পদ্মা সেতু প্রকল্প-ঋণচুক্তি বাতিল এবং কিছু বিবেচ্য বিষয় by আহমেদ স্বপন মাহমুদ

দুর্নীতির অভিযোগ সুরাহায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। জনগণকে পরিষ্কারভাবে তা জানানো দরকার। কারণ বিশ্বব্যাংক সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিষয়ে যে অভিযোগ করেছে তা সরকার সঠিকভাবে আমলে নিয়ে এতদিনেও সুরাহা কেন করেনি? কেবল জোর গলায় দুর্নীতি হয়নি বললেই কি সমাধান হয়ে যায়?


এ দেশে উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি হয় এ কথা সবার জানা। প্রতিদিন সাধারণ মানুষ কাজকর্ম করতে গিয়ে প্রশাসন কর্তৃক যে হয়রানির শিকার হয় তা বিবেচনায় আনলেই দুর্নীতির বিষয়টি বোঝা যায়, এর জন্য উচ্চতর গবেষণার প্রয়োজন হয় না।


নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ। দেশে গণমাধ্যমে এর উত্তাপ টের পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে পদ্মা সেতু সংশ্লিষ্ট বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি। কেবল বাংলাদেশের সম্মানহানির বিষয় নয়, বিশ্বব্যাংকও রেহাই পাচ্ছে না। প্রশ্ন উঠছে খোদ বিশ্বব্যাংকের রহস্যজনক ভূমিকা নিয়ে। রহস্য এ কারণে যে, বিশ্বব্যাংক ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই 'ব্রেটনউডের দৈত্য' নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত যত উন্নয়ন ফর্মুলা নিয়ে বাজারে হাজির হয়েছে তার কোনোটি উন্নয়নে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এগুলো বরাবরই প্রশ্নের সম্মুখীন। ফলে এটা রহস্যজনক যে, কেবল দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক একটি ঋণচুক্তি বাতিল করে দেবে? না, তার আড়ালে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত আছে?
মনে রাখা জরুরি, বিশ্বব্যাংক একটি মুনাফাকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কোনো দাতা সংস্থা নয়। এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয় বিশ্বশক্তিধর আমেরিকার নীতি ও পরামর্শ অনুযায়ী। বিভিন্ন সদস্য দেশ বিশ্বব্যাংকের অংশীদার হলেও ব্যাংক পরিচালনায় সর্বোচ্চ প্রেসিডেন্ট পদটি আমেরিকার নাগরিকের হতেই হবে। এমনকি ভোটাধিকারেও আমেরিকার অংশীদারিত্ব বেশি। যে কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমেরিকার রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির নীতি, রাজনৈতিক নীতি ও পরামর্শ অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক পরিচালিত হয়। খোদ হোয়াইট হাউসের প্রভাব বিশ্বব্যাংকে শতভাগ। আমেরিকার নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। অবশ্য এসব প্রকল্পের পেছনে বড় বড় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, দেশের আমলা, প্রশাসন ও রাজনীতিকরা জড়িত থাকে নিজ নিজ স্বার্থে। একটি মুনাফাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংকের মূল লক্ষ্য কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও মুনাফা অর্জন। দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প-ঋণ পরিশোধ করতে হয় সুদআসলে। কেবল তাই নয়, রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি, বাজার ব্যবস্থা ইত্যাদির ধরন কী হবে তার সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাংক বাতলে দেয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হস্তক্ষেপ করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি বাতিল করা খুব সহজ কথা? সরকার ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে অনেক দেনদরবার, সমঝোতা ইত্যাদি শেষে যখন বোর্ড অব গভর্নরস সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো চুক্তি অনুমোদন করা হয় তা বাতিল করে দেওয়াটা সহজ কথা নয়? সেটা ব্যাংকের জন্যও সুখবর হতে পারে না। কেননা এখানে তার মুনাফা ও স্বার্থের বিষয়টিও জড়িত। তাহলে কী এমন বিষয় রয়েছে যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তার বিদায়ের আগ মুহূর্তে চুক্তি বাতিলে সই করে গেলেন? মামুলি অভিযোগ, সরকার প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে আন্তরিক নয়, আর বিশ্বব্যাংক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে সেসব প্রকল্পে কাজ করে না। বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে অবহিত যে কেউ জানেন, এটা আদৌ কোনো শক্তিশালী যুক্তি নয়। তাহলে প্রকৃত যুক্তি বা সত্য বিষয়টি কী? এর পেছনে কি এমন কোনো শক্তি আছে যার ফলে ব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে? কারণ, এর ফলে সরকার ও ব্যাংকের মাঝে সৃষ্ট জটিলতা দ্বারা কোনো মহলের স্বার্থ হাসিল হবে? এটা দাবার ঘুঁটির চাল কি-না? ভাববার বিষয়।
ঋণ সাহায্য সবসময়ই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যেমন আমেরিকা মোট ঋণ সাহায্যের পঞ্চাশ শতাংশ দেয় ইসরায়েলকে। কারণ সহজেই অনুমেয়। বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তিটিও রাজনৈতিক কারণের বাইরে নয়। তাহলে বাতিলও কি রাজনৈতিক?
এ নিয়ে ভাবনা এ কারণেই জরুরি যে, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে এক ধরনের টানাপড়েন ইদানীং লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে। নেপথ্যে তেল-গ্যাস-কয়লা বিষয়টিও থাকতে পারে। গ্যাস রফতানির জন্য আমেরিকার চাপের কথা সবারই জানা কথা। কারণ বিশ্বব্যাংকের যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত কেবল ব্যাংকের সিদ্ধান্ত কি? সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি, শক্তিধর লবিস্ট, বহুজাতিক কোম্পানি ও হোয়াইট হাউস তথা অপরাপর শক্তির কোনো যোগসাজশ আছে কি-না সেগুলো মনোযোগের সঙ্গে বিশ্লেষণ করা জরুরি।
সরকারের মধ্যে একটি অস্থিরতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমলা-প্রশাসন-সরকারের সম্পর্ক সবসময়ই মধুর। বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে জনগণের দাবিকে সরকার কদাচিৎ গুরুত্ব দেয়। জলবায়ু তহবিল নিয়ে, বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের দাবি কোনোদিনই সরকার আমলে নেয়নি। কোনো চুক্তি সম্পর্কে, শর্তাবলি সম্পর্কে কখনোই জনগণকে অবহিত করে না সরকার। বরং বিশ্বব্যাংক-এডিবি-আইএমএফের নীতি-পরামর্শ বাস্তবায়ন করে সাধারণ মানুষের দুর্যোগের কারণ হয়েছে বারবার। তাহলে হঠাৎ করে এমন মধুর সম্পর্ক তিক্ত হবে কেন?
দুর্নীতির অভিযোগ সুরাহায় সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। জনগণকে পরিষ্কারভাবে তা জানানো দরকার। কারণ বিশ্বব্যাংক সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিষয়ে যে অভিযোগ করেছে তা সরকার সঠিকভাবে আমলে নিয়ে এতদিনেও সুরাহা কেন করেনি? কেবল জোর গলায় দুর্নীতি হয়নি বললেই কি সমাধান হয়ে যায়? এ দেশে উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি হয় এ কথা সবার জানা। প্রতিদিন সাধারণ মানুষ কাজকর্ম করতে গিয়ে প্রশাসন কর্তৃক যে হয়রানির শিকার হয় তা বিবেচনায় আনলেই দুর্নীতির বিষয়টি বোঝা যায়, এর জন্য উচ্চতর গবেষণার প্রয়োজন হয় না। স্বীকার করতে দোষ কী যে, দুর্নীতি এখনও একটি সমস্যা, যা কাটিয়ে ওঠা জরুরি। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা মিললে দোষীদের শাস্তি বিধান করা আবশ্যক। এ দাবি কেবল বিশ্বব্যাংকের হবে কেন, এ দাবি জনগণের। কারণ বিশ্বব্যাংক সুনির্দিষ্টভাবে যেসব অভিযোগ আনছে সরকারের বিরুদ্ধে সে বিষয়ে কেবল রাজনৈতিক বক্তব্য দিলে বিষয়টি সুরাহা হবে না। প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিকভাবে নিরপেক্ষ ও সঠিক তদন্ত। সে বিষয়ে সরকার তেমন কিছু তথ্য-উপাত্ত হাজির করছে না। ফলে এ ক্ষেত্রে সংশয় জাগে, তাহলে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ কি শতভাগ ঠিক?
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব সুখকর নয়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব যে অস্থিরতা তৈরি করছে তাতে এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ ভুক্তভোগী, কোনো সন্দেহ নেই। ফলে এই ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষুণ্ন হওয়ার যে বিষয়টি হাজির হয়েছে তা কোনোমতেই শুভ নয়, সুনামের নয়। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেশী আমেরিকা, ভারত, চীনসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি রয়েছে। অন্যদিকে সরকার কেন দীর্ঘ নয় মাসে দুর্নীতির অভিযোগ সুরাহা করেনি তাও প্রশ্নের সম্মুখীন।
আমরা জানি, সরকারের আমলা-প্রশাসন ও রাজনীতিকরা ঋণ প্রকল্প গ্রহণে সবসময় দু'পা এগিয়ে থাকে। কারণ এ জাতীয় বড় বড় প্রকল্প থেকে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে। ঋণচুক্তি বাতিলের কারণে কোথাও কারও স্বার্থের হানি হয়েছে কি-না বা স্বার্থ হাসিল হয়েছে কি-না সেগুলোও ভাবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বস্তুত বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মাঝে সৃষ্ট ঘটনা অনেক বিষয়ে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের সময় এসেছে আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ প্রকল্প গ্রহণ না করে নিজস্ব অর্থায়নে জনমতামত, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প গ্রহণ করা ও বাস্তবায়ন করা। কারণ আশির দশকে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় সাধারণ জনগণের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ-প্রতিবেশ বিনষ্ট করে বিশ্বব্যাংক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। পরে নব্বই দশকে 'ওয়াশিংটন কনসেনসাস' প্যাকেজও কোনো ভূমিকা রাখেনি। মূলত উদারনীতি অর্থনীতি, সেবা খাত বেসরকারিকরণ, করপোরেট শক্তির হাতে উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাকে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার কাজকেই অগ্রসর করে বিশ্বব্যাংক, কখনও কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি, কখনও দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র চাপিয়ে দিয়ে, যা জনগণের জীবন-জীবিকাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়। ফলে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ প্রকল্প গ্রহণ না করে কীভাবে স্বাধীনতার চেতনাকে সমুন্নত রেখে অর্থনীতির স্বাধীন ভিত তৈরি করা যায়, সেদিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। এতে স্বনির্ভরতার ভিত যেমন শক্ত হবে, তেমনি প্রতিষ্ঠা পাবে জনগণের গণতান্ত্রিক মালিকানা।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ : কবি, গবেষক
 

No comments

Powered by Blogger.