সৌরম-লের আধুনিক দুই গ্রহ by নাদিরা মজুমদার
সৌরম-লের সপ্তম ও অষ্টম গ্রহ ইউরেনাস ও নেপচুনকে ইতিহাসগতভাবে আধুনিক গ্রহও বলা হয়। কারণ, এদের খোঁজখবর আমরা জানতে পারি আধুনিককালে।
এই গ্রহ দুটো আবার আট সদস্যের সৌরম-লের সর্বশেষ গ্রহও বটে। ইউরেনাস ও নেপচুনের মধ্যে মিল ও অমিল দুই-ই রয়েছে; এমনকি বাকি ছয়টি গ্রহের সঙ্গেও যথেষ্ট অমিল দেখা যায়। কারণ অবশ্য কিছু রয়েছে। দুই গ্রহকে ঘিরে বিদ্যমান বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব না পেলে তার সমাধানও হচ্ছে না তাই।সপ্তম গ্রহ ইউরেনাসের কথাই ধরা যাক। প্রাচীন গ্রিসের স্বর্গদেব ছিলেন ইউরেনাস; এমনকি পৌরাণিক যুগের প্রথম দিকে ক্ষমতাবান দেবতার মর্যাদাটিও তাকে দেয়া হয়েছিল। টেলিস্কোপের সাহায্যে তন্নতন্ন করে রাতের আকাশ খুঁজতে খুঁজতে জ্যোতির্বিদ উইলিয়াম হের্শেল ইউরেনাসের প্রথম খোঁজ পান। ফলে আবিষ্কার হয় প্রথম আধুনিক একটি গ্রহের; ১৭৮১ সালের ১৩ মার্চ ছিল সেদিন। এর আগে আর কেউ যে ইউরেনাসকে আকাশে দেখেনি, তা নয় কিন্তু। দেখেছেন! তবে তারা সবাই তাকে আরেকটি তারকা মনে করে স্রেফ অগ্রাহ্য করেছেন। যেমনÑ১৬৯০ সালে জন ফ্ল্যামস্টিভ ইউরেনাসকে তারকার মর্যাদা দিয়ে ‘৩৪ টাউরি’ নামে তাকে ক্যাটালগবদ্ধ করেন।
সে যা হোক, ইংল্যান্ডের রাজা তখন সম্রাট তৃতীয় জর্জ এবং হের্শেলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক তিনি। হের্শেল তাই আধুনিক গ্রহটির নাম দেন ‘গিয়োর্দিয়ুম সিডুস’ বা জর্জীয় গ্রহ। ইংরেজ উপনিবেশ থেকে মাত্র বছর কয় আগে স্বাধীনতা পাওয়া আমেরিকানদের নামটি মোটেই পছন্দ হয় না। তারা তাই নাম দেয় ‘হের্শেল’। এভাবে দুই নাম নিয়ে একটি গ্রহ ১৮৫০ সাল পর্যন্ত পরিচিত হতে থাকে। কিন্তু প্রথাগত রীতিমাফিক গ্রহের নামকরণ হতে হয় চিরায়ত পৌরাণিক নামানুসারে। এই রীতিরই দস্তুর বজায় রাখতে জ্যোতির্বিদ বোর্ড ‘ইউরেনাস’ নামটির প্রস্তাব করেন এবং ১৮৫০ সালে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীতও হয়। হের্শেলের মৃত্যু হয় ১৮২২ সালে, তাই তিনি তাঁর জর্জীয় গ্রহের নতুন নামটি জেনে যেতে পারেননি।
যে পথ ধরে যাকে কক্ষপথ বলা হয়, ইউরেনাস সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, সূর্য থেকে তার সেই পথের দূরত্ব কমছে কম ২৮৭০৯৯০০০০ কিলোমিটার (বা ১৯২১৮ এস্ট্রনমিক্যাল ইউনিক) তো হবেই। দূরত্বটি বাস্তবিকই সুবিশাল; সৌরম-লের সুদূর প্রান্ত আরকি! এত দূরে কে কবে যাবে! তা সত্ত্বেও সুখবর একটি সৃষ্টি হয়েছে ঠিকই। এই মুহূর্ত পর্যন্ত একমাত্র মহাযান হিসেবে ভয়েজার-২ ১৯৮৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ইউরেনাসকে দর্শন করে। আর এই দর্শনকালেই ভয়েজার-২ ইউরেনাসের কিছু কিছু ‘অস্বাভাবিক’ আচরণও দেখে ফেলে। যেমন-সৌরম-লের সব গ্রহই সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসছে; ইউরেনাসও ঘুরছে, তাতে কোন ব্যতিক্রম নেই। সব গ্রহের মতো সেও সূর্যকে প্রদক্ষিণের সময় নিজের অক্ষের চারদিকে বনবন করে ঘুরছে। এটিও ব্যতিক্রমহীন আচার। তবে সৌরম-লের অধিকাংশ গ্রহই যখন নিজের অক্ষ ধরে ঘোরার সময় সূর্যের পরিভ্রমণ পথ (ইক্লিপটিক) বরাবর প্রায় উল্লম্বভাবে অবস্থান করে, ইউরেনাস কিন্তু তা করছে না। সে বরং নিজের অক্ষের চারদিকে ঘোরার সময় ইক্লিপটিকের সঙ্গে প্রায় সমান্তরালে অবস্থান করছে। ব্যতিক্রম এখানেই।
