগুলো দ্রুত ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমি লিড মিনিস্ট্রি হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি। কাজগুলো সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য শীঘ্রই একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হবে। সফরকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অজানা শহীদ সৈনিকদের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। আমার এ সফরের অন্যতম দিক ছিল ঐতিহ্যবাহী মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা রাশিয়া সফরকালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাই এটি ছিল আমার জন্য একটি অনন্য প্রাপ্তি, বিরল সম্মান। আমি ‘সমসাময়িক বাংলাদেশ : রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিত’ বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেই। পরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরসহ বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর আমাকে সম্মানসূচক ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করেন। আমি রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলন ও বিতরণকারী কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাজপ্রম’ কার্যালয় পরিদর্শন করি। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে তাদের আধুনিক গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করি। মস্কোর শেরেমেতিয়েভোব বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকে বিদায়ের পূর্ব পর্যন্ত যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে, পুতিন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাশিয়ার সরকার ও জনগণের আত্মিক সম্পর্ক অমরত্ব লাভ করেছে। জাতির পিতার প্রতি তাঁদের এ শ্রদ্ধাবোধ আমাকে গর্বিত করেছে। তাঁরা বলেছেন, জাতির পিতার প্রতিচ্ছবির মধ্য দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে দেখেন। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সরকার ও জনগণের বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক ও অকৃত্রিম। আমি মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া মুক্তিকামী বাঙালীদের পক্ষে দাঁড়ায় এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে তিনবার ভেটো প্রদান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃঢ় অবস্থান নেয়। ভারতের মিত্রশক্তির সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন দ্রুত ও সহজ হয়। রাশিয়া সরকার মুুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনে অংশ নেয়। ১৯৭২ সালে রাশিয়ার রিয়ার এ্যাডমিরাল এস জুএনকোর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দরে পোঁতা মাইন, ডুবন্ত জাহাজসহ ডেব্রিস অপসারণ করে। এ বিপজ্জনক কাজ করতে গিয়ে রাশিয়ার নৌসেনা জুরি ভিক্টোরোভাক রেডকিন মৃত্যুবরণ করেন। দেশের বিদ্যুত, ব্রিজ, যোগাযোগ, শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে রাশিয়া অনন্য অবদান রেখেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া আমাদের পরম বন্ধু। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের আজীবন কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব নবায়ন করেছি। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য আমরা গত বছর রাশিয়ার তিন মহান নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ, নিকোলাই পদগনি ও আলেক্সি কোসেগিন-কে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং আরও ৭ রাশিয়ান বন্ধুসহ প্রাভদা পত্রিকাকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দিয়েছি। রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের স্বার্থ অটুট রেখে আমরাও রাশিয়ার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছি। আমরা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। পুতিনও বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানের ৭শ’ মিলিয়ন থেকে শীঘ্রই এক বিলিয়নে উন্নীত হবে। তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিয়ায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক, সিরামিক, কৃষিজাত পণ্য ইত্যাদি রফতানি বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ আছে। আমরা এ সুযোগগুলো সদ্ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। রাশিয়া বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর গ্রুপ ‘ব্রিকস’ এর সদস্য। দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে আমাদের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়াতে চাই। রাশিয়া সম্প্রতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হয়েছে। তাই আমাদের শুল্ক ও কোটামুক্তভাবে আমদানির অনুরোধ করেছি। রাশিয়া-বেলারুশ-কাজাখস্তান সাস্টমস ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছি। রাশিয়ার জনশক্তি রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে তাই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির জন্য রাশিয়াকে অনুরোধ করেছি। রাশিয়া আমাদের ‘এশিয়া ইউরোপ মিটিংয়ে অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করেছে। আমরা রাশিয়াকে সার্কের পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। রাশিয়াও আমাদের সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশে রাশিয়ার বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছি। আমরা ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী প্রতিনিধিদলের
রাশিয়া সফল উপলক্ষে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়ার সহযোগিতায় চলতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় চুক্তি নিয়ে সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পলিসির কোন পরিবর্তন হয়নি। আমরা কোন পন্থী নই, আমরা বাংলাদেশপন্থী। যারা অস্ত্র চুক্তি নিয়ে সমালোচনা করেন তাঁরা কী চান না বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শক্তিশালী হোক? মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যারা সমর্থন করেছে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কিনলে অপরাধী, আর বিরোধিতাকারী দেশ থেকে কিনলে সাধুবাদ-এটা কেমন কথা? যারা এতোদিন সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেছে, সামরিক বাহিনীর ঘাড়ে চড়ে ক্ষমতা ভোগ করেছে-সেই সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে সমরাস্ত্র কিনলে তাদের এত বিরোধিতা কেন?
বুধবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশের জনগণের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস আছে। কারণ আমরা জনগণের জন্য কাজ করি। তাই আগামী নির্বাচনে দেশের জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় যাব, নইলে যাব না। জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। এ নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে এখনও চলছে। এ ব্যাপারে তিনি দেশবাসীকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
সম্প্রতি রাশিয়া সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেই প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রবীণ সাংবাদিক, সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের বিভিন্ন ইস্যুতে করা অসংখ্য প্রশ্নের খোলামেলা উত্তর দেন তিনি। সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নোত্তর পর্বে ক’জন সিনিয়র সম্পাদক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের একটি মামলার রায় ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি মামলার রায় হয়েছে, ইনশাল্লাহ সকল যুদ্ধাপরাধীরই বিচার হবে। যখনই কোন যুদ্ধাপরাধী পাওয়া যাবে, তখনই তাদের বিচার করা হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনীতিতে আসার আভাস দিয়েছেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশ। এদেশে যেকোন নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমি বিশ্বাস করি এবং কামনা করি ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে এ সময় তাঁর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াবহ হামলা-নির্যাতনের খবর একমাত্র জনকণ্ঠ সাহসের সঙ্গে জাতির সামনে তুলে ধরার বিষয়টি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তুলে ধরে বলেন, ওই সময় একমাত্র দৈনিক জনকণ্ঠই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিল। জনকণ্ঠ সাহসের সঙ্গে আমাদের পাশে না দাঁড়ালে আমরা শেষ হয়ে যেতাম। তখন অনেক পত্রিকাই সাহস নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্যাতনের কথা তুলে ধরতে পারেনি। ওই সময় জনকণ্ঠই সাহস করে সবকিছু দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেছে। অনেকে ইচ্ছে করেই কিছু লেখেননি। আবার অনেকে লেখার সাহস পাননি। একমাত্র আমার সরকারের সময়ই সকল গণমাধ্যম সবকিছু বলতে পারে। গণমাধ্যমের মালিক ও সম্পাদকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, স্বাধীনতা ভাল, কিন্তু স্বাধীনতার পাশাপাশি সবারই সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাচ্ছে। এমন পরিবেশ বহাল থাকুক এটা চান কীনা আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন।
জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিক উল্লাহ খান মাসুদ প্রশ্ন করেন, পৃথিবীর কোন দেশেই সামরিক বাহিনীর জন্য কী কী অস্ত্র কেনা হচ্ছে, কত পরিমাণ মজুদ আছে বা কী কী অস্ত্র আছে এটা প্রকাশ করে না। দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এসব রাষ্ট্রীয় গোপনীয় ব্যাপার। বাংলাদেশে এটা প্রকাশ করা হয় কেন? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামরিক বাহিনীর অনেক কিছুই প্রকাশ করা উচিত নয়। সংবিধানেই রয়েছে প্রতিরক্ষাবাহিনীর অনেক কিছু গোপনীয় রাখার বিষয়ে। তিনি বলেন, ’৭৫-এর পর পরাজিত শত্রুদের পদলেহন করতে করতে আমাদের আজ এ অবস্থা হয়েছে। আমরা তা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। আমরা যে বীরের জাতি এ গর্ব সবাই করতে পারি না। তাই এই অবস্থার অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দল সংসদে আসবে কি না, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। বিরোধী দলে থাকতে আমি দুই মিনিটও কথা বলতে পারতাম না। বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রী গত ৪ বছরে ৭/৮ বার মাত্র সংসদে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছেন। এত উদারভাবে কখনও সংসদ চলেনি। নির্দিষ্ট সময়েই আগামী নির্বাচন হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ চার বছরে ৫ হাজার ৫০৯টি বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হয়েছে। একটি নির্বাচন নিয়েও গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা মারামারি, কাটাকাটি বা ভোট কারচুপির কথা লিখতে পারেননি। প্রতিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এরপরও কী বলবেন আমাদের দিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়?
