খেলাপি ঋণ-সরকার কঠোর না হলে অর্থনীতি বিপদে পড়বে by মইনুল ইসলাম
সংসদে একজন সাংসদের জিজ্ঞাসার জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে ঋণখেলাপির বর্তমান সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজার ৪৩৭। গত ২৫ জুনের পত্রপত্রিকায় ব্যাংকওয়ারি ঋণখেলাপির সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাগুলো নিছকই পরিসংখ্যান।
এগুলো থেকে সমস্যার প্রকৃত গুরুত্ব বোঝা তো যাচ্ছেই না, বরং মনে হতে পারে যে ব্র্যাক ব্যাংক বুঝি খুবই বিপদগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে সর্বোচ্চ ২৯ হাজার ২০৩ খেলাপি ঋণগ্রহীতার কারণে। গভীরে গেলে দেখা যাবে, হয়তো অধিকতর স্বচ্ছতা-সহকারে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালাতে গিয়ে পুনঃতফসিলীকরণের বদ খাসলতটা ব্র্যাক ব্যাংক এখনো ভালোভাবে রপ্ত করতে পারেনি!
অর্থমন্ত্রীর পরিবেশিত ঋণখেলাপি-সংক্রান্ত তথ্য অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ হতো, যদি তিনি ১৯৯৭ সালে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এস এ এম এস কিবরিয়ার সংসদে পেশ করা দুই হাজার ১১৬ স্টার ঋণখেলাপির তালিকার ফরম্যাটটি ব্যবহার করতেন, যাঁদের কাছে ন্যূনপক্ষে এক কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আটকে ছিল। ওই তালিকাটি সমস্যার গভীরে যাওয়ার জন্য অনেক বেশি সহায়ক ছিল। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই, ওই তালিকাটিকে নমুনা কাঠামো (Sampling frame) হিসেবে ব্যবহার করে আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) একদল গবেষককে নিয়ে একটি সাড়া জাগানো গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছিলাম, যে গবেষণা প্রতিবেদনটি অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ২০১০ সালে A profile of Bank Loon Defoult in the Private Sector in Bangladesh শীর্ষক একটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব, বক্ষমান নিবন্ধে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সম্পর্কে যে আলোচনা-বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হবে, তার পেছনে সত্যানুসন্ধানীর নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পাবে, যা অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করবে আমাদের দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের এই দুরারোগ্য ব্যাধিটি মোকাবিলায়।
প্রথমেই জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন, খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করে চলেছে, সেটা ‘অর্ধসত্য’ এবং খণ্ডিত চিত্র। কারণ, প্রকাশিত পরিমাণে চতুরতার সঙ্গে ‘অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ’ বাদ রাখা হচ্ছে বারবার। এটা জনগণের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণার শামিল, যাঁরা অবলোপন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত নন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে মন্দ ঋণ অবলোপন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যে পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো খেলাপি ঋণ বা মন্দ ঋণকে ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করে আলাদা একটি হিসাবের বইয়ে স্থানান্তর করা হয় (এটাকেই বলা হয় রাইট অফ করা)। অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ সঞ্চিতি রাখার বাধ্যবাধকতা থাকার কথা। এই শর্তের কারণে সব ব্যাংক তাদের পাঁচ বছরের পুরোনো মন্দ ঋণের পুরোটা সময়মতো রাইট অফ করতে সমর্থ হয় না, যে সমস্যাকে সঞ্চিতির ঘাটতি (প্রভিশনিং শর্টফল) নামে অভিহিত করা হয়। ২০০২ সাল থেকে বর্তমান ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট কত মন্দ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে এবং ওই অবলোপনকৃত মন্দ ঋণের কত শতাংশ এ পর্যন্ত আদায় করা গেছে, তার কোনো হিসাব এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করছে না বহু দিন ধরে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা বাড়তে বাড়তে পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেই আমার জিজ্ঞাসা, অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ কি খেলাপি ঋণ নয়? কাদের কাছে এত বিপুল খেলাপি ঋণ আটকে রয়েছে, তা জানার অধিকার জনগণের কি নেই? এত বিপুল খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করে যেসব ক্ষমতাবান ‘স্টার ঋণ খেলাপি’ তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসেবে আবারও ক্ষমতা দেখাচ্ছেন, তাঁদের বাংলাদেশ ব্যাংক আড়াল করে চলেছে কী রহস্যজনক কারণে? অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ নিয়ে এই লুকোচুরি আর কত দিন চলবে? এই অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ব্যর্থতার চিত্রটা কেন গোপন করা হচ্ছে? জনগণের আমানত লোপাট করে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী এসব ‘জাতিদ্রোহী ব্যক্তিরা’ আর কত দিন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া পেয়ে যাবেন?
