কালান্তরের কড়চা : এবারের বঙ্গদর্শন-২-একুশের পদক প্রদানের অনুষ্ঠানও কি একটি মামুলি সরকারি অনুষ্ঠান? by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

আমার এবারের বঙ্গদর্শনেও প্রিয় ও অপ্রিয় দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছি। একটি প্রিয় অভিজ্ঞতার কথা আগে বলেছি। এবার একটি অপ্রিয় অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১১ সালে একুশের পদকদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আমার মনে হয়েছে, এ অনুষ্ঠানটি, বলতে গেলে, একুশের গোটা অনুষ্ঠানই যেন বেশি মাত্রায় সরকারিকরণ হয়ে গেছে।


সরকারিকরণ মানেই আমলানির্ভর ও আমলাসর্বস্ব অনুষ্ঠান। এ ধরনের অনুষ্ঠান বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে চলতে পারে। আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক শাসনামলে চলা দৃষ্টিকটু। এবারের একুশে পদক দানের অনুষ্ঠানে দর্শকদের সারিতে বসে আমার মনে হয়েছে, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরে এসেছে, তা মনে হয় না। মনে হয় সামরিক আমলাদের হাত থেকে অসামরিক আমলাদের হাতে দৃশ্যত ক্ষমতা ফিরে এসেছে। সামরিক শাসন ও বিএনপি আমলের মতোই কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেই গণরাজনীতির কালচারের কোনো স্পর্শ নেই।
মঞ্চে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি এবং তাঁর হাত দিয়ে পদক প্রদান অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তাঁকে ঘিরে পদাধিকারবলে মন্ত্রী ও সরকারি লোকজনের মঞ্চে একাধিপত্য মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। স্বাধীনতার পদক ও একুশের পদক প্রদানের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। একটি রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান, অন্যটি রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের সম্মান। একুশের পদক দানের অনুষ্ঠানের চরিত্রই তাই হবে আলাদা। এই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, আমলারাই প্রাধান্য বিস্তার করবেন না; প্রাধান্য বিস্তার করবেন দেশের সমাজ-সংস্কৃতির বরেণ্য নেতারা।
স্বাধীনতার আগে এটাই ছিল ভাষাশহীদ দিবসের গণভিত্তিক চরিত্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রব্যবস্থায় সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির প্রভুত্ব যত বাড়তে থাকে, একুশের গণভিত্তিক সেক্যুলার চরিত্র তত হারাতে থাকে। এখন তো একুশের বহু সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠান শুরু হয় কোরআন পাঠ দ্বারা। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একুশের পদকদান অনুষ্ঠানে দেখলাম কোরআন, বেদ ও ত্রিপিটক অথবা বাইবেলও পাঠ করা হয়েছে। অথচ পাকিস্তান আমলে সেই ভাষা দিবস অনুষ্ঠানের শুরুর বছরগুলোতে ঢাকায় প্রভাতফেরি বা কোনো অনুষ্ঠানে কোনো ধর্মগ্রন্থই পাঠ হতে দেখা যায়নি। সত্য কথা বলতে কী, পাকিস্তান আমলেও আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, কালচারে ধর্মীয় সংস্কৃতির এতটা প্রভাব ছিল না। এই সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে দীর্ঘকালের সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসন। বিএনপি তো এই সংস্কৃতিরই মানস-সংগঠন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ঘাড়েও এই সংস্কৃতির ভূত চেপেছে। এই ভূত তাড়ানোর সাহসী ওঝা বর্তমান আওয়ামী লীগে নেই।
এবারের একুশে পদক দানের অনুষ্ঠানেও সব পেশা ও সার্ভিসের লোকজনই উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। আমি কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে খুঁজে পাইনি। তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, না তাঁরা ইচ্ছে করেই আসেননি, তা আমি জানি না। মঞ্চে কতিপয় মন্ত্রীর এবং অনুষ্ঠানে কতিপয় আমলার দাপটই ছিল বেশি। মঞ্চে যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কে ছিলেন, তা জানি না। তথ্য বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হলেই ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সভাপতিত্ব করা বা বক্তৃতা দেওয়ার অধিকার জন্মে_এটা আমি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মন্ত্রিত্বের পদাধিকারবলে পাট সম্মেলনে, মৎস্য সম্মেলনে হয়তো বক্তৃতা দেওয়া চলে, কিন্তু শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক সম্মেলনে কেবল মন্ত্রিত্বের দাবিতে ভাষণ দেওয়া যায় না, মগজে কিছু বিদ্যাবুদ্ধি থাকতে হয়।
জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে দিলি্লতে এক বিজ্ঞান সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তিনি রেগে গিয়ে আমন্ত্রণকারীদের বলেছিলেন, 'ভারত কি এতই এতিম হয়ে গেল যে বিজ্ঞান সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য একজন বিজ্ঞানীকে আপনারা খুঁজে পেলেন না? আমি রাজনীতি ভালো বুঝি। হয়তো ভালোভাবে সরকার চালাতেও পারি। তাই বলে বিজ্ঞান সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য আমাকে নকল বিজ্ঞানী সাজতে হবে?' নেহরুর কাছ থেকে এই ধমক খাওয়ার পর বিজ্ঞান সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার জন্য একজন খ্যাতনামা বিজ্ঞানীকে ডেকে আনা হয়েছিল। নেহরু সম্মেলনে দর্শক হয়ে এসে বিজ্ঞানীদের কথা শুনেছেন।
ঔপনিবেশিক আমলে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির মাথায় বিদেশি শাসকরা একজন করে সাদা আমলার (বড় লাট বা ছোট লাটের) বা কালো আমলার (নেটিভ ব্যুরোক্র্যাট) কর্তৃত্ব চাপিয়ে দিতেন। শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাক বা না থাক, তা নিয়ে বিদেশি শাসকদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তাঁরা চাইতেন, উপনিবেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির মাথায় তাঁদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, যাতে শিক্ষা-সংস্কৃতির মাধ্যমে শাসিত জাতির মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জেগে না ওঠে; শিক্ষা ও সংস্কৃতি যেন তাদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পথ না দেখায়।
বিদেশি শাসকদের কবল থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি, কিন্তু তাঁদের মানসিক দাসত্বের শেকল ভাঙতে পারিনি। বরং তাঁদের ঔপনিবেশিক রীতিনীতির অন্ধ অনুকরণ দ্বারা আমরা ঔপনিবেশিক যুগের পরিবেশ স্বাধীন দেশেও জিইয়ে রেখেছি। ব্রিটিশ আমলে নিয়ম ছিল ব্রিটিশ ভাইসরয় বা প্রভিন্সিয়াল গভর্নর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর থাকবেন পদাধিকারবলে। শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁদের কোনো জ্ঞানগম্যি না থাকলেও চলবে। এই ঔপনিবেশিক প্রথা মেনে চলতে গিয়ে পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও ময়মনসিংহের এক অর্ধশিক্ষিত বটতলার উকিল এবং এক 'স্বশিক্ষিত' মহিলা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর ও ভাইস চ্যান্সেলর হয়ে কনভোকেশনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ারও সুযোগ পেয়েছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই বঙ্গবন্ধু এই ঔপনিবেশিক যুগের দাসপ্রথা উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদাধিকারবলে দেশের সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপ্রধান আর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হবেন না। তিনি এই পদ ছেড়ে দেবেন এবং আইন করবেন, দেশের খ্যাতনামা পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর নিযুক্ত করা হবে।
বঙ্গবন্ধু এই সিদ্ধান্ত কার্যকর এবং নতুন নিয়ম প্রবর্তন করার সুযোগ পাননি। তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের দ্বারা দেশে ঔপনিবেশিক যুগের দাসপ্রথাগুলোই বলবৎ রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধান এখনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় প্রকৃত শিক্ষিত, শিক্ষাবিদদের কর্র্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশে এখন অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। কিন্তু উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায়ও আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হয়নি। ফলে গণতান্ত্রিক সরকারের শিক্ষা সংস্কার এবং নতুন শিক্ষানীতিও লালফিতায় ফাইলবন্দি থাকে। তা কার্যকর হয় না।
ব্রিটেনসহ ইউরোপের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যত সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমনকি রানিও ইচ্ছে করলেই পদাধিকারবলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদে বসতে পারেন না। এই পদে সাধারণত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা মনোনীত হন। বিশ্ববিদ্যালয় আমন্ত্রণ না জানালে কোনো প্রধানমন্ত্রীও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে হাজির হতে বা ভাষণ দিতে পারেন না। মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর ইচ্ছে ছিল অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে আমন্ত্রিত হওয়ার ও ভাষণ দেওয়ার। অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কর্তৃপক্ষ মার্গারেট থ্যাচারকে এ আমন্ত্রণ লাভের যোগ্য মনে করেনি। মার্গারেট থ্যাচার অনেক চেষ্টা করেও আমন্ত্রণ পাননি।
অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা নিয়ম আছে, বিদেশের বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ বা বুদ্ধিজীবীকে অঙ্ফোর্ডে এনে ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে ভাষণ দানের ব্যবস্থা করার। কিন্তু এই ব্যাপারেও অতিথি বক্তা বাছাইয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের মতামত গ্রহণ করা হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন তাঁকে অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষামূলক ভাষণ দানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এটা অত্যন্ত সম্মানজনক আমন্ত্রণ। কিন্তু ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারে বাধা এল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্রদের কাছ থেকে। তাদের সঙ্গে ভুট্টোবিরোধী ক্যাম্পেইনে প্রচুর শ্বেতাঙ্গ ছাত্রছাত্রীও যোগ দিয়েছিল।
ভুট্টোবিরোধী ক্যাম্পেইনের নেতারা অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানালেন, ভুট্টো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য প্রধান দায়ী ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি একজন যুদ্ধাপরাধীও। তাঁকে অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষার উচ্চ পাদপীঠে আসতে দেওয়া যায় না। এই সময় বাংলাদেশের ড. কামাল হোসেন, ড. মোশাররফ হোসেন প্রমুখ অঙ্ফোর্ডেই অবস্থান করছিলেন। ড. কামাল হোসেনের বিচউড রোডের বাড়িতে ভুট্টোবিরোধী ক্যাম্পেইনের নেতৃস্থানীয় ছাত্ররা বহু মিটিং করেছেন। ড. কামাল হোসেনও এই ক্যাম্পেইনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমিও তাঁর বাসার সভায় কয়েকবার গিয়েছি।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে এটা ছিল বিরাট প্রেস্টিজ ইস্যু। তিনি অঙ্ফোর্ডের আমন্ত্রণটি যাতে বাতিল না হয় সে জন্য পাল্টা ক্যাম্পেইনে দুই হাতে অর্থ ব্যয় করেছেন। বিশিষ্ট ব্রিটিশ নেতাদের দ্বারা তাঁর আমন্ত্রণটি যাতে বলবৎ থাকে, সে জন্য অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। কোনো ফল হয়নি। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীও চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার স্বার্থে ভুট্টোর অঙ্ফোর্ড-ভাষণের ব্যবস্থাটি বলবৎ রাখতে।
অঙ্ফোর্ডে এই ভুট্টো-বিতর্কের সময় আমি একদিন লন্ডনের পেডিংটন স্টেশন থেকে অঙ্ফোর্ডে যাচ্ছি, দেখি ট্রেনের যে কক্ষে আসন পেয়েছি, সেই কক্ষে ব্রিটেনের প্রাক্তন টোরি প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান চায়ের কাপ হাতে বসে আছেন। তিনিও অঙ্ফোর্ডে যাচ্ছেন। অঙ্ফোর্ডে পেঁৗছে ভুট্টোবিরোধী ক্যাম্পেইনের ছাত্রনেতাদের কাছে শুনেছি, ভুট্টোকে অঙ্ফোর্ডে ভাষণ দিতে আসার আমন্ত্রণটি যাতে বাতিল না হয়, সেই ক্যাম্পেইনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হ্যারল্ড ম্যাকমিলান। এত চাপ সৃষ্টি এবং শক্তিশালী লবিং এবং তদবির সত্ত্বেও জুলফিকার আলী ভুট্টো অঙ্ফোর্ডে আসতে পারেননি। তাঁকে অঙ্ফোর্ডে আসার আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
আমার এ লেখায় ভুট্টো সম্পর্কিত এ ঘটনাটির উল্লেখ সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক না হলেও এ জন্যই উল্লেখ করেছি, কোনো দেশে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই প্রথম মুক্তদ্বার নীতি গ্রহণ করতে হয়। এই মুক্তদ্বার দিয়ে যে আলো-বাতাস ঢোকে, তা দিয়েই গণতান্ত্রিক সমাজের মনমানসিকতা তৈরি হয়। এই মনমানসিকতা ছাড়া কেবল কেতাবি বুলি ও মন্ত্রীদের গণতন্ত্র সম্পর্কে অহরহ উচ্চারিত আপ্তবাক্যে সমাজ বা রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি হয় না।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের রাহুমুক্ত নয়। রাষ্ট্রপ্রধান যিনিই হোন, শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর লেশমাত্র সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক যুগের নিয়ম অনুযায়ী তিনি চ্যান্সেলর হন। তারপর যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে অনেক অযোগ্য ব্যক্তিকেও ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করে। ফলে দেশে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটছে, কিন্তু তার মান নিম্নগামী। উচ্চশিক্ষার প্রসারের নামে ব্যাঙের ছাতার মতো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু নিচুতলার বা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার শিরদাঁড়া ভঙ্গুর। শিক্ষা এখন হাজার হাজার তথাকথিত শিক্ষিত তৈরি করে বিদেশে মেধা পাচারের বড় ব্যবসা।
