হৈমন্ত্রীদের এক শ' বছর by মিলু শামস
দূর সম্পর্কের কোন এক দিদিমা বলিয়া
উঠিলেন, "পোড়া কপাল আমার! নাতবউ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল।" আর এক দিদিমা
শ্রেণীয়া বলিলেন, "আমাদেরই যদি হার না মানাইবে তবে অপু বাহির হইতে বউ আনিতে
যাইবে কেন।"
আমার মা খুব জোরের সহিত বলিয়া উঠিলেন, "ওমা,
সে কী কথা বউমার বয়স সবে এগারো বৈ তো নয়, এই আসছে ফাল্গুনে বারোয় পা দেবে।
খোট্টার দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন বাড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে।" দিদিমারা
বলিলেন, "বাছা এখনো চোখে এত কম তো দেখিনা। কন্যাপৰ নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে
বয়স ভাঁড়াইয়াছে।"
মা বলিলেন, "আমরা যে কুষ্ঠি দেখিলাম।" কথাটা সত্য কিন্তু কোষ্ঠিতেই প্রমাণ আছে, মেয়ের বয়স সতেরো। প্রবীণরা বলিলেন, "কুষ্ঠিতে কি আর ফাঁকি চলে না।"
এই লইয়া ঘোর তর্ক, এমন-কি বিবাদ হইয়া গেল। এমন সময়ে সেখানে হৈম আসিয়া উপস্থিত। কোনুএক দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, "নাত বউ, তোমার বয়স কত বলো তো।" মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশারা করিলেন। হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না;
বলিল, "সতেরো।"
মা ব্যসত্ম হইয়া বলিয়া উঠিলেন,
"তুমি জানো না।"
হৈম কহিল, "আমি জানি আমার বয়স সতেরো।" দিদিমারা পরস্পর গা টেপাটেপি করিলেন। বধূর নিবর্ুদ্ধিতায় রাগিয়া উঠিয়া মা বলিলেন, "তুমি তো সব জান। তোমার বাবা যে বলিলেন, তোমার বয়স এগারো।"
হৈম চমকিয়া কহিল, "বাবা বলিয়াছেন? কখনও না।" মা কহিলেন, "অবাক করিল। বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে 'কখনওই না।' "এই বলিয়া আর-একবার চোখ টিপিলেন।
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল; স্বর আরও দৃঢ় করিয়া বলিল, "বাবা এমন কথা কখনওই বলিতে পারেন না।"
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, "তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস?"
হৈম বলিল, "আমার বাবা তো কখনও মিথ্যা বলেন না।"
ইহার পর মা যতই গালি দিতে লাগিলেন কথাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারিদিকে লেপিয়া গেল।
(হৈমনত্মী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
দুই
কথার কালি আর শ্রমের ঘাম-রক্ত মেখে পায়ে পায়ে পেরিয়ে গেল এক শ' বছর। উনিশ শ' দশ থেকে দু'হাজার দশ। কারা জেটকিন থেকে আজকের বাজার অর্থনীতি, দিশেহারা নারী আন্দোলন। কারা জেটকিনের বিশ্ব নারী দিবস ঘোষণার পাঁচ বছর পর প্রাচ্যের খ্যাতিমান কবির হাতে 'হৈমনত্মী'র জন্ম। হৈমনত্মী আমাদের বুঝিয়েছে সংস্কারের টাবু আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একে দেখা যায় না এর পীড়ন অনুভব করা যায়। অদৃশ্য এক চক্রবূ্যহের মতো ঘিরে থাকে পা থেকে মাথা পর্যনত্ম। এ থেকে বেরোনো কি সম্ভব? একা নারীর পৰে? একেবারেই নয়। সংস্কার তৈরি হয় নারী-পুরম্নষের যৌথ জীবন ধারায়, উৎপাদন কাঠামোকে কেন্দ্র করে। এ থেকে বেরোতে দুজনারই সমান আনত্মরিকতা প্রয়োজন। নইলে দুজনার নিশ্বাসই ব্যাহত হয়। হৈমনত্মীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