ভয়েজার-২ আরও দেখে যে ইউরেনাসের দক্ষিণ মেরু প্রায় সরাসরি সূর্যের দিকে মুখ করে রয়েছে। এমনতর আচরণের কারণে ইউরেনাসের বিষুবরেখা বরাবর এলাকার তুলনায় মেরু অঞ্চল অধিক পরিমাণে সৌরশক্তি পাচ্ছে। অথচ তা সত্ত্বেও তার বিষুব এলাকা মেরু এলাকার চেয়ে উষ্ণতর। কোন কার্যপদ্ধতির জন্য এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, জানা নেই আমাদের। এটিও একটি ব্যতিক্রম।
প্রকৃতপক্ষে, ইউরেনাসের দুই মেরুর মধ্যে কোনটি আসলে উত্তর মেরুÑএই নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বেশ বাকবিত-া অব্যাহত রয়েছে। আরেকভাবে বলতে হয় যে, গ্রহটির অক্ষরেখা ৯০ ডিগ্রীর সামান্য বেশি পরিমাণে ঝুঁকে থাকার কারণে সরাসরি ঘূর্ণন হচ্ছে, নাকি অক্ষরেখা ৯০ ডিগ্রীর সামান্য কম পরিমাণে ঝুঁকে রয়েছে বলে পশ্চাৎমুখী (রেট্রোগ্রেইড) ঘূর্ণন হচ্ছেÑপ্রশ্নের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত উত্তর মেরুর সঠিক শনাক্তকরণ অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে। শুক্র গ্রহটির বেলায় অক্ষরেখা প্রায় ১৮০ ডিগ্রী পরিমাণ ঝুঁকে থাকায় তার পশ্চাৎমুখী ঘূর্ণন বা রেট্রোগ্রেইডের মীমাংসা প্রায় বিতর্কবিহীনভাবে হয়ে যায়। ইউরেনাস-বিতর্ক কবে শেষ হবে কে জানে? ইউরেনাস প্রধানত শিলা এবং নানা ধরনের হিম বরফের উপাদানে গঠিত। তবে তাতে হাইড্রোজেনের পরিমাণ মাত্র পনেরো শতাংশ, আর হিলিয়ামের পরিমাণ আরও কম। কিন্তু বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের গঠন-উপাদানের অধিকাংশই হাইড্রোজেন। এই দুই বড় সাইজের গ্যাসীয় গ্রহের সঙ্গে ইউরেনাসের পার্থক্য এখানেই। অথচ আবার ইউরেনাসের (এবং এমনকি নেপচুনের) কেন্দ্রÑযাকে ফোর বা মর্মবস্তু বলা হয়Ñতার সঙ্গে বৃহস্পতি ও শনির মর্মবস্তুর খুবই মিল রয়েছে। পার্থক্য কেবল যে, এদের মতো এই দুই আধুনিক গ্রহের তরল ধাতব হাইড্রোজেনের বিশাল কোন সমন্বয় নেই। এবং মনে হয় যে, বৃহস্পতি ও শনির মতো ইউরেনাসের মর্মবস্তুও শিলাময় নয়, বরং কমবেশি সুষমভাবে বণ্টিত অবস্থায় রয়েছে। ইউরেনাসের বায়ুম-লটিতে রয়েছে প্রায় ৮৩ শতাংশ হাইড্রোজেন, প্রায় ১৫ শতাংশ হিলিয়াম আর বাকি দুই শতাংশ মিথেন।
আর সব গ্যাসীয় গ্রহের মতোই ইউরেনাসকে ঘিরেও রয়েছে ঘন মেঘের বন্ধনী। কিন্তু তারা খুবই অস্বচ্ছ, অস্পষ্ট; তবে ভয়েজার-২-এর ক্যামেরা তাদের ছবি ঠিকই তুলতে সক্ষম হয়। সম্প্রতি হাবল স্পেস টেলিস্কোপও (এইচএসটি) ইউরেনাসকে ঘিরে থাকা আঁকাবাঁকা ডোরাকাটা সুন্দর প্রাণবন্ত বন্ধনীর ছবি তুলেছে। ফলে, আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে ভয়েজার-২ যে আকর্ষণহীন এক ইউরেনাসকে দেখে, আসলে সে তা নয়!
