চিন্তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব
এই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। কারণ একমাত্র মানুষই চিন্তনের অধিকারী। আহার, নিদ্রা ইত্যাদি জৈবিক দিকগুলোর ক্ষেত্রে মানুষ আর পশুতে কোন ভেদ নেই। কিন্তু মানুষ শুধু চিন্তাশক্তির বলেই অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।
আবার কেবলমাত্র চিন্তনের অধিকারীই নয়, সেই চিন্তাশক্তির প্রতিফলনও ঘটাতে পারে মানুষ। তাইতো মানুষের চেয়ে শক্তিমান বলশালী বাঘ, হাতি, সিংহকেও মানুষ খাঁচায় পুরতে পারে। মানুষ আজ যাচ্ছে ভিন্ন গ্রহে, নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে, আবার কাব্য-কাহিনীতে কতই না তার প্রতিফলন। মানুষের প্রতিটি কর্মের সাথেই তার চিন্তার প্রতিফলন প্রকাশ পায়।এখন দেখা যাক এই চিন্তা কত প্রকার। মানুষ সফল চিন্তা এবং ব্যর্থ চিন্তা দুটোই করে থাকে। আবার যে কোন বিষয়ের ওপর ইতিবাচক চিন্তা (পজিটিভ চিন্তা) নেতিবাচক চিন্তা (নেগেটিভ চিন্তা) দুটোই করে থাকে।
অপরদিকে ব্যথ্য চিন্তা বা নেতিবাচক চিন্তা মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়, মানুষের মনুষ্যত্ব কিংবা তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। তাই অস্তিত্বকে বাঁচাবার জন্য তার শ্রেষ্ঠ চিন্তা বা ইতিবাচক চিন্তা করা খুবই প্রয়োজন।
দেখা যায় মানুষের চিন্তার বেশিরভাগই ব্যর্থ চিন্তা। সারাদিন মানুষ অনেক চিন্তা করে। এমনকি মানুষ যখন সম্পূর্ণ কর্মহীনভাবে বিশ্রাম করে তখনও কিন্তু মানুষের মন ক্রিয়া করে তাকে। অর্থাৎ মানুষের মন কিছু না কিছু চিন্তা করেই থাকে। দেখা যাচ্ছে কার্যকর চিন্তা মাত্র বিশ শতাংশ। আর এই ব্যর্থ চিন্তা বা নেগেটিভ চিন্তা মানুষের পক্ষে কতখানি ক্ষতিকারক তা আলোচনা করলেই বোঝা যাবে। দেখা গেছে, অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি যথা থাইরয়েড, পিটিউটরি এড্রিনল ইত্যাদি গ্রন্থির ক্ষতিসাধন হয় ব্যর্থ বা নেতিবাচক চিন্তার জন্য। এই অন্তঃস্রাব গ্রন্থি শরীরের জৈব রাসায়নিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে এবং শারীরিক বিকাশ ও কোষের বিভিন্ন সিক্রিয়েশন করতে সাহায্য করে। হাইপোথালমস মস্তিষ্কের মুখ্য অংশ যা মানুষকে মানসিক স্থিতির ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। যখন ব্যর্থ চিন্তা বা নেগেটিভ চিন্তা করা হয় তখন হাইপোথালমসের ওপর সোজাসুজি প্রভাব বিস্তার হয়। এই হাইপোথালমস সমগ্র অন্তঃস্রাবী গ্রন্থির সঞ্চালক। বিশেষ করে পিটুইটারি গ্রন্থির অন্তঃস্রাব কম বা বেশি নিয়ন্ত্রিত হয় হাইপোথামস দ্বারা। অন্তঃস্রাবের উত্থান-পতনের (কম বেশি) কারণে পেপটিক আলসার, সংক্রামক রোগ ব্লাড প্রেসার এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এছাড়াও দেখা গেছে, কোন সমস্যা বা কোন মানুষের প্রতি নেতিবাচক চিন্তা থাকলে ওই অনর্থক চিন্তার ফলে
০ মানুষের শক্তিক্ষয় হয়। অজস্র চিন্তারাশি তার মস্তিষ্কে ক্রিয়া করতে করতে অবশেষে অবসাদ বোধ হতে থাকে এবং এই অবসাদ দূর করার জন্য নেশায় আসক্ত হতে হয়।
০ ক্রোধের সৃষ্টি হয়। আর ক্রোধ এমনই জিনিস যা মানুষকে ধ্বংসের কাজে লিপ্ত করতে পারে।
০ মনে শান্তির ধীরে ধীরে দেহের ওপর ক্রিয়া করে, ফলে তখনই সৃষ্টি হয় বিভিন্ন রোগ।
০ নেতিবাচক চিন্তা মানুষের শ্রেষ্ঠ চিন্তাকে বিনষ্ট করে, সাথে সাথে দেহের ওপর এর প্রভাব প্রতিফলিত হয়।
০ ব্যর্থ চিন্তা মানুষের যে কোন বিকাশের পথ বন্ধ করে দেয়। ফলে উৎসাহ ও আগ্রহ কমে যায়। হতোদ্যমে নিরুৎসাহ ব্যক্তি জীবনে চলার পথে বার বার পিছিয়ে পড়ে।
০ ব্যর্থচিন্তা বা নেতিবাচক চিন্তার ফলে কোন ভাল কাজ করা বা কোন সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ব্যর্থতাকেই জীবনের সম্বল করে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে থাকে মাত্র।
০ মন সবসময়েই সন্দেহে ভারাক্রান্ত থাকে। ফলত মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণা ইত্যাদিতে জর্জরিত হয়ে থাকে। ফলে অকাল বার্ধক্যের শিকার হতে হয়।