এ কথা বুঝেছিলেন মেরি ওলস্টোন ক্রাফট। ফরাসী বিপস্নবের আবহে যিনি বেড়ে উঠেছিলেন। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী ধারণ করে লিখেছিলেন বিখ্যাত দুই বই_'দি ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব উইমেন' এবং 'দি রংগস অব উইমেন।' তিনি বলেছিলেন, নারীর অধিকার স্বীকৃত হলেও তা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বাসত্মবায়ন করা কঠিন। সেই আঠারো শতকে তিনি যা উপলব্ধি করেছিলেন আজ এত বছর পরও তা সমান প্রযোজ্য। আরও বলেছিলেন, 'নারীর প্রতি প্রত্যৰ অপমান ও অবজ্ঞতার বিরম্নদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু নানাবিধ বিশেষণে গাল ভরা প্রশংসা করে তাকে যে অনত্মপুরে রম্নদ্ধ করে রাখা হয় তার বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করা খুবই কঠিন।
বুঝেছিলেন বেগম রোকেয়া_"আমরা সমাজেরই অর্ধ-অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরম্নষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে_একই।"
তিন
বীজ ছিল ফরাসী বিপস্নবের গর্ভে। ১৭৮৯ সালের সেই বিপস্নবী আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নতুন দিগনত্ম রেখা স্পষ্ট করে। বিপস্নবের প্রভাবে ফরাসী চিনত্মাবিদদের মনে নতুন ভাবধারা জন্ম নেয়। এর প্রভাবে সমাজে আলোড়ন তোলার পাশাপাশি নারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই বছরই ফরাসী নারীদের অগ্রগামী একটি দল 'নারী ও পুরম্নষের সমান অধিকার' পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য 'শ্রম ও কাজের অধিকারের জন্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগের জন্য' শিরোনামে একটি স্মারকলিপি ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদে পেশ করে। তাদের বক্তব্য ছিল, "নারীদের যদি ফাঁসি কাষ্ঠে ওঠার অধিকার থাকে তাহলে মঞ্চে ওঠার অধিকারও আছে।"
সেই প্রথম স্পষ্ট করে কিছু বলা। অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত নারীরা শিৰার বিষয়টি গুরম্নত্বের সঙ্গে সামনে আনেন। তারা বললেন, পরিবারে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা নির্দিষ্ট হতে হবে, সম্পত্তিতে অধিকার দিতে হবে এবং নারীর নিজের রোজগারের ওপর তার অধিকার আইনত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব দাবি জানাতে গিয়ে একসময় ভোটাধিকারের দাবি সামনে এসে পড়ে। ভোটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন মূলত সম্পদশালী নারীরা। শ্রমিক নারীদের এতে সমর্থন ছিল। ধনী নারী আর শ্রমিক নারীদের স্বার্থ ছিল আলাদা। তাদের চাওয়া দাবি-দাওয়াগুলো সমানত্মরালে আবর্তিত হয়নি কখনও। তাদের জীবনধারাই পরস্পরবিরোধী। আজও আমাদের এ ছোট দেশেও মধ্যবিত্ত নারীদের আন্দোলন পোশাক কারখানার শ্রমিক নারীদের আন্দোলন থেকে মৌলিক পার্থক্য বজায় রেখে চলছে। কর্মৰেত্রে এবং শিৰা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য যখন হাইকোর্ট রম্নল জারি করেন পোশাক কারখানার হাজার হাজার নারী শ্রমিকের কাছে তখন এই নিপীড়নের চেয়ে বেশি জরম্নরী হয়ে ওঠে মাস শেষে নির্দিষ্ট সময়ে মজুরী পাওয়ার বিষয়টি ন্যায্য মজুরীর বিষয়টি। যদিও তারাও যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার। যাহোক, মজার বিষয় হচ্ছে সার্বজনীন ভোটাধিকার পেতে পুরম্নষদেরও সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৮৬৭ সালের আগে সম্পদশালী উচ্চ শিৰিত পুরম্নষরাই শুধু ভোট দিতে পারতেন। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন যখন প্রকট রূপ নিয়েছে তখন সরকার ও বিত্তবানদের পৰ থেকে বলা হয়েছিল, পুরম্নষের মতো ধনী উচ্চ শিৰিত নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টিই কেবল বিবেচনা করা যেতে পারে। আসলে আঠারো শতক থেকে বিশ শতক পর্যনত্ম সময় ছিল অধিকার অর্জনের আন্দোলনে ঘটনাবহুল সময়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল নারী ফ্রন্টের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জামর্ান সমাজতন্ত্রী নেত্রী কারা জেটকিনের নেতৃত্বে ৮ মার্চকে আনত্মজর্াতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর দু'বছর আগে ৮ মার্চ শিকাগো শহরের শ্রমিক নারীরা আট ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে আন্দোলন করলে পুলিশের সঙ্গে রক্তৰয়ী সংঘর্ষ হয়। তাতে বেশ ক'জন নারী শ্রমিক নিহত হন। সেই শ্রমিক নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধানত্ম হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দিনটি রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে পালন করা হতো। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘ অনুমোদন দেয়ায় তার নিজেরও কিছু দায়বদ্ধতা এসে যায়। ঘোষিত হয় নারী দশক, রচিত হয় সিডও সনদ, অনুষ্ঠিত হয় নারী সম্মেলন। সবই আনত্মজর্াতিক পরিম-লে। জাতীয় পযর্ায়েও কাজ হয় কিছু কিছু। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য। নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরম্নতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে নারীর অধিকারকে সমান গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে।
চার
এক শ' বছর। তার আগের দু'তিন শ' বছর। এক শ' বছরের পরের বছর। আমরা এগোচ্ছি ...। আন্দোলনে এগোচ্ছি_দলিল দসত্মাবেজে এগোচ্ছি। শুধু একটি প্রশ্ন ছন্নাছাড়া মাছির মতো ঘুরপাক খায়_এ চলা আমাদের জীবনের বাসত্মাবতাকে ছুঁতে পারছে তো? কর্পোরেট ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবনের অত্যাধুনিক চেয়ার টেবিলে বসে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো তরম্নণ যখন বিয়ের পূর্বশর্তর্ হিসেবে কন্যার বাবার দেয়া ফ্যাটের চাবি হসত্মানত্মরের দিন গোনে তখন আবার হৈমনত্মীকে মনে পড়ে যায়। "কন্যার বাপ সবুর করিতে পরিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিয়ের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেৰিক গুরম্নত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেই জন্যই তাড়া।" এক শ' বছরের শুরম্নর পাঁচ বছর পরের কাহিনীর সঙ্গে এক শ' বছর পরের কাহিনীর কি নিভর্ুল ঐক্য! শিৰায় যোগ্যতায় সমান পারদর্শী মেয়ের বাবা বিয়েতে মেয়েকে সাজানোর জন্য এক সেট গয়না আর যে ঘরে সে যাবে সে ঘর সাজাতে এক সেট ফার্নিচার দেবেনই। না না যৌতুক নয় ছি ছি! শিৰিত ভদ্রজনেরা যৌতুক দেয় নাকি! এত মেয়েকে বাবার দেয়া উপহার। এ উপহার নিতে শিৰিত মেয়েটিরও কোন আপত্তি নেই। কী হাঁটলাম, কীভাবে হাঁটলাম? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণী পাওয়া মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রীর বিয়ে হয় 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে লেগেছে' পদ্ধতিতে। তার পর সে মেয়ে স্বামীর হাতে খুন হয়ে ফিরে আসে। স্বামী গুরম্নপাপের লঘুদ- নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। তাহলে সত্যিই এ কি জন্মের ঋণ? নারী হয়ে জন্মানোর ৰতিপূরণ? শোপেন হাওয়ার যেমন বলেছেন, " সনত্মানের জন্ম দিয়ে, সনত্মান পালন করে ও স্বামীদের অধীনে থেকেই নারীরা তাদের জীবনের ঋণ পরিশোধ করবে। তাদের ইচ্ছামত মত প্রকাশ করতে দেয়া যায় না।" এক-দু' শ' বছর পর আজও কি বাতাসে দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের সেই কথা প্রতিধ্বনি তোলেন? কাকে দুষব ব্যক্তিকে, প্রতিষ্ঠানকে নাকি পদ্ধতিকে। সিস্টেম তৈরি করে ব্যক্তিকে আবার ব্যক্তি প্রভাবিত করে সিস্টেমকে। যারা ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করার কথা বলেছিলেন অবস্থার দুর্বিপাকে আজ তাদের কণ্ঠ ৰীণ। তবে তারা নারীর কাজকে গৃহের চৌহদ্দি থেকে বের করে সামাজিক শ্রমের মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেকথাও ভোলা যায় না। শোপেন হাওয়ারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যারা বলেছিল, নারী বাইরের কাজে গেলে সংসার জীবনে সঙ্কট তৈরি হয়, তাই তাদের ঘরেই থাকা প্রয়োজন, ঘরকন্নাই নারীদের একমাত্র কাজ।" তারাও বিলুপ্ত প্রজাতির কাতারে নিজেদের নাম লেখায়নি। বরং ঝাড়ে বংশে শতগুণ বর্ধিত হয়ে অশরীরীর মতো বিচরণ করছে। তাহলে কি চলাতেই ভুলছিল? দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী না হয়ে একাকি পথ চলার আনন্দ খুঁজে নেয়া হয়েছিল? তাও তো নয়। পথের সাথী হয়েছিলেন অনেকে সেই শুরম্ন থেকে। অনেক বিরোধ থাকার পরও। আজও আছেন চলার সঙ্গী। নইলে একটুও এগোনো সম্ভব হতো না। যেটুকু অর্জন তা যৌথ চলারই ফল। নারী এবং পুরম্নষ দুজনার যৌথ চলাই কেবল এগিয়ে নেবে সামনে এক শ' বছর দু'শ' বছর হাজার বছর। এর কোন বিকল্প নেই।
সরষঁংযধসং৬৭@মসধরষ.পড়স
মা বলিলেন, "আমরা যে কুষ্ঠি দেখিলাম।" কথাটা সত্য কিন্তু কোষ্ঠিতেই প্রমাণ আছে, মেয়ের বয়স সতেরো। প্রবীণরা বলিলেন, "কুষ্ঠিতে কি আর ফাঁকি চলে না।"
এই লইয়া ঘোর তর্ক, এমন-কি বিবাদ হইয়া গেল। এমন সময়ে সেখানে হৈম আসিয়া উপস্থিত। কোনুএক দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, "নাত বউ, তোমার বয়স কত বলো তো।" মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশারা করিলেন। হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না;
বলিল, "সতেরো।"
মা ব্যসত্ম হইয়া বলিয়া উঠিলেন,
"তুমি জানো না।"
হৈম কহিল, "আমি জানি আমার বয়স সতেরো।" দিদিমারা পরস্পর গা টেপাটেপি করিলেন। বধূর নিবর্ুদ্ধিতায় রাগিয়া উঠিয়া মা বলিলেন, "তুমি তো সব জান। তোমার বাবা যে বলিলেন, তোমার বয়স এগারো।"
হৈম চমকিয়া কহিল, "বাবা বলিয়াছেন? কখনও না।" মা কহিলেন, "অবাক করিল। বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে 'কখনওই না।' "এই বলিয়া আর-একবার চোখ টিপিলেন।
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল; স্বর আরও দৃঢ় করিয়া বলিল, "বাবা এমন কথা কখনওই বলিতে পারেন না।"
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, "তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস?"