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলবাহিনী, প্রশাসনসহ সবকিছুই থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। নির্বাচন কমিশনই ইচ্ছা অনুযায়ী যে কাউকে বদলি করতে পারে। গত ৪ বছরে উপ-নির্বাচনসহ অনেক নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরে গেছে। আমরা জনগণের রায় মেনে নিয়েছি, কোথাও ভোট কেড়ে নেইনি। তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই আগামী নির্বাচন হবে। পৃথিবীর যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, যেসব দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়Ñ বাংলাদেশেও আগামী নির্বাচন সেভাবেই হবে। এ নিয়ে বিরোধী দলের কোন কথা থাকলে তারা সংসদে এসে বলতে পারে।
ছাত্রলীগের সন্ত্রাস সম্পর্কিত ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্তের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখনই কোন সরকার আসে, তখনই সরকারী পার্টিতে ঢুকে পড়ে সুযোগ সন্ধানীরা অপকর্ম করে। আমার কথা পরিষ্কার। দুুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভাল। যখনই যেখানে কোন ঘটনা ঘটছে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। গ্রেফতার করে মামলা দিয়ে শাস্তি দিচ্ছি। সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না। সরকারের ভাবমূর্তি যারা ক্ষুণœ করবে তাদের আমার দরকার নেই। যেই কোন অপকর্ম করুক সেই যেই হোক তাদের আমরা ছাড়ছি না, ছাড়বও না। আওয়ামী লীগ এত দুর্বল হয়ে যায়নি যে অপকর্মকারীদের দলে রাখতে হবে। প্রশাসনকে আমি কড়া নির্দেশ দিয়েছি- ছাত্রলীগ কেন যেই কোন অপরাধ করবে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে।
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নিয়ে একাত্তরের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুর এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে’ এই অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করেছে। ষড়যন্ত্র অবশ্যই হয়েছে। না হলে বিশ্বব্যাংকের তদন্তকারী বিশেষজ্ঞ দল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে একটি রিপোর্ট পাঠাল। দুদকে পৌঁছানোর আগেই একটি পত্রিকা কীভাবে তা হুবহু ছাপিয়ে দিল। বিশ্বব্যাংকের তদন্তকারী দল ও দুদকের মধ্যে শর্ত রয়েছে বাইরে কোন কিছুই প্রকাশ করা হবে না। এর পেছনেও যে দুরভিসন্ধি রয়েছে কিনা তা দেশবাসীকেই বিচার করতে হবে। তবে পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে। বিকল্প ব্যবস্থাও আমাদের হাতে রয়েছে। সেতুর কাজ শুরু হয়েছে এবং চলছে। মূল কাজও আমরা শুরু করব এবং শেষও করব। জানুয়ারির মধ্যে আমরা বিশ্বব্যাংক থেকে চূড়ান্ত কথা জানতে চাই। তারা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে কী না। জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না পেলে বিকল্পপন্থায় নিজস্ব অর্থায়নেই মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করব।
সমরাস্ত্র ক্রয় নিয়ে কমিশন খেয়েছে’Ñ বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের এমন অভিযোগ সম্পর্কে প্রবীণ সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার টু সরকার এই চুক্তি হয়েছে। এখানে কমিশনের কোন সুযোগ নেই। যাদের কমিশন খাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁরাই একথা বলেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, আমাদের কমিশনের বিষয় জানা নেই, কমিশন খাওয়ার অভ্যাসও নেই। ব্যারিস্টার মওদুদের শুধু কমিশন খাওয়ারই অভ্যাস সেই, রাজনীতিতে ডিগবাজিতেও তিনি চ্যাম্পিয়ন। মৃত ব্যক্তিকে জীবিত বানিয়ে বাড়ি আত্মসাত এবং একই স্বাক্ষরে বিশটি ভুয়া ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে মওদুদ আহমদের টাকা রাখার ঘটনাও দেশবাসীর অজানা নয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কৌতুকচ্ছলে বলেন, যাঁরা কমিশনের ভাগ খেতে চান তাদের ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
বৈশাখী টিভির প্রধান সম্পাদক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের কোন নীতি পরিবর্তন হয়নি। আমাদের নীতিই হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারোর সঙ্গে বৈরিতা নয়। তিনি বলেন, রাশিয়া আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে রাশিয়া। আমরা কোন পন্থী নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে যে দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব দরকার তা করব। তিনি বলেন, আমাদের মন্ত্রিসভায় মস্কোপন্থী, মার্কিনপন্থী, চীনপন্থী, ভারতপন্থী সবাই আছেন। তবে আমি কোন পন্থী নই, আমি বাংলাদেশপন্থী।
এপির ফরিদ হোসেনের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, শতকরা সাড়ে ৪ ভাগ সুদে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। যার মধ্যে ৯০ ভাগ অর্থই দিচ্ছে রাশিয়া। আর এই সুদ এখন নয়, ২০১৮ সাল থেকে দিতে হবে। আর স্টেট ক্রেডিট নেয়া নতুন কিছু নয়। এর আগে চীন থেকে ঋণচুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র আনা হলেও সুদ দিতে হয়েছে পরদিন থেকেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এর আগে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র কেনা হয়েছে, তখন তো কোন কথা হয়নি। রাশিয়ার ক্ষেত্রে হচ্ছে কেন?