পাঠকদের জানাতে চাই, ব্যাংকগুলোর বর্তমান তারল্যসংকটের জন্য প্রধানত খেলাপি ঋণই দায়ী, যদিও সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ হইচই করছে এবং সমস্যাটার প্রধান দায়ভার সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ঋণখেলাপ করার কালচারকে আড়াল করতে চাইছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাইভেট ব্যাংকগুলো, যেহেতু ব্যাংক আমানতের সিংহভাগটা নিজেদের দখলে নিয়ে গেছে, তাই খেলাপি ঋণ আড়াল করার সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ বারবার পুনঃতফসিলীকরণ এবং নতুন ঋণ মঞ্জুর করে পুরোনো খেলাপি ঋণ ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেওয়া। কিছুদিন আগে জনৈক ফজলুর রহমান ১৩ বার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করাতে সক্ষম হয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কারও চাকরি গেছে কি? ২০০০ সালে যে রহমান ব্রাদার্স, ১৩৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের কারণে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’র মর্যাদা পেয়েছিল, ওই তিন ভ্রাতার বড় ভ্রাতাই হলেন এবারের ফজলুর রহমান। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, তাঁদের খেলাপি ঋণের বড় অংশটাই হয়তো অবলোপন সুবিধা পেয়ে মূল ব্যালেন্স শিট থেকে হারিয়ে গেছে। গত এক যুগেও তাঁদের মতো ‘স্টার ঋণখেলাপিরা’ দোর্দণ্ড প্রতাপে ব্যাংকিং খাতকে লুণ্ঠনের কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে চলেছেন কাদের মদদে? অর্থমন্ত্রী অর্থঋণ আদালতের প্রায় ৩২ হাজার মামলার পরিসংখ্যান দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবছর ব্যাংক ঋণ-সংক্রান্ত কয়টি মামলা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সব কটি ধাপ সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে ব্যাংকের পক্ষে চূড়ান্তভাবে ফয়সালা হচ্ছে, ওই সংখ্যাটি তাঁর জন্য প্রকাশ করা বড়ই বিব্রতকর হবে, চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায়। ঋণখেলাপিদের অর্থের জোর এ দেশের বিচারক, বাদী পক্ষের উকিল, ব্যাংকের আইন শাখা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ—সবাইকে কব্জা করার রেওয়াজ সৃষ্টি করেছে, তাই অর্থঋণ আদালতে মামলা ফয়সালা হলেও উচ্চতর আদালতে প্রায় সব মামলাই আটকে আছে বছরের পর বছর। ১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এ দেশের বিচারব্যবস্থার বেহালদশা ভালোভাবে জানতেন বলেই। তাঁর কথা পাত্তা পায়নি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চালু করা হয়েছিল ‘দেউলিয়া আইন’। কিন্তু গত ১৫ বছরে এ দেশে কাউকে চূড়ান্তভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে কি? মিজানুর রহমান চৌধুরী দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জাতীয় পার্টি থেকে তড়িঘড়ি আওয়ামী লীগে যোগদান করলেন। অতএব, তাঁর বিরুদ্ধে চলমান দেউলিয়া মামলা রহস্যজনকভাবে ঘুমিয়ে পড়ল। এরপর আরও কয়েক বছর মিজান চৌধুরী বেঁচে ছিলেন, কিন্তু মামলাটি আর চালু হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেউলিয়া আইনে রুজু করা মামলাগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো, ওই ঘুম গত ১১ বছরেও আর ভাঙেনি। বরং বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০২ সালে ‘মন্দ ঋণ অবলোপন’ পদ্ধতি চালু করে পুরোনো মন্দ ঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলার সুচারু বন্দোবস্ত চালু করল। ওই পথে গায়েব হয়ে গেল খেলাপি ঋণ ইস্যুটা। অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ গত ১০ বছরে ১০ শতাংশও আদায় হয়নি, চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি। ‘স্টার ঋণখেলাপি’রা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ হজম করে সবাই আবার ‘দরবেশ’ বনে গেছেন! হায়রে বাংলাদেশ!
