চীনা পর্যটক মা হার চোখে: পনেরো শতকের মক্কা-মদিনা by সৈয়দ আশফাক হাসান
আপডেট- ২৪ আগস্ট, ২০১৯:
পৃিথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় ‘সামুদ্রিক’ অভিযানের মধ্যে চীনা পর্যটক জ্যাং
হার (মা হা) অভিযানগুলো অন্যতম। তিনি মোট সাতটি দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযান
পরিচালনা করেন, যার বিস্তৃতি ছিল চীন থেকে সুদূর আফ্রিকা মহাদেশ পর্যন্ত।
ইতিহাসের বিবরণ অনুসারে বিখ্যাত কলম্বাসের সমুদ্রযাত্রার নব্বই বছর আগে
(১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে) অ্যাডমিরাল জ্যাং হা তাঁর বিশ্বভ্রমণ শুরু করেন।
পনেরো
শতকের গোড়ার দিকে মিং সম্রাট ডাইনেস্টি ‘বিশ্বভ্রমণ’-এর লক্ষ্যে এই বিশাল
কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মিং সাম্রাজ্যের শাসকদের
প্রচারণা, ব্যবসার প্রসার ও অন্যান্য সভ্যতার জ্ঞান ও সম্পদ আহরণ করা। এই
অভিযানের নেতা নির্বাচন করা হয় অ্যাডমিরাল জ্যাং হাকে। ধর্মবিশ্বাসে তিনি
ছিলেন মুসলিম। অ্যাডমিরাল জ্যাং হা মোট সাতটি অভিযান পরিচালনা করেন।
ঐতিহাসিক সেই অভিযানে লোকবল ও জাহাজ সংখ্যার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য
পাওয়া যায় না। বলা হয়ে থাকে, ৬২টি বড় জাহাজ ও ১০০টি ছোট জাহাজের সমন্বয়ে
গড়ে তোলা হয় নৌবহরটি। আর নিরাপত্তা ও অন্যান্য সুবিধা লাভের জন্য তাঁর
বহরের সঙ্গে সংযুক্ত হয় আরো কিছু জাহাজ। সব মিলিয়ে যার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায়
তিন শ। লোকবল ছিল প্রায় ৩০ হাজার। যাদের ভেতরে ছিল সৈনিক, কারিগর, গবেষক,
চিকিৎসক, সেবক ও সাধারণ মানুষ।
অ্যাডমিরাল জ্যা হা চীন থেকে শুরু করে ইন্দো-মালয় দ্বীপপুঞ্জ, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। ৩০ বছরে তিনি সর্বমোট এক লাখ ৬০ হাজার নটিক্যাল মাইল (প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার) পথ পাড়ি দেন। ৫০টিরও বেশি বন্দরে তিনি যাত্রাবিরতি দেন। এই যাত্রায় জ্যাং হা ৪১টিরও বেশি ‘আন্তর্জাতিক নৌপথ’ আবিষ্কার করেন।
অ্যাডমিরাল জ্যাং হা কে ছিলেন?
