স্মরণ-হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের জন্য by সুলতানা কামাল
ষাটের দশকে যে কয়জন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী টেলিভিশন ও রেডিওতে সংগীত পরিবেশন করে কণ্ঠ ও গায়কির চমৎকারিত্বে সংগীতমোদীদের চমকে দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন সিলেটের কন্যা রাখী চক্রবর্তী। পঁয়ষট্টি-পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় বিবেচনায় রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি সরকারি রোষের কারণে শিল্পীদের
নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে, সেই সময় রাখী চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। পূর্ব পাকিস্তানের (তদানীন্তন) একটি মেয়ে পশ্চিমবঙ্গে শান্তিনিকেতনে গান শিখতে গেছে, তাঁর পাসপোর্টই কেড়ে নেওয়া হলো এবং তাঁকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ (anti-state) ঘোষণা করা হলো। একে তো হিন্দুসম্প্রদায়ে জন্ম, তার ওপর শান্তিনিকেতনে গান শিখতে গেছেন—পাকিস্তানি মানসিকতায় তার পরিচয়ের বাইরে অন্য রকম আর কী হতে পারে? যা-ই হোক, বহু ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রাখী তাঁর আরাধ্য কাজ শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। শান্তিনিকেতনে তিনি পেয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনের মতো শিক্ষকদের।
মফস্বলবাসিনী ছিলেন বলে শান্তিনিকেতন থেকে ফেরত আসার আগ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে তাঁর পরিচিতি তেমন ব্যাপক ছিল না। কিন্তু ঢাকায় ফিরে তাঁর প্রথম পরিবেশনাই গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল শ্রোতাদের। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের শীর্ষস্থানীয় তারকাশিল্পীদের একজন হিসেবে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করে নিয়েছিলেন।
সে সময় টেলিভিশনে যাঁদের রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত দর্শক-শ্রোতা, রাখী চক্রবর্তী নিশ্চিতভাবেই ছিলেন তাঁদের অন্যতম। মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছর আগে সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আমার মেয়ে দিয়া একটি গান করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। দিয়ার গান শুনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ওর গানের প্রতিভাটা কার সূত্রে পাওয়া?’ বললাম, ওর বাবার বোন হলেন রাখী চক্রবর্তী। হুমায়ূন আহমেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে আরামের ভঙ্গিতে বসে ছিলেন, রাখী চক্রবর্তীর নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্র সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত আগ্রহের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই “ভালোবাসা কারে কয়”-এর রাখী চক্রবর্তী?’ একেকটা গান এমনিভাবে তাঁর নামের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
রাখী অনেক দিন ধরে প্রবাসী। বিলেতে গানের চর্চাটা বজায় রাখেননি—তাই অনেকের কাছেই তিনি এখন আর তেমন পরিচিত নন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের কিছু গান এখনো তাঁরই গাওয়া গান হিসেবে কানে লেগে আছে অনেকের কাছে। ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে,’ ‘আহা আজি এ বসন্তে’, ‘আমি হূদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইলো না কেহ’ গানগুলো রাখীই নতুন করে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথের পূজা, স্বদেশ বা প্রকৃতি পর্যায়ের গানেরই চল ছিল বেশি। রাখী একটা অন্য ধরনের পরিবেশনাকে মানুষের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর ‘আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি’ অথবা ‘মরি লো মরি আমার বাঁশীতে ডেকেছে কে’ গানগুলো এখনো এক অনন্য পরিবেশনা বলে আমাদের মনে গেঁথে আছে।