অপরদিকে শ্রেষ্ঠ চিন্তা বা ইতিবাচক চিন্তা মানুষকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তা আলোচনা করলেই জানা যাবে।
০ ইতিবাচক চিন্তা বা শ্রেষ্ঠ চিন্তার ফলে মানুষের মনে দৃঢ় সঙ্কল্প আসে। যার দৃঢ়তা আছে তার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।
০ রাগ, দ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা ইত্যাদি যখন উৎপন্ন হয় তখন চিন্তা বা ইতিবাচক চিন্তা ওই প্রতিক্রিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
০ শ্রেষ্ঠ চিন্তা মানুষের মনকে শান্ত রাখে। অশান্তির বাতাবরণ তাকে কাবু করতে পারে না।
০ যে কোন সমস্যার সমাধানে চিন্তা করার শক্তি আসে এবং সেই শক্তির দ্বারা সফলতাও প্রাপ্ত হয়।
০ নিজেকে নিজে সাহায্য করা যায়, উন্নত জীবন পাবার লক্ষ্যে।
০ শুভ চিন্তার ফলে যেকোন কাজে উৎসাহ আসে।
০ বুদ্ধি-বৃত্তির বিকাশ ঘটে, উন্নতির সোপান দেখা যায়। শ্রেষ্ঠ চিন্তা বা ইতিবাচক চিন্তা মানুষকে বহুভাবে সাহায্য করে। যারা সুচিন্তক বা শ্রেষ্ঠ চিন্তার অধিকারী তারা অবশ্যই জানেন, সুচিন্তা সর্বদা সন্তুষ্ট ও আনন্দে থাকার ক্ষেত্রে, সমাজের ক্ষেত্রে একজন অনন্য বন্ধুরূপে সাথীরূপে পান।
উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা ইত্যাদি আকর্ষণ করতে পারে না, ফলে চেহারায়, শরীরে এক ইনারবিউটি ফুটে ওঠে যা সৌম্য শান্ত ভাব এনে দেয়।
দু’একটি উদাহরণ দেয়া যাক, যাতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ব্যাপারটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। যে ছেলেটি কোন কিছুতে ব্যর্থ হবার পর সেটা পড়াশোনা বা খেলাধুলা যাই হোক না কেন তাকে যদি বলা হয় তোমার দ্বারা হবে না, তুমি অকর্মণ্য ইত্যাদি, তাহলে ছেলেটি নিরুৎসাহী হয়ে যায়। ফলে হয় আর এগুতে পারে না বা সে কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। আবার যদি বলা হয়, চেষ্টা কর অবশ্যই পারবে, তোমার দ্বারা হবেই হবে ইত্যাদি তাহলে ওই ছেলের ভিতরে এগিয়ে যাওয়ার বা কৃতকার্য হবার দৃঢ়তা আসে, মানসিক জোর পায়। ফলে অন্তত নব্বইভাগই জয়ী হয়। সুতরাং ইতিবাচক চিন্তা বা শ্রেষ্ঠ চিন্তা মানুষের জীবনকে সবদিক থেকে উপকৃত করে। রাজযোগ এডুকেশন এ্যান্ড রিসার্চ ফাউন্ডেশন দীর্ঘ গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনুধাবন করতে পেরেছে যে, নেতিবাচক চিন্তা ও ব্যর্থচিন্তা থেকে যে ক্রোধ, ঈর্ষা, ভয়, শঙ্কা ইত্যাদি সৃষ্টি হয়, এতে মুখের চেহারা যেমন পাল্টে যায় ঠিক তেমনি মস্তিষ্কের বিভিন্ন ধমনিতে রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং কখনও কখনও এই ধমনি ছিঁড়ে গিয়ে মস্তিষ্কের কোষে আঘাত হানে। ফলে বিভিন্ন মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় মানুষ। মানুষের ভাবাবেগ বা পাগলাটে ভাবের কারণে ও মস্তিষ্ক প্রদাহ থেকে এটি সৃষ্টি হয়। যা হোক, ইতিবাচক চিন্তা বা শ্রেষ্ঠ বা শুভ চিন্তার ভাল ফল অবশ্যই পাওয়া যায়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু কিভাবে এই ইতিবাচক চিন্তা বা শ্রেষ্ঠ করা যায় বা নেতিবাচক চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায় তার জন্য এক সরল ও সাধাসিধে ব্যবস্থার প্রয়োগ শেখানো হয় রাজযোগ পদ্ধতিতে। আমরা আউটার বিউটিফিকেশনের জন্য অনেক কিছু করি, কিন্তু ইনারবিউটির সাথে সাথে সুস্থ জীবনধারার জন্য কিছু করা অবশ্যই দরকার। সেই ক্ষেত্রে দেশে বিদেশে যোগাসন ও ধ্যান অভ্যাস করানো হচ্ছে, এমনকি বিভিন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেও। সারা বিশ্বে কয়েক হাজার শাখার মাধ্যমে রাজযোগ এডুকেশন সেন্টার বিভিন্ন নামে মানুষের মনকে উন্নত অর্থাৎ শান্ত, নেতিবাচক চিন্তা মুক্তি, ইতিবাচক চিন্তা সম্পন্ন শুভ ভাবনা ও শ্রেষ্ঠ সঙ্কল্পের জন্য প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে যার দ্বারা হাজার হাজার বিভিন্ন বয়সের মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
No comments