মূল নাম ‘মা হা’ বা ‘মা সান পাও’। ১৩৭১ খ্রিস্টাব্দে চীনের হুই মুসলিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা চীনের পশ্চিমাংশ (সম্ভবত মোঙ্গল) থেকে ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে এসে বসবাস শুরু করেন। ধারণা করা হয়, তিনি ইউয়ান সাম্রাজ্যের জিয়ান ইয়াংয়ের প্রভাবশালী রাজপুত্র জায়েদুদ্দিন শাহ শামসুদ্দিনের উত্তরসূরি ছিলেন। তাঁর পরিবার ছিল ধর্মপরায়ণ। তাঁর প্রপিতা, দাদা ও বাবা সবাই ছিলেন হাজি।
মা হা ছিলেন যুবরাজ ইয়ানের একনিষ্ঠ ভক্ত, যিনি পরবর্তী সময়ে সম্রাট ইয়াংল নামেই পরিচিত হন। মা হাকেও তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং আস্থাশীল মনে করতেন। আস্থার প্রতিদান হিসেবে প্রথমে সেনানায়ক এবং পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। মা হা সেনাধিনায়ক হিসেবে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন এবং সব যুদ্ধে জয় লাভ করেন। বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য সম্রাট ইয়াংল ও তাঁর পরবর্তী আরো দুই সম্রাটের প্রিয়ভাজন ছিলেন। বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সম্রাট ইয়াংল তাঁকে ‘জ্যাং হা’ নামে ভূষিত করেন।
জ্যাং হার বিবরণে পবিত্র মক্কা নগরী
মা হুয়ানের বিবরণীতে অ্যাডমিরাল জ্যাং হার অভিযানের পথপ্রণালি ও এলাকাভিত্তিক বিবরণ পাওয়া যায়। সেই বিবরণে পবিত্র মক্কা নগরীর চিত্রও উঠে এসেছে। তিনি লেখেন, এই দেশটি হলো সেই দেশ, যেখানে ‘স্বর্গের বর্গক্ষেত্র’ বা ‘ম-খেই-খ্যা’ (চৈনিক উচ্চারণ অনুসারে) রয়েছে। কু-লি (কালিকাট, কেরালা) থেকে যদি তুমি পশ্চিম দিকে ২৪০ ডিগ্রি বরাবর যাত্রা শুরু করো, তবে তিনটি চাঁদের সময়কাল পর তাদের শহরের জেটিতে (সম্ভবত এডেন) পৌঁছানো যায়। এর বৈদেশিক নাম ‘চিহতা’। চিহতা থেকে আরো পশ্চিম-উত্তরে এক দিনের পথ পেরোলে এমন শহর পাওয়া যায়, যেখানে এদের রাজা থাকেন। এর নামই ম-খেই-খ্যার রাজধানী (সম্ভবত তিনি জেদ্দা শহর বোঝাতে চেয়েছেন)।
এরা মুসলিম ধর্মের অনুসারী। এখানেই প্রথম একজন ‘মানুষ’ আসেন, যিনি একটি মতবাদ প্রবর্তন করেন, যা এখন পর্যন্ত তাঁরা একে নিখুঁতভাবে পালন করেন। এখানকার লোকেরা বেশ সুদর্শন ও সাহসী। তাঁদের গায়ের রং গাঢ়, অনেকটা বেগুনি! (সম্ভবত রোদে বা গরমে পুড়ে যাওয়ায় চামড়ার রং অতি বাদামি দেখিয়ে থাকবে)। এরা মাথায় কাপড় বাঁধেন এবং অনেক লম্বা জামা পরেন। পায়ে চামড়ার জুতা পরেন। মহিলারা পুরো মাথা ঢেকে রাখেন। তাঁদের চেহারাও দেখা যায় না। তাঁরা আল-লা-ফি (আরবি) ভাষায় কথা বলেন। এ দেশে মদ নিষিদ্ধ। এদের পোশাক ও আচরণ সুন্দর, শান্ত ও প্রশংসনীয়। এখানে কোনো দুস্থ বা গরিব পরিবার নেই। এরা সবাই তাঁদের ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলেন আর নিয়ম ভঙ্গ করেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। সত্যি বলতে, সবচেয়ে ‘সুখী মানুষদের’ দেশ এটি। বিয়ে ও মরদেহ সৎকারে এঁরা ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ করেন।