একাত্তরে কলকাতায় রাখী গান করেছেন বাংলাদেশের শিল্পীদের হয়ে। তার আগে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে প্রতিবাদী সংগঠন ‘কলম-তুলি-কণ্ঠ’, যার মাধ্যমে সিলেটের নাগরিক সমাজ পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছিল, রাখী তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছায়ানটের অনুষ্ঠানে ’৬৬ থেকে ৭০ পর্যন্ত নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। পাকিস্তান আমলে শ্রদ্ধেয় কলিম শরাফীর নেতৃত্বে রবীন্দ্রসংগীতের যে একটি মাত্র ৪৫ আরপিএমের রেকর্ড বেরিয়েছিল, তার শিল্পীদের মধ্যে আফসারী খানম, ফাহমিদা খাতুন, কলিম শরাফীর সঙ্গে রাখীও ছিলেন। বিরল সুকণ্ঠের অধিকারিণী অত্যন্ত প্রতিভাবান এই শিল্পী মাঝেমধ্যে কদাচিৎ বিবিসিতে আমন্ত্রিত হয়ে গান করেছেন অথবা লন্ডনে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তাঁর একটি মাত্র অডিও-ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে, তা-ও পরিবার-পরিজনের অনেক জোরাজুরির কারণে।
আনন্দধারা প্রকাশিত সেই ক্যাসেটের প্রচ্ছদে রাখী চক্রবর্তী সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘রাখী চক্রবর্তীর জন্মভূমি সিলেট। গুণগ্রাহী মাতা রাখীকে পাঠালেন শান্তিনিকেতনে। সংগীতভবনে পাঠ নিলেন সুশীল ভঞ্জ, ভি ভি ওয়াজেলওয়ার, শান্তিদেব ঘোষ, বীরেন পালিত, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতী বসু আর রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেনের কাছে। দেশে ফিরে জয় করে নিলেন সব চিত্ত। দেশে তখন পাকিস্তানি জঙ্গি শাসন। সেনাছাউনি থেকে হুকুম এল, সেখানে গিয়ে সংগীত পরিবেশন করতে হবে। রাখী অমান্য করলেন সেই আদেশ। চারদিক থেকে ঘনিয়ে এল জীবন-সংশয় ষড়যন্ত্র। তিনি চিহ্নিত হলেন রাষ্ট্রদ্রোহীরূপে।
১৯৭০ সালে ইএমআইয়ের ব্যাপ্তবাদনে রাখীর গান সংগীতরসিকদের বিমোহিত করে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সিলেটে রাখী চিত্রশিল্পী, লেখক ও কণ্ঠশিল্পী সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ‘কলম-তুলি-কণ্ঠ’ নামে সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গান গেয়েছেন কলকাতার রবীন্দ্রসদনে, একাডেমি অব ফাইন আর্টস মঞ্চে। ১৯৭৩ সালে তিনি চলে যান যুক্তরাজ্যে। আর ফেরেননি।
কিছুদিন আগে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা তাঁর ‘শ্রুতি গীতবিতান’-এর জন্য রেডিও-টেলিভিশনের আর্কাইভ থেকে খুঁজে খুঁজে রাখী চক্রবর্তীর কয়েকটি গান সেই অ্যালবামে যুক্ত করেছেন।
রাখী চক্রবর্তী ১১ জুন যুক্তরাজ্যের হার্টলিপুল শহরে একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। চার মাস ধরে তিনি নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর স্বামী ডাক্তার মন্মথ রায় দুই বছর হলো মারা গেছেন। তাঁদের একটি ছেলে, রাহুল রায় যুক্তরাজ্যেই বসবাস করছেন এবং পেশাগত কাজে জড়িত আছেন।
রাখী চক্রবর্তীর মৃত্যুতে অনেক রবীন্দ্রসংগীত বোদ্ধা ও রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমী একজন নক্ষত্রতুল্য শিল্পী হারানোর ক্ষতি অনুভব করবেন। আমি হারালাম একজন বন্ধু ও বোনকে।
মফস্বলবাসিনী ছিলেন বলে শান্তিনিকেতন থেকে ফেরত আসার আগ পর্যন্ত জাতীয়ভাবে তাঁর পরিচিতি তেমন ব্যাপক ছিল না। কিন্তু ঢাকায় ফিরে তাঁর প্রথম পরিবেশনাই গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল শ্রোতাদের। তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের শীর্ষস্থানীয় তারকাশিল্পীদের একজন হিসেবে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করে নিয়েছিলেন।
সে সময় টেলিভিশনে যাঁদের রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত দর্শক-শ্রোতা, রাখী চক্রবর্তী নিশ্চিতভাবেই ছিলেন তাঁদের অন্যতম। মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছর আগে সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আমার মেয়ে দিয়া একটি গান করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। দিয়ার গান শুনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ওর গানের প্রতিভাটা কার সূত্রে পাওয়া?’ বললাম, ওর বাবার বোন হলেন রাখী চক্রবর্তী। হুমায়ূন আহমেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে আরামের ভঙ্গিতে বসে ছিলেন, রাখী চক্রবর্তীর নাম উচ্চারিত হওয়া মাত্র সোজা হয়ে বসে অত্যন্ত আগ্রহের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেই “ভালোবাসা কারে কয়”-এর রাখী চক্রবর্তী?’ একেকটা গান এমনিভাবে তাঁর নামের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
