মাদ্রিদে তিন বাঙাল by মুনতাসীর মামুন
ইতালির বাঙালিরা তার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। শাহীন তিন বছর ইতালিতে ছিল। টুকটাক কাজ করেছে। ভাল যে থাকেনি তা তো বলাই বাহুল্য।
২০০৩-০৪ এর দিকে অনেকে স্পেনে আসতে থাকে। শাহীন ইতালিতে সুবিধা করতে পারছিল না। সে মনস্থ করে স্পেন চলে যাবে।তারপর একদিন বাসে চেপে সে স্পেনে নামে। ইতালিতে সে অবৈধ ছিল কিন্তু বাসে করে কীভাবে চলে এল সে স্পেনে তা আর জিজ্ঞেস করা হয়নি। শাহীন জানত তার এক চাচা থাকেন স্পেনে। ঠিকানা ছিল তার কাছে। ইচ্ছে ছিল চাচার এখানে থেকে কাজ কারবারের খোঁজ করা, তারপর থিতু হয়ে বসা। চাচার কাছে পেঁৗছুল সে। কিন্তু, চাচা তখন তাকে কোন সাহায্য করেননি।
এবার মাদ্রিদের পথে নামল শাহীন। চাকরি খোঁজার পালা। দু'একজন যে সাহায্য করেনি তা নয়। প্রবাসে বাঙালিরা একে অপরকে যথেষ্ট সাহায্য করে। খুঁজতে খুঁজতে সে চাকরি পেল এক ভারতীয় দোকানে। দোকানের মালিকের মূল ব্যবসা কাপড়ের। সামান্য কর্মচারী হিসেবে ঢুকল শাহীন। তার কাজে খুশি মালিক। সততায় আরও খুশি। তখন মালিক তাকে বলল, অনেক চাকরি করেছ এখন নিজে ব্যবসা শুরম্ন করো।
বললেই তো আর ব্যবসা শুরম্ন করা যায় না। পুঁজি কোথায়। মালিক তাকে বাকিতে কাপড় দিলেন ব্যবসা করার জন্য। নিজের দোকানেই তাকে ব্যবসা শুরম্ন করতে দিলেন। সাহস নিয়ে শাহীন ব্যবসা শুরম্ন করল। প্রবাসে এরকম অনেক ঘটনা আমি শুনেছি। বাঙালি কর্মচারীর সততা আর কাজে মুগ্ধ হয়ে ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অনেক মালিক।
গত কয়েক বছরে শাহীন নিজের স্থান করে নিয়েছে। এখন সে স্বাধীন ব্যবসায়ী। সে আরেকজন ব্যবসায়ীর কথা জানান। মাড়োয়ারি, থাকতেন বাংলাদেশের বরিশালে। ১৯৪৭ সালের পর বরিশাল ছেড়ে ওপার চলে যান। তারপর চলে আসেন স্পেনে। সেই কাপড়ের ব্যবসা শুরম্ন করেন। এখন কোটিপতি।
খুব নির্লিপ্তভাবে শাহীন তার কাহিনী শেষ করে। কমলার রস খেতে খেতে একমনে তার গল্প শুনছিলাম। খালি মনে হচ্ছিল, দেশটা স্বাধীন হওয়ার পর কত না সুযোগ বেড়েছে আমাদের। দলে দলে মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। ভাষা জানা নেই, রীতিনীতি জানা নেই কিন্তু কোথায় কোথায় চলে গিয়ে ঠিক ঠিকই থিতু হয়ে যাচ্ছে। সত্যি এই এন্টারপ্রাইজের কোন তুলনা নেই। মনে মনে বলি, লাল সালাম।
শাহীনকে জিজ্ঞেস করি, 'এখন কী অবস্থা?'
'না এখন অবস্থা ভাল, 'কোন ভনিতা না করে নির্দ্বিধায় জানায় শাহীন। 'গ্রামে এক কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেছি। ছোট ভাইটাকে নিয়ে এসেছি, কাপড়ের ব্যবসায় লাগিয়ে দিয়েছি। পরের ভাইটিকেও আনতে হবে। বিয়েও করেছি।'
'বউ কই?'