যেমন দেখেছিলেন কাবা
এখান থেকে অর্ধদিনের বেশি যাত্রা করলে একটি ‘উন্মুক্ত’ জায়গায় পৌঁছানো যায়, যাকে এরা কাই-পাই (কাবা) বলে ডাকে। এর চারপাশ দেয়ালঘেরা। এই দেয়ালে ৪৬৬টি দরজা আছে। দরজার দুই পাশের থামগুলো সাদা জেড পাথরের। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৬৭টি খিলান রয়েছে। সামনে ৯৯টি, পেছনে ১০১টি, বাঁয়ে ১৩২টি এবং ডানে ১৩৫টি। উন্মুক্ত জায়গায় রয়েছে একটি ঘর, যা পাঁচ রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। দেখতে বর্গাকার এবং ওপরের দিক সমতল। ভেতরে পাঁচটি আড়াআড়ি স্তম্ভ রয়েছে, যা সুগন্ধিযুক্ত। আর আছে স্বর্ণ নির্মিত তাক। এর সাজসজ্জাও বেশ সুন্দর। দেয়ালগুলো কাদা দিয়ে লেপন করা। তবে তার সঙ্গে সুগন্ধি মিশ্রণ রয়েছে, যা জায়গাটিকে ঘ্রাণে আবেশিত করে রাখে।
ঘরটি শণ-রেশমের তৈরি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত। প্রতিবছর ১২তম চাঁদের দশম দিনে বিভিন্ন জায়গা (বিভিন্ন দেশ) থেকে মুসলিমরা এখানে আসেন। তাঁদের অনেককেই এক-দুই বছরের দূরের যাত্রা পথ পেরোতে হয়। অনেকেই এখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় গিলাফের কাপড়ের অংশ ‘ছিঁড়ে’ নিয়ে যায়। যখন ‘ছেঁড়া’ শেষ হয়, রাজা তখন আরেকটি নতুন গিলাফ দিয়ে তা ঢেকে দেন। এমনটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। এর বাঁ পাশে সু-মা-ই (ইসমাঈল আ.), একজন পবিত্র মানুষের কবর। কবরের দেয়াল সবুজ-পাথরের তৈরি। এটির দৈর্ঘ্য ১২ ফুট, উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট ও প্রস্থ তিন ফুট। যে দেয়াল কবর ঘিরে রেখেছে তা বেগুনি রঙের টোপাজ দ্বারা সজ্জিত।
মক্কার আবহাওয়া ও কৃষিব্যবস্থার বর্ণনা
আবহাওয়ার বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে বছরের বেশির ভাগ সময় এখানে বেশ গরম। এখানে কোনো বৃষ্টি, বজ্রপাত, বরফ বা ঠাণ্ডা নেই। রাতে যে শিশির পড়ে তা বেশ ভারী। এখানকার ফল-ফসলাদি এই শিশিরের ওপর নির্ভরশীল। যদি রাতে একটি খালি পাত্র বাইরে রাখা হয়, তবে সূর্যোদয় পর্যন্ত এতে প্রায় চার ইঞ্চি পরিমাণ পানি জমা হয়।
এখানে চাল ও শস্য খুবই অপ্রতুল। যা-ও অল্প কিছু হয় তার মধ্যে রয়েছে আকাড়া চাল, গম, কালো বাজড়া, লাউ আর কিছু সবজি। কিছু কিছু তরমুজ ও বাঙ্গি হয়। মাঝেমধ্যে একটি তরমুজ ওঠাতে দুজনের প্রয়োজন হয়। এখানে একপ্রকার গাছ হয়, দেখতে অনেকটা তুতগাছের মতো, যাতে পেঁচালো ফুল ফোটে। বছরে দুবার ফোটে। ফলের ভেতর শালগম, পার্সিয়ান খেজুর, ডালিম, আপেল আর পিচ ফল পাওয়া যায়, যার ওজন চার থেকে পাঁচ পাউন্ড পর্যন্ত হয়।
গবাদি পশুর ভেতরে উট, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, ষাঁড়, ছাগল, বিড়াল, কুকুর, হাঁস, কবুতরসহ নানা জাতের পাখির দেখা পাওয়া যায়। কিছু পাখি আর হাঁস ওজনে প্রায় ১৪-১৫ পাউন্ড বা সাত-আট কেজি হয়।
এ দেশে সুগন্ধি পানি (সম্ভবত আতর) তৈরি হয়। পশুর ভেতরে জিরাফ, সিংহ, উট পাখি, অস্ট্রিচ, লিনাক্স দেখা যায়। মূল্যবান সম্পদের মাঝে নানা রকম দামি পাথর মণি-মুক্তা, আম্বর ও কোরাল পাওয়া যায়।
মদিনায়ও গিয়েছিলেন জ্যাং হা
মদিনার বর্ণনায় লেখা হয়েছে, ‘এ শহর থেকে পশ্চিমে আরো এক দিনের পথ এগোলে যে শহর পাওয়া যায় তার নাম ম-তি-না (মদিনা)। যেখানে পবিত্র পুরুষ ‘মা-হা-মা’ (মুহাম্মদ সা.)-এর কবর রয়েছে। এখানে একটি আলোক-নির্দেশক কবরের মাথার কাছ থেকে বের হয়ে সোজা আকাশের দিকে মেঘের ভেতরে ছুটে গেছে।
অ্যাডমিরাল জ্যা হা চীন থেকে শুরু করে ইন্দো-মালয় দ্বীপপুঞ্জ, ভারত মহাসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর হয়ে আফ্রিকার পূর্ব উপকূল পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। ৩০ বছরে তিনি সর্বমোট এক লাখ ৬০ হাজার নটিক্যাল মাইল (প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার) পথ পাড়ি দেন। ৫০টিরও বেশি বন্দরে তিনি যাত্রাবিরতি দেন। এই যাত্রায় জ্যাং হা ৪১টিরও বেশি ‘আন্তর্জাতিক নৌপথ’ আবিষ্কার করেন।
অ্যাডমিরাল জ্যাং হা কে ছিলেন?
মূল নাম ‘মা হা’ বা ‘মা সান পাও’। ১৩৭১ খ্রিস্টাব্দে চীনের হুই মুসলিম বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা চীনের পশ্চিমাংশ (সম্ভবত মোঙ্গল) থেকে ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে এসে বসবাস শুরু করেন। ধারণা করা হয়, তিনি ইউয়ান সাম্রাজ্যের জিয়ান ইয়াংয়ের প্রভাবশালী রাজপুত্র জায়েদুদ্দিন শাহ শামসুদ্দিনের উত্তরসূরি ছিলেন। তাঁর পরিবার ছিল ধর্মপরায়ণ। তাঁর প্রপিতা, দাদা ও বাবা সবাই ছিলেন হাজি।
মা হা ছিলেন যুবরাজ ইয়ানের একনিষ্ঠ ভক্ত, যিনি পরবর্তী সময়ে সম্রাট ইয়াংল নামেই পরিচিত হন। মা হাকেও তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং আস্থাশীল মনে করতেন। আস্থার প্রতিদান হিসেবে প্রথমে সেনানায়ক এবং পরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। মা হা সেনাধিনায়ক হিসেবে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন এবং সব যুদ্ধে জয় লাভ করেন। বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য সম্রাট ইয়াংল ও তাঁর পরবর্তী আরো দুই সম্রাটের প্রিয়ভাজন ছিলেন। বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সম্রাট ইয়াংল তাঁকে ‘জ্যাং হা’ নামে ভূষিত করেন।
জ্যাং হার বিবরণে পবিত্র মক্কা নগরী
মা হুয়ানের বিবরণীতে অ্যাডমিরাল জ্যাং হার অভিযানের পথপ্রণালি ও এলাকাভিত্তিক বিবরণ পাওয়া যায়। সেই বিবরণে পবিত্র মক্কা নগরীর চিত্রও উঠে এসেছে। তিনি লেখেন, এই দেশটি হলো সেই দেশ, যেখানে ‘স্বর্গের বর্গক্ষেত্র’ বা ‘ম-খেই-খ্যা’ (চৈনিক উচ্চারণ অনুসারে) রয়েছে। কু-লি (কালিকাট, কেরালা) থেকে যদি তুমি পশ্চিম দিকে ২৪০ ডিগ্রি বরাবর যাত্রা শুরু করো, তবে তিনটি চাঁদের সময়কাল পর তাদের শহরের জেটিতে (সম্ভবত এডেন) পৌঁছানো যায়। এর বৈদেশিক নাম ‘চিহতা’। চিহতা থেকে আরো পশ্চিম-উত্তরে এক দিনের পথ পেরোলে এমন শহর পাওয়া যায়, যেখানে এদের রাজা থাকেন। এর নামই ম-খেই-খ্যার রাজধানী (সম্ভবত তিনি জেদ্দা শহর বোঝাতে চেয়েছেন)।
এরা মুসলিম ধর্মের অনুসারী। এখানেই প্রথম একজন ‘মানুষ’ আসেন, যিনি একটি মতবাদ প্রবর্তন করেন, যা এখন পর্যন্ত তাঁরা একে নিখুঁতভাবে পালন করেন। এখানকার লোকেরা বেশ সুদর্শন ও সাহসী। তাঁদের গায়ের রং গাঢ়, অনেকটা বেগুনি! (সম্ভবত রোদে বা গরমে পুড়ে যাওয়ায় চামড়ার রং অতি বাদামি দেখিয়ে থাকবে)। এরা মাথায় কাপড় বাঁধেন এবং অনেক লম্বা জামা পরেন। পায়ে চামড়ার জুতা পরেন। মহিলারা পুরো মাথা ঢেকে রাখেন। তাঁদের চেহারাও দেখা যায় না। তাঁরা আল-লা-ফি (আরবি) ভাষায় কথা বলেন। এ দেশে মদ নিষিদ্ধ। এদের পোশাক ও আচরণ সুন্দর, শান্ত ও প্রশংসনীয়। এখানে কোনো দুস্থ বা গরিব পরিবার নেই। এরা সবাই তাঁদের ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলেন আর নিয়ম ভঙ্গ করেন এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম। সত্যি বলতে, সবচেয়ে ‘সুখী মানুষদের’ দেশ এটি। বিয়ে ও মরদেহ সৎকারে এঁরা ধর্মীয় প্রথা অনুসরণ করেন।
যেমন দেখেছিলেন কাবা
এখান থেকে অর্ধদিনের বেশি যাত্রা করলে একটি ‘উন্মুক্ত’ জায়গায় পৌঁছানো যায়, যাকে এরা কাই-পাই (কাবা) বলে ডাকে। এর চারপাশ দেয়ালঘেরা। এই দেয়ালে ৪৬৬টি দরজা আছে। দরজার দুই পাশের থামগুলো সাদা জেড পাথরের। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৬৭টি খিলান রয়েছে। সামনে ৯৯টি, পেছনে ১০১টি, বাঁয়ে ১৩২টি এবং ডানে ১৩৫টি। উন্মুক্ত জায়গায় রয়েছে একটি ঘর, যা পাঁচ রঙের পাথর দিয়ে তৈরি। দেখতে বর্গাকার এবং ওপরের দিক সমতল। ভেতরে পাঁচটি আড়াআড়ি স্তম্ভ রয়েছে, যা সুগন্ধিযুক্ত। আর আছে স্বর্ণ নির্মিত তাক। এর সাজসজ্জাও বেশ সুন্দর। দেয়ালগুলো কাদা দিয়ে লেপন করা। তবে তার সঙ্গে সুগন্ধি মিশ্রণ রয়েছে, যা জায়গাটিকে ঘ্রাণে আবেশিত করে রাখে।
