বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু by আনোয়ার হোসেন

পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে করা ঋণচুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সরকার এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াও খতিয়ে দেখছে। জানা গেছে, চুক্তি বাতিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের জন্য একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে সেতু বিভাগ।


গত মঙ্গলবার বিকেলে এ-সংক্রান্ত চিঠিতে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সই করেন বলে সূত্র জানায়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়েছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপানি সংস্থা জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি করা হয়েছে আরও ১১৫ কোটি মার্কিন ডলারের। সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার।
জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে করা ঋণচুক্তি বিষয়ে একটি সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গেছে।’ কবে গেছে, এতে কী বলা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নাকি মালয়েশিয়ার টাকায় পদ্মা সেতু হবে, তা এক মাসের মধ্যে জানা যাবে বলেও মন্ত্রী জানান।
চিঠির বিষয়ে জানতে সেতু বিভাগের সচিব খোন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দপ্তরে গেলে তিনি সাক্ষাৎ দিতে রাজি হননি। ফোনে চেষ্টা করা হলে তিনি কোনো কিছু বলতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। তবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা তাঁদেরও মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। আনুষ্ঠানিক চিঠিও দেওয়া হবে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু বিষয়ে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। এতে সেতু বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ইআরডিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রতিনিধিরা ছিলেন। সূত্র জানায়, সভায় পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বিষয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিলের পক্ষে মত দেওয়া হয়। এ সময় পদ্মা সেতু বিষয়ে শুধু মালয়েশিয়ার প্রস্তাবের ওপর নির্ভর না করে অন্য কোনো দেশ আগ্রহী হলে সেটাও বিবেচনায় নেওয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। সূত্র জানায়, ইআরডির পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে আরেকবার আলোচনা করার মত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এতে সায় দেননি।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও ইআরডি সূত্র জানায়, সেতু বিভাগের প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ইআরডিতে পাঠানো হবে। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে আসবে। এরপর সেটি অর্থমন্ত্রী হয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সংস্থাদের কাছে পাঠানো হবে।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিল হলে দাতাদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকার দ্রুত সেতু নির্মাণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হওয়ার কথা দাতাদের জানিয়ে দেওয়ার কৌশলও নিতে পারে বলে জানা গেছে।
বিশ্বব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, তারা এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছ থেকে কোনো তথ্য পায়নি। তারা এখনো আগের অবস্থানেই রয়েছে। অর্থাৎ পদ্মা সেতুর দুর্নীতি নিয়ে কানাডার পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দুর্নীতির অভিযোগেই বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার বাইরে এখন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশের পক্ষ থেকে পদ্মা সেতু করার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসেনি। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনানুষ্ঠানিকভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে। পদ্মা সেতু বিষয়ে বিভিন্ন দেশের আগ্রহ দেখানোর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী রোববার সেতু বিভাগে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক ডাকা হয়েছে।
এদিকে মালয়েশিয়া পদ্মা সেতু বিষয়ে গতকাল একটি খসড়া সমঝোতা স্মারক সেতু বিভাগে পাঠিয়েছে। কূটনৈতিক খামে করে এ খসড়া পাঠানো হয়েছে। গতকাল এ খসড়ার ওপর সেতু বিভাগ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছে।
মালয়েশিয়ার খসড়া: সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সেতু বিভাগ মালয়েশিয়ার সরকারের কাছে দুই পাতার একটি খসড়া সমঝোতা স্মারক পাঠিয়েছিল। কিন্তু সেটা মালয়েশিয়ার সরকার গ্রহণ করেনি। গতকাল মালয়েশিয়া ১০ পাতার একটি খসড়া পাঠিয়েছে সেতু বিভাগে।
চূড়ান্ত সমঝোতা স্মারকে মালয়েশিয়ার পক্ষে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত দাতো সেরি সামি ভেলি এবং বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত স্বাক্ষর করবেন। সমঝোতার পর মালয়েশিয়া একটি কোম্পানি নিয়োগ করবে, যারা প্রকল্পের অর্থ জোগাড় করবে এবং নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। মালয়েশিয়া তাদের প্রস্তাবে আরও বলেছে, দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কারিগরি ও তদারক কমিটি করা হবে। টোল কত হবে, সেতুটি কত বছর মালয়েশিয়ার মালিকানায় থাকবে বিস্তারিত ঠিক করবে ওই দুটি কমিটি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সরকার প্রায় ২১৬ কোটি টাকা খরচ করে একটি নকশা প্রণয়ন করেছে। মালয়েশিয়া তাদের খসড়া সমঝোতা স্মারকে প্রয়োজনে নকশা পরিবর্তন করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে। তবে সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, এতে সরকারের আপত্তি আছে। বিশেষজ্ঞদেরও গতকাল আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে মতামত দিতে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নকশা ঠিক আছে। এটা পরিবর্তন করতে গেলে অনেক সময় ব্যয় হয়ে যাবে।
এদিকে সেতু বিভাগ থেকে পাঠানো খসড়া সমঝোতায় বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে কত টাকা অর্থায়ন করবে মালয়েশিয়া এবং দুই দেশের কারা এটা তদারক করবে, সেটা রাখার প্রস্তাব করা হয়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব মৈত্রী সেতু হয়েছে, অনেকটা সে রকম করতে চেয়েছিল সেতু বিভাগ।
পিপিপি: খসড়া সমঝোতা স্মারকে মালয়েশিয়া বলেছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প তাঁরা নির্মাণ, পরিচালনা, মালিকানা ও হস্তান্তর ভিত্তিতে (বিওওটি) করতে চায়। আর অর্থায়নের পদ্ধতি হবে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগ (পিপিপি)।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, পিপিপিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে প্রথমে এ প্রকল্পটি অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে তালিকাভুক্ত করে অনুমোদন করতে হয়। এরপর বিনিয়োগকারীদের প্রাকেযাগ্যতা যাচাই দরপত্র আহ্বান করে সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করতে হয়। সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাবে সবচেয়ে যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার ক্ষেত্রে এটা করা হচ্ছে না।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, এ প্রক্রিয়া এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার সরকারকে এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করছে সরকার। এ জন্যই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হচ্ছে মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের।

No comments

Powered by Blogger.