হৈম বলিল, "আমার বাবা তো কখনও মিথ্যা বলেন না।"
ইহার পর মা যতই গালি দিতে লাগিলেন কথাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারিদিকে লেপিয়া গেল।
(হৈমনত্মী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
দুই
কথার কালি আর শ্রমের ঘাম-রক্ত মেখে পায়ে পায়ে পেরিয়ে গেল এক শ' বছর। উনিশ শ' দশ থেকে দু'হাজার দশ। কারা জেটকিন থেকে আজকের বাজার অর্থনীতি, দিশেহারা নারী আন্দোলন। কারা জেটকিনের বিশ্ব নারী দিবস ঘোষণার পাঁচ বছর পর প্রাচ্যের খ্যাতিমান কবির হাতে 'হৈমনত্মী'র জন্ম। হৈমনত্মী আমাদের বুঝিয়েছে সংস্কারের টাবু আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একে দেখা যায় না এর পীড়ন অনুভব করা যায়। অদৃশ্য এক চক্রবূ্যহের মতো ঘিরে থাকে পা থেকে মাথা পর্যনত্ম। এ থেকে বেরোনো কি সম্ভব? একা নারীর পৰে? একেবারেই নয়। সংস্কার তৈরি হয় নারী-পুরম্নষের যৌথ জীবন ধারায়, উৎপাদন কাঠামোকে কেন্দ্র করে। এ থেকে বেরোতে দুজনারই সমান আনত্মরিকতা প্রয়োজন। নইলে দুজনার নিশ্বাসই ব্যাহত হয়। হৈমনত্মীরা মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
এ কথা বুঝেছিলেন মেরি ওলস্টোন ক্রাফট। ফরাসী বিপস্নবের আবহে যিনি বেড়ে উঠেছিলেন। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার বাণী ধারণ করে লিখেছিলেন বিখ্যাত দুই বই_'দি ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব উইমেন' এবং 'দি রংগস অব উইমেন।' তিনি বলেছিলেন, নারীর অধিকার স্বীকৃত হলেও তা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বাসত্মবায়ন করা কঠিন। সেই আঠারো শতকে তিনি যা উপলব্ধি করেছিলেন আজ এত বছর পরও তা সমান প্রযোজ্য। আরও বলেছিলেন, 'নারীর প্রতি প্রত্যৰ অপমান ও অবজ্ঞতার বিরম্নদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু নানাবিধ বিশেষণে গাল ভরা প্রশংসা করে তাকে যে অনত্মপুরে রম্নদ্ধ করে রাখা হয় তার বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করা খুবই কঠিন।
বুঝেছিলেন বেগম রোকেয়া_"আমরা সমাজেরই অর্ধ-অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরম্নষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে_একই।"
তিন
বীজ ছিল ফরাসী বিপস্নবের গর্ভে। ১৭৮৯ সালের সেই বিপস্নবী আন্দোলনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নতুন দিগনত্ম রেখা স্পষ্ট করে। বিপস্নবের প্রভাবে ফরাসী চিনত্মাবিদদের মনে নতুন ভাবধারা জন্ম নেয়। এর প্রভাবে সমাজে আলোড়ন তোলার পাশাপাশি নারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই বছরই ফরাসী নারীদের অগ্রগামী একটি দল 'নারী ও পুরম্নষের সমান অধিকার' পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য 'শ্রম ও কাজের অধিকারের জন্য ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিয়োগের জন্য' শিরোনামে একটি স্মারকলিপি ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদে পেশ করে। তাদের বক্তব্য ছিল, "নারীদের যদি ফাঁসি কাষ্ঠে ওঠার অধিকার থাকে তাহলে মঞ্চে ওঠার অধিকারও আছে।"
