ইতি-নেতি-প্রচারেই প্রসার : ৪০ বছরেও যে সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায়নি by মাসুদা ভাট্টি
যুদ্ধ মূলত দুই ধরনের_সশস্ত্র ও মনস্তাত্তি্বক। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর থেকে এ পর্যন্ত, অর্থাৎ বিগত ৪০ বছর বাংলাদেশ এক মনস্তাত্তি্বক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে_এ কথা বললে কি ভুল বলা হবে? ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস এবং স্বাভাবিকভাবেই দিনটিকে কেন্দ্র করে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগ চোখে পড়েছে।
কিন্তু দিনটিকে উপলক্ষ করে যে বিতর্ক এই ৪০ বছর পরও আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে ভারাক্রান্ত করেছে তা রীতিমতো দুঃখজনক। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল তা আসলে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির ফসল। এখানে তা প্রমাণের প্রয়োজন এ কারণেই নেই যে, এ নিয়ে বহু তত্ত্ব ও তথ্য ইতিমধ্যে বেরিয়ে গেছে। রাজনৈতিকভাবে বাঙালি সেনাশাসিত পাকিস্তানের নিগড় থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে বের করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মনে করেছিল, রাজনৈতিক সমাধান কোনো সমাধান নয়, গণতন্ত্রের পথ আসলে কোনো পথ নয়, তাই অস্ত্র দিয়ে অধিকারের দাবিকে দমন করে, মানুষ নিধন করে কেবল এ মাটির অধিকার তাদের কব্জায় রাখতে চেয়েছিল। ইতিহাসের যে বর্বরতম হত্যাকাণ্ড একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল তার নজির খুব কমই পাওয়া যাবে। আমরা তুলনামূলক আলোচনায় উল্লেখ করতে পারি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কাল ছয় বছর, এর আগে প্রথম মহাযুদ্ধ তো এক দশকের বেশি সময় ধরে চলেছে বলে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে মাত্র ৯ মাসে যে পরিমাণ বাঙালি হত্যার নৃশংসতা পাকিস্তানি বাহিনী দেখিয়েছে তা মানব ইতিহাসের চরমতম ক্ষত হয়ে থাকার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, উন্নত বিশ্ব কিংবা আরো একটু স্পষ্ট করে বললে পশ্চিমারা এই ক্ষতকে অতটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে বিশ্বাস করে না। কেন করে না? সমস্যাটা কি আমাদের, নাকি ওদের?
একাত্তর সম্পর্কিত যত দলিলপত্র এখন উন্মুক্ত হয়েছে তার বেশির ভাগেই কিন্তু হতাহতের সংখ্যা বাংলাদেশের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে মার্কিন ও ব্রিটিশ দলিলপত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার যে নগ্ন সত্যের উল্লেখ রয়েছে তা গবেষকদের জন্য যথেষ্ট বাংলাদেশের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে। প্রশ্ন হলো, যুদ্ধকালে শুধু সশস্ত্র অবস্থায় হতাহতের সংখ্যা দিয়ে ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট হয় না, যুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধপরবর্তীকালে এ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অব্যবস্থার ফলে ক্ষতিগ্রস্ততাও যুদ্ধের মোট ক্ষতিকে নির্দেশ করে। একাত্তরে পৃথিবীর অনেক দেশই বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন দেয়নি। না দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি আরবভূমে পশ্চিমা আক্রমণে অনেক আরব রাষ্ট্রই পশ্চিমা পক্ষকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে। যুদ্ধে এ রকম নীতিগত, অবস্থানগত, স্বার্থগত নানা অবস্থান থাকবেই। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটিতে হতাহত ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশটিরই, এতে বাইরের কেউ অংশ নিক কী না নিক, নিজেদের প্রয়োজনেই এই হিসাব হওয়া উচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শাসনামল মাত্র সাড়ে তিন বছরের। এর মধ্যে প্রথম বছরকে আমাদের বাদ দিতে হবে হিসাব থেকে। কারণ একটি সদ্য স্বাধীন দেশের আনন্দ-উৎসবের মধ্যে ত্যাগ আর স্বজন হারানোর যে বেদনাবিধুর চিত্র, তা কেবল যাঁরা ওই সময় এ দেশে ছিলেন তাঁরাই বলতে পারবেন।
