কৃষি ভর্তুকি-পেটের ভাত ও ভালো থাকার গল্প by ইশা মোহাম্মদ
কৃষি ভর্তুকি দিয়েই কৃষিকে রক্ষা করা যায় না। বাজার দ্বন্দ্বে তার টিকে থাকার যোগ্যতাও প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকদের নিজস্ব কোনো বাজার নেই। সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী এবং বেপারী-ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য। তারাই ষড়যন্ত্র করে ধানের দাম কমিয়ে দিয়েছে এবং নিজেরা মজুদদারি করছে। পরে বেশি দামে বিক্রি করবে।
সরকার যদি বেশি দামে ধান কেনে, তবে কৃষকদের সুবিধা হয়। কয়েকবার ঘোষণা দিয়েও সরকার ধান কিনছে না। গত বছর বলেছিল, ধান কেনায় একটা সমস্যা হচ্ছে_ গুদামজাত করে রাখার জায়গা নেই। যদি জায়গা না থাকে তবে এখন কিনে ক'দিন পর বেচে দিলেই 'স্থান' সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে
কৃষি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। তারপরও কথা উঠেছে। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ধানের দাম কম, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের চালান বসে যাবে। চাষযোগ্য মূলধন ফেরত না পেলে তারা পরের বছর চাষ করতে পারবে না। কিংবা বেশি আয়ের ফসল চাষ করার চেষ্টা করবে। কৃষক অবশ্যই বেশি আয়ের ফসল চাষ করার অধিকার রাখে। কিন্তু ধানের দাম কমে যাওয়ার ভয়ে কৃষক ধান চাষ পরিত্যাগ করলে ধানের মোট উৎপাদন কমে যাবে। কোনো এলাকায় কোনো কৃষক ধান চাষ বন্ধ করে দিয়ে অন্য ফসলে লাভ করলে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয় এবং তারাও ধান চাষ ত্যাগ করে। এটি সংক্রামক ব্যাধির মতো সর্বজনে ছড়িয়ে পড়লে পরিণতিতে দেখা যাবে, ধান চাষ একেবারেই হচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রপ ডাইভারসিটির বিশাল সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগে যে ধানক্ষেতে আউশ ধানের চাষ হতো, সেখানে বেগুনের চাষ চালু করে কৃষকরা লাভবান হয়েছিল। এখন সেখানে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুলের চাষের লাভ বেগুন চাষের চেয়েও বেশি। এসব জমিতে এখন আর আউশ ধানের চাষ হয় না। এক সময় একটি উৎকৃষ্ট দেশি ধান ছিল 'পাটনাই'। পাটনাই ধানের জমিতে যে কোনো ধরনের 'ক্ষেত-খামারি' করা যায়। এমনকি আলু-পটোলও করা যায়। কিন্তু কৃষকরা পাটনাই চাষ পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে এবং ওইসব জমিতে লাভজনক ফুলের চাষ কিংবা ক্ষেত-খামারি করা হচ্ছে। এ রকম আরও অসংখ্য ধানের জাত আছে, যেগুলো চাষিদের আগ্রহের অভাবে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। ধান চাষ কম হওয়াও যেমন বিপজ্জনক, তেমনি দেশি জাত বিলুপ্ত হওয়াও বিপজ্জনক। দেশের ভবিষ্যৎ না বুঝে অনেকেই কৃষকদের 'ভূমিপণ্য'কে অগ্রাহ্য করার পরামর্শ দিয়ে বিকল্প ফসলের চাষে উদ্বুদ্ধ করে বেশ বাহবা কুড়াচ্ছেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে, পৃথিবীর সব জাতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা গেছে খাদ্যশস্যের বিকল্প খাদ্যশস্যই। অন্য কোনো বিকল্প নেই। যারাই খাদ্যশস্য ত্যাগ করে লাভজনক চাষাবাদে গেছে তারাই পরাধীন হয়ে গেছে কিংবা দুর্ভিক্ষে মরেছে। খাদ্যশস্যের বিকল্প অন্য কিছু হয় না। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির সাধারণ সূত্রও অন্ধ। চায়ের বদলে কফি কিংবা কফির বদলে চায়ের হিসাব খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে অচল। তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই খাদ্যশস্যের গুরুত্ব দিতে হবে এবং সে কারণেই ভর্তুকি।
বাজারে দাম না পেলে কেবল ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের ভূমিপণ্যে ধরে রাখা যাবে না। এ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য, 'ভাতের অভাব নেই' অবস্থা সৃষ্টি করা। ধানচাষিরা বারবার মার খেলে সে অবস্থা আর থাকবে না। ভাতের অভাব আবার ফিরে আসবে। বাংলার স্বর্ণযুগ বলতে যে সময়টা বোঝানো হয়, সেটি মূলত মানুষের গায়ে গা-ভরা সোনার গহনার গল্প নয়, মানুষের পেটে ভাত থাকার গল্প। সে সময়ে বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খেত। শেখ হাসিনা সুনাম অর্জন করেছেন, দু'বেলা পেটভরে ভাত খাওয়াতে পেরেছেন_ তা যদি নস্যাৎ হয়ে যায়, তবে তার অন্যান্য অর্জনও কালিমাযুক্ত হয়ে যাবে। তাই ধানচাষিদের রক্ষার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে, যেন তারা ধান চাষ পরিত্যাগ না করে।
কৃষি ভর্তুকি দিয়েই কৃষিকে রক্ষা করা যায় না। বাজার দ্বন্দ্বে তার টিকে থাকার যোগ্যতাও প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকদের নিজস্ব কোনো বাজার নেই। সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী এবং বেপারী-ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য। তারাই ষড়যন্ত্র করে ধানের দাম কমিয়ে দিয়েছে এবং নিজেরা মজুদদারি করছে। পরে বেশি দামে বিক্রি করবে। সরকার যদি বেশি দামে ধান কেনে, তবে কৃষকদের সুবিধা হয়। কয়েকবার ঘোষণা দিয়েও সরকার ধান কিনছে না। গত বছর বলেছিল, ধান কেনায় একটা সমস্যা হচ্ছে_ গুদামজাত করে রাখার জায়গা নেই। যদি জায়গা না থাকে তবে এখন কিনে ক'দিন পর বেচে দিলেই 'স্থান' সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ফড়িয়াদের কম দামের কাছে কৃষকদের নতি স্বীকার করানো ঠিক হবে না।
ভর্তুকির চরিত্রও পাল্টাতে হবে। যেভাবে এবং যে হিসাবে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেটি উৎপাদন পরিবেশবান্ধব নয়। তাছাড়া ভর্তুকি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় 'দান'। যারা প্রান্তিক চাষি এবং ভাগচাষি বা সংবৎসরের খোরাকির চাষি তারাই কেবল ভর্তুকির দান পাওয়ার যোগ্য। ধনী কৃষক কিংবা জোতদার মহাজনরা ভর্তুকির দান পাবে না। এই ভর্তুকিরও একটা আনুপাতিক সমহারের হিসাব থাকতে হবে। একটা হিসাব সবসময়ই 'একক' থাকে। অন্য হিসাবগুলো পরিবর্তিত হয়। সেই একক হিসাবটি হচ্ছে, 'কত মণ ধান' উৎপাদন করেছে, তার ওপর ভিত্তি করে ভর্তুকি নির্ধারণ। কে কত জমি চাষ করেছে, তার ওপর নির্ভর করে ভর্তুকি নির্ধারণ করা হলে ভাগচাষিদের যে 'উৎপাদন বন্ধ্যত্ব রোগ' আছে তাকে নিরাময় করা যাবে না। ভালো হবে যদি মোট ধান উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে ভর্তুকির টাকা নগদে দেওয়া যায় সরাসরি চাষির হাতে। ধনী কৃষক যদি টাকা না পায় তবে মাথাপিছু ভর্তুকির পরিমাণও বেশি হবে।
