সময়ের প্রতিধ্বনি-প্রভাবমুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কাম্য by মোস্তফা কামাল

গতকাল ২৯ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে দেশের স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় ১১টি জেলার ১৯০টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। প্রথম দিনের নির্বাচন ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। কোথাও বড় কোনো অঘটন ঘটেনি। আমরা এর ধারাবাহিকতা দেখতে চাই।


এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন নিজেকে আরো বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রমাণের সুযোগ পাবে। এ সুযোগ নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশন হাতছাড়া করবে না বলে আমাদের প্রত্যাশা।
২৮ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম পর্যায়ে ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত উপকূলীয় ৫৯৪টি ইউনিয়নের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোটার তালিকায় ত্রুটি ও আইনি জটিলতার কারণে ২৬টি ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। নির্বাচনের পরিবেশ না থাকায় আরো স্থগিত হয়েছে পাথরঘাটার তিনটি ইউনিয়নের নির্বাচন। এ ছাড়া সীমানা নির্ধারণসংক্রান্ত সমস্যা ও আইনি জটিলতায় আপাতত নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে না ২০৫টি ইউনিয়ন পরিষদের। বাকি তিন হাজার ৮০৪টি ইউনিয়নের নির্বাচন মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয়ে জুন মাসজুড়ে চলবে।
সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় আচরণবিধি ভঙ্গের মানসিকতা আগের চেয়ে অনেক কম বলে মনে হচ্ছে। রঙিন পোস্টার, মাইক ব্যবহার, নির্বাচনী সমাবেশ করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের বিধিবিধান মানছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও যে বেশ সচেতন তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ধন্যবাদ পেতে পারে। কারণ নির্বাচন কমিশনের কঠোর মনোভাবের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও নেতা-কর্মীরা সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি (যেসব স্থানে বিএনপি শক্তিশালী) এবং কোথাও কোথাও অর্থ ও পেশিশক্তি প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ আছে। বর্তমানে যাঁরা চেয়ারম্যান ও মেম্বার আছেন তাঁরাও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অভিযোগ আছে, তাঁরা নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকে এলাকায় সরকারি অর্থে উন্নয়ন কাজ করছেন। অথচ বিগত নির্বাচনের পর এলাকায় তেমন কোনো উন্নয়নকাজ করেননি। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে উন্নয়নকাজ বেশ চোখে পড়ছে। তা ছাড়া বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, একটি বাড়ি একটি খামার প্রভৃতি প্রকল্পের কার্ড ইস্যুর মাধ্যমে ভোটারদের কাছে টানছেন। এসব অভিযোগ অমূলক নয়।
আমরা অতীতে দেখেছি, নির্বাচন মানেই কেন্দ্র দখল করে সিল মারা, ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা-পাল্টা হামলা। যাঁর যেখানে শক্তি বেশি তিনি সেখানে তা প্রদর্শন করেন। ভয়ভীতি প্রদর্শন অথবা অর্থ দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এজেন্টদের বাগিয়ে এনে সমঝোতার ভিত্তিতে সিল মারার সংস্কৃতি লালন করছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাঁরা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকেন তাঁরাও বিত্তবান প্রভাবশালী প্রার্থীর কাছ থেকে টাকা খেয়ে সিল মারায় সহযোগিতা করেন। এর ফলে দাগী আসামি, সন্ত্রাসী-অযোগ্য প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এতে হিতে বিপরীত হয়। স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক কাঠামো শক্তিশালী করতেই নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান-মেম্বার করা হয়। অথচ যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচিত না হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনও স্থবির হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসীরা চেয়ারম্যান-মেম্বার হয়ে গ্রামের মানুষকে সব সময় চাপের মধ্যে রাখে। স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে ছোট-বড় অনেক সন্ত্রাসী এখন গ্রামে অবস্থান করছে। নির্বাচনের আগে থেকেই এলাকায় এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা গ্রামের সহজ সরল মানুষকে ভয় দেখিয়ে ভোট বাগানোর পাঁয়তারা করছে। অনেক প্রার্থী দুই হাতে টাকা বিলিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ কলুষিত করছেন। কোনো কোনো প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। তাঁরা ভালোবাসা নয়, দাপট দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে ভোট আদায় করতে চান।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। বিজ্ঞজনরা বলে থাকেন, 'ফলবান বৃক্ষ যেমন ফলের ভারে নুয়ে পড়ে, ক্ষমতাবান লোকদেরও তেমনই হওয়া উচিত।' কিন্তু আমরা বাস্তব ক্ষেত্রে তার কোনো প্রমাণ পাই না। আমরা দেখি, ক্ষমতার দম্ভে মানুষ আর মানুষ থাকে না। গ্রামে-গঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের দাপট দেখলে মনে হয়, নেতা-কর্মীদের দম্ভ বড় বেশি বেড়ে গেছে।
আমরা সবাই জানি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হয় না। তার পরও রাজনৈতিক দলের সমর্থন চান স্থানীয় নেতারা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, গ্রামের মেম্বার পদপ্রার্থীও কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য। থানা পর্যায় থেকে রাজনৈতিক দলগুলো চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের সমর্থন দেয়। যাঁরা দলীয় সমর্থন লাভে ব্যর্থ হন তাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফলে নির্বাচন কমিশনের শর্ত থাকলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবেই হয়ে যায়। সম্ভবত এ কারণেই রাজনৈতিক দলগুলোও বলে আসছে, দলীয় ভিত্তিতেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলে আসছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়া ভালো। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। কাজেই এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের চিন্তাভাবনা করতে হবে।
এ মুহূর্তে আমরা যা চাই তা হচ্ছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। পুরো বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আন্তরিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাঁদের শৈথিল্য কিংবা অনৈতিক কাজের কারণে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যাতে বিঘি্নত না হয় সেদিকটার প্রতিও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
এর আগে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পৌর নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন তাদের নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে বলেই সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যদি কোনো ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে থাকে তাহলে এখনই তা সুধরে নিতে হবে। সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ের এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারলে নির্বাচন কমিশনের তো বটেই, সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। সরকার নিশ্চয়ই ক্ষুদ্র স্বার্থে বৃহত্তর স্বার্থ পরিত্যাগ করবে না।
ছবিসহ জাতীয় পরিচয়পত্র এখন আমাদের জাতীয় সম্পদ। দেরিতে হলেও এটা করার কারণে এখন জাল ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন কেন্দ্র দখল করে সিল মারা এবং ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইয়ের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ এসব দৃশ্য এখন আর মানুষ দেখতে চায় না। মানুষ ভোটের দিনটিকে উৎসবের দিন হিসেবে গণ্য করে। ভোটের দিন নির্বাচনী এলাকাগুলোয় আমরা উৎসবের আমেজ দেখতে পাই। ভোটাররা মনের আনন্দে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চায়। এ উৎসবের পরিবেশটা যাতে বজায় থাকে সে জন্য যা যা করণীয় তা নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশন করবে। কোনো কারণে যাতে পরিবেশ বিঘি্নত না হয় সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.