সে জন্যই বলছি, খেলাপি ঋণ আড়াল করার এই মারাত্মক আত্মঘাতী মোনাফেকি বন্ধ করা হোক। এ দেশের ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতির যে সংখ্যা বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করেছে তার বিপুলাংশই ব্যাংক ঋণ লুটেরা পুঁজিপতি। তাঁরা এ দেশ থেকে বিদেশে নিয়মিতভাবে পুঁজি পাচার করে চলেছেন। তাঁরা শিল্প স্থাপনের নামে ব্যাংক ঋণ বাগিয়ে ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে তা বিদেশে নিয়ে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, ভারত এই ‘পলাতক পুঁজি’র প্রধান গন্তব্য। বাংলাদেশের পুঁজি বিনিয়োজিত হয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা ও ভারতে। ব্যাংক পুঁজি লুণ্ঠন সমাধা করে তাঁরা নজর দিয়েছেন শেয়ারবাজারে, ওটাও লুণ্ঠিত হলো দু-দুবার। আবারও হিড়িক পড়ল ২০১১ সালের পুঁজি পাচারের। টাকার বৈদেশিক বিনিময় হারের মারাত্মক ধস ঘটিয়েছে ওই সর্বশেষ পুঁজি পাচারের হিড়িক।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, স্টার ঋণখেলাপিদের কার্যকরভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে মোকাবিলা করুন। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করে বর্তমান সরকার যেমন একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে, তেমনি সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন-প্রস্তাবিত ‘ঋণখেলাপির বিচার ট্রাইব্যুনাল’ স্থাপন করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন স্টার ঋণখেলাপির সত্যিকার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করুন। তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের ‘খেলাপি ঋণের ক্যানসার’ নিরাময়ের পথ খুলে যাবে। ওই পথেই নিরসন হবে ব্যাংকিং সিস্টেমের তারল্যসংকট। শুধু পরিসংখ্যান আওড়ানো একেবারেই ‘বে-ফজুল’ কাজ হচ্ছে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
অর্থমন্ত্রীর পরিবেশিত ঋণখেলাপি-সংক্রান্ত তথ্য অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ হতো, যদি তিনি ১৯৯৭ সালে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এস এ এম এস কিবরিয়ার সংসদে পেশ করা দুই হাজার ১১৬ স্টার ঋণখেলাপির তালিকার ফরম্যাটটি ব্যবহার করতেন, যাঁদের কাছে ন্যূনপক্ষে এক কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আটকে ছিল। ওই তালিকাটি সমস্যার গভীরে যাওয়ার জন্য অনেক বেশি সহায়ক ছিল। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই, ওই তালিকাটিকে নমুনা কাঠামো (Sampling frame) হিসেবে ব্যবহার করে আমি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) একদল গবেষককে নিয়ে একটি সাড়া জাগানো গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছিলাম, যে গবেষণা প্রতিবেদনটি অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে ২০১০ সালে A profile of Bank Loon Defoult in the Private Sector in Bangladesh শীর্ষক একটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। অতএব, বক্ষমান নিবন্ধে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সম্পর্কে যে আলোচনা-বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হবে, তার পেছনে সত্যানুসন্ধানীর নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পাবে, যা অর্থমন্ত্রীকে সহায়তা করবে আমাদের দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের এই দুরারোগ্য ব্যাধিটি মোকাবিলায়।
