দেশে ক্রমবর্ধমান হারে বেকারত্ব বাড়লেও উদ্বেগ নেই সরকারের by জাহিদুল ইসলাম
দেশে প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখের বেশি লোক কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাত্রলীগের কিছু কর্মীকে সরকারি চাকরি দেয়া হলেও বেসরকারি খাতে এ সময়ে উল্লেখযোগ্য কোনো নতুন কর্ম সৃষ্টি হয়নি।
বিভিন্ন সঙ্কটে বেসরকারি খাতে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় দেশে মাত্র ২৬ লাখ লোক বেকার রয়েছে বলে দাবি করছে সরকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত সর্বশেষ ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০’ (এলএফএস) অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬ লাখ। এ হিসেবে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র সাড়ে চার শতাংশ লোক বেকার রয়েছে। তিন বছর আগের জরিপে দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২১ লাখ এবং বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিবিএস ২০১০ সালের এপ্রিল ও মে মাসে এই জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের ফলাফল কিছুদিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে বিবিএস।
তবে বেকারের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন সমস্যা বিরাজ করায় বিপুলসংখ্যক লোক বেকার হয়ে গেছে। দেশে বর্তমানে তিন কোটির বেশি লোক বেকার রয়েছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই সরকারের। ২ কোটি ৮০ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানে ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে তা ভুলে গেছে। সরকারি চাকরিতে সীমিতসংখ্যক নিয়োগ দেয়া হলেও শাসক দলীয়করণ ও রাজনৈতিক বিভিন্ন রকমের কোটার কারণে সাধারণ লোকজন এর সুফল পায়নি।
অন্যদিকে তাছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের চরম সঙ্কট, ফার্নেস অয়েলসহ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতে তীব্র তারল্য সঙ্কট ও সুদের হার বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এ সময়ে বেসরকারি খাতে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। এ অবস্থায় বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রদান করছে সরকার।
জরিপের প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী কৃষিখাতে কর্মসংস্থান সাম্প্রতিক সময়ে কমে গেছে। ফলে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এ সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক খাতেও বেকারত্ব বেড়ে গেছে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল লোকের সংখ্যা বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মহিলাদের বেকারত্বের হার কমেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম মানুষের (১৫ বছরের বেশি বয়সী) সংখ্যা ৫ কোটি ৬৭ লাখ। ২০০৫-০৬ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৯৫ লাখ। ফলে শ্রমবাজারে প্রবেশ করেছে আরও ৭২ লাখ সক্ষম মানুষ। এদিকে ২০১০ সালে বাংলাদেশে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম যে ৫ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ ছিল তাদের মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি ৪১ লাখ। ফলে ২০১০ সালে বাংলাদেশে মোট বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ হয়েছে।
খাতভিত্তিক কর্মসংস্থানের তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছরে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ ৩২ লাখের বেশি কমে গেছে। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের পরিমাণ বেড়েছে ১ কোটির বেশি। ২০১০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে মোট ৬৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০০৬-০৭ সালে এ খাতে মোট কর্মসংস্থান ছিল ১ কোটি ২০ হাজার মানুষের।
তথ্য অনুযায়ী, কৃষি খাতে কর্মসংস্থানের হার কমেছে। ২০১০ সালে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের। ২০০৬-০৭ সালের জরিপে কৃষি খাতে ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান ছিল।
জরিপ অনুযায়ী গ্রামেই বেকারত্ব বেশি। বর্তমানে সারা দেশে ২৬ লাখ বেকারের মধ্যে ১৭ লাখই গ্রামের। এর মধ্যে ১১ লাখ পুরুষ আর ৬ লাখ নারী। আর সারা দেশের শহরগুলোতে বেকার রয়েছে ৯ লাখ লোক। এর মধ্যে ৫ লাখ পুরুষ আর ৪ লাখ নারী।
বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে সরকারের তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিবিএস’র জরিপ পরিচালনার পদ্ধতির সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করেন তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি সপ্তাহে মাত্র এক ঘণ্টা কাজ করলেই তাকে কর্মজীবী হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে বিবিএস। ‘গত সপ্তাহে আপনি কোনো কাজ করেছেন?’ জরিপ পরিচালনায় জড়িত কর্মীদের এমন প্রশ্নের জবাবে কেউ ইতিবাচক জবাব দিলেই তাকে কর্মজীবীর তালিকায় তুলে আনা হয়েছে। এ সময়ে কী কাজ করেছে, এ কাজের পারিশ্রমিক কত তা জানতে চাওয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে।
দেশে অন্তত তিন কোটি লোক বেকার রয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) একে আজাদ বলেন, প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ লোক নতুন করে কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ লোক কর্মস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। আর ৫ লাখ লোকের কর্মস্থান হয় বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হলেও প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ লোক বেকার থেকে যায়।
এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, দেশে শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মিলে বেকার লোকের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। দেশে ২৬ লাখ লোক বেকার রয়েছে মর্মে সরকারি তথ্য শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে সরকারি পরিসংখ্যানের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি একে আজাদ।
ভয়াবহভাবে বেকার সমস্যা বাড়লেও এ বিষয়ে সরকারের মধ্যে কোনো উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা নেই। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিভিন্ন সময়ে তারল্য সঙ্কট, ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদের হার, ব্যাংকিং খাতে সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়া, জ্বালানি ও বিদ্যুত্ সঙ্কট, দ্রব্যমূল্যের অব্যাহত বৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়নে স্থবিরতার কারণেও। তবে বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কথা বলা হয় না।
বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যাচার করা হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন। চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়েছে বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান একটি আলোচনা সভায় দাবি করেছেন। ড. আকবর আলি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল দেশে দুই কোটি ৮০ লাখ বেকার লোক রয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে তা ২ কোটির নিচে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে দেশে ২৫ লাখ বেকার লোক রয়েছে। মাত্র দুই বছরের মাথায় দেশে দুই কোটির বেশি বেকার কমে যাওয়ার বিষয়টিকে তিনি অসম্ভব বলে মন্তব্য করেন।
এ ব্যাপারে রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মোর্শেদী বলেন, বেকারত্ব সমস্যা দেশে দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষিত বেকার সমস্যা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান না করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
No comments