হৃদয়নন্দন বনে-শিপ্্ শিপ্্ বৃষ্টি আর আষাঢ়ে গল্প by আলী যাকের
আষাঢ়ে গল্পগুলো কি সত্যিই অবাস্তব? সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, গল্পগুলো শুনতে অবাস্তব মনে হলেও আসলে বাস্তবতার সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নাট্যকলায় এক ধরনের নাট্যরীতি আছে, যাকে বলা হয়ে থাকে অসংলগ্ন নাটক। অনেকে আবার অসম্ভব নাটকও বলেন একে।
যেমন ব্রিটেনের নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট্-এর 'গডোর অপেক্ষায়' নাটকে আমরা দেখতে পাই দুই তরুণ এক মরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে চলেছে গডোর জন্য
যখন এই কলামটি আমি লিখছি, আমার পড়ার ঘরের জানালার ধারে বসে, তখন আকাশ ছেয়ে আছে মেঘে। শিপ্্ শিপ্্ করে বৃষ্টি হচ্ছে সারা ঢাকা শহরে। অবশেষে বলা যায়, আষাঢ় জেঁকে বসেছে আমাদের এই শহরে। এর আগে চট্টগ্রাম এবং সিলেটে হৈ হৈ করে যা হয়ে গেল, সেটাকে ঠিক আষাঢ়ের বৃষ্টি বলা যায় না। ঢল নেমেছিল সেখানে। সেই ঢলে ভেসে গেছে বাড়িঘর কুটোর মতো। ধসে পড়েছে পাহাড়। আর ওই পাহাড়ের নিচে যারা অস্থায়ী বাসা বানিয়েছিল; পাহাড় ধসে অনেকেই মারা পড়েছে তাদের মধ্যে। আমার গত সপ্তাহের হৃদয়নন্দন বনে সেই জন্যই এখন মনে হচ্ছে, সময়োচিত ছিল না। যখন এমন দুর্যোগ, এমন ভোগান্তি মানুষের, এই আষাঢ় মাসের শুরুতেই, তখন এ মাসের গুণকীর্তন করার মতো মন-মানসিকতা কি থাকে মানুষের? তবে, আবারও বলছি, এই জন্য আমি আষাঢ়কে দুষি না। আষাঢ়ের আচরণ কখনোই তেমন নয়। দীর্ঘদিন ধরে, কালের সাক্ষী হিসেবে এই মাসটিকে আমি দেখে আসছি বঙ্গ দেশে। রৌদ্রতপ্ত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে, তখন আষাঢ় আসে শান্তির প্রলেপ নিয়ে। ঝড়, বন্যা এবং ধ্বংসের মূর্তি নিয়ে নয়। আজ সকালের এই বৃষ্টিটি আমার অতি পরিচিত। দূরে কোথাও বৃষ্টি হওয়ার খবর যখন পাই, মন কিছুটা খারাপ হয়। মনে হয়, এখানে বৃষ্টি হবে কখন?
শিপ্ শিপ্ বৃষ্টিতে, এই আষাঢ় মাসেই, অনেক সময় কেটেছে আমার; বাংলাদেশের নানা মফস্বল শহরে এবং আমার গ্রামের বাড়িতে। মফস্বল শহরে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই স্কুলে গেছি। ভেজা কাপড় পরেই ক্লাস করেছি। আবার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছি বাসায়। আর গ্রামের অভিজ্ঞতা তো আরও বিচিত্র। সেখানে বৃষ্টিভেজা জলভরা মাঠে খেলেছি নানারকম খেলা। ফেরার পথে কাঁচা মাটির রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়েও গেছি কত! সেই যে, ছড়ায় আছে না_ পা পিছলে আলুর দম? অনেকটা সেই রকম। তবে আষাঢ় মাসের সঙ্গে বাঙালির জীবনে প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে গল্প বলা এবং গল্প শোনার এক প্রক্রিয়া। একে বলা হয় আষাঢ়ে গল্প। কথায় আছে_ গল্পের গরু গাছে চড়ে। এই গল্পের সবচেয়ে মোক্ষম সময় হচ্ছে আষাঢ় মাস। বাইরে যখন অবিরাম বৃষ্টি, পথঘাট কাদা-কাদা, কারোই মন কাজে যেতে আগ্রহী নয়; তখন এক গামলা মুড়ি নিয়ে গোল হয়ে বসে চুটিয়ে গল্প করতে কার না মন চায়! এই রকম আমাদের বাল্যকালে হতো, মা কিংবা দিদিকে ঘিরে। আজকাল আর হয় না। সময় নেই কারও হাতেই। এমনকি আমাদের বাচ্চাদেরও আর সময় হয় না আমাদেরকে ঘিরে বসে গল্প শোনার। ওদের হাতেও সময় নেই। ধেয়ে চলেছে ক্রমাগত। প্রয়োজনেই। অতএব, এই আষাঢ়ের কোনো অলস দুপুরে যদি বৃষ্টি নামে এবং আমার হাতে যদি কোনো কাজ না থাকে, তাহলে বৃষ্টির তালে তাল মিলিয়ে ঘরের মাঝে একলা বসে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প ফাঁদি।
এই একটা সুবিধা আছে। নিজেই বক্তা, নিজেই শ্রোতা হলে কথাগুলো সব নিঃশব্দে চলে। কথা চলে মাথার ভেতরে। কথাকে কল্পনার ফানুস হিসেবে তৈরি করা যায়। রঙ চড়ানো যায় যত খুশি। তখন মনে হয়, আমিই রাজা, আমিই প্রজা, আমিই রাজ্যময়। পাঠক, আপনারাও চেষ্টা করে দেখবেন, আপনাদের জীবনে এমন অনেক আপাত তুচ্ছ ঘটনা ঘটে, যা হয়তো আপনাদের মনঃপূত নয়। সেই ঘটনাগুলোর কথা মনে হলেই মনটা তিক্ত হয়ে ওঠে। ভাবতে ইচ্ছে করে না সেই সব কথা। কিন্তু একটু চেষ্টা করে সেই ঘটনাগুলোকে সামান্য ডানে কিংবা বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিন; দেখবেন গল্পগুলো প্রায় মনোরম হয়ে উঠেছে। তখন আর তত খারাপ লাগবে না। এই রকম কত গল্প বানাই আমি মনে মনে, তার কোনো হিসাব নেই। সেই যে রবীন্দ্রনাথের 'বীরপুরুষ' কবিতায় আছে না? 'রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা/ এমন কেন সত্যি হয় না আহা?' আসলে সত্য কী? এই রবীন্দ্রনাথই তো বলেছেন কবির উদ্দেশে, '...তুমি যা রচিবে তাহাই সত্য বটে'। অতএব, আমাদের দুঃখ-কষ্টের গল্পগুলোকে আনন্দ-সুখের গল্পে পরিণত করতে অসুবিধা কোথায়? এই আমাদেরই জীবনে, খুব বেশি দিন আগে নয়; ছিল নাকি এমন সময়, যখন ঠা ঠা রোদে পিচঢালা রাস্তার পাশে বাসের জন্য আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে আছি। যাব লোহারপুল থেকে গুলিস্তান। তারপর সেখান থেকে হাঁটা পথে নটর ডেম কলেজ। গরমে ঘামছি অবিরত, কিন্তু করুণা হচ্ছে না বাস মহাশয়ের। অবশেষে তিনি হেলে-দুলে এলেন। টাউন টু এ সার্ভিস। আমরা বলতাম, মুড়ির টিন। সেখানে ইলিশ মাছের চালানের মতো গাদাগাদি করে দাঁড়ালাম। তারপর মোবিল-পেট্রোলের কটু গন্ধে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় গিয়ে পেঁৗছলাম গন্তব্যে। কিন্তু এই যাত্রায় বাসে উঠেই ভুলে গেলাম পরিবেশের কথা। মনে পড়ল গতকাল দুপুরে, আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসরে আমারই অনুরোধে আমার পছন্দের একটি গান বাজানো হয়েছিল_ 'মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে, যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না'। এমনকি হেমন্তের ওই গানের আগে আমার নামও উচ্চারণ করেছিলেন ঘোষিকা। গ্রীষ্মের ওই খরতাপে, বাসের ওই ভিড়ের চাপে আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে গানটি গেয়ে চলেছি_ '...যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না'। এই চোখের খোঁজ করতে করতে পেঁৗছে গেছি, যেখানে যাবার ছিল। কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হয়ে গেছে। আমাদের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার এই ঘটনাগুলো শুনলে আষাঢ়ে গল্প বলেই মনে হবে। কিন্তু এ যে অতি বড় সত্য! তাতে কি সন্দেহ আছে কোনো?
আমি অনেক সময় ভেবেছি, আষাঢ়ে গল্পগুলো কি সত্যিই অবাস্তব? সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, গল্পগুলো শুনতে অবাস্তব মনে হলেও আসলে বাস্তবতার সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নাট্যকলায় এক ধরনের নাট্যরীতি আছে, যাকে বলা হয়ে থাকে অসংলগ্ন নাটক। অনেকে আবার অসম্ভব নাটকও বলেন একে। যেমন ব্রিটেনের নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট্-এর 'গডোর অপেক্ষায়' নাটকে আমরা দেখতে পাই দুই তরুণ এক মরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে চলেছে গডোর জন্য। এই গডো হতে পারে ঈশ্বর, হতে পারে এমন কোনো মানুষ, যে কোনো সুখবর পেঁৗছে দেবে হতাশ এই তরুণদ্বয়ের কাছে। হতে পারে এমন কোনো পরিবর্তন, যাতে তাদের জীবন অর্থবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু নাটকের শেষ পর্যন্ত যার জন্য তারা অপেক্ষায়, তিনি আর আসেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এক অস্থির সমাজ, যেখানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির অভাব অস্থির করে তুলেছে মানুষকে। অস্থির করে তুলেছে তরুণদের। কেননা, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু তাদেরকে হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ তারা কোনো আশার আলোই দেখতে পাচ্ছে না। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে, আমাদের সাধারণ চোখে, অসংলগ্ন, অবাস্তব কিংবা অসম্ভব মনে হলেও সত্য হচ্ছে যে, ওই অস্থিরতাই হলো গিয়ে সত্য। এই অসংলগ্নতার একটা দেশজ সংস্করণ আমি অনেক সময় আমাদের সহকর্মী নাট্যবন্ধুদের বলে থাকি। ধরা যাক, কোনো একটি শহর দুর্ভিক্ষকবলিত আজ। সেখানে সাধারণ মানুষের না আছে কাজ, না আছে জীবন ধারণের কোনো উপায়। অথচ তাদের ক্ষুধা আছে। এই রকম ক্ষুধায় কাতর এক বৃদ্ধ ফুটপাতে শুয়ে কাতরাচ্ছে এবং তার ছেলে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্ষুধার তীব্রতায় টিকতে না পেরে বৃদ্ধ এক সময় মারা যায়। যুবকটি, যদিও ক্ষুধায় সমান কাতর, তবুও অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে তার বাবার মরদেহকে সে কাঁধে তুলে নেয়। উদ্দেশ্য, মরদেহের সৎকার। বিষণ্ন মুখে এই যুবক যখন তার বাবার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, হঠাৎ পাশের এক রেস্তোরাঁ থেকে খাবারের সুগন্ধ ভেসে আসে। সে আর সহ্য করতে পারে না। অতি যত্নে বাবার মৃতদেহটি ফুটপাতে নামিয়ে রেখে খাদ্যের সন্ধানে সে ছুটে যায় ওই রেস্তোরাঁর দরজায়। আপাত দৃষ্টিতে এটি অসম্ভব বলেই মনে হবে। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে সত্য আর কী হতে পারে? একে কি আমরা তবে আষাঢ়ে গল্প বলব? নাকি অতি বাস্তব সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করব এমন ঘটনাকে?
