শিক্ষা : সাফল্য ও বাজেট বরাদ্দ by ড. মিল্টন বিশ্বাস
যথার্থ ও ভারসাম্যময় শিক্ষাপদ্ধতি একটি দেশের অগ্রগতির চালিকাশক্তি। এ জন্য শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সম্পৃক্ত। বর্তমান সরকারের আমলে প্রণীত 'জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০' আমাদের সহায়তা করছে মঙ্গলময় কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত হতে। ধাপে ধাপে এ নীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এ শতাব্দীতে শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতি তার প্রাত্যহিক জীবন চিন্তা করতে পারে না। শিক্ষাই কেবল তার বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াকে সহজতর করে তুলতে পারে। এ জন্য শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতির নতুন আবিষ্কার এবং প্রয়োগ দেশের জাতীয় বাজেটের একটি অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দে এসব ভাবনার প্রতিফলন দেখা গেল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার কর্মকাণ্ড শুরু করে। এখন ২০১২ সাল। এই দীর্ঘ চার দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, পাল্টে গেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চিন্তাচেতনা। পাকিস্তান আমলে শিক্ষাপদ্ধতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করেছিল। একাধিক শিক্ষা প্রণালি ছিল এর মূল কারণ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে 'কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন'-এর রিপোর্টে এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানারূপ বৈষম্য অবসানের কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পাকিস্তানের পুরনো ভূত ভর করে। ১৯৭৩ সালে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তারও মৃত্যু ঘটে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসকদের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে। বঙ্গবন্ধুর আমলে শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া হয়; ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির পিতার আদর্শের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের আমলে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়ায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যে সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার যে কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নেও বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা; শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলা। অঙ্গীকার পূরণে কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। ৩১ হাজার ২০৮টি সরকারি, রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ৬৩ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের চাকরির মর্যাদা তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। বছরে ৭৮ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, দাখিল ও ইবতেদায়ি স্তরের শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনেই বিনা মূল্যে ২২ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৩টি পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে। রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা স্কেলের প্রারম্ভিক ১০০ শতাংশ প্রদান করা হচ্ছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার সরকারি ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ৫০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়াসহ ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে জাতির পিতা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও জাতীয় বীরদের সঠিক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভর্তি সংকট সমাধানে ঢাকায় ১১টি মাধ্যমিক স্কুল ও ছয়টি কলেজ নির্মাণের কাজ চলছে। ১০০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শিক্ষা কোর্স ও ৩১টি মাদ্রাসায় চারটি করে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। যুগান্তকারী এসব উদ্যোগ চার দশকের বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্রে অনন্য সংযোজন ও ব্যতিক্রমী সাফল্য। ২৬ মে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেল, গাজীপুর সদরের গাছা ইউনিয়নের কুনিয়াপাছর গ্রামের বড়বাড়িতে শুরু হওয়া দেশের প্রথম অনলাইন স্কুলে শিশুদের পাঠদান করছেন ঢাকার এক শিক্ষক। রেডিও লিংকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সাহায্যে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পাচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। মহাজোট সরকারের আমলে ডিজিটাল বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম দৃশ্যই সর্বত্র দেখা যাচ্ছে; বিস্তৃত হচ্ছে এর পরিধিও।
ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন ২০২১ সফল করার জন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে। এটি ছিল নির্বাচনী অঙ্গীকারের অংশ। শিক্ষাকে তথ্য-প্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে একীভূত করার লক্ষ্যে বাজেটে ১০০-২০০ কোটি টাকা আইসিটি সেক্টরে বরাদ্দ ছিল বৈপ্লবিক। অর্থাৎ প্রথম বাজেট তথ্য-প্রযুক্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে উপস্থাপিত হয়েছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৩.৫ শতাংশে উত্তীর্ণ হয়। ১৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত ছিল অভিনন্দনযোগ্য। ৪০ হাজার ক্লাসরুম তৈরির প্রকল্পও ছিল সেই বাজেটে। ৭৮.১৭ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকার বাজেট ছিল পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে বেশি। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাত মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ২২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে মোট বরাদ্দের ১১.৫ শতাংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি বাজেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরে দ্বিগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলতি অর্থবছরে যেখানে এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে আগামী অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একই খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে দুই হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। একই অবস্থা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আগামী অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একই খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে চার হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ৩১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল, যা ছিল বাজেটের ৭.১ শতাংশ। দূরদর্শী সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা। দিন বদলের ইশতেহার, রূপকল্প ২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শেষ বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দও দূরদর্শী ও বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করছে। তবে 'বুয়েট আবার অশান্ত করতে তৎপর কয়েক শিক্ষক নেতা। নেপথ্যে মদদ দিচ্ছে জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ হিযবুত, অর্থ জোগাচ্ছে বাইরের শক্তি।' গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ৮ জুন প্রকাশিত এই সংবাদটি উদ্বেগের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সংকটে ফেলে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা রুখে দিতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করা, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির ইন্ধনদাতা জামায়াত-বিএনপি চক্রের অভাব নেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
