রঙ্গব্যঙ্গ-ফরমালিন by মোস্তফা কামাল
আবদুল হকের স্ত্রী মর্জিনা বিবি ভ্রু কুঁচকে বললেন, তোমাকে না বলেছি, বাজার থেকে এসব ফলটল আর এনো না। জেনেশুনে বাচ্চাদের আর কত বিষ খাওয়াবে! এমনিতেই ভেজাল খাওয়াতে খাওয়াতে নানা রোগব্যাধিতে আমরা অস্থির। তার ওপর আবার ফরমালিন খাইয়ে ওদের শরীরটাকে একেবারে বিষাক্ত করে দেব! তুমি পত্রিকায় দেখনি,
গ্যাস্ট্রিক, কিডনি সমস্যাসহ নানা রোগের অন্যতম কারণ ভেজাল খাদ্য! তার পরও তুমি কেন কিনছ?
আবদুল হক বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, আমি তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
মর্জিনা বিবি গলা চড়িয়ে বললেন, ও! এখনো বুঝতে পারনি? এই দেখ তোমার ফলের কাণ্ড!
'ফলের কাণ্ড! ফল আবার কী দোষ করল!'
'আরে আগে কথা তো শেষ করি! তারপর বল। তুমি ফল কিনেছ কবে মনে আছে?'
'সাত আট দিন তো হবেই।'
'হুম, ঠিক আট দিন আগে।'
'এই দেখ, তোমার সেই পাকা কলা একটুও পচেনি। এই আপেলটা দেখ, দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র গাছ থেকে পেড়ে আনা হয়েছে। কি, তোমার তা মনে হচ্ছে না?'
আবদুল হক ইতিবাচক মাথা নেড়ে বললেন, হুম। কিন্তু লোকটা তো বলল, তার ফল ফরমালিনমুক্ত। সে জন্যই তো কিনেছি! তা না হলে কে কিনত?
'আরে! লোকটা বলল, আর তুমি বিশ্বাস করলে! না, তোমার মতো সরলসোজা মানুষ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এই যুগে তুমি বেমানান। ওই দিনও তুমি মাছ কিনে এনে বললে, এই নাও, এক্কেবারে ফরমালিনমুক্ত তাজা মাছ। নদী থেকে ধরে এনে তোমার কাছে বিক্রি করেছে। তারপর কী ঘটেছে জানো!'
'কী ঘটেছে?'
'তুমি তো মাছ কিনে রেখে চলে গেলে অফিসে। আমি মাছটা যে ফ্রিজে রাখব, সে কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। তারপর বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেলাম গানের স্কুলে। সেখান থেকে বাসায় না এসে বাপের বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসায় আসার পর রান্না ঘরে এসে দেখি মাছগুলো পড়ে আছে। আমি তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলাম! এত টাকার মাছ! কী হবে! ব্যাগ খুলে দেখলাম, মাছ ঠিক আছে। একটুও পচেনি। এবার বোঝ! ফরমালিন দেওয়া না হলে এই মাছ ভালো থাকত!'
মর্জিনা বিবির কথা শুনে আবদুল হকের চোখ দুটো যেন কপালে উঠে গেল। তিনি কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। মাছ বিক্রেতা তাঁকে কছম কেটে বলল, নদী থেকে সে নিজে মাছ ধরে এনেছে। অথচ সেই মাছেও ফরমালিন! সেই সকালে মাছ কিনেছি। রাত পর্যন্ত সেই মাছের কিচ্ছু হয়নি! এই বিষ খেয়ে খেয়ে তো পুরো শরীরই বিষাক্ত হয়ে যাবে! তিনি স্ত্রীকে বললেন, মর্জিনা বিবি, কাল থেকে মাছ খাওয়া বন্ধ।
'তাহলে খাবে কী?'
'সবজি খাব, সবজি! বুঝতে পারছ?'
'সবজি! তুমি কি জানো, শাকসবজি-তরিতরকারিতেও ফরমালিন দেয়?'
'তাহলে শাকসবজিও বাদ! মাংস-ডিম খাব।'
'প্রতিদিন কি আর মাংস-ডিম খাওয়া যায়! তা ছাড়া যে দাম! তুমি কুলাতে পারবে? দশ-পনেরো দিনেই বাজার খরচের টাকা শেষ হয়ে যাবে! তখন কী হবে!'
'তাহলে কী করব বলো! আর ভালো লাগছে না। আচ্ছা শোন, দুপুরের জন্য কী রান্না করেছ?'
'মাছ আর ডাল।'
'ওই ফরমালিনযুক্ত মাছ?'
'এ ছাড়া উপায় কী? এত টাকার মাছ! ফেলে দেব?'
'আমি ভাত খাব না।'
'তাহলে খাবে কী?'
'আমাকে এক বাটি দুধ দাও। দুধ দিয়ে মুড়ি খাই।'
'ওতেও তো ভেজাল!'
'তাহলে আর কী করব, না খেয়ে থাকব!'
'না খেয়ে কয় দিন! এক দিন, দুই দিন... তারপর?'
আবদুল হক মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তিনি কী করবেন কিছুই ভেবে পান না। তিনি মনে মনে ভাবেন, এসব বিষ খেয়ে খেয়ে আমরা না হয় কোনোমতে জীবন পার করলাম! বাচ্চাদের কী হবে! তারা কী করে বাঁচবে!
২.
ফরমালিনবিষয়ক একটি গল্প বলা যেতে পারে। গল্পটি এ রকম। নজরুল আর বিপুল দুই ভাই। ওরা বিকেলে বল নিয়ে মাঠে খেলতে যায়। খিলক্ষেত স্কুল মাঠে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। দুই ভাই দুই দিকে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের দিকে বল ছুড়ছে। ওদের খেলা দেখে আরো কিছু ছেলেপেলে সেখানে এসে জড়ো হলো। তাদের কেউ কেউ খেলায় যোগ দিল। খেলা দেখতে আরো কিছু লোক সেখানে এলো। বাংলাদেশে তো আর লোকের অভাব নেই! এত এত লোকের কাজ কোথায়? নাই কাজ তো খই ভাজ!
হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা সাপ মাঠের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কোনো সাপুড়ে হয়তো তাড়া করছিল সাপটাকে। সাপটাকে দেখে ছেলেপেলেরা ভয়ে দৌড়াতে লাগল। দৌড়াদৌড়ির একপর্যায়ে সাপটি নজরুলের পায়ের নিচে পড়ল। আর অমনি সাপটি তার পায়ে কামড় বসিয়ে দিল। তার পরই ঘটল এক মহাকাণ্ড!
সাপের কামড় খেয়ে ভয়ে নজরুল চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার কান্না থেমে গেল। সে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সাপটার দিকে তাকিয়ে রইল। সাপটা কেবল ছটফট করছে। ঘটনা কী! অসংখ্য লোক সাপটার ছটফটানি দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সাপটাকে দেখছে। ছটফট করতে করতে একসময় সাপটা মারা যায়।
এই দৃশ্য দেখে লোকজন বলাবলি শুরু করল, সাপের কামড়ে তো মানুষ মারা যায়! এত দেখছি উল্টো ঘটনা! মানুষ কামড়ে সাপটাই মারা গেল!
এ সময় আরেকজন লোক গলা বাড়িয়ে বলল, আরে ভাই, বুঝলেন না ব্যাপারটা? ভেজাল আর ফরমালিনযুক্ত খাবার খেতে খেতে আমাদের পুরো শরীরই বিষাক্ত হয়ে গেছে। সাপের কামড়েও এখন আর কিচ্ছু হয় না। উল্টো সাপই বিষে জর্জরিত হয়! এরপর শুনবেন, মানুষ মারা যাওয়ার পর লাশও আর পচবে না।
কথাটি শুনে অন্যেরা হো হো করে হেসে উঠলেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
আবদুল হক বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, আমি তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।
মর্জিনা বিবি গলা চড়িয়ে বললেন, ও! এখনো বুঝতে পারনি? এই দেখ তোমার ফলের কাণ্ড!
'ফলের কাণ্ড! ফল আবার কী দোষ করল!'
'আরে আগে কথা তো শেষ করি! তারপর বল। তুমি ফল কিনেছ কবে মনে আছে?'
'সাত আট দিন তো হবেই।'
'হুম, ঠিক আট দিন আগে।'
'এই দেখ, তোমার সেই পাকা কলা একটুও পচেনি। এই আপেলটা দেখ, দেখে মনে হচ্ছে এই মাত্র গাছ থেকে পেড়ে আনা হয়েছে। কি, তোমার তা মনে হচ্ছে না?'
আবদুল হক ইতিবাচক মাথা নেড়ে বললেন, হুম। কিন্তু লোকটা তো বলল, তার ফল ফরমালিনমুক্ত। সে জন্যই তো কিনেছি! তা না হলে কে কিনত?
'আরে! লোকটা বলল, আর তুমি বিশ্বাস করলে! না, তোমার মতো সরলসোজা মানুষ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। এই যুগে তুমি বেমানান। ওই দিনও তুমি মাছ কিনে এনে বললে, এই নাও, এক্কেবারে ফরমালিনমুক্ত তাজা মাছ। নদী থেকে ধরে এনে তোমার কাছে বিক্রি করেছে। তারপর কী ঘটেছে জানো!'
'কী ঘটেছে?'
'তুমি তো মাছ কিনে রেখে চলে গেলে অফিসে। আমি মাছটা যে ফ্রিজে রাখব, সে কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। তারপর বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেলাম গানের স্কুলে। সেখান থেকে বাসায় না এসে বাপের বাড়িতে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাসায় আসার পর রান্না ঘরে এসে দেখি মাছগুলো পড়ে আছে। আমি তো একেবারে অস্থির হয়ে গেলাম! এত টাকার মাছ! কী হবে! ব্যাগ খুলে দেখলাম, মাছ ঠিক আছে। একটুও পচেনি। এবার বোঝ! ফরমালিন দেওয়া না হলে এই মাছ ভালো থাকত!'
