ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর-প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় হোক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আগামী ৬ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ পরশু বাংলাদেশে আসছেন। তাঁর এই সফরকে ঘিরে দুটি দেশেই ব্যাপক প্রত্যাশা জন্ম নিয়েছে। ভারতীয় জনগণের প্রত্যাশা, তাদের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পণ্য পরিবহনসহ সহজ যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবিলায় অগ্রগতি হবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা সেই তুলনায় একটু বেশিই বলতে হবে।


আমরা চাই অভিন্ন নদীগুলো থেকে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশ যেভাবে মরতে বসেছে, তা থেকে রক্ষা পেতে। এ জন্য একটি সুসম পানিবণ্টন চুক্তি হোক এবং জরুরি ভিত্তিতে তার যথাযথ বাস্তবায়ন হোক। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করার মাধ্যমে সে ঘাটতি আমরা কমিয়ে আনতে চাই। এ ছাড়া সাড়ে ছয় কিলোমিটার অচিহ্নিত সীমানা নির্ধারণ, অপদখলীয় জমি হস্তান্তর ও ছিটমহল বিনিময়, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, ভবিষ্যতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং এমন আরো অনেক বিষয়ে প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে সমঝোতা হওয়া প্রয়োজন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এক সফরেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে_এমনটা আশা করা যায় না। বরং বলা যায়, তাঁর সফরের মধ্য দিয়ে সমাধানের যে প্রক্রিয়াটা শুরু হতে যাচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে অদূর-ভবিষ্যতে বাকি সমস্যাগুলোরও সমাধান সম্ভব হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং তৎপরবর্তী সরকারগুলোর ভারতবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে সেই সম্পর্কে দীর্ঘস্থায়ী ফাটল ধরে। দুটি দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো না কমে বরং বাড়তেই থাকে। অথচ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান না হলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্ধেক অঞ্চল শুষ্ক মৌসুমে প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হবে এবং বর্ষাকালে সারা দেশ বন্যায় ভাসবে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব থাকলেও ভারত থেকে আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা বাণিজ্য ঘাটতি কেবল বাড়িয়েই গেছে। ছিটমহলগুলোতে থাকা হাজার হাজার বাংলাদেশি মানবেতর জীবন যাপন করলেও সেই সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ ছিল না। অন্যদিকে নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতোই এ দেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাদের ঘাঁটি বানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে ভারতের যতটা না ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশের ক্ষতি হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থে এবং উন্নয়নের স্বার্থে সেসব হীন মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সেদিক থেকে বর্তমান সরকারের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সেটি আরো বেশি প্রশংসা পেত, যদি এ ব্যাপারে জাতিকে এত বেশি অন্ধকারে রাখা না হতো। তার পরও আমরা আশা করি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সঙ্গে আসা বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন পাঁচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর সফল হবে। আমরা অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে পারস্পরিক আস্থার আলোতে বেরিয়ে আসার পথ দেখতে পাব।

No comments

Powered by Blogger.