সরাসরি কৃষকের কাছে টাকা পেঁৗছানোর জন্য ছোটখাটো অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা যেতে পারে গ্রামগঞ্জে। অনেকটা পথসভার মতো। সেখানে উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ক বক্তৃতাদির সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে। যেসব কৃষক সারাবছর একদিনও হাসে না তারা এই অনুষ্ঠানে অন্তত একদিন হাসতে পারে। সঙ্গে পাঁপর ভাজা কিংবা জিলাপি কিনেও খেতে পারে। অনুষ্ঠান এমন আনন্দঘন করা যেতে পারে, যাতে সেখানে তারা বউ-বাচ্চা নিয়েও আসতে পারে। পাড়ার সাংস্কৃতিক দল পালাগানের প্রতিযোগিতায় নামতে পারে। তারা বলতে পারে, তারা ভালো আছে। সত্যিই কি কৃষকরা ভালো আছে? তারা ভালো নেই। কিন্তু ভালো থাকার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আশা করেছে। অন্য সময়ে পায়নি, এখন পাচ্ছে।
কৃষকের ভালো থাকার প্রত্যাশা পূরণের সঙ্গে কৃষি ভর্তুকির সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভর্তুকি কৃষকের হাতে পেঁৗছতে হবে। সরাসরি কৃষকের কাছে 'সাহায্য' নিয়ে যেতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। খুব বেশি টাকা খরচ হবে না। তবে লাভ হবে লাখো কোটি টাকারও বেশি।
মহাজোট সরকারকে যে কোনো সময় নির্বাচন দিতে হতে পারে। পরিস্থিতি তুঙ্গে ওঠার আগেই নির্বাচন ঘোষণা করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। সে নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবে না, তারা রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং নির্বাচন ঘোষণা করলে মহাজোটের কোনো সমস্যাই হবে না। নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর বাড়ি বাড়ি যাওয়ার চেয়েও নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি যাওয়া ভালো, অন্তত গ্রামের মানুষের কাছে। শহরের মধ্যবিত্তরা দোদুল্যমান এবং দিন দিন লুম্পেন হয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপর খুব একটা বেশি নির্ভর করা ঠিক হবে না। গ্রামের মানুষের 'আস্থা' ধরে রাখা দরকার। কিন্তু একেবারে খালি হাতে তাদের কাছে যাওয়াও ঠিক হবে না। কৃষি ভর্তুকির বিষয়টি স্বীকৃত সাহায্য। এটি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে যাওয়াও অসমীচীন হবে না। আর যদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটা করা যায় তবে আরও ভালো হয়। হয় না কি এমন? কৃষকরা খবর দেয়, একে অন্যকে ভালো থাকার খবর! আমরা ভালো আছি, তোমরা ভালো থেকো। বলতে তো পারে তারা গানে গানে, হাসিমুখে অন্তত একদিন।
ড. ইশা মোহাম্মদ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
কৃষি ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। তারপরও কথা উঠেছে। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ধানের দাম কম, কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রান্তিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের চালান বসে যাবে। চাষযোগ্য মূলধন ফেরত না পেলে তারা পরের বছর চাষ করতে পারবে না। কিংবা বেশি আয়ের ফসল চাষ করার চেষ্টা করবে। কৃষক অবশ্যই বেশি আয়ের ফসল চাষ করার অধিকার রাখে। কিন্তু ধানের দাম কমে যাওয়ার ভয়ে কৃষক ধান চাষ পরিত্যাগ করলে ধানের মোট উৎপাদন কমে যাবে। কোনো এলাকায় কোনো কৃষক ধান চাষ বন্ধ করে দিয়ে অন্য ফসলে লাভ করলে অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয় এবং তারাও ধান চাষ ত্যাগ করে। এটি সংক্রামক ব্যাধির মতো সর্বজনে ছড়িয়ে পড়লে পরিণতিতে দেখা যাবে, ধান চাষ একেবারেই হচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে ক্রপ ডাইভারসিটির বিশাল সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগে যে ধানক্ষেতে আউশ ধানের চাষ হতো, সেখানে বেগুনের চাষ চালু করে কৃষকরা লাভবান হয়েছিল। এখন সেখানে ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুলের চাষের লাভ বেগুন চাষের চেয়েও বেশি। এসব জমিতে এখন আর আউশ ধানের চাষ হয় না। এক সময় একটি উৎকৃষ্ট দেশি ধান ছিল 'পাটনাই'। পাটনাই ধানের জমিতে যে কোনো ধরনের 'ক্ষেত-খামারি' করা যায়। এমনকি আলু-পটোলও করা যায়। কিন্তু কৃষকরা পাটনাই চাষ পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে এবং ওইসব জমিতে লাভজনক ফুলের চাষ কিংবা ক্ষেত-খামারি করা হচ্ছে। এ রকম আরও অসংখ্য ধানের জাত আছে, যেগুলো চাষিদের আগ্রহের অভাবে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। ধান চাষ কম হওয়াও যেমন বিপজ্জনক, তেমনি দেশি জাত বিলুপ্ত হওয়াও বিপজ্জনক। দেশের ভবিষ্যৎ না বুঝে অনেকেই কৃষকদের 'ভূমিপণ্য'কে অগ্রাহ্য করার পরামর্শ দিয়ে বিকল্প ফসলের চাষে উদ্বুদ্ধ করে বেশ বাহবা কুড়াচ্ছেন। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে, পৃথিবীর সব জাতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস অনুসন্ধান করে জানা গেছে খাদ্যশস্যের বিকল্প খাদ্যশস্যই। অন্য কোনো বিকল্প নেই। যারাই খাদ্যশস্য ত্যাগ করে লাভজনক চাষাবাদে গেছে তারাই পরাধীন হয়ে গেছে কিংবা দুর্ভিক্ষে মরেছে। খাদ্যশস্যের বিকল্প অন্য কিছু হয় না। এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির সাধারণ সূত্রও অন্ধ। চায়ের বদলে কফি কিংবা কফির বদলে চায়ের হিসাব খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে অচল। তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই খাদ্যশস্যের গুরুত্ব দিতে হবে এবং সে কারণেই ভর্তুকি।
বাজারে দাম না পেলে কেবল ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের ভূমিপণ্যে ধরে রাখা যাবে না। এ সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য, 'ভাতের অভাব নেই' অবস্থা সৃষ্টি করা। ধানচাষিরা বারবার মার খেলে সে অবস্থা আর থাকবে না। ভাতের অভাব আবার ফিরে আসবে। বাংলার স্বর্ণযুগ বলতে যে সময়টা বোঝানো হয়, সেটি মূলত মানুষের গায়ে গা-ভরা সোনার গহনার গল্প নয়, মানুষের পেটে ভাত থাকার গল্প। সে সময়ে বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খেত। শেখ হাসিনা সুনাম অর্জন করেছেন, দু'বেলা পেটভরে ভাত খাওয়াতে পেরেছেন_ তা যদি নস্যাৎ হয়ে যায়, তবে তার অন্যান্য অর্জনও কালিমাযুক্ত হয়ে যাবে। তাই ধানচাষিদের রক্ষার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে, যেন তারা ধান চাষ পরিত্যাগ না করে।
কৃষি ভর্তুকি দিয়েই কৃষিকে রক্ষা করা যায় না। বাজার দ্বন্দ্বে তার টিকে থাকার যোগ্যতাও প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকদের নিজস্ব কোনো বাজার নেই। সেখানে মধ্যস্বত্বভোগী এবং বেপারী-ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য। তারাই ষড়যন্ত্র করে ধানের দাম কমিয়ে দিয়েছে এবং নিজেরা মজুদদারি করছে। পরে বেশি দামে বিক্রি করবে। সরকার যদি বেশি দামে ধান কেনে, তবে কৃষকদের সুবিধা হয়। কয়েকবার ঘোষণা দিয়েও সরকার ধান কিনছে না। গত বছর বলেছিল, ধান কেনায় একটা সমস্যা হচ্ছে_ গুদামজাত করে রাখার জায়গা নেই। যদি জায়গা না থাকে তবে এখন কিনে ক'দিন পর বেচে দিলেই 'স্থান' সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু ফড়িয়াদের কম দামের কাছে কৃষকদের নতি স্বীকার করানো ঠিক হবে না।
