যে যাবার সে যায় by সিরাজুল ইসলাম মুনির
"আমি আমার কবরের মাটি খোঁড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি আমার কবরে বিছিয়ে দেয়ার জন্য বাঁশ কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি আমার কবরে বিছিয়ে দেয়ার জন্য পাটি বোনার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি আমার মৃতদেহে পরিয়ে দেয়ার জন্য আনা কাফনের সাদা ভাঁজ খোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছি ..." _আবিদ আজাদ চারপাশে রেলিং দেয়া ছোট্ট খাট।
দুই ফুট চওড়া, সাত ফুট লম্বা। খাটে শুয়ে আছি আমি। সাদা কাপড়ে আমার মাথা থেকে পা পর্যনত্ম মুড়ে দেয়া হয়েছে। খাটের কাছাকাছি অযত্নে পড়ে আছে একটা কাঠের বাক্স। শহীদ তাজউদ্দীন সরণির 'শেষযাত্রা' দোকান থেকে ওটা আনা হয়েছে। জানাজা শেষে আমাকে এই বাক্সে ভরে নিয়ে যাওয়া হবে আমার গ্রামে।হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তার আমাকে নানাভাবে পরীৰা নিরীৰা করলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, নাই। আসলে আমি অনেক আগেই 'নাই' হয়ে গেছি।
সকাল বেলা আমি আমাদের শোবার ঘর থেকেই আমার স্ত্রীকে ডেকে বললাম, বৃষ্টি, নাসত্মা দাও।
বৃষ্টি রান্নাঘর থেকে জবাব দিল, বস টেবিলে। আমি ডাইনিং রম্নমে যাবার আগেই বৃষ্টি নাসত্মা এনে টেবিলে রাখে। ডাইনিং-এর দরজায় দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টির নাসত্মার আয়োজন দেখলাম। টোস্টেড পাউরম্নটি, ডিমের মামলেট, জ্যাম জেলি আর সাগরকলা। টি পট, সিল্ক পট আর সুগার পটে চায়ের সরঞ্জাম। নাসত্মা খাব আমরা দুজন। চৌহান আর আমি। বৃষ্টি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের নাসত্মাