চলন্ত বাসে ধর্ষণ- আমরা ক্ষুব্ধ, লজ্জিত, বেদনাহত
নয়াদিলি্লতে 'ভারতকন্যা' যখন চলন্ত বাসে ধর্ষিত হয়েছিলেন, আমরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কারণ, স্থান-কাল-পাত্রভেদে যে কোনো ধর্ষণই কেবল ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে সহিংসতা নয়; প্রকৃতপক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধ।
কিন্তু মানিকগঞ্জেও একইভাবে একজন গার্মেন্টকর্মী ধর্ষিত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভের পাশাপাশি জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁটের বেদনাও যুক্ত হলো। আমরা ক্ষুব্ধ, লজ্জিত ও বেদনাহত। এ ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি সমাজে নারীর চরম নিরাপত্তাহীনতাই নগ্নভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। মানিকগঞ্জের এই অপকর্ম এক অর্থে দিলি্লর ঘটনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ভারতকন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন রাতের বেলা একটি অনিয়মিত বাসে; আর আমাদের 'সেলাই দিদিমণি' একটি নিয়মিত যাত্রীবাহী বাসে উঠে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হলেন। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যও এটা সতর্কতা সংকেত। নানা সীমাবদ্ধতা ও বিড়ম্বনা সত্ত্বেও শিল্প উৎপাদনক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার তরুণীর যে দৃপ্ত পদচারণা_ মানিকগঞ্জের অঘটন সেই সাবলীলতায় বড় আঘাত হয়ে থাকবে। এখন ধর্ষণের শিকার তরুণীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষত ও দহন কত দ্রুত দূর করা যায়, সবার উচিত হবে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় ভিকটিমের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবন আরও দুর্বিষহ হতে দেখি আমরা। এ ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি হওয়া চলবে না। এই দায়িত্ব বিশেষভাবে প্রশাসনের। নারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা মাঝে মধ্যেই সংবাদ শিরোনাম হয়। আলোচ্য ঘটনাটি সেগুলোর নিকৃষ্টতম, সন্দেহ নেই। তবে এর মধ্য দিয়ে গার্মেন্ট কর্মীর কর্মস্থলে যাতায়াতের নিরাপত্তার প্রশ্নটিও আরেকবার উঠল। কারখানার নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা থাকলে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দেশের রফতানি সূচক ঊর্ধ্বমুখী রাখা এই নারীদের নিরাপত্তা জোরদার হতো। ধর্ষক বাসচালক ও তার সহকারী ইতিমধ্যে ধরা পড়ায় এবং নিজেদের দোষ শিকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ায় বিচার কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ হলো বলে ধারণা করা যায়। এখন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই জরুরি। ওই তরুণী যে অবমাননা, নির্যাতন ও আতঙ্কের শিকার হয়েছেন, কেবল তার শাস্তি নয়। আর কেউ যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির দুঃসাহস না পায়, সে জন্যও এই ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার ওপরও জোর দেওয়ার তাগিদ তৈরি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত এই ঘটনার মধ্য দিয়ে। সচেতন নাগরিকই হতে পারে সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে উত্তম প্রহরী। ধর্ষকদের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তা প্রেরণাদায়ক। তারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে এভাবে সোচ্চার থাকবে বলে প্রত্যাশা। এ প্রসঙ্গে আমরা নির্যাতনের শিকার তরুণীটিকে উদ্ধার এবং ধর্ষকদের চিনিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হকার হান্নান মিয়ার সাহসিকতাকে সাধুবাদ জানাই আমরা। সমাজের অন্যরাও যাতে এভাবে দায়িত্বশীল থাকে, সে জন্য তাকে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করা উচিত হবে। এভাবে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মধ্য দিয়েই একটি মানবিক ও লিঙ্গবৈষম্যহীন সমাজের পথে আমাদের অগ্রযাত্রা সহজ হবে।
No comments