রাখী অনেক দিন ধরে প্রবাসী। বিলেতে গানের চর্চাটা বজায় রাখেননি—তাই অনেকের কাছেই তিনি এখন আর তেমন পরিচিত নন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের কিছু গান এখনো তাঁরই গাওয়া গান হিসেবে কানে লেগে আছে অনেকের কাছে। ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে,’ ‘আহা আজি এ বসন্তে’, ‘আমি হূদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইলো না কেহ’ গানগুলো রাখীই নতুন করে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন। সে সময় রবীন্দ্রনাথের পূজা, স্বদেশ বা প্রকৃতি পর্যায়ের গানেরই চল ছিল বেশি। রাখী একটা অন্য ধরনের পরিবেশনাকে মানুষের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর ‘আমার মল্লিকাবনে যখন প্রথম ধরেছে কলি’ অথবা ‘মরি লো মরি আমার বাঁশীতে ডেকেছে কে’ গানগুলো এখনো এক অনন্য পরিবেশনা বলে আমাদের মনে গেঁথে আছে।
একাত্তরে কলকাতায় রাখী গান করেছেন বাংলাদেশের শিল্পীদের হয়ে। তার আগে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে প্রতিবাদী সংগঠন ‘কলম-তুলি-কণ্ঠ’, যার মাধ্যমে সিলেটের নাগরিক সমাজ পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছিল, রাখী তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছায়ানটের অনুষ্ঠানে ’৬৬ থেকে ৭০ পর্যন্ত নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন। পাকিস্তান আমলে শ্রদ্ধেয় কলিম শরাফীর নেতৃত্বে রবীন্দ্রসংগীতের যে একটি মাত্র ৪৫ আরপিএমের রেকর্ড বেরিয়েছিল, তার শিল্পীদের মধ্যে আফসারী খানম, ফাহমিদা খাতুন, কলিম শরাফীর সঙ্গে রাখীও ছিলেন। বিরল সুকণ্ঠের অধিকারিণী অত্যন্ত প্রতিভাবান এই শিল্পী মাঝেমধ্যে কদাচিৎ বিবিসিতে আমন্ত্রিত হয়ে গান করেছেন অথবা লন্ডনে কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। তাঁর একটি মাত্র অডিও-ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে, তা-ও পরিবার-পরিজনের অনেক জোরাজুরির কারণে।
আনন্দধারা প্রকাশিত সেই ক্যাসেটের প্রচ্ছদে রাখী চক্রবর্তী সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘রাখী চক্রবর্তীর জন্মভূমি সিলেট। গুণগ্রাহী মাতা রাখীকে পাঠালেন শান্তিনিকেতনে। সংগীতভবনে পাঠ নিলেন সুশীল ভঞ্জ, ভি ভি ওয়াজেলওয়ার, শান্তিদেব ঘোষ, বীরেন পালিত, মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতী বসু আর রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীলিমা সেনের কাছে। দেশে ফিরে জয় করে নিলেন সব চিত্ত। দেশে তখন পাকিস্তানি জঙ্গি শাসন। সেনাছাউনি থেকে হুকুম এল, সেখানে গিয়ে সংগীত পরিবেশন করতে হবে। রাখী অমান্য করলেন সেই আদেশ। চারদিক থেকে ঘনিয়ে এল জীবন-সংশয় ষড়যন্ত্র। তিনি চিহ্নিত হলেন রাষ্ট্রদ্রোহীরূপে।
১৯৭০ সালে ইএমআইয়ের ব্যাপ্তবাদনে রাখীর গান সংগীতরসিকদের বিমোহিত করে। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সিলেটে রাখী চিত্রশিল্পী, লেখক ও কণ্ঠশিল্পী সমন্বয়ে গড়ে তোলেন ‘কলম-তুলি-কণ্ঠ’ নামে সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গান গেয়েছেন কলকাতার রবীন্দ্রসদনে, একাডেমি অব ফাইন আর্টস মঞ্চে। ১৯৭৩ সালে তিনি চলে যান যুক্তরাজ্যে। আর ফেরেননি।
কিছুদিন আগে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা তাঁর ‘শ্রুতি গীতবিতান’-এর জন্য রেডিও-টেলিভিশনের আর্কাইভ থেকে খুঁজে খুঁজে রাখী চক্রবর্তীর কয়েকটি গান সেই অ্যালবামে যুক্ত করেছেন।
রাখী চক্রবর্তী ১১ জুন যুক্তরাজ্যের হার্টলিপুল শহরে একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন। চার মাস ধরে তিনি নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর স্বামী ডাক্তার মন্মথ রায় দুই বছর হলো মারা গেছেন। তাঁদের একটি ছেলে, রাহুল রায় যুক্তরাজ্যেই বসবাস করছেন এবং পেশাগত কাজে জড়িত আছেন।
রাখী চক্রবর্তীর মৃত্যুতে অনেক রবীন্দ্রসংগীত বোদ্ধা ও রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমী একজন নক্ষত্রতুল্য শিল্পী হারানোর ক্ষতি অনুভব করবেন। আমি হারালাম একজন বন্ধু ও বোনকে।
No comments