সেই অভাবনীয় সময়ে বাংলাদেশ যতটুকুই সাফল্য দেখিয়ে থাকুক না কেন, তাই-ই উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সাফল্য হিসেবে আমার বিবেচনায় মূলত বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনই প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া দেশের বিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণেও সেই সরকার সাফল্য অর্জন করে। এমনকি দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো এবং চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও তৎকালীন সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাও বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়ায়। এত কিছুর মধ্যে সেই সময়ের সরকার, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো যা বিস্মৃত হয় তা হলো একটি ভয়ংকর যুদ্ধ-স্মৃতিতাড়িত বাঙালি জাতিকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফরমে দাঁড় করিয়ে মানুষের মন থেকে সেই ভয়ংকর স্মৃতি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা। অবশ্য তখন দেশে দেশে 'পোস্ট কনফ্লিক্ট রিকনসিলিয়েশন'-এর ধারণাই তেমনভাবে তৈরি হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, দেশের ভেতরে যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল যুদ্ধের ৯ মাস সময় ধরে, তাদের তালিকা তৈরি এবং বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছিল। শুধু এ ক্ষেত্রে বিদেশে প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। সেটা শুধু যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের ক্ষেত্রেই নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হাতে বাঙালির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কেও দেশের বাইরে তেমনভাবে প্রচার সম্ভব হয়নি। গণহত্যাও এর বাইরে নয়। লোকবলের অভাব কিংবা দূরদৃষ্টির অভাব, যাই-ই বলি না কেন, তখন তা সম্ভব হলে আজকে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতো।
দেশের বাইরে হয়নি, তার না হয় কারণ ছিল; কিন্তু দেশের ভেতরেও প্রচারযুদ্ধে তৎকালীন সরকারের সাফল্য ছিল না, নাহলে অত যুদ্ধক্ষত মাত্র সামান্য সময়েই মুছে গিয়ে দেশের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং তারপর সামরিক শাসনের হাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অপমান করা হয়েছে। আজকে যাঁদের আমরা যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক দেখতে পাচ্ছি তাঁদের প্রায় সবাই হয় দেশের ভেতর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, নাহলে দেশের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। উল্লেখ্য, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম তখন লন্ডনে ব্যস্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নিয়ে এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হতাহতের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ যে দাবি করে আসছিল তার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছিল এ কমিটি।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বরাবরই যে পিছিয়ে ছিল আর অপপ্রচারকারীরা যে বরাবরই এগিয়েছিল গত ৪০ বছরে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রথমেই প্রশ্ন তোলা হয়, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর কেন এই বিচার? একেবারে সদ্য সম্প্রতি দি ইকনোমিস্ট পত্রিকা এ বিষয়ে সংবাদ-নিবন্ধ প্রকাশ করতে গিয়ে এ প্রশ্নটি দিয়েই শুরু করেছে এবং তারপর যথারীতি শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশের ভেতর বিভক্তি থেকে হতাহতের দাবিকে অসার প্রমাণের চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার খুঁত খুঁজতে খুঁজতে শেষ হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার পুনরায় যে ক্ষমতায় আসতে পারবে না তা একটি স্পষ্ট বাক্যে বুঝিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিবন্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ড. ইউনূস ইস্যুতেও বাংলাদেশকে ঘিরে পশ্চিমা গণমাধ্যমে যে অপপ্রচারের বন্যা বয়ে গেছে তাতে সত্যাসত্য নির্ধারণের ধার কেউ ধারেনি। বাংলাদেশ, দেশের সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে পশ্চিমা গণমাধ্যম এমন গণহেনস্তা করেছে যাতে এ পক্ষের বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। সুস্থ সাংবাদিকতার রীতিতেও তাকে কোনোভাবেই বিবেচনায় আনা