ঘরটি শণ-রেশমের তৈরি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত। প্রতিবছর ১২তম চাঁদের দশম দিনে বিভিন্ন জায়গা (বিভিন্ন দেশ) থেকে মুসলিমরা এখানে আসেন। তাঁদের অনেককেই এক-দুই বছরের দূরের যাত্রা পথ পেরোতে হয়। অনেকেই এখান থেকে ফিরে যাওয়ার সময় গিলাফের কাপড়ের অংশ ‘ছিঁড়ে’ নিয়ে যায়। যখন ‘ছেঁড়া’ শেষ হয়, রাজা তখন আরেকটি নতুন গিলাফ দিয়ে তা ঢেকে দেন। এমনটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। এর বাঁ পাশে সু-মা-ই (ইসমাঈল আ.), একজন পবিত্র মানুষের কবর। কবরের দেয়াল সবুজ-পাথরের তৈরি। এটির দৈর্ঘ্য ১২ ফুট, উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট ও প্রস্থ তিন ফুট। যে দেয়াল কবর ঘিরে রেখেছে তা বেগুনি রঙের টোপাজ দ্বারা সজ্জিত।
মক্কার আবহাওয়া ও কৃষিব্যবস্থার বর্ণনা
আবহাওয়ার বর্ণনা এভাবে দিয়েছেন যে বছরের বেশির ভাগ সময় এখানে বেশ গরম। এখানে কোনো বৃষ্টি, বজ্রপাত, বরফ বা ঠাণ্ডা নেই। রাতে যে শিশির পড়ে তা বেশ ভারী। এখানকার ফল-ফসলাদি এই শিশিরের ওপর নির্ভরশীল। যদি রাতে একটি খালি পাত্র বাইরে রাখা হয়, তবে সূর্যোদয় পর্যন্ত এতে প্রায় চার ইঞ্চি পরিমাণ পানি জমা হয়।
এখানে চাল ও শস্য খুবই অপ্রতুল। যা-ও অল্প কিছু হয় তার মধ্যে রয়েছে আকাড়া চাল, গম, কালো বাজড়া, লাউ আর কিছু সবজি। কিছু কিছু তরমুজ ও বাঙ্গি হয়। মাঝেমধ্যে একটি তরমুজ ওঠাতে দুজনের প্রয়োজন হয়। এখানে একপ্রকার গাছ হয়, দেখতে অনেকটা তুতগাছের মতো, যাতে পেঁচালো ফুল ফোটে। বছরে দুবার ফোটে। ফলের ভেতর শালগম, পার্সিয়ান খেজুর, ডালিম, আপেল আর পিচ ফল পাওয়া যায়, যার ওজন চার থেকে পাঁচ পাউন্ড পর্যন্ত হয়।
গবাদি পশুর ভেতরে উট, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, ষাঁড়, ছাগল, বিড়াল, কুকুর, হাঁস, কবুতরসহ নানা জাতের পাখির দেখা পাওয়া যায়। কিছু পাখি আর হাঁস ওজনে প্রায় ১৪-১৫ পাউন্ড বা সাত-আট কেজি হয়।
এ দেশে সুগন্ধি পানি (সম্ভবত আতর) তৈরি হয়। পশুর ভেতরে জিরাফ, সিংহ, উট পাখি, অস্ট্রিচ, লিনাক্স দেখা যায়। মূল্যবান সম্পদের মাঝে নানা রকম দামি পাথর মণি-মুক্তা, আম্বর ও কোরাল পাওয়া যায়।
মদিনায়ও গিয়েছিলেন জ্যাং হা
মদিনার বর্ণনায় লেখা হয়েছে, ‘এ শহর থেকে পশ্চিমে আরো এক দিনের পথ এগোলে যে শহর পাওয়া যায় তার নাম ম-তি-না (মদিনা)। যেখানে পবিত্র পুরুষ ‘মা-হা-মা’ (মুহাম্মদ সা.)-এর কবর রয়েছে। এখানে একটি আলোক-নির্দেশক কবরের মাথার কাছ থেকে বের হয়ে সোজা আকাশের দিকে মেঘের ভেতরে ছুটে গেছে।
No comments