প্রথমেই জোর দিয়ে বলা প্রয়োজন, খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করে চলেছে, সেটা ‘অর্ধসত্য’ এবং খণ্ডিত চিত্র। কারণ, প্রকাশিত পরিমাণে চতুরতার সঙ্গে ‘অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ’ বাদ রাখা হচ্ছে বারবার। এটা জনগণের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণার শামিল, যাঁরা অবলোপন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত নন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে মন্দ ঋণ অবলোপন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, যে পদ্ধতি অনুসরণ করে পাঁচ বছরের বেশি পুরোনো খেলাপি ঋণ বা মন্দ ঋণকে ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করে আলাদা একটি হিসাবের বইয়ে স্থানান্তর করা হয় (এটাকেই বলা হয় রাইট অফ করা)। অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ সঞ্চিতি রাখার বাধ্যবাধকতা থাকার কথা। এই শর্তের কারণে সব ব্যাংক তাদের পাঁচ বছরের পুরোনো মন্দ ঋণের পুরোটা সময়মতো রাইট অফ করতে সমর্থ হয় না, যে সমস্যাকে সঞ্চিতির ঘাটতি (প্রভিশনিং শর্টফল) নামে অভিহিত করা হয়। ২০০২ সাল থেকে বর্তমান ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট কত মন্দ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে এবং ওই অবলোপনকৃত মন্দ ঋণের কত শতাংশ এ পর্যন্ত আদায় করা গেছে, তার কোনো হিসাব এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করছে না বহু দিন ধরে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতা বাড়তে বাড়তে পর্বতপ্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেই আমার জিজ্ঞাসা, অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ কি খেলাপি ঋণ নয়? কাদের কাছে এত বিপুল খেলাপি ঋণ আটকে রয়েছে, তা জানার অধিকার জনগণের কি নেই? এত বিপুল খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করে যেসব ক্ষমতাবান ‘স্টার ঋণ খেলাপি’ তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালক হিসেবে আবারও ক্ষমতা দেখাচ্ছেন, তাঁদের বাংলাদেশ ব্যাংক আড়াল করে চলেছে কী রহস্যজনক কারণে? অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ নিয়ে এই লুকোচুরি আর কত দিন চলবে? এই অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ব্যর্থতার চিত্রটা কেন গোপন করা হচ্ছে? জনগণের আমানত লোপাট করে দেওয়ার অপরাধে অপরাধী এসব ‘জাতিদ্রোহী ব্যক্তিরা’ আর কত দিন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া পেয়ে যাবেন?
পাঠকদের জানাতে চাই, ব্যাংকগুলোর বর্তমান তারল্যসংকটের জন্য প্রধানত খেলাপি ঋণই দায়ী, যদিও সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসায়ী সমাজ হইচই করছে এবং সমস্যাটার প্রধান দায়ভার সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের ঋণখেলাপ করার কালচারকে আড়াল করতে চাইছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাইভেট ব্যাংকগুলো, যেহেতু ব্যাংক আমানতের সিংহভাগটা নিজেদের দখলে নিয়ে গেছে, তাই খেলাপি ঋণ আড়াল করার সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে খেলাপি ঋণ বারবার পুনঃতফসিলীকরণ এবং নতুন ঋণ মঞ্জুর করে পুরোনো খেলাপি ঋণ ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নেওয়া। কিছুদিন আগে জনৈক ফজলুর রহমান ১৩ বার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করাতে সক্ষম হয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কারও চাকরি গেছে কি? ২০০০ সালে যে রহমান ব্রাদার্স, ১৩৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের কারণে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’র মর্যাদা পেয়েছিল, ওই তিন ভ্রাতার বড় ভ্রাতাই হলেন এবারের ফজলুর রহমান। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, তাঁদের খেলাপি ঋণের বড় অংশটাই হয়তো অবলোপন সুবিধা পেয়ে মূল ব্যালেন্স শিট থেকে হারিয়ে গেছে। গত এক যুগেও তাঁদের মতো ‘স্টার ঋণখেলাপিরা’ দোর্দণ্ড প্রতাপে ব্যাংকিং খাতকে লুণ্ঠনের কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করে চলেছেন কাদের মদদে? অর্থমন্ত্রী অর্থঋণ আদালতের প্রায় ৩২ হাজার মামলার পরিসংখ্যান দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবছর ব্যাংক ঋণ-সংক্রান্ত কয়টি মামলা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সব কটি ধাপ সাফল্যের সঙ্গে পেরিয়ে ব্যাংকের পক্ষে চূড়ান্তভাবে ফয়সালা হচ্ছে, ওই সংখ্যাটি তাঁর জন্য প্রকাশ করা বড়ই বিব্রতকর হবে, চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায়। ঋণখেলাপিদের অর্থের জোর এ দেশের বিচারক, বাদী পক্ষের উকিল, ব্যাংকের আইন শাখা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ—সবাইকে কব্জা করার রেওয়াজ সৃষ্টি করেছে, তাই অর্থঋণ আদালতে মামলা ফয়সালা হলেও উচ্চতর আদালতে প্রায় সব মামলাই আটকে আছে বছরের পর বছর। ১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এ দেশের বিচারব্যবস্থার বেহালদশা ভালোভাবে জানতেন বলেই। তাঁর কথা পাত্তা পায়নি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চালু করা হয়েছিল ‘দেউলিয়া আইন’। কিন্তু গত ১৫ বছরে এ দেশে কাউকে চূড়ান্তভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়েছে কি? মিজানুর রহমান চৌধুরী দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে জাতীয় পার্টি থেকে তড়িঘড়ি আওয়ামী লীগে যোগদান করলেন। অতএব, তাঁর বিরুদ্ধে চলমান দেউলিয়া মামলা রহস্যজনকভাবে ঘুমিয়ে পড়ল। এরপর আরও কয়েক বছর মিজান চৌধুরী বেঁচে ছিলেন, কিন্তু মামলাটি আর চালু হয়নি। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেউলিয়া আইনে রুজু করা মামলাগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো, ওই ঘুম গত ১১ বছরেও আর ভাঙেনি। বরং বিএনপি-জামায়াত সরকার ২০০২ সালে ‘মন্দ ঋণ অবলোপন’ পদ্ধতি চালু করে পুরোনো মন্দ ঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলার সুচারু বন্দোবস্ত চালু করল। ওই পথে গায়েব হয়ে গেল খেলাপি ঋণ ইস্যুটা। অবলোপনকৃত মন্দ ঋণ গত ১০ বছরে ১০ শতাংশও আদায় হয়নি, চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি। ‘স্টার ঋণখেলাপি’রা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ হজম করে সবাই আবার ‘দরবেশ’ বনে গেছেন! হায়রে বাংলাদেশ!
সে জন্যই বলছি, খেলাপি ঋণ আড়াল করার এই মারাত্মক আত্মঘাতী মোনাফেকি বন্ধ করা হোক। এ দেশের ২৩ হাজার ২১২ জন কোটিপতির যে সংখ্যা বাংলাদেশ ব্যাংক উল্লেখ করেছে তার বিপুলাংশই ব্যাংক ঋণ লুটেরা পুঁজিপতি। তাঁরা এ দেশ থেকে বিদেশে নিয়মিতভাবে পুঁজি পাচার করে চলেছেন। তাঁরা শিল্প স্থাপনের নামে ব্যাংক ঋণ বাগিয়ে ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে তা বিদেশে নিয়ে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, ভারত এই ‘পলাতক পুঁজি’র প্রধান গন্তব্য। বাংলাদেশের পুঁজি বিনিয়োজিত হয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব আফ্রিকা ও ভারতে। ব্যাংক পুঁজি লুণ্ঠন সমাধা করে তাঁরা নজর দিয়েছেন শেয়ারবাজারে, ওটাও লুণ্ঠিত হলো দু-দুবার। আবারও হিড়িক পড়ল ২০১১ সালের পুঁজি পাচারের। টাকার বৈদেশিক বিনিময় হারের মারাত্মক ধস ঘটিয়েছে ওই সর্বশেষ পুঁজি পাচারের হিড়িক।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, স্টার ঋণখেলাপিদের কার্যকরভাবে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে মোকাবিলা করুন। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করে বর্তমান সরকার যেমন একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছে, তেমনি সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন-প্রস্তাবিত ‘ঋণখেলাপির বিচার ট্রাইব্যুনাল’ স্থাপন করে দেশের শীর্ষস্থানীয় ১০০ জন স্টার ঋণখেলাপির সত্যিকার দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করুন। তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের ‘খেলাপি ঋণের ক্যানসার’ নিরাময়ের পথ খুলে যাবে। ওই পথেই নিরসন হবে ব্যাংকিং সিস্টেমের তারল্যসংকট। শুধু পরিসংখ্যান আওড়ানো একেবারেই ‘বে-ফজুল’ কাজ হচ্ছে।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments