প্রবাসে ওরা টাকার মেশিন ১ ॥ অর্থনীতি শক্ত করে, আয় বাড়ে পরিবারের তবু কদর নেই- বিরামহীন শ্রম ও শত প্রতিকূলতার বিনিময়ে আসে রেমিটেন্স by শাহ্ আলম খান
বিদেশের মাটিতে বিরামহীন পরিশ্রম, অফুরন্ত ঘাম আর শত প্রতিকূলতায় হৃদয়ে জমাট রক্তক্ষরণের এক শিহরিত নাম হচ্ছে রেমিটেন্স। কেউ একে বলেন বৈদেশিক মুদ্রা, কেউ বা প্রবাসী আয়।
প্রতিদিন, প্রতিমাস ও প্রতিবছর এভাবে গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এর সুফল ভোগ করছেন এ দেশের লাখ লাখ পরিবার তথা জাতি ও অর্থনীতি। আর এই সুফল সরবরাহে নেপথ্য কারিগরের কাজ করছেন এ দেশের প্রায় কোটি যুবা। প্রবাসে এরা শ্রমশক্তি বিক্রি করেন। এতে যা মজুরি পান তাতে সর্বোচ্চ কৃচ্ছ্রের চেষ্টা করেন। এভাবে তিলে তিলে সঞ্চয় করেন বৈদেশিক মুদ্রা। এক সময় ব্যাংকিং চ্যানেলে অথবা ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থায় রেমিটেন্স হিসেবে পাঠান এ দেশে। বিদেশের মাটিতে ওদের ঘাম ঝরানো এ শ্রমের বিনিময়ে এ দেশের অধিকাংশ পরিবারের ভরণ-পোষণ চলে। পরনে নতুন কাপড় ওঠে। বোনের বিয়ে হয়। স্বজনের ভাল ব্যবসা হয়। হুন্ডিওয়ালার পকেট ভরে। ব্যাংকের মুনাফা হয়। সরকারের রাজস্ব বাড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক বড় হয়। এ সবের ফলে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি ঘটে। অর্থনীতির প্রাচীর মজবুত হয়। সর্বোপরি ক্ষমতাসীনদের সাফল্যের পাল্লা ভারি হয়।এ কারিগরদের প্রথম প্রবাসে গমনের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তীতে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিতে অনন্যোপায় হয়ে শুধু পারিবারিক সচ্ছলতার জন্যই কেউ কেউ বিছিন্নভাবে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে শুরু করেন। তবে সরকারীভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ প্রথম শ্রমশক্তি রফতানি শুরু করে মূলত ১৯৭৬ সাল থেকে। ওই সময় দেশ থেকে প্রথমে পুরুষ শ্রমিক রফতানি শুরু হয়। আর ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো মহিলা শ্রমিকও রফতানি শুরু হয়। এভাবে এক, দুই, তিন করে বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৫৭টি দেশে এ সংখ্যা এখন পুরুষ-মহিলা মিলে বেসরকারী হিসাবে প্রায় কোটিতে পা রেখেছে।
যদিও সরকারী বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের দেয়া বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ সংখ্যা ৭৫ লাখ থেকে ৯০ লাখের মধ্যে শোনা গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্যমতে, সার্বিকভাবে দেশের শতকরা ৫ ভাগ লোক বিদেশে কাজ করছেন। এ হিসাবে দেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি বিবেচনায় নিলে ৭৫ লাখ জনশক্তি প্রবাসে কাজ করছে। আর জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। কিন্তু অনুমোদনহীন অবস্থান করা শ্রমিকদের ধরলে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেও সংস্থাটির অভিমত।
শুধু গত চার বছরেই (২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাগাদ) বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৬১৫ শ্রমিক পাঠিয়েছে এবং এ সময় প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বলে জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান। তিনি জানান, বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য মালয়েশিয়ার বাজার বন্ধ থাকা সত্ত্বেও গত বছর ৬ লাখ ৯ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক বিদেশে গেছে।
তবে সংখ্যায় এরা যাই হোক, পরিবার-পরিজন থেকে সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার এবং বোদ্ধা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন ‘ওরা (জনশক্তি) আমাদের টাকার মেশিন।’ অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করার কারিগর।
ওদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে খানার (পরিবার) সংখ্যা ৩৩ লাখ। গড় সদস্য সংখ্যা ৪.৪ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, এই হিসাবে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ পরিবারেরই (প্রায় ২৫ লাখ) কোন না কোন সদস্য প্রবাসে শ্রম বিক্রি করছেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিস) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশের যত লোক কাজ করছে এর মধ্যে বাংলাদেশী পুরুষ কর্মী ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর নারী কর্মী রয়েছেন ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
দেশের শ্রমশক্তি সরবরাহ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, বর্তমানে দেশে প্রতিবছর ১৮ লাখ নতুন শ্রমশক্তি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ লাখ যাচ্ছেন দেশের বাইরে। তিনি আশা প্রকাশ করে আরও বলেন, আগামী ৫ বছরে এ সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত হবে এবং প্রবাসীদের পাঠানো আয়ও দ্বিগুণ হবে।
সম্প্রতি প্রবাসে জনশক্তির স্ফীতি প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিগত জোট সরকারের সময় ৭৫টি দেশে প্রতিবছর দুই থেকে আড়াই লাখ মানুষ যেত। বতর্মানে ১৫৭টি দেশে প্রতিবছর ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ যাচ্ছে।
এসব পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে সহজেই অনুমান করা যায়, দেশের অধিকাংশ পরিবারেরই আয়ের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয় অর্থাৎ রেমিট্যান্স।
তবে বিশ্বের বিভিন্ন শ্রমবাজার থেকে এ স্বর্ণোজ্জ্বল রেমিট্যান্স কুড়িয়ে আনার নেপথ্য নায়কদের তিক্ততাও কম নয়। প্রবাস জীবন কাটিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে ফেরত এসেছেন এমন কয়েকজন টাকার মেশিনওয়ালার সঙ্গে এ ব্যাপারে ঘনিষ্ঠ আলোচনায় তাদের প্রবাসে শ্রমশক্তি বিক্রির তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। পাবনার সাঁথিয়ার বছির মোল্লা, কুমিল্লা সদরের উজ্জ্বল, দাউদকান্দির চাষারচরের ইসমাইল, গজারিয়ার খলিলুল্লাহ ও জসিমউদ্দিন, চাঁদপুর শাহরাস্তির ফয়সালসহ অনেকেরই দেয়া বর্ণনা ছিল খুবই হৃদয়বিদারক। তাঁদের বক্তব্যে বিদেশের ওই কাজের ক্ষেত্রগুলোতেও কমপ্লায়েন্সের চরম দীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। তাঁরা জানান, ‘বিদেশের মাটিতে পা ফেলেই এ দেশের লাখ লাখ যুবা কঠোর থেকে কঠোরতম কাজের শিকলে আটকা পড়েন। কাঁকডাকা ভোর থেকেই তাদের কর্মস্থলে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হয়। নির্ধারিত সময়েই কাজে যোগদান, বিরামহীন রুটিন ওয়ার্ক, তারপর ওভারটাইম, তবু ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, আবার পান থেকে চুন খসলেই জরিমানা, কাক্সিক্ষত ছুটিও অপ্রত্যাশিতভাবে বিনা নোটিসে বাতিল হওয়া, প্রতিবাদ জানালেই দেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি এসবই বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিত্যনিয়তি।
তবে বিদেশের মাটিতে আমাদের জনশক্তির অদম্য দৃঢ়তার কথাও অবলীলায় প্রকাশ করেন প্রবাস ফেরত এ বাংলাদেশীরা। তাঁরা বলেন, ‘তবু থেমে থাকে না এ অদম্য যুবাদের পথচলা। বিদেশে পাড়ি জমানোর খরচ ওঠাতে ও পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করে চলেন দিনের পর দিন। শুধু তাই নয়, দেশে বেশি টাকা পাঠাতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও অনেকের না নেই।’
অথচ সপ্তাহান্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে ফোলানো-ফাঁপানো রেমিট্যান্স ফিগার দেখে সরকার, আমলা, ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। সভা-সেমিনারে আলোচনার বিষয়বস্তু হয় এ রেমিট্যান্স। কিন্তু কেউ গভীরভাবে ভেবে দেখেন না এ বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স অর্জনের ক্ষেত্রে নেপথ্য কারিগরদের শেকলে বাঁধা তিক্ততার জীবন প্রবাহের কথা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খোদ সরকারেরই শীর্ষপর্যায়ের এক মন্ত্রী সরল স্বীকারোক্তি প্রকাশ করে বলেন, এ কথা সত্য রেমিট্যান্সের নেপথ্য কারিগররা প্রবাসে কিভাবে থাকেন, কী পরিবেশে কাজ করেন তা আমরা এ দেশে যারা থাকি তারা জানিই না। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারি, প্রতিবছর এঁরা কত বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিচ্ছেন। আর যখনই এঁরা প্রবাস থেকে নিঃস্ব হয়ে কিংবা লাশ হয়ে দেশে ফিরে আসছেন, তখন এঁরা খবরের কাগজেও শিরোনাম হচ্ছেন।
তিনি মত প্রকাশ করে বলেন, এঁরা বিদেশে অনিশ্চিত পরিবেশে কাজ করছেন, সেই দেশের উন্নয়নে অংশীদার হচ্ছেন। এর বিনিময়ে এ দেশের রেমিট্যান্স সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু সেই অর্থে এ রাষ্ট্র ও সরকার কিংবা বেসরকারী খাত কোন মহল থেকেই এঁদের কল্যাণের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে না। সঙ্গতকারণেই সময় এসেছে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার।
তবে তিনি এ ব্যাপারে তাঁর সরকারের (বর্তমান) কৃতিত্বের কথাও দাবি করে বলেন, চাহিদার তুলনায় উদ্যোগ এখনও সীমিত হলেও অতীতের যে কোন সরকারের তুলনায় এ খাতে ভাল কাজের অবদান বর্তমান সরকারেরই সবচেয়ে বেশি। দেশের মানুষও এটি বিশ্বাস করে। এর সুফলও কিন্তু মানুষ পাচ্ছে।
আর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও রেমিট্যান্স বিশ্লেষক ড. আবুল বারকাত আগামী দিনে দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের গুরুত্ব উপলব্ধি করে খাতটির কল্যাণে করণীয় সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেন। তিনি জানান, দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণে সেবার মান অনেকাংশেই বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তবে তিনি এটিও মনে করেন না সরকার এককভাবে এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারী খাত ও উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে তাদের অধিক মুনাফার লোভ সামলে রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে উদ্যোগী ভূমিকা রাখতে হবে। সুশীল সমাজকেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।
No comments