email : writermiltonbiswas@gmail.com
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশের প্রথম সরকার কর্মকাণ্ড শুরু করে। এখন ২০১২ সাল। এই দীর্ঘ চার দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে, পাল্টে গেছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে মানুষের চিন্তাচেতনা। পাকিস্তান আমলে শিক্ষাপদ্ধতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য তৈরি করেছিল। একাধিক শিক্ষা প্রণালি ছিল এর মূল কারণ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে 'কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন'-এর রিপোর্টে এ দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান নানারূপ বৈষম্য অবসানের কথা উল্লেখ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পাকিস্তানের পুরনো ভূত ভর করে। ১৯৭৩ সালে চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তারও মৃত্যু ঘটে পঁচাত্তর-পরবর্তী স্বৈরশাসকদের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলে। বঙ্গবন্ধুর আমলে শিক্ষকদের সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দেওয়া হয়; ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতির পিতার আদর্শের ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের আমলে একটি শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়ায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের লক্ষ্যে সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার যে কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নেও বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করা; শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলা। অঙ্গীকার পূরণে কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। ৩১ হাজার ২০৮টি সরকারি, রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। ঝরে পড়া শিশুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য প্রায় ৬৩ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের চাকরির মর্যাদা তৃতীয় শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। বছরে ৭৮ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কারিগরি, দাখিল ও ইবতেদায়ি স্তরের শিক্ষার্থীদের বছরের প্রথম দিনেই বিনা মূল্যে ২২ কোটি ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৩টি পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে। রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা স্কেলের প্রারম্ভিক ১০০ শতাংশ প্রদান করা হচ্ছে। প্রায় সাড়ে চার হাজার সরকারি ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ৫০৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়াসহ ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে জাতির পিতা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও জাতীয় বীরদের সঠিক ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভর্তি সংকট সমাধানে ঢাকায় ১১টি মাধ্যমিক স্কুল ও ছয়টি কলেজ নির্মাণের কাজ চলছে। ১০০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল শিক্ষা কোর্স ও ৩১টি মাদ্রাসায় চারটি করে অনার্স কোর্স চালু হয়েছে। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। যুগান্তকারী এসব উদ্যোগ চার দশকের বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্রে অনন্য সংযোজন ও ব্যতিক্রমী সাফল্য। ২৬ মে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেল, গাজীপুর সদরের গাছা ইউনিয়নের কুনিয়াপাছর গ্রামের বড়বাড়িতে শুরু হওয়া দেশের প্রথম অনলাইন স্কুলে শিশুদের পাঠদান করছেন ঢাকার এক শিক্ষক। রেডিও লিংকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সাহায্যে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পাচ্ছে মানসম্মত শিক্ষা। মহাজোট সরকারের আমলে ডিজিটাল বাংলাদেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে এ রকম দৃশ্যই সর্বত্র দেখা যাচ্ছে; বিস্তৃত হচ্ছে এর পরিধিও।
ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯-১০ অর্থবছরে ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন ২০২১ সফল করার জন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে। এটি ছিল নির্বাচনী অঙ্গীকারের অংশ। শিক্ষাকে তথ্য-প্রযুক্তি প্রসারের সঙ্গে একীভূত করার লক্ষ্যে বাজেটে ১০০-২০০ কোটি টাকা আইসিটি সেক্টরে বরাদ্দ ছিল বৈপ্লবিক। অর্থাৎ প্রথম বাজেট তথ্য-প্রযুক্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে উপস্থাপিত হয়েছিল। ২০১০-১১ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ১৩.৫ শতাংশে উত্তীর্ণ হয়। ১৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত ছিল অভিনন্দনযোগ্য। ৪০ হাজার ক্লাসরুম তৈরির প্রকল্পও ছিল সেই বাজেটে। ৭৮.১৭ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকার বাজেট ছিল পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে বেশি। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাত মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ২২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব খাতে চলতি অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে মোট বরাদ্দের ১১.৫ শতাংশ শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি বাজেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরে দ্বিগুণ বেড়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলতি অর্থবছরে যেখানে এক হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেখানে আগামী অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একই খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে দুই হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। একই অবস্থা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। আগামী অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একই খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে চার হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ৩১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছিল, যা ছিল বাজেটের ৭.১ শতাংশ। দূরদর্শী সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা। দিন বদলের ইশতেহার, রূপকল্প ২০২১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শেষ বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দও দূরদর্শী ও বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করছে। তবে 'বুয়েট আবার অশান্ত করতে তৎপর কয়েক শিক্ষক নেতা। নেপথ্যে মদদ দিচ্ছে জামায়াত-শিবির ও নিষিদ্ধ হিযবুত, অর্থ জোগাচ্ছে বাইরের শক্তি।' গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ৮ জুন প্রকাশিত এই সংবাদটি উদ্বেগের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সংকটে ফেলে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা রুখে দিতে হবে এখনই। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভালো ফল করা, শিক্ষার মান বৃদ্ধি, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির ইন্ধনদাতা জামায়াত-বিএনপি চক্রের অভাব নেই।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
email : writermiltonbiswas@gmail.com
No comments