মর্জিনা বিবির কথা শুনে আবদুল হকের চোখ দুটো যেন কপালে উঠে গেল। তিনি কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। মাছ বিক্রেতা তাঁকে কছম কেটে বলল, নদী থেকে সে নিজে মাছ ধরে এনেছে। অথচ সেই মাছেও ফরমালিন! সেই সকালে মাছ কিনেছি। রাত পর্যন্ত সেই মাছের কিচ্ছু হয়নি! এই বিষ খেয়ে খেয়ে তো পুরো শরীরই বিষাক্ত হয়ে যাবে! তিনি স্ত্রীকে বললেন, মর্জিনা বিবি, কাল থেকে মাছ খাওয়া বন্ধ।
'তাহলে খাবে কী?'
'সবজি খাব, সবজি! বুঝতে পারছ?'
'সবজি! তুমি কি জানো, শাকসবজি-তরিতরকারিতেও ফরমালিন দেয়?'
'তাহলে শাকসবজিও বাদ! মাংস-ডিম খাব।'
'প্রতিদিন কি আর মাংস-ডিম খাওয়া যায়! তা ছাড়া যে দাম! তুমি কুলাতে পারবে? দশ-পনেরো দিনেই বাজার খরচের টাকা শেষ হয়ে যাবে! তখন কী হবে!'
'তাহলে কী করব বলো! আর ভালো লাগছে না। আচ্ছা শোন, দুপুরের জন্য কী রান্না করেছ?'
'মাছ আর ডাল।'
'ওই ফরমালিনযুক্ত মাছ?'
'এ ছাড়া উপায় কী? এত টাকার মাছ! ফেলে দেব?'
'আমি ভাত খাব না।'
'তাহলে খাবে কী?'
'আমাকে এক বাটি দুধ দাও। দুধ দিয়ে মুড়ি খাই।'
'ওতেও তো ভেজাল!'
'তাহলে আর কী করব, না খেয়ে থাকব!'
'না খেয়ে কয় দিন! এক দিন, দুই দিন... তারপর?'
আবদুল হক মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন। তিনি কী করবেন কিছুই ভেবে পান না। তিনি মনে মনে ভাবেন, এসব বিষ খেয়ে খেয়ে আমরা না হয় কোনোমতে জীবন পার করলাম! বাচ্চাদের কী হবে! তারা কী করে বাঁচবে!
২.
ফরমালিনবিষয়ক একটি গল্প বলা যেতে পারে। গল্পটি এ রকম। নজরুল আর বিপুল দুই ভাই। ওরা বিকেলে বল নিয়ে মাঠে খেলতে যায়। খিলক্ষেত স্কুল মাঠে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই। দুই ভাই দুই দিকে দাঁড়িয়ে একজন আরেকজনের দিকে বল ছুড়ছে। ওদের খেলা দেখে আরো কিছু ছেলেপেলে সেখানে এসে জড়ো হলো। তাদের কেউ কেউ খেলায় যোগ দিল। খেলা দেখতে আরো কিছু লোক সেখানে এলো। বাংলাদেশে তো আর লোকের অভাব নেই! এত এত লোকের কাজ কোথায়? নাই কাজ তো খই ভাজ!
হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা সাপ মাঠের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কোনো সাপুড়ে হয়তো তাড়া করছিল সাপটাকে। সাপটাকে দেখে ছেলেপেলেরা ভয়ে দৌড়াতে লাগল। দৌড়াদৌড়ির একপর্যায়ে সাপটি নজরুলের পায়ের নিচে পড়ল। আর অমনি সাপটি তার পায়ে কামড় বসিয়ে দিল। তার পরই ঘটল এক মহাকাণ্ড!
সাপের কামড় খেয়ে ভয়ে নজরুল চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার কান্না থেমে গেল। সে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সাপটার দিকে তাকিয়ে রইল। সাপটা কেবল ছটফট করছে। ঘটনা কী! অসংখ্য লোক সাপটার ছটফটানি দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সবাই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সাপটাকে দেখছে। ছটফট করতে করতে একসময় সাপটা মারা যায়।
এই দৃশ্য দেখে লোকজন বলাবলি শুরু করল, সাপের কামড়ে তো মানুষ মারা যায়! এত দেখছি উল্টো ঘটনা! মানুষ কামড়ে সাপটাই মারা গেল!
এ সময় আরেকজন লোক গলা বাড়িয়ে বলল, আরে ভাই, বুঝলেন না ব্যাপারটা? ভেজাল আর ফরমালিনযুক্ত খাবার খেতে খেতে আমাদের পুরো শরীরই বিষাক্ত হয়ে গেছে। সাপের কামড়েও এখন আর কিচ্ছু হয় না। উল্টো সাপই বিষে জর্জরিত হয়! এরপর শুনবেন, মানুষ মারা যাওয়ার পর লাশও আর পচবে না।
কথাটি শুনে অন্যেরা হো হো করে হেসে উঠলেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments