সিডনির মেলব্যাগ- যুদ্ধাপরাধের শাস্তি ও ওডারল্যান্ডের দেশে প্রশান্তি
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা একাত্তরের আবেগকে অনেকেই বায়বীয় বলে উড়িয়ে দেন। অনেকে ভাবেন সময়ের সাথে সাথে চেতনাও পুরনো হয়ে যায়। একশ্রেণীর উন্নাসিক ও বদ বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে খাটো করতেও দ্বিধান্বিত নয়।
তাঁদের অপপ্রচারে মনে হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ ধূলিধূসর কোন পা-ুলিপি, জীবনের তাকে তুলে রাখা কোন প্রাচীন বই। এরা ভুলে যায় ইতিহাসেরও অদৃশ্য দুটো চোখ আছে। মর্মভেদী সে দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারেনি বলেই হিটলারের মতো শয়তানকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছিল। মানবতা, জীবন ও নারী শক্তির প্রতি অসম্মান বা অশ্রদ্ধা কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি, বলবেও না। জ্ঞানপাপীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও হত্যাকা- নিয়ে পানি ঘোলা করলেও সময় বসে থাকেনি। সময়ের ছুরিতে শান দেয়া চেতনা যে একদিন জ্বলে উঠতে পারে তারই প্রমাণ দিচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।আমরা প্রবাসী। প্রবাস জীবন ও বাংলাদেশের জীবনে অনেক দূরত্ব। মিডিয়া ও প্রযুক্তি নিরন্তর তা ঘোচানোর কাজে ব্যস্ত থাকলেও দূরত্ব ঘুচে যায়নি। তবে কমে এসেছে। টিভি চ্যানেল, কম্পিউটার, নানা আকাশ বাহনে স্বদেশ আজ বিদেশের ঘরে ঘরে জাগ্রত। তারপরও অন্ধের ঠুলি যায়নি। সিডনির সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী বিশেষত তরুণ তরুণীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কঠিন মতামত রাখলেও অগ্রজ বা আমাদের সমান বয়সীদের ভেতর মতপার্থক্য ও দ্বিধা দেখেছি। একদল তো মনে করে জামায়াত কোন অন্যায়ই করেনি। গণতান্ত্রিক বিশ্বে বসবাস করার পরও এরা অন্ধ। এর মূল কারণ ধর্ম বা প্রচলিত সংস্কার বোধ। অজ্ঞাত কারণে পবিত্র ইসলাম ও একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের সমার্থক করার প্রচেষ্টা চলে আসছে দীর্ঘকাল। ধর্মের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য, পবিত্রতা, নারীর প্রতি সম্মান, সর্বজীবে দয়া ভুলে মানুষকে পাকিস্তান প্রেমে উদ্বুদ্ধকারীদের এরা ত্রাতা মনে করে। আরেক দল বছরের পর বছর অপপ্রক্রিয়া, ইতিহাস বিকৃতি আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাসনের কুপ্রভাবে ধরেই নিয়েছিল আর যাই হোক যুদ্ধাপরাধীদের দ-িত হবার কোন সুযোগ নেই, বিচার হবেও না কোন দিন। কিন্তু সময় মুখ লুকিয়ে হেসেছিল। মুখ লুকিয়ে হেসেছিল শহীদের আত্মা, ধর্ষিতের হৃদয় ও বাংলাদেশ।
সন্দেহপ্রবণ বা সংশয়বাদীদের দোষ ধরি না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানিয়ে ফেলেছিল ঘাতক দালালরা। বিএনপিকে সামনে রেখে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসিয়ে চেতনা ও দেশের বারোটা বাজানোর সাক্ষী যে প্রজন্ম তার ভেতর সন্দেহ থাকবেই। এক সময় এটাও মনে হয়েছিল সত্যি বুঝি বিচার হবে না, সাজাহীন থেকে যাবে বাংলা, বাঙালীর দুশমন।
অস্ট্রেলিয়ার সুধী বাঙালী মহলের পাশাপাশি শ্বেতাঙ্গদের ভেতরও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কৌতূহল আছে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক হলেন প্রয়াত ওডারল্যান্ড। সম্মুখ সমরে জানবাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করার নেপথ্য নায়ক। সুদূর পার্থে চিরনিদ্রায় শায়িত এই বীর প্রতীকের সাথে কয়েকবার কথা হয়েছিল আমার। তীব্র ক্ষোভ আর নিন্দায় ফেটে পড়তেন। তাঁর আপত্তি ছিল দুটোÑপ্রথমত, বঙ্গবন্ধুর মতো জাতির জনক বা মহান নেতাকে হত্যা, দ্বিতীয়ত, রাজাকার পুনর্বাসন। এ বিষয়ে লন্ডন প্রবাসী মিডিয়া ভুবনের খ্যাতিমান এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিককেও ইন্টারভিউ করেছিলাম। মেলবোর্ন এজ পত্রিকার এই সাংবাদিক একাত্তরের ষোল ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার সাক্ষী। ভদ্রলোক এখনও হাসপাতালে কিনা জানি না। তবে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায়ও কথা বলেছিলেন। ব্রুস উইলসন প্রচ- শ্লেষ আর ব্যঙ্গ নিয়ে কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘মানবতার শত্রু, বাংলাদেশের রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীরা একদিন টের পাবে, ক্ষমতা কাকে বলে।’ খুব আশ্চর্য করে জানিয়েছিলেন তিনি বাংলার মাটি ও মানুষকে চেনেন, চেনেন বলেই আস্থা হারাতে রাজি নন। এমন কথা ওডারল্যান্ডের মুখেও শুনেছিলাম। প্রত্যয় বা আশার কথা শুনতে কার না ভাল লাগে। ভাল লাগার সে গল্প মেলব্যাগের মাধ্যমে জনগণকেও জানানো হয়েছিল, কিন্তু সন্দেহ যায়নি। আজ ওডারল্যান্ড প্রয়াত, ব্রুস উইলসনও হয়তো বেঁচে নেই। সময় আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এঁরা অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধারা যা ভাবেন বা চিন্তা করেন তা কখনও ব্যর্থ হয় না। হয় না এই কারণে, মূলত দেশ ও মানুষের প্রতি ভালবাসাই ধর্ম, যে কোন ধর্মের মূল কথাই হচ্ছে দেশপ্রেম।
ফলে আজ এটা প্রমাণিত বাংলাদেশে বসবাসকারী পাকিস্তানপন্থীরা ছাড় পাবে না। বিশেষত যারা একাত্তরে ধর্ষণ, হত্যা ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। বাকিদের বেলায় সহাবস্থান ও একত্রিত দেশাত্মবোধের উদ্বোধনও তাই জরুরী। যুদ্ধাপরাধীদের সাজা ও শাস্তি যেন হিংসাকে উস্কে না দেয়। যে প্রজন্ম একাত্তর দেখেনি বা জন্মায়নি তাদের কোন দোষ নেই, তাদের আমাদের সাথে নিয়েই চলতে হবে। চলতে হবে তাদের সাথেও যারা আগুনে পুড়ে বাংলাদেশী হয়ে উঠেছেন।
বাচ্চু রাজাকারের দ-াদেশ ওডারল্যান্ডের দেশেও স্বস্তি আর ন্যায্যতার ছায়া ফেলেছে। এ যেন দীর্ঘকাল পর দেশের মুখে উজ্জ্বল এক প্রসন্ন হাসি। একে ধরে রাখতেই হবে।
No comments