অতএব, আষাঢ়ের বৃষ্টি যখন জমে ওঠে, যখন গোল হয়ে জমিয়ে বসে আমরা গল্প ফাঁদি, তখন সেই গল্পগুলো নিছক আষাঢ়ে গল্প হয় না হয়তো বা। তার মধ্যেও সত্য থাকে, যাতে সত্যদর্শী মন আগ্রহী হতে পারে নিজস্ব অনুসন্ধানে। এই আষাঢ়ে আরও অনেক আষাঢ়ে গল্প বলার ইচ্ছে রইল।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
যখন এই কলামটি আমি লিখছি, আমার পড়ার ঘরের জানালার ধারে বসে, তখন আকাশ ছেয়ে আছে মেঘে। শিপ্্ শিপ্্ করে বৃষ্টি হচ্ছে সারা ঢাকা শহরে। অবশেষে বলা যায়, আষাঢ় জেঁকে বসেছে আমাদের এই শহরে। এর আগে চট্টগ্রাম এবং সিলেটে হৈ হৈ করে যা হয়ে গেল, সেটাকে ঠিক আষাঢ়ের বৃষ্টি বলা যায় না। ঢল নেমেছিল সেখানে। সেই ঢলে ভেসে গেছে বাড়িঘর কুটোর মতো। ধসে পড়েছে পাহাড়। আর ওই পাহাড়ের নিচে যারা অস্থায়ী বাসা বানিয়েছিল; পাহাড় ধসে অনেকেই মারা পড়েছে তাদের মধ্যে। আমার গত সপ্তাহের হৃদয়নন্দন বনে সেই জন্যই এখন মনে হচ্ছে, সময়োচিত ছিল না। যখন এমন দুর্যোগ, এমন ভোগান্তি মানুষের, এই আষাঢ় মাসের শুরুতেই, তখন এ মাসের গুণকীর্তন করার মতো মন-মানসিকতা কি থাকে মানুষের? তবে, আবারও বলছি, এই জন্য আমি আষাঢ়কে দুষি না। আষাঢ়ের আচরণ কখনোই তেমন নয়। দীর্ঘদিন ধরে, কালের সাক্ষী হিসেবে এই মাসটিকে আমি দেখে আসছি বঙ্গ দেশে। রৌদ্রতপ্ত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে, তখন আষাঢ় আসে শান্তির প্রলেপ নিয়ে। ঝড়, বন্যা এবং ধ্বংসের মূর্তি নিয়ে নয়। আজ সকালের এই বৃষ্টিটি আমার অতি পরিচিত। দূরে কোথাও বৃষ্টি হওয়ার খবর যখন পাই, মন কিছুটা খারাপ হয়। মনে হয়, এখানে বৃষ্টি হবে কখন?
শিপ্ শিপ্ বৃষ্টিতে, এই আষাঢ় মাসেই, অনেক সময় কেটেছে আমার; বাংলাদেশের নানা মফস্বল শহরে এবং আমার গ্রামের বাড়িতে। মফস্বল শহরে এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই স্কুলে গেছি। ভেজা কাপড় পরেই ক্লাস করেছি। আবার বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে এসেছি বাসায়। আর গ্রামের অভিজ্ঞতা তো আরও বিচিত্র। সেখানে বৃষ্টিভেজা জলভরা মাঠে খেলেছি নানারকম খেলা। ফেরার পথে কাঁচা মাটির রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়েও গেছি কত! সেই যে, ছড়ায় আছে না_ পা পিছলে আলুর দম? অনেকটা সেই রকম। তবে আষাঢ় মাসের সঙ্গে বাঙালির জীবনে প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে গল্প বলা এবং গল্প শোনার এক প্রক্রিয়া। একে বলা হয় আষাঢ়ে গল্প। কথায় আছে_ গল্পের গরু গাছে চড়ে। এই গল্পের সবচেয়ে মোক্ষম সময় হচ্ছে আষাঢ় মাস। বাইরে যখন অবিরাম বৃষ্টি, পথঘাট কাদা-কাদা, কারোই মন কাজে যেতে আগ্রহী নয়; তখন এক গামলা মুড়ি নিয়ে গোল হয়ে বসে চুটিয়ে গল্প করতে কার না মন চায়! এই রকম আমাদের বাল্যকালে হতো, মা কিংবা দিদিকে ঘিরে। আজকাল আর হয় না। সময় নেই কারও হাতেই। এমনকি আমাদের বাচ্চাদেরও আর সময় হয় না আমাদেরকে ঘিরে বসে গল্প শোনার। ওদের হাতেও সময় নেই। ধেয়ে চলেছে ক্রমাগত। প্রয়োজনেই। অতএব, এই আষাঢ়ের কোনো অলস দুপুরে যদি বৃষ্টি নামে এবং আমার হাতে যদি কোনো কাজ না থাকে, তাহলে বৃষ্টির তালে তাল মিলিয়ে ঘরের মাঝে একলা বসে নিজেই নিজের সঙ্গে গল্প ফাঁদি।