'না, বউ গ্রামে। আমি এখন বছরে কয়েকবার আসা যাওয়া করছি, এই তো এলাম কয়েকদিন আগে।'
'হঁ্যা, শাহীন এসেছে খবর পেয়েই নিয়ে এসেছি', জানাল মাসুম।
আসত্মে আসত্মে কমলার রস শেষ করি। রোদের ঝাঁঝ খানিকটা কমেছে কিন্তু চোখে পড়ার মতো নয়। টু্যরিস্টদের আনাগোনা এখনও খানিকটা বেড়েছে। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটার দিকে এগুচ্ছে। বললাম, 'চলো, ওঠা যাক এই জায়গাটাই ঘুরে ফিরে দেখি।'
এলাকাটা খানিকটা উঁচু। হয়ত টিলা মতোন ছিল। চারপাশে সরম্ন গলি। ছোট ছোট দোকান রাসত্মায় রাসত্মায়। আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠি। মাসুমই পথ দেখায়। খানিকটা হেঁটে বেশ বড় একটা ইলেকট্রনিকসের দোকানের সামনে দাঁড়াই। মাসুম বলে, 'আমার দুলাভাইয়ের দোকান।'
'ক্যামেরার ব্যাটারিটা বদলে নেয়া যাক।' বলেন হাশেম ভাই।
আমরা ভেতরে ঢুকি। মাসুমের দুলাভাই কাউন্টারের দিকে এগিয়ে আসেন। মাসুম পরিচয় করিয়ে দেয়। আমরা মনির ভাইয়ের বাসায় আছি শুনে তিনি বলেন, 'মনির ভাই আমাকে এখানে আসার ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছেন। শুধু তাই না, গুছিয়ে বসার ব্যাপারেও সাহায্য করেছেন। এমন লোক হয় না।'
তিনি হাসেম ভাইয়ের ক্যামেরা নিয়ে ব্যসত্ম হয়ে পড়েন। আমি মনির ভাইয়ের কথা ভেবে অবাক হই। বিদেশে সাধারণত সাদা কলারের মানুষজন নীল কলারের মানুষজনের জন্য তেমন ভাবে না। আরও কয়েকজনের কাছে শুনেছি, মনির ভাই অনেককে সাহায্য করেছেন মাদ্রিদের আসার ব্যাপারে।
হাশেম ভাইয়ের ক্যামেরায় নতুন ব্যাটারি ভরা হয়। হাশেম ভাই বেশ খুশি। ক্যামেরাটা চালু করা গেল। মাসুমের দুলাইভাই ব্যাটারির পয়সা নিতে অস্বীকার করেন। আমরা আর জোরাজুরি করি না। করে লাভ নেই।
দোকান থেকে বেরিয়ে এক গলি ছেড়ে আরেক গলিতে পড়ি। একটি দোকন দেখিয়ে মাসুম বলে, 'বাংলাদেশী দোকান।' আমরা ভেতরে ঢুকি। বিদেশে যাকে গ্রোসারি শপ বলা হয় সে রকম আর কি! দোকানী আমাদের পরিচয় পেয়ে এগিয়ে আসেন, দেশের খবরাখবর জানতে চান। বলেন, 'কী নেবেন?'
'কিছু না', জানাই আমি, 'ঘুরে ফিরে দেখছি।'
'তাহলে কিছু খান।'
'এই তো খেয়ে এলাম।' হাশেম ভাই বলেন।
'একটা সফট ড্রিংক নেন।' ফ্রিজ খুলে সে কয়েকটা কোকের ক্যান বের করে। আমরা সমস্বরে বলি,
'না, না, কিছু লাগবে না।' বেচারা অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
'আমরা আপনাদের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছি, কেমন আছেন আপনারা জানতে,' বলি আমি।
'না, আমার ভালই আছি।' জানান তিনি। আরও কিছুৰণ আলাপ করে বেরিয়ে আসি।
আরেক গলিতে গিয়ে পড়ি। বেকারির মতো একটি দোকান দেখে হাশেম ভাইকে বলি,
'একটা রম্নটি কিনে নিই, লাগতে পারে সকালে।'
'ঠিক বলেছো,' জানান হাশেম ভাই।
এ দোকানটিও বাঙালির। মালিক চেনা মাসুমের। আমি তখন রম্নটি বাছাই শেষ করেছি। মালিক পরিচিত হতে এগিয়ে আসেন, পরিচিত হয়ে রম্নটির দাম জিজ্ঞেস করি।
'কী যে কন', মালিক হেসে জানায়, 'আরও লাগবে না কি কন। বিস্কুট।'
'না না,' জানাই আমি, 'রম্নটিই যথেষ্ট, কতো দিতে হবে।'
'আপনার থাইকা রম্নটির দাম নিমু,' হেসে বলেন, মালিক, 'কী যে কন!'
'আমি তো আরও কিছু কিনতে চেয়েছিলাম। দাম না নিলে কিনমু কীভাবে?'
'যা খুশি নেন, দাম নিতে পারব না।'
'হাশেম ভাই,' বলি আমি, 'আর কিছু কেনা যাবে না দেখছি।'
দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। 'কয়েকটা টি-শার্ট কিনব,' জানাই মাসুমকে। শাহীনের সঙ্গে মাসুম আলাপ করে। তারপরে আরেকটি গলিতে যাই। মোটামুটি বড়সড় একটি দোকানে ঢুকি। বাঙালির দোকান না বলে গুদাম বলা ভালো, পাইকারি সব বিক্রি। আরও কয়েকটি দোকানে নিয়ে যায় মাসুম। পছন্দ হয় না। আর পাইকারি বলে একটা দুটোয় দামেও সুবিধা হয় না। ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ে এক হান্ডিক্রাফটসের দোকান।
এ ধরনের দোকান আমার পছন্দের। দোকানটি বেশ বড়। মালিক এক ইন্দোনেশীয় মহিলা। আফ্রিকার মূর্তি, মরক্কোর তৈরি বিভিন্ন ব্যাগ, ইন্দোনেশীয় কাঠের টুকিটাকিতে ভর্তি। আফ্রিকার কাঠের মূর্তিগুলি নেড়েচেড়ে দেখি চীনের তৈরি। শুধু এখানে নয়, আরে। অনেক দেশে দেখিছি, নিজেদের ঐতিহ্য অনুসারে আর তারা ক্রাফটসের কাজ করে না। চীন থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করে আনে। আমরা দু'জন বেশ কিছু কাঠের মূর্তি কিনলাম। বাইরে এগুলো দাম আমার জানা। প্রায় অর্ধেক দামে পাওয়া গেল। মরক্কোর চামড়ার তৈরি ব্যাগগুলিও সুন্দর। গোটা দুয়েক ব্যাগ কিনলাম, পরে টলেডোতে দেখেছি, এ ব্যাগের দাম দ্বিগুণ। এখানেও পাইকারি রেট। মাসুমের স্পেনিশ আর আমাদের ইংরেজীতে দাম আরও কমানো যায় কিনা তার কসরত চলল। দাম আরও খানিকটা কমল। হাশেম ভাইকে বললাম, 'বিসত্মর লাভ হয়েছে।'
(চলবে)
No comments