এইচএসটি ও ভয়েজার-২-এর ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, মৌসুমি প্রভাব ইউরেনাসকে তীব্রভাবে প্রভাবান্বিত করছে। যেমনÑসূর্য যখন ইউরেনীয় অক্ষাংশের নিম্নাংশে চলে আসে, তখন হয়তো ইউরেনীয় দিন-রাত্রি আবহাওয়ার ওপরে আরও জোরালো প্রভাব ফেলে থাকে। ২০০৭ সালে, সূর্য যখন সরাসরি ইউরেনাসের বিষুবরেখার ওপরে চলে এসেছিল, তখন গ্রহটি সম্বদ্ধে আরও বেশ কিছু আমরা জানতে পারি।
ইউরেনাসের উচ্চতর বায়ুম-লে যে মিথেন গ্যাস রয়েছে, তা লাল আলো শোষণ করে নেয়। তাই ইউরেনাসের বর্ণ নীল রঙের। হয়তো বা বৃহস্পতির মতোই তারও রয়েছে রঙিন বন্ধনী, তবে মিথেনের অসংখ্য স্তরের নিচে লুকিয়ে পড়াতে দেখা যায় না তাদের। আবার শনির মতো তার বন্ধনীগুলোও বেশ বড়সড় আকারের কণিকা থেকে শুরু করে অতি মিহি ধুলোর কণিকা দিয়ে তৈরি। ইউরেনাসকে ঘিরে রয়েছে এমন অন্তত ১৩টি বন্ধনীর কথা আমরা জানি। তারা সবাই-ই অত্যন্ত অস্পষ্ট, অস্বচ্ছ এবং সব অস্বচ্ছের মধ্যে সবচেয়ে কম অস্বচ্ছ বন্ধনীটির নাম দেয়া হয়েছে “এপসাইলন রিং”। এ পর্যন্ত শনি ছিল আমাদের জানা প্রথম বন্ধনীধারী গ্রহ, এবং ফলে, সে অদ্ভুত, স্বতন্ত্র গ্রহের পরিচিতি পায়। কিন্তু ইউরেনাসের বন্ধনী আবিষ্কার হওয়াতে ভালোই হয়Ñশনির অদ্ভুত পরিচিতি ঘুচে যায়, আর আমরাও বুঝতে পারছি যে গ্রহের বন্ধনী থাকাটা অদ্ভুত, স্বতন্ত্র কোন ব্যাপার নয়, রবং থাকাটাই স্বাভাবিক।
ভয়েজার-২-এর ইউরেনাস দর্শনের আগেই বড় সাইজের পাঁচটি ইউরেনীয় উপগ্রহের কথা আমরা জানতাম। ভয়েজার-২ আরও বাড়তি এগারোটি ছোট্টমাপের গাঢ় রঙের উপগ্রহের হদিস পায়। পরবর্তীকালে, আরও কয়েকটি নতুন উপগ্রহ আবিষ্কার হয়। তবে তারা বেশ দূরে দূরে অবস্থান করছে। ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন উপগ্রহ যদি আবিষ্কার হয় তো অবাক হওয়ার কিছু নেই এক অর্থে, ইউরেনাসের উপগ্রহগুলোকে তিনটি সুস্পষ্ট শ্রেণীতেও তাই শ্রেণীবদ্ধ করা চলে। আমাদের সৌরম-লের মহাজাগতিক বাস্তব নামকরণ ও পরিচিতি চিরায়ত পুরাণ থেকে দেয়ার প্রথাগত রীতি চালু থাকলেও, ইউরেনাসের উপগ্রহগুলোর নামকরণে কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা যায়। উইলিয়াম শেক্সপিয়র ও আলেকজান্ডার পোপের সাহিত্যকর্মে বর্ণিত চরিতের নাম দেয়া হচ্ছে ইউরেনাসের উপগ্রহগুলোকে। বিরল ব্যতিক্রমই বটে। হতে পারে যে, ‘জর্জীয় গ্রহ’ তথা ইউরেনাসের আবিষ্কারক ইংরেজ জ্যোতর্বিদ উইলিয়াম হেলেন হওয়াতে নিজের পক্ষে উপগ্রহের নামকরণে ব্যতিক্রমটি মেনে নেয়া হয়।
সে যা হোক! ইউরেনাসের স্বাভাবগত আচরণের আরেকটি বিশেষত্ব হলো যে, তার চুম্বকীয় ক্ষেত্রটি নিজের কেন্দ্রবিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয়নি, বরং ঘূর্ণন অক্ষের বিবেচনায় প্রায় ৬০ ডিগ্রী ঝুঁকে রয়েছে। আপাত এমন অদ্ভুত আচরণের জন্য বোধ করিবা ইউরেনাসের অগভীর ঘনত্ব দায়ী। মহাকাশের সুদূর দূরে থাকলেও, পরিষ্কার স্বচ্ছ আকাশে ইউরেনাসকে কখনওবা খালি চোখেও দেখা সম্ভব। তবে মহাকাশের কোনদিকে তাকাতে হবে, আগে থেকে তা জেনে নিতে হবে। (চলবে)
No comments