চলে না। কিন্তু তাতে কার কী এল-গেল, প্রচারমাধ্যমে দেশের ভেতরে যেমন, দেশের বাইরেও বর্তমান সরকার যে পিছিয়ে আছে তার প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমান যুগটাই হচ্ছে লবিস্ট, পাবলিসিটি ম্যানেজারের। এই যুগে কী অভ্যন্তরীণ, কী আন্তর্জাতিক, যেখানেই যা করতে চাওয়া হোক না কেন, প্রয়োজন দক্ষ প্রচারকের, যিনি বা যাঁরা পারবেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার চালাতে। প্রচারেই প্রসার, কথাটির অনুধাবন বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং যত দ্রুত সম্ভব। দেশে-বিদেশে সরকারের অবস্থা এতটা নাজুক হতো না যদি প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের স্ট্র্যাটেজি আগে থেকেই নির্ধারিত থাকত। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি একটু গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবেন।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com
একাত্তর সম্পর্কিত যত দলিলপত্র এখন উন্মুক্ত হয়েছে তার বেশির ভাগেই কিন্তু হতাহতের সংখ্যা বাংলাদেশের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষ করে মার্কিন ও ব্রিটিশ দলিলপত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার যে নগ্ন সত্যের উল্লেখ রয়েছে তা গবেষকদের জন্য যথেষ্ট বাংলাদেশের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে। প্রশ্ন হলো, যুদ্ধকালে শুধু সশস্ত্র অবস্থায় হতাহতের সংখ্যা দিয়ে ক্ষতির পরিমাণ নির্দিষ্ট হয় না, যুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধপরবর্তীকালে এ যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অব্যবস্থার ফলে ক্ষতিগ্রস্ততাও যুদ্ধের মোট ক্ষতিকে নির্দেশ করে। একাত্তরে পৃথিবীর অনেক দেশই বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন দেয়নি। না দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট কারণ থাকতে পারে। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি আরবভূমে পশ্চিমা আক্রমণে অনেক আরব রাষ্ট্রই পশ্চিমা পক্ষকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিচ্ছে। যুদ্ধে এ রকম নীতিগত, অবস্থানগত, স্বার্থগত নানা অবস্থান থাকবেই। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটিতে হতাহত ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের এখতিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশটিরই, এতে বাইরের কেউ অংশ নিক কী না নিক, নিজেদের প্রয়োজনেই এই হিসাব হওয়া উচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম শাসনামল মাত্র সাড়ে তিন বছরের। এর মধ্যে প্রথম বছরকে আমাদের বাদ দিতে হবে হিসাব থেকে। কারণ একটি সদ্য স্বাধীন দেশের আনন্দ-উৎসবের মধ্যে ত্যাগ আর স্বজন হারানোর যে বেদনাবিধুর চিত্র, তা কেবল যাঁরা ওই সময় এ দেশে ছিলেন তাঁরাই বলতে পারবেন।
সেই অভাবনীয় সময়ে বাংলাদেশ যতটুকুই সাফল্য দেখিয়ে থাকুক না কেন, তাই-ই উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সাফল্য হিসেবে আমার বিবেচনায় মূলত বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্য স্বীকৃতি আদায় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনই প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া দেশের বিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণেও সেই সরকার সাফল্য অর্জন করে। এমনকি দেশটির রাজনৈতিক কাঠামো এবং চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও তৎকালীন সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাও বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়ায়। এত কিছুর মধ্যে সেই সময়ের সরকার, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো যা বিস্মৃত হয় তা হলো একটি ভয়ংকর যুদ্ধ-স্মৃতিতাড়িত বাঙালি জাতিকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফরমে দাঁড় করিয়ে মানুষের মন থেকে সেই ভয়ংকর স্মৃতি মুছে ফেলার প্রচেষ্টা। অবশ্য তখন দেশে দেশে 'পোস্ট কনফ্লিক্ট রিকনসিলিয়েশন'-এর ধারণাই তেমনভাবে তৈরি হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, দেশের ভেতরে যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল যুদ্ধের ৯ মাস সময় ধরে, তাদের তালিকা তৈরি এবং বিচারের মুখোমুখিও করা হয়েছিল। শুধু এ ক্ষেত্রে বিদেশে প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। সেটা শুধু যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের ক্ষেত্রেই নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হাতে বাঙালির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কেও দেশের বাইরে তেমনভাবে প্রচার সম্ভব হয়নি। গণহত্যাও এর বাইরে নয়। লোকবলের অভাব কিংবা দূরদৃষ্টির অভাব, যাই-ই বলি না কেন, তখন তা সম্ভব হলে আজকে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতো।