এবার বঙ্গদর্শনের সময়ও উপলব্ধি করেছি, বাংলাদেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক আমলের নিয়মরীতি এখনো বলবৎ আছে। স্বায়ত্তশাসিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগে ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণ, এখন দলীয় নিয়ন্ত্রণও বেড়েছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাদের দলীয় দাপট প্রকট হয়ে ওঠে। বঙ্গ লিখতে অঙ্গ ফাটে এমন মন্ত্রীরাও শিক্ষা-সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠানে এসে মঞ্চ দখল করেন, অর্বাচীন ভাষণ দেন এবং তার চাইতে অনেক বেশি জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের তা দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনতে হয়।
নেহরুর মতো এমন বোধোদয় আমাদের কোনো মন্ত্রীর আছে কি না জানি না। পশুসম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী হয়ে মহাকাশ সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সভায় প্রধান অতিথি হওয়া এবং সেই বিজ্ঞান সম্পর্কে সভায় দাঁড়িয়ে হাস্যকর কথাবার্তা বলা তাঁর মানায় না। আমাদের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীও এমন যে সরকারি অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়ার জন্য তাঁরা হা-পিত্যেশ করে বসে থাকেন এবং দাওয়াতের কার্ড পেলে ছুটে গিয়ে সভায় প্রধান অতিথি বা সভাপতি হিসেবে আমন্ত্রিত কোনো কোনো মন্ত্রীর অর্বাচীন বক্তব্য শোনেন। আমেরিকায় আইসেনহাওয়ার যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন একবার কথাশিল্পী আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে তাঁর সঙ্গে বিদেশ সফরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হেমিংওয়ে প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী হওয়ার চাইতে স্পেনে ষাঁড়ের লড়াই দেখতে যাওয়া বেশি পছন্দ করেন।
এবার ঢাকায় একুশের পদক প্রদানের অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে আমার মনে হয়েছে, এটা যেকোনো ধরনের চিরাচরিত সরকারি অনুষ্ঠানের সঙ্গে তুল্য। এটা যে মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিপূত একটি ভাষা-সংস্কৃতিমূলক অনুষ্ঠান তা মনেই হয় না। প্রধানমন্ত্রী পদক বিতরণ করছেন, একাধিক মন্ত্রী মঞ্চের শোভা বর্ধন করে বসে আছেন, এটা তো যেকোনো সরকারি অনুষ্ঠানেই দেখা যায়। লন্ডনে এবং দিলি্ল ও কলকাতায়ও দেখেছি, সাহিত্য একাডেমীর পুরস্কার প্রদানের সভায় কিংবা সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সভায় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং মন্ত্রীরাও উপস্থিত থাকেন বটে, তাঁদের উপস্থিতি গৌণ। দেশের বিদ্বৎজন, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরাই মঞ্চে বসা ও ভাষণ দানে প্রাধান্য পান। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। বিদ্বৎজনকেই দর্শকের সারিতে বসে অর্বাচীন বক্তব্য ও ভাষণ শুনতে হয়। সম্ভবত এ জন্যই ঢাকার সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা-সংস্কৃতি বিষয়ক সভা-সম্মেলনগুলোতে জ্ঞানী-গুণী বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতি কম দেখি। এবারের একুশের পদক বিতরণ অনুষ্ঠানেও তাই দেখেছি। অনেক পরিচিত বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সম্পাদককে খুঁজেও অনুষ্ঠানে পাইনি। তাঁরা কি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পাননি, না ইচ্ছে করেই আসেননি? প্রশ্নটা অনেককেই করেছি। জবাব পাইনি।
একুশের এই পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে যথারীতি মধ্যমণি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি সজ্জন ও সরল মানুষ। কিন্তু শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত সভায় সভাপতিত্ব করা বা ভাষণ দেওয়া তাঁর মানায় কি? তাঁর ভাষণ শুনে মনে হচ্ছিল, একটা মেঠো রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনছি। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দেশের একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার এবং ভাষণ দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলে কি ভালো হতো না? যে নিয়ম শুধু ব্রিটেনে নয়, ভারতেও এখন চালু রয়েছে। তথ্যমন্ত্রীকে অনুষ্ঠান শেষে একটু রূঢ়ভাবেই বলেছি, কেবল 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর' ভঞ্জনামূলক তাঁর ভাষণ আমার ভালো লাগেনি।
(পরবর্তী অংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ২৯ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১১

No comments

Powered by Blogger.