রাশিয়া সফর সবদিক থেকে সফল ॥ রাশিয়া সফর সবদিক থেকে সফল দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যার সুফল জনগণ দীর্ঘমেয়াদে ভোগ করবে। বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী রূপ নেবে। এতে উভয়দেশই লাভবান হবে। তিনি বলেন, রাশিয়া আমাদের পরম বন্ধু। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের আজীবন কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব নবায়ন করেছি। তিনি বলেন, রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের স্বার্থ বজায় রেখে আমরাও রাশিয়ার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছি। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
তিনি বলেন, ৪১ বছর আগে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের পরম বন্ধু লিওনিদ ব্রেজনেভের আমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন। ৪১ বছর পর বাংলাদেশের কোন প্রধানমন্ত্রীর এটাই রাশিয়াতে সরকারী সফর। তাই রাশিয়া সরকারও এ সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। আমি আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর আমাদের বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিলেন বলেই বিশ্বে মিত্র বাড়াতে পেরেছি। দেশের উন্নয়নে বিশ্বকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বর্তমানে সরকারের ওপরে আস্থা স্থাপন করেছে। বিশ্ব এখন বলছে, বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ১৮ জানুয়ারি রাশিয়া বিমানবন্দরে আমাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। আমার সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন। পরদিন ক্রেমলিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মি. ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে আমার একান্ত বৈঠক হয়। তারপর আমাদের নেতৃত্বে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ-রাশিয়া সম্পর্ক আরও জোরদার করার ব্যাপারে আমরা একমত হই। আমরা বাংলাদেশ রাশিয়া যৌথ কমিশন গঠনেও একমত হই। এ কমিশন উভয় দেশের সহযোগিতার বিভিন্ন দিকনির্ধারণ করবে এবং এগুলোর বাস্তবায়ন সমন্বয় করবে। সফরকালে বাংলাদেশ ও রাশিয়ারর মধ্যে তিনটি চুক্তি ও ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ সংক্রান্ত দুটি চুক্তি হয়েছে। এর একটি বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রস্তুতিমূলক কাজের অর্থায়নের জন্য ৫শ’ মিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি হয়। অপর চুক্তিটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পারমাণবিক শক্তিসংক্রান্ত একটি তথ্যকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে। এর মাধ্যমে জনগণকে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র সম্পর্কে সচেতন করা হবে। নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হবে। সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। উভয় দেশ পারমাণবিক বিদ্যুতসংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করবে।
বিদ্যুতকেন্দ্রটিতে এক হাজার মেগাওয়াটের দুটি রিয়েক্টর থাকবে। এর মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতির পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমি জানি পারমাণবিক বিদ্যুতের জন্য জনগণের আকাক্সক্ষা আছে। আবার তাদের মধ্যে একটা অজানা ভয় কাজ করে। আমরা জনগণের এ উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়েছি। পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তার প্রতিটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চুল্লিতে ব্যবহৃত তেজস্ত্রিয় জ্বালানি বর্জ্য রাশিয়ায় ফিরিয়ে নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের জন্য রাশিয়া এক বিলিয়ন ডলার স্টেট ক্রেডিট হিসেবে দিচ্ছে। জাতির পিতার নির্দেশে ১৯৭৪ সালে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করা হয়। এ নীতির আলোকে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রণয়ন করা হয়। এর আওতায় সশস্ত্রবাহিনীকে পুনর্গঠন ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আমরা রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করেছি। এতে আমাদের সামরিক বাহিনী উচ্চতর প্রশিক্ষণ পাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক শক্তিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে রাশিয়া ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে ৮টি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করে। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় রাশিয়া থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে রাশিয়া-বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় সরঞ্জাম ক্রয়, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় জোরদার করা হয়। সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ স্বল্প মূল্যে রাশিয়া থেকে ক্রয় করা হয়। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলায় রাশিয়া সহযোগিতা করে। তখন বাংলাদেশের রিজার্ভ মানি ছিল না। রাশিয়ার সঙ্গে বার্টার সিস্টেমে বাণিজ্য করার সুযোগ করে দেয়। আমরা পাট, চাসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি করতাম। বিনিময়ে রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতাম। সামরিক সরঞ্জামও এ পণ্য সামগ্রীতে ছিল।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আমরা যখনই শাান্তিরক্ষী পাঠিয়েছি, রাশিয়া থেকে এপিসিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ক্রয় করে থাকি। এ ব্যয় জাতিসংঘ পরে পরিশোধ করে। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র জয়ের ফলে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে এই বিশাল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টিও আমলে নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ। সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ফলে আমাদের এ প্রশংসনীয় অবস্থানটি ধরে রাখা সহজ হবে। এর ফলে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকার পূরণের পাশাপাশি দেশ আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে কৃষি, উচ্চশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞান, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক, সংস্কৃতি, সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিষয়ে সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় দেশের মন্ত্রী ও সচিবগণ এগুলো স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শেষে এক যৌথ প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে পুতিন বাংলাদেশ-রাশিয়া সামরিক প্রযুক্তি সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথা বলেন। বাংলাদেশে প্রথম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, এতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং ঋণ দু’টোই নিশ্চিত করা হয়েছে। সফরকালে রাশিয়ার যোগাযোগ ও গণমাধ্যমবিষয়কমন্ত্রী নিকোলাই নিকিফোরভ, ফেডারেল কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন ভ্যালেন্টিনা আই মোতভিয়েনকো এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন ‘রোসাটম’-এর মহাপরিচালক সার্গেই কিরিয়েনকো আমার সঙ্গে সাক্ষাত করেন।
গণমাধ্যমবিষয়কমন্ত্রী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা আরও বিস্তৃত করতে ও স্পিড বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর মতে, তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারে বাংলাদেশে একটি বিপ্লব সাধিত হয়েছে। তারা আইসিটির বিভিন্ন খাতেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ফেডারেল কাউন্সিলের চেয়ারপার্সন ভ্যালেন্টিনা আই মোতভিয়েনকো দু’দেশের এমপিদের মধ্যে আরও যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ, ভারত ও রাশিয়ার কর্মকা-ের ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে রাশিয়া বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ‘রোসাটম’ এ বছরের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের মূল নির্মাণ কাজ শুরু করার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য বাংলাদেশকে মার্চের মধ্যে একটি আইনী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে। মে মাসের মধ্যে ডিজাইন সম্পন্ন হবে। আগস্টের মধ্যে নির্মাণ এলাকার প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মূল নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এ কাজগুলো দ্রুত ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমি লিড মিনিস্ট্রি হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছি। কাজগুলো সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য শীঘ্রই একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হবে। সফরকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অজানা শহীদ সৈনিকদের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। আমার এ সফরের অন্যতম দিক ছিল ঐতিহ্যবাহী মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদান। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা রাশিয়া সফরকালে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভাষণ দিয়েছিলেন। তাই এটি ছিল আমার জন্য একটি অনন্য প্রাপ্তি, বিরল সম্মান। আমি ‘সমসাময়িক বাংলাদেশ : রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষিত’ বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দেই। পরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরসহ বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর আমাকে সম্মানসূচক ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদান করেন। আমি রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলন ও বিতরণকারী কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্যাজপ্রম’ কার্যালয় পরিদর্শন করি। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে তাদের আধুনিক গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করি। মস্কোর শেরেমেতিয়েভোব বিমানবন্দরে অবতরণের পর থেকে বিদায়ের পূর্ব পর্যন্ত যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে, পুতিন থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাশিয়ার সরকার ও জনগণের আত্মিক সম্পর্ক অমরত্ব লাভ করেছে। জাতির পিতার প্রতি তাঁদের এ শ্রদ্ধাবোধ আমাকে গর্বিত করেছে। তাঁরা বলেছেন, জাতির পিতার প্রতিচ্ছবির মধ্য দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশকে দেখেন। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সরকার ও জনগণের বন্ধুত্ব ঐতিহাসিক ও অকৃত্রিম। আমি মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়ার সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া মুক্তিকামী বাঙালীদের পক্ষে দাঁড়ায় এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে তিনবার ভেটো প্রদান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃঢ় অবস্থান নেয়। ভারতের মিত্রশক্তির সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করে। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন দ্রুত ও সহজ হয়। রাশিয়া সরকার মুুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনে অংশ নেয়। ১৯৭২ সালে রাশিয়ার রিয়ার এ্যাডমিরাল এস জুএনকোর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ দল চট্টগ্রাম ও মংলাবন্দরে পোঁতা মাইন, ডুবন্ত জাহাজসহ ডেব্রিস অপসারণ করে। এ বিপজ্জনক কাজ করতে গিয়ে রাশিয়ার নৌসেনা জুরি ভিক্টোরোভাক রেডকিন মৃত্যুবরণ করেন। দেশের বিদ্যুত, ব্রিজ, যোগাযোগ, শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশে রাশিয়া অনন্য অবদান রেখেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, রাশিয়া আমাদের পরম বন্ধু। দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের আজীবন কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করেছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্ব নবায়ন করেছি। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য আমরা গত বছর রাশিয়ার তিন মহান নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ, নিকোলাই পদগনি ও আলেক্সি কোসেগিন-কে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা এবং আরও ৭ রাশিয়ান বন্ধুসহ প্রাভদা পত্রিকাকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দিয়েছি। রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের স্বার্থ অটুট রেখে আমরাও রাশিয়ার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছি। আমরা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। পুতিনও বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বর্তমানের ৭শ’ মিলিয়ন থেকে শীঘ্রই এক বিলিয়নে উন্নীত হবে। তৈরি পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিয়ায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক, সিরামিক, কৃষিজাত পণ্য ইত্যাদি রফতানি বাড়ানোর ব্যাপক সুযোগ আছে। আমরা এ সুযোগগুলো সদ্ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। রাশিয়া বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর গ্রুপ ‘ব্রিকস’ এর সদস্য। দেশটির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে আমাদের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়াতে চাই। রাশিয়া সম্প্রতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার সদস্য হয়েছে। তাই আমাদের শুল্ক ও কোটামুক্তভাবে আমদানির অনুরোধ করেছি। রাশিয়া-বেলারুশ-কাজাখস্তান সাস্টমস ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত রফতানির সুযোগ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছি। রাশিয়ার জনশক্তি রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে তাই বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানির জন্য রাশিয়াকে অনুরোধ করেছি। রাশিয়া আমাদের ‘এশিয়া ইউরোপ মিটিংয়ে অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করেছে। আমরা রাশিয়াকে সার্কের পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। রাশিয়াও আমাদের সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার পর্যবেক্ষক হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশে রাশিয়ার বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছি। আমরা ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী প্রতিনিধিদলের
No comments