ভর্তুকির চরিত্রও পাল্টাতে হবে। যেভাবে এবং যে হিসাবে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেটি উৎপাদন পরিবেশবান্ধব নয়। তাছাড়া ভর্তুকি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় 'দান'। যারা প্রান্তিক চাষি এবং ভাগচাষি বা সংবৎসরের খোরাকির চাষি তারাই কেবল ভর্তুকির দান পাওয়ার যোগ্য। ধনী কৃষক কিংবা জোতদার মহাজনরা ভর্তুকির দান পাবে না। এই ভর্তুকিরও একটা আনুপাতিক সমহারের হিসাব থাকতে হবে। একটা হিসাব সবসময়ই 'একক' থাকে। অন্য হিসাবগুলো পরিবর্তিত হয়। সেই একক হিসাবটি হচ্ছে, 'কত মণ ধান' উৎপাদন করেছে, তার ওপর ভিত্তি করে ভর্তুকি নির্ধারণ। কে কত জমি চাষ করেছে, তার ওপর নির্ভর করে ভর্তুকি নির্ধারণ করা হলে ভাগচাষিদের যে 'উৎপাদন বন্ধ্যত্ব রোগ' আছে তাকে নিরাময় করা যাবে না। ভালো হবে যদি মোট ধান উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে ভর্তুকির টাকা নগদে দেওয়া যায় সরাসরি চাষির হাতে। ধনী কৃষক যদি টাকা না পায় তবে মাথাপিছু ভর্তুকির পরিমাণও বেশি হবে।
সরাসরি কৃষকের কাছে টাকা পেঁৗছানোর জন্য ছোটখাটো অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা যেতে পারে গ্রামগঞ্জে। অনেকটা পথসভার মতো। সেখানে উদ্বুদ্ধকরণ বিষয়ক বক্তৃতাদির সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে। যেসব কৃষক সারাবছর একদিনও হাসে না তারা এই অনুষ্ঠানে অন্তত একদিন হাসতে পারে। সঙ্গে পাঁপর ভাজা কিংবা জিলাপি কিনেও খেতে পারে। অনুষ্ঠান এমন আনন্দঘন করা যেতে পারে, যাতে সেখানে তারা বউ-বাচ্চা নিয়েও আসতে পারে। পাড়ার সাংস্কৃতিক দল পালাগানের প্রতিযোগিতায় নামতে পারে। তারা বলতে পারে, তারা ভালো আছে। সত্যিই কি কৃষকরা ভালো আছে? তারা ভালো নেই। কিন্তু ভালো থাকার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আশা করেছে। অন্য সময়ে পায়নি, এখন পাচ্ছে।
কৃষকের ভালো থাকার প্রত্যাশা পূরণের সঙ্গে কৃষি ভর্তুকির সম্পর্ক আছে। কিন্তু ভর্তুকি কৃষকের হাতে পেঁৗছতে হবে। সরাসরি কৃষকের কাছে 'সাহায্য' নিয়ে যেতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। খুব বেশি টাকা খরচ হবে না। তবে লাভ হবে লাখো কোটি টাকারও বেশি।
মহাজোট সরকারকে যে কোনো সময় নির্বাচন দিতে হতে পারে। পরিস্থিতি তুঙ্গে ওঠার আগেই নির্বাচন ঘোষণা করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসবে। সে নির্বাচনে যারা অংশগ্রহণ করবে না, তারা রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সুতরাং নির্বাচন ঘোষণা করলে মহাজোটের কোনো সমস্যাই হবে না। নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর বাড়ি বাড়ি যাওয়ার চেয়েও নির্বাচনের আগে বাড়ি বাড়ি যাওয়া ভালো, অন্তত গ্রামের মানুষের কাছে। শহরের মধ্যবিত্তরা দোদুল্যমান এবং দিন দিন লুম্পেন হয়ে যাচ্ছে। তাদের ওপর খুব একটা বেশি নির্ভর করা ঠিক হবে না। গ্রামের মানুষের 'আস্থা' ধরে রাখা দরকার। কিন্তু একেবারে খালি হাতে তাদের কাছে যাওয়াও ঠিক হবে না। কৃষি ভর্তুকির বিষয়টি স্বীকৃত সাহায্য। এটি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে যাওয়াও অসমীচীন হবে না। আর যদি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটা করা যায় তবে আরও ভালো হয়। হয় না কি এমন? কৃষকরা খবর দেয়, একে অন্যকে ভালো থাকার খবর! আমরা ভালো আছি, তোমরা ভালো থেকো। বলতে তো পারে তারা গানে গানে, হাসিমুখে অন্তত একদিন।
ড. ইশা মোহাম্মদ : জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
No comments