এই একটা সুবিধা আছে। নিজেই বক্তা, নিজেই শ্রোতা হলে কথাগুলো সব নিঃশব্দে চলে। কথা চলে মাথার ভেতরে। কথাকে কল্পনার ফানুস হিসেবে তৈরি করা যায়। রঙ চড়ানো যায় যত খুশি। তখন মনে হয়, আমিই রাজা, আমিই প্রজা, আমিই রাজ্যময়। পাঠক, আপনারাও চেষ্টা করে দেখবেন, আপনাদের জীবনে এমন অনেক আপাত তুচ্ছ ঘটনা ঘটে, যা হয়তো আপনাদের মনঃপূত নয়। সেই ঘটনাগুলোর কথা মনে হলেই মনটা তিক্ত হয়ে ওঠে। ভাবতে ইচ্ছে করে না সেই সব কথা। কিন্তু একটু চেষ্টা করে সেই ঘটনাগুলোকে সামান্য ডানে কিংবা বাঁয়ে ঘুরিয়ে দিন; দেখবেন গল্পগুলো প্রায় মনোরম হয়ে উঠেছে। তখন আর তত খারাপ লাগবে না। এই রকম কত গল্প বানাই আমি মনে মনে, তার কোনো হিসাব নেই। সেই যে রবীন্দ্রনাথের 'বীরপুরুষ' কবিতায় আছে না? 'রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা/ এমন কেন সত্যি হয় না আহা?' আসলে সত্য কী? এই রবীন্দ্রনাথই তো বলেছেন কবির উদ্দেশে, '...তুমি যা রচিবে তাহাই সত্য বটে'। অতএব, আমাদের দুঃখ-কষ্টের গল্পগুলোকে আনন্দ-সুখের গল্পে পরিণত করতে অসুবিধা কোথায়? এই আমাদেরই জীবনে, খুব বেশি দিন আগে নয়; ছিল নাকি এমন সময়, যখন ঠা ঠা রোদে পিচঢালা রাস্তার পাশে বাসের জন্য আধ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করে আছি। যাব লোহারপুল থেকে গুলিস্তান। তারপর সেখান থেকে হাঁটা পথে নটর ডেম কলেজ। গরমে ঘামছি অবিরত, কিন্তু করুণা হচ্ছে না বাস মহাশয়ের। অবশেষে তিনি হেলে-দুলে এলেন। টাউন টু এ সার্ভিস। আমরা বলতাম, মুড়ির টিন। সেখানে ইলিশ মাছের চালানের মতো গাদাগাদি করে দাঁড়ালাম। তারপর মোবিল-পেট্রোলের কটু গন্ধে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় গিয়ে পেঁৗছলাম গন্তব্যে। কিন্তু এই যাত্রায় বাসে উঠেই ভুলে গেলাম পরিবেশের কথা। মনে পড়ল গতকাল দুপুরে, আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসরে আমারই অনুরোধে আমার পছন্দের একটি গান বাজানো হয়েছিল_ 'মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে, যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না'। এমনকি হেমন্তের ওই গানের আগে আমার নামও উচ্চারণ করেছিলেন ঘোষিকা। গ্রীষ্মের ওই খরতাপে, বাসের ওই ভিড়ের চাপে আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে গানটি গেয়ে চলেছি_ '...যার চোখ তাকে আর মনে পড়ে না'। এই চোখের খোঁজ করতে করতে পেঁৗছে গেছি, যেখানে যাবার ছিল। কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হয়ে গেছে। আমাদের জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতার এই ঘটনাগুলো শুনলে আষাঢ়ে গল্প বলেই মনে হবে। কিন্তু এ যে অতি বড় সত্য! তাতে কি সন্দেহ আছে কোনো?
আমি অনেক সময় ভেবেছি, আষাঢ়ে গল্পগুলো কি সত্যিই অবাস্তব? সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, গল্পগুলো শুনতে অবাস্তব মনে হলেও আসলে বাস্তবতার সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নাট্যকলায় এক ধরনের নাট্যরীতি আছে, যাকে বলা হয়ে থাকে অসংলগ্ন নাটক। অনেকে আবার অসম্ভব নাটকও বলেন একে। যেমন ব্রিটেনের নাট্যকার স্যামুয়েল বেকেট্-এর 'গডোর অপেক্ষায়' নাটকে আমরা দেখতে পাই দুই তরুণ এক মরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করে চলেছে গডোর জন্য। এই গডো হতে পারে ঈশ্বর, হতে পারে এমন কোনো মানুষ, যে কোনো সুখবর পেঁৗছে দেবে হতাশ এই তরুণদ্বয়ের কাছে। হতে পারে এমন কোনো পরিবর্তন, যাতে তাদের জীবন অর্থবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু নাটকের শেষ পর্যন্ত যার জন্য তারা অপেক্ষায়, তিনি আর আসেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এক অস্থির সমাজ, যেখানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির অভাব অস্থির করে তুলেছে মানুষকে। অস্থির করে তুলেছে তরুণদের। কেননা, অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু তাদেরকে হাতছানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ তারা কোনো আশার আলোই দেখতে পাচ্ছে না। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে, আমাদের সাধারণ চোখে, অসংলগ্ন, অবাস্তব কিংবা অসম্ভব মনে হলেও সত্য হচ্ছে যে, ওই অস্থিরতাই হলো গিয়ে সত্য। এই অসংলগ্নতার একটা দেশজ সংস্করণ আমি অনেক সময় আমাদের সহকর্মী নাট্যবন্ধুদের বলে থাকি। ধরা যাক, কোনো একটি শহর দুর্ভিক্ষকবলিত আজ। সেখানে সাধারণ মানুষের না আছে কাজ, না আছে জীবন ধারণের কোনো উপায়। অথচ তাদের ক্ষুধা আছে। এই রকম ক্ষুধায় কাতর এক বৃদ্ধ ফুটপাতে শুয়ে কাতরাচ্ছে এবং তার ছেলে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্ষুধার তীব্রতায় টিকতে না পেরে বৃদ্ধ এক সময় মারা যায়। যুবকটি, যদিও ক্ষুধায় সমান কাতর, তবুও অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে তার বাবার মরদেহকে সে কাঁধে তুলে নেয়। উদ্দেশ্য, মরদেহের সৎকার। বিষণ্ন মুখে এই যুবক যখন তার বাবার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে, হঠাৎ পাশের এক রেস্তোরাঁ থেকে খাবারের সুগন্ধ ভেসে আসে। সে আর সহ্য করতে পারে না। অতি যত্নে বাবার মৃতদেহটি ফুটপাতে নামিয়ে রেখে খাদ্যের সন্ধানে সে ছুটে যায় ওই রেস্তোরাঁর দরজায়। আপাত দৃষ্টিতে এটি অসম্ভব বলেই মনে হবে। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে সত্য আর কী হতে পারে? একে কি আমরা তবে আষাঢ়ে গল্প বলব? নাকি অতি বাস্তব সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করব এমন ঘটনাকে?
অতএব, আষাঢ়ের বৃষ্টি যখন জমে ওঠে, যখন গোল হয়ে জমিয়ে বসে আমরা গল্প ফাঁদি, তখন সেই গল্পগুলো নিছক আষাঢ়ে গল্প হয় না হয়তো বা। তার মধ্যেও সত্য থাকে, যাতে সত্যদর্শী মন আগ্রহী হতে পারে নিজস্ব অনুসন্ধানে। এই আষাঢ়ে আরও অনেক আষাঢ়ে গল্প বলার ইচ্ছে রইল।
আলী যাকের :সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments