ফেনিল জলরাশি বালুর গালিচা_ সবই আছে তবু কী যেন নেই- পর্যটন নগরী কক্সবাজার-১
এর নাম কেন 'হলুদ ফুল' ছিল তা ব্যাখ্যার অতীত। তবে সৌন্দর্যের উদাহরণ হিসেবে একে হাজির করাতে হলে এমন অনেক নামেই তাকে ডাকা যায়। বিসত্মীর্ণ ফেনিল জলরাশির পাশে রূপালি বালুর গালিচা,
অভগ্ন সৈকতের কোথাও কোথাও পাথরখণ্ডের সারি সৌন্দর্যপিপাসুদের হৃদয় হরণ করার জন্য যথেষ্ট। মুহূর্তে মুহূর্তের গর্জন ছন্দের মাধ্যমে তা জানানও দিচ্ছে প্রাচীন বাকুলিয়া বা রাখাইন পেঙ্গওয়া বা হলুদ ফুল অথবা ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের নামের কক্সবাজার। পর্যটকদের নজর কাড়ার গর্ববোধ নিয়ে দেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অপরিকল্পনা, অব্যবস্থাপনাসহ নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও আপন মাধুর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৌন্দর্য বেশি বলে আফসোসের মাত্রাও বেশি। প্রথম নজরেই তাই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আফসোসের সুরে পর্যটকদের বলতে শোনা যায়, এত সুন্দর স্থান শুধু 'জল, বালি আর হোটেলে ঘুম'-এর ঘেরাটোপেই আটকে আছে। যথাযথ নিরাপত্তার অভাবও এ নৈসর্গিক রূপের মাঝে প্রায়ই ছন্দপতন ঘটায় । কক্সবাজারে 'সবই আছে, তারপরও কী যেন নেই।'কলাতলী বিচের কাছে বিচ ভিউ রিসোর্টে পুরো পরিবার নিয়ে উঠেছেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা তরম্নণী সিনথিয়া। আড়াই বছরের মেয়ে আফ্রা ও স্বামী এইচএসবিসি ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকতর্া আশরাফুল কবির সিদ্দিকী ছাড়াও সঙ্গে আছেন মা, বড় বোন কাশফি, ভাগ্নে রাফসান ও ছোট বোন তানজিয়া। কেমন লাগছে কক্সবাজার_ প্রশ্ন করতেই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে ওঠেন, দেশের কোথাও এমন সুন্দর স্থান আছে কিনা আমার জানা নেই। বছরজুড়েই এখানে আসার জন্য উপলৰ খুঁজে বের করি। গত বছরেও কক্সবাজার এসেছি আটবার। যিনি এতটাই কক্সবাজারপ্রেমী তাঁর কাছে তো সে জায়গার কোন খুঁত দেখতে পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাসত্মবতার বাইরে গেলেন না সিনথিয়া। বললেন, এখানে এসে নিজেকেই বিনোদন তৈরি করতে হয়। প্রশাসনিকভাবে কোন ব্যবস্থা নেই। ভাবতে কষ্ট হয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশে আমাদের বিচের চেয়ে অনেক ছোট বিচও পর্যটকদের জন্য সর্বোচ্চ আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হয়েছে। বিদেশী পর্যটকরা সেসব জায়গা বাদ দিয়ে আমাদের এখানে কেন আসবেন? চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়েও অনুযোগ করেন তিনি। বলেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বুক চিরে বিলাসবহুল এসি বাসগুলো কক্সবাজার পেঁৗছে। অথচ তারা গাড়িতে চট্টগ্রামবাসীদেরই তোলে না।
ছিনতাইয়ের ভয়ে
দিনের বেলায় বিচে বেশিৰণ থাকার কারণে ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা জালোওয়াশান খান পড়নত্ম বিকেলে পরিবারের সঙ্গে বৌদ্ধ মন্দির দেখতে যান। মন্দিরে থাকতে থাকতেই সন্ধ্যা নেমে আসায় রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পথে ছিনতাই হওয়ার ঘটনা লোকমুখে শুনেছেন। কলাতলী বিচে আসার আগ পর্যনত্ম পথে পথে সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে থাকেন। তার মতে, ভাগ্য ভাল কোন অঘটন ঘটেনি। স্থানীয়রা জানান, এক বিদেশী দম্পতির হিমছড়িতে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারানো এবং এক হোটেল ম্যানেজারের বিদেশী তরম্নণী পর্যটক ধর্ষণের ঘটনাসহ বিভিন্ন ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ায় পর্যটকদের মধ্যে সেসব এলাকা নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করে। কলাতলী বিচ ও পুরনো বিচ লাবণী পয়েন্ট ছাড়া কক্সবাজারের অন্যান্য দর্শনীয় স্থান থেকে দিনে দিনে ফেরার চেষ্টায় থাকেন দেশী ও বিদেশী পর্যটকরা। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার আগের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে দাবি করলেও আগের নেতিবাচক প্রচারের কারণে ঝুঁকি নিতে রাজি হন না কেউই। বিশেষ করে ইনানী বিচ হয়ে হিমছড়ি পার হতে পর্যটকদের আতঙ্ক কাজ করে বেশি। মহাখালীতে একটি বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত পর্যটক জান্নাত কক্সবাজারে এ প্রতিবেদককে বললেন, হিমছড়ির কাছে বিচমুখী মারমেইড ক্যাফে সন্ধ্যার পর অপরূপ লাগে। তবে দলে ভারি না হলে সন্ধ্যার সে সৌন্দর্য দেখতে যেতে সাহস পাই না।
জানা গেছে, দুই বছর আগে ইনানী পর্যটন স্পট আলোকিত রাখার জন্য ৬টি এ্যারোজেন বৈদু্যতিক বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে সে বাতিগুলো এখন ঠিকভাবে জ্বলে না। এছাড়া ইনানী বিচ থেকে হিমছড়ি হয়ে মূল বিচে আসার রাসত্মাটিতেও অন্ধকার ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে। ফলে সন্ধ্যায় বিচের অসাধারণ রূপ দেখার মায়া ত্যাগ করে দিনের আলোতেই ইনানী বিচ, পাটুয়ারটেকের পাথরের সত্মূপ, কানা রাজার গুহা ও হিমছড়ি দেখে হোটেলে ফিরে আসেন পর্যটকরা। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি মাসেই কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে গণডাকাতি হয় ৫টি গাড়িতে। এছাড়া শুধু কক্সবাজার জেলায় গত মাসে ৩টি ডাকাতি, ৪টি খুনসহ বিভিন্ন ধরনের ২৩৫টি অপরাধের ঘটনা ঘটে। নবেম্বর মাসে এ ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটে ২০৮টি। এছাড়া ডাকাতি, দসু্যতা, খুন, দাঙ্গা, নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশ আক্রানত্ম, সিঁদেল চুরি, চুরি, অস্ত্র উদ্ধার, বিস্ফোরক ও মাদকদব্য, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে ২০০৯ সালে মামলা হয়েছে মোট ২ হাজার ৫৬৬টি।
আতঙ্কের নাম রোহিঙ্গা
সংশিস্নষ্টদের মতে, কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে রোহিঙ্গাদের কারণে। কুতুপালং ও নয়াপাড়ার দু'টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গার সংখ্যা ২৮ হাজার হলেও সারা কক্সবাজারে তালিকার বাইরে অবৈধভাবে ছড়িয়ে আছে ৪ লাখ রোহিঙ্গা। মূলত এরাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। অবৈধভাবে বসবাসরত মানবেতর জীবনযাপনকারী রোহিঙ্গারা দরিদ্র্যের কারণে হেন অপরাধ নেই যাতে জড়িয়ে পড়ছে না। এমনকি অতিদরিদ্র রোহিঙ্গা নারীরা পতিতাবৃত্তিতেও জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ক্যাম্প এবং ক্যাম্পের আশপাশের দুর্গম এলাকায় জঙ্গী প্রশিৰণ দেয়া হয়। নিরাপত্তার খাতিরে জঙ্গী রোহিঙ্গাদের কথা মাথায় রেখে কক্সবাজার বিমানবন্দরে রেড এলার্ট জারি করা আছে গত দেড় মাস ধরে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিষয়ক অপারেটর আব্দুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, রেড এলার্ট জারি হওয়ার কারণে বিমানবন্দরজুড়ে এখন চার সত্মরের নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতকর্তা অবলম্বন করেছি। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গত এক মাসে গ্রেফতার করা হয়েছে ৬শ' রোহিঙ্গাকে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র সরোয়ার কামাল এ প্রতিবেদককে বলেন, কক্সবাজারের একটি বড় সমস্যা রোহিঙ্গা। সীমানত্ম দুর্বলতার সুযোগে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে। আর ভুক্তভোগী হচ্ছে বাংলাদেশ। এমনও হয়, সীমানত্ম দিয়ে রোহিঙ্গারা এখানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে অর্থ উপার্জন করে কয়েক মাস পর দেশে ফিরে যায়। বাংলাদেশের ১ টাকা সেখানের স্থানীয় মুদ্রায় ১৮ টাকা করে বিবেচিত হয়। তাই বাংলাদেশ তাদের জন্য একটি আকর্ষণীয় শ্রমবাজার। মাছ ধরার ট্রলার, স' মিল, রিকশা, ভ্যান, হোটেল, এমনকি বাসাবাড়িতে গৃহকমর্ীর কাজেও রোহিঙ্গাদের দেখা যায়। স্থানীয়দের চেয়ে তারা অর্ধেক বেতনে কাজ করে। এ দেশের মানুষের সঙ্গে চেহারায় মিল থাকায় এবং মুসলিম হওয়ায় ক্যাম্পের বাইরে থাকা অবৈধদের সহজে শনাক্ত করা যায় না।
পর্যটকদের নিরাপত্তা
কক্সবাজারে দেশী-বিদেশী পর্যটক হয়রানি বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গত ২২ ডিসেম্বর স্থানীয় কয়েকটি সংগঠন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি দেয়। তাদের দাবি ছিল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না ঘটালে এবং সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পর্যটক হয়রানি বন্ধ না করলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ধস নেমে আসবে। ৰতিগ্রসত্ম হবে পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় ৰুদ্র ব্যবসায়ীসহ সংশিস্নষ্টরা। সংগঠনগুলোর এ দাবির বিষয়ে জেলা প্রশাসক গিয়াসউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা হয় তাঁর কার্যালয়ে। সে সময় জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, কক্সবাজারের এখনকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভাল। কিন্তু অনেকে এখনও এ ব্যাপারে আস্থা রাখতে পারছেন না। জেলায় যেসব অপরাধের ঘটনা ঘটেছে তাতে পর্যটকদের শিকার হতে হয়নি। গত ঈদ-উল-ফিতরের সময় এক লাখ পর্যটক এসেছিলেন। কিন্তু একটি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেনি। তিনি বলেন, পর্যটকদের জন্য নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা ও পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা এ তিনটি বিষয়ের ওপর আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি। ইতোমধ্যে আমরা ৮২ জনের পর্যটন পুলিশের অনুমোদন পেয়েছি। এখন পর্যনত্ম ২১ জন পুলিশ পাওয়া গেছে। অন্য পদগুলোও শীঘ্রই পূরণ হয়ে যাবে। হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশের মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ রম্নটে ওয়াইকং থেকে শাপলাপুর পর্যনত্ম পাহাড়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া ২২ কিলোমিটার রাসত্মায় দিনেদুপুরেও ডাকাতি হয়। আছরের আজানের পর সে রাসত্মায় গাড়ি চলে না। সেখানে ডাকাতি ঠেকাতে গাড়ির সামনে-পেছনে পুলিশ এসকর্ট দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
একই কথা বললেন কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও আইনশৃঙ্খলা রৰায় প্রশাসন অত্যনত্ম সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।
No comments