টেলিভিশনে মৃত মানুষের মুখ by মাহবুব মোর্শেদ
কয়েকদিন ধরে মৃত্যু সংবাদ পড়লাম একের পর এক। ১৮ মে মারা গেলেন মিসরীয় সঙ্গীতশিল্পী ওয়ারদা আল জাজাইরিয়া। ১৯ মে মারা গেলেন শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ। ২০ মে মারা গেলেন লকারবি বোমা হামলায় অভিযুক্ত মেগরাহি। ২১ মে সঙ্গীতশিল্পী রবিন গিব। ২২ মে মারা গেলেন অর্থনীতিবিদ মোজাফ্ফর আহমদ।
এই তালিকায় লকারবি বোমা হামলায় অভিযুক্ত মেগরাহি ছাড়া দু'জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর দু'জন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বনামধন্য। বিবিসিতে রবিন গিবের মৃত্যুর সংবাদ দেখছিলাম। রবিন গিবের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে দেখানো হচ্ছিল তার উচ্ছল ও প্রাণচঞ্চল কনসার্টের ছবি, আরও নানা স্মরণীয় ঘটনাবলি। শুধু রবিন গিবই নন, বিখ্যাত ব্যক্তিরা মারা গেলে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত টিভিগুলোতে মৃত ব্যক্তির লাশের ছবি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। রীতি মেনেই সেটি দেখানো হয় না। মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এ রীতি সর্বত্র প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশে একে মান্য করা হয় না। মনে পড়ে, প্রিয় ও বিখ্যাত এক ব্যক্তির মৃতদেহের ছবি টেলিভিশনের খবরে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। আমার স্মৃতিতে আঁকা ছিল তার প্রাণোচ্ছল একটা ছবি। হতে পারে সেটা গণমাধ্যমে দেখে বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সূত্রে। কিন্তু এখন তাকে মনে করতে গেলেই সেই মৃত মলিন মুখটাই মনে পড়ে। এর জন্য টিভিকেই দায়ী করতে হয়। প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যমে মৃত মানুষের মুখ দেখব কি দেখব না এ কি ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়? বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামষ্টিক পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ও বটে। সমাজের শ্রদ্ধেয়, গুণী ও কৃতী একজন মানুষের চলচ্ছবি টেলিভিশনগুলোর কাছে থাকবার কথা। মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে সে ছবি পরিবেশন করাই যুক্তিযুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের টিভিগুলো অকুস্থলে পেঁৗছে মৃত মানুষের মুখটাই প্রথম খোঁজে। সে মুখটাই দেখানো হয়। মৃত মুখ কি মৃত্যু সংবাদের চেয়ে কিছু জানান দেয়? বাড়তি কিছুই জানায় না মৃত মানুষের মুখ। বরং জনসমক্ষে এভাবে মৃতের মুখ দেখানোটা তার প্রতি অসম্মানজনক। মৃতের পরিবারগুলোর এই প্রদর্শনের প্রতি সায় থাকে না সবসময়। কিন্তু সায় থাকলেই কি দেখানো উচিত? অনেকেরই মনে হবে, এভাবে দেখানো অসঙ্গত। কিন্তু টিভিগুলোর তেমন দায়িত্বশীলতার নজির কোথায়? অবশ্য অনেকে বলেন, টিভিগুলো জীবিত অবস্থায় কীর্তিমানদের কাছে যায় না। ফলে প্রচার করবার মতো ফুটেজ থাকে না। আর তাই নিরুপায় হয়ে মৃতদেহের মাধ্যমেই মুখটা দেখানো হয়। বিখ্যাত, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের কফিনে ঢাকা মরদেহ দেখিয়েই হয়তো ক্ষান্ত হচ্ছে টিভিগুলো; কিন্তু বাকিদের বেলায় কী হচ্ছে। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর ছবি দেখানোর প্রশ্নই নেই। অস্বাভাবিক মৃত্যুর ছবি অহরহ প্রচারিত হয় ছবিতে। সেগুলোর পরিবেশনা, সরাসরি মৃতদেহ পরিবেশন ইত্যাদি দেখলে কিন্তু রীতিমতো অশ্রদ্ধা জাগে। এ প্রশ্নও জাগে যে, কী ভেবে এই বীভৎস ছবিগুলো প্রদর্শন করা হচ্ছে? মৃতদের পরিবারের ওপর এই প্রচার কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে? এতে কি বীভৎসতার প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে নাকি এই বীভৎসতাই গা সওয়া, মন সওয়া হয়ে উঠছে? টিভি কি শুধু অপরাধ-খুন-হত্যা পছন্দ করে এমন মানুষই দেখে? নাকি শিশুরাও দেখে। তারা মৃতদেহ, বীভৎস মৃতদেহ দেখবে কেন? এক সময় দৈনিক পত্রিকায় বীভৎস ছবি প্রকাশ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। কেউ কেউ বলতেন, বীভৎস ছবি সার্কুলেশন বাড়ায়। কেউ কেউ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার যুক্তিও দেখাতেন। কিন্তু কালে কালে প্রমাণিত হয়েছে, বীভৎস ছবি একদম প্রচার না করলেই সার্কুলেশন সবচেয়ে বাড়ে। আর বীভৎসতার ছবি দিয়ে বীভৎসতার সমালোচনা করা যায় না। বরং সৌন্দর্য দিয়েই কদর্যতার মোকাবেলা করাই রীতি। প্রিয় ও পছন্দের ব্যক্তির মরদেহের ছবি হোক কি অচেনা, অজানা কোনো ব্যক্তির অপঘাতে মৃত্যুর ছবিই হোক টিভিতে তা প্রচারের আগে কি আমাদের টিভি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একটু ভাববেন?
No comments