দেশের বাইরে হয়নি, তার না হয় কারণ ছিল; কিন্তু দেশের ভেতরেও প্রচারযুদ্ধে তৎকালীন সরকারের সাফল্য ছিল না, নাহলে অত যুদ্ধক্ষত মাত্র সামান্য সময়েই মুছে গিয়ে দেশের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং তারপর সামরিক শাসনের হাতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের দেশে ফিরিয়ে এনে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের অপমান করা হয়েছে। আজকে যাঁদের আমরা যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক দেখতে পাচ্ছি তাঁদের প্রায় সবাই হয় দেশের ভেতর গা-ঢাকা দিয়েছিলেন, নাহলে দেশের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। উল্লেখ্য, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম তখন লন্ডনে ব্যস্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি নিয়ে এবং পশ্চিমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের হতাহতের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ যে দাবি করে আসছিল তার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছিল এ কমিটি।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, প্রচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বরাবরই যে পিছিয়ে ছিল আর অপপ্রচারকারীরা যে বরাবরই এগিয়েছিল গত ৪০ বছরে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রথমেই প্রশ্ন তোলা হয়, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর কেন এই বিচার? একেবারে সদ্য সম্প্রতি দি ইকনোমিস্ট পত্রিকা এ বিষয়ে সংবাদ-নিবন্ধ প্রকাশ করতে গিয়ে এ প্রশ্নটি দিয়েই শুরু করেছে এবং তারপর যথারীতি শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশের ভেতর বিভক্তি থেকে হতাহতের দাবিকে অসার প্রমাণের চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত বিচারপ্রক্রিয়ার খুঁত খুঁজতে খুঁজতে শেষ হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার পুনরায় যে ক্ষমতায় আসতে পারবে না তা একটি স্পষ্ট বাক্যে বুঝিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিবন্ধের সমাপ্তি ঘটেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ড. ইউনূস ইস্যুতেও বাংলাদেশকে ঘিরে পশ্চিমা গণমাধ্যমে যে অপপ্রচারের বন্যা বয়ে গেছে তাতে সত্যাসত্য নির্ধারণের ধার কেউ ধারেনি। বাংলাদেশ, দেশের সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে পশ্চিমা গণমাধ্যম এমন গণহেনস্তা করেছে যাতে এ পক্ষের বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণই অনুপস্থিত। সুস্থ সাংবাদিকতার রীতিতেও তাকে কোনোভাবেই বিবেচনায় আনা চলে না। কিন্তু তাতে কার কী এল-গেল, প্রচারমাধ্যমে দেশের ভেতরে যেমন, দেশের বাইরেও বর্তমান সরকার যে পিছিয়ে আছে তার প্রমাণ তো হাতেনাতেই পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমান যুগটাই হচ্ছে লবিস্ট, পাবলিসিটি ম্যানেজারের। এই যুগে কী অভ্যন্তরীণ, কী আন্তর্জাতিক, যেখানেই যা করতে চাওয়া হোক না কেন, প্রয়োজন দক্ষ প্রচারকের, যিনি বা যাঁরা পারবেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে ইতিবাচক প্রচার চালাতে। প্রচারেই প্রসার, কথাটির অনুধাবন বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি এবং যত দ্রুত সম্ভব। দেশে-বিদেশে সরকারের অবস্থা এতটা নাজুক হতো না যদি প্রচারের ক্ষেত্রে সরকারের স্ট্র্যাটেজি আগে থেকেই নির্ধারিত থাকত। আশা করি, সরকারের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি একটু গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখবেন।
লেখক : সম্পাদক, একপক্ষ
editor@ekpokkho.com
No comments