সেই প্রথম স্পষ্ট করে কিছু বলা। অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত নারীরা শিৰার বিষয়টি গুরম্নত্বের সঙ্গে সামনে আনেন। তারা বললেন, পরিবারে নারীর ভূমিকা ও মর্যাদা নির্দিষ্ট হতে হবে, সম্পত্তিতে অধিকার দিতে হবে এবং নারীর নিজের রোজগারের ওপর তার অধিকার আইনত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব দাবি জানাতে গিয়ে একসময় ভোটাধিকারের দাবি সামনে এসে পড়ে। ভোটাধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন মূলত সম্পদশালী নারীরা। শ্রমিক নারীদের এতে সমর্থন ছিল। ধনী নারী আর শ্রমিক নারীদের স্বার্থ ছিল আলাদা। তাদের চাওয়া দাবি-দাওয়াগুলো সমানত্মরালে আবর্তিত হয়নি কখনও। তাদের জীবনধারাই পরস্পরবিরোধী। আজও আমাদের এ ছোট দেশেও মধ্যবিত্ত নারীদের আন্দোলন পোশাক কারখানার শ্রমিক নারীদের আন্দোলন থেকে মৌলিক পার্থক্য বজায় রেখে চলছে। কর্মৰেত্রে এবং শিৰা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য যখন হাইকোর্ট রম্নল জারি করেন পোশাক কারখানার হাজার হাজার নারী শ্রমিকের কাছে তখন এই নিপীড়নের চেয়ে বেশি জরম্নরী হয়ে ওঠে মাস শেষে নির্দিষ্ট সময়ে মজুরী পাওয়ার বিষয়টি ন্যায্য মজুরীর বিষয়টি। যদিও তারাও যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার। যাহোক, মজার বিষয় হচ্ছে সার্বজনীন ভোটাধিকার পেতে পুরম্নষদেরও সংগ্রাম করতে হয়েছে। ১৮৬৭ সালের আগে সম্পদশালী উচ্চ শিৰিত পুরম্নষরাই শুধু ভোট দিতে পারতেন। নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলন যখন প্রকট রূপ নিয়েছে তখন সরকার ও বিত্তবানদের পৰ থেকে বলা হয়েছিল, পুরম্নষের মতো ধনী উচ্চ শিৰিত নারীদের ভোটাধিকারের বিষয়টিই কেবল বিবেচনা করা যেতে পারে। আসলে আঠারো শতক থেকে বিশ শতক পর্যনত্ম সময় ছিল অধিকার অর্জনের আন্দোলনে ঘটনাবহুল সময়। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রগতিশীল নারী ফ্রন্টের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জামর্ান সমাজতন্ত্রী নেত্রী কারা জেটকিনের নেতৃত্বে ৮ মার্চকে আনত্মজর্াতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর দু'বছর আগে ৮ মার্চ শিকাগো শহরের শ্রমিক নারীরা আট ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে আন্দোলন করলে পুলিশের সঙ্গে রক্তৰয়ী সংঘর্ষ হয়। তাতে বেশ ক'জন নারী শ্রমিক নিহত হন। সেই শ্রমিক নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধানত্ম হয়। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দিনটি রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে পালন করা হতো। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে অনুমোদন দেয়। জাতিসংঘ অনুমোদন দেয়ায় তার নিজেরও কিছু দায়বদ্ধতা এসে যায়। ঘোষিত হয় নারী দশক, রচিত হয় সিডও সনদ, অনুষ্ঠিত হয় নারী সম্মেলন। সবই আনত্মজর্াতিক পরিম-লে। জাতীয় পযর্ায়েও কাজ হয় কিছু কিছু। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য। নতুন রাষ্ট্রের যাত্রা শুরম্নতে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে নারীর অধিকারকে সমান গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে।
চার
এক শ' বছর। তার আগের দু'তিন শ' বছর। এক শ' বছরের পরের বছর। আমরা এগোচ্ছি ...। আন্দোলনে এগোচ্ছি_দলিল দসত্মাবেজে এগোচ্ছি। শুধু একটি প্রশ্ন ছন্নাছাড়া মাছির মতো ঘুরপাক খায়_এ চলা আমাদের জীবনের বাসত্মাবতাকে ছুঁতে পারছে তো? কর্পোরেট ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ভবনের অত্যাধুনিক চেয়ার টেবিলে বসে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো তরম্নণ যখন বিয়ের পূর্বশর্তর্ হিসেবে কন্যার বাবার দেয়া ফ্যাটের চাবি হসত্মানত্মরের দিন গোনে তখন আবার হৈমনত্মীকে মনে পড়ে যায়। "কন্যার বাপ সবুর করিতে পরিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিয়ের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেৰিক গুরম্নত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেই জন্যই তাড়া।" এক শ' বছরের শুরম্নর পাঁচ বছর পরের কাহিনীর সঙ্গে এক শ' বছর পরের কাহিনীর কি নিভর্ুল ঐক্য! শিৰায় যোগ্যতায় সমান পারদর্শী মেয়ের বাবা বিয়েতে মেয়েকে সাজানোর জন্য এক সেট গয়না আর যে ঘরে সে যাবে সে ঘর সাজাতে এক সেট ফার্নিচার দেবেনই। না না যৌতুক নয় ছি ছি! শিৰিত ভদ্রজনেরা যৌতুক দেয় নাকি! এত মেয়েকে বাবার দেয়া উপহার। এ উপহার নিতে শিৰিত মেয়েটিরও কোন আপত্তি নেই। কী হাঁটলাম, কীভাবে হাঁটলাম? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণী পাওয়া মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্রীর বিয়ে হয় 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে লেগেছে' পদ্ধতিতে। তার পর সে মেয়ে স্বামীর হাতে খুন হয়ে ফিরে আসে। স্বামী গুরম্নপাপের লঘুদ- নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ান। তাহলে সত্যিই এ কি জন্মের ঋণ? নারী হয়ে জন্মানোর ৰতিপূরণ? শোপেন হাওয়ার যেমন বলেছেন, " সনত্মানের জন্ম দিয়ে, সনত্মান পালন করে ও স্বামীদের অধীনে থেকেই নারীরা তাদের জীবনের ঋণ পরিশোধ করবে। তাদের ইচ্ছামত মত প্রকাশ করতে দেয়া যায় না।" এক-দু' শ' বছর পর আজও কি বাতাসে দার্শনিক শোপেন হাওয়ারের সেই কথা প্রতিধ্বনি তোলেন? কাকে দুষব ব্যক্তিকে, প্রতিষ্ঠানকে নাকি পদ্ধতিকে। সিস্টেম তৈরি করে ব্যক্তিকে আবার ব্যক্তি প্রভাবিত করে সিস্টেমকে। যারা ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করার কথা বলেছিলেন অবস্থার দুর্বিপাকে আজ তাদের কণ্ঠ ৰীণ। তবে তারা নারীর কাজকে গৃহের চৌহদ্দি থেকে বের করে সামাজিক শ্রমের মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেকথাও ভোলা যায় না। শোপেন হাওয়ারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যারা বলেছিল, নারী বাইরের কাজে গেলে সংসার জীবনে সঙ্কট তৈরি হয়, তাই তাদের ঘরেই থাকা প্রয়োজন, ঘরকন্নাই নারীদের একমাত্র কাজ।" তারাও বিলুপ্ত প্রজাতির কাতারে নিজেদের নাম লেখায়নি। বরং ঝাড়ে বংশে শতগুণ বর্ধিত হয়ে অশরীরীর মতো বিচরণ করছে। তাহলে কি চলাতেই ভুলছিল? দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী না হয়ে একাকি পথ চলার আনন্দ খুঁজে নেয়া হয়েছিল? তাও তো নয়। পথের সাথী হয়েছিলেন অনেকে সেই শুরম্ন থেকে। অনেক বিরোধ থাকার পরও। আজও আছেন চলার সঙ্গী। নইলে একটুও এগোনো সম্ভব হতো না। যেটুকু অর্জন তা যৌথ চলারই ফল। নারী এবং পুরম্নষ দুজনার যৌথ চলাই কেবল এগিয়ে নেবে সামনে এক শ' বছর দু'শ' বছর হাজার বছর। এর কোন বিকল্প নেই।
সরষঁংযধসং৬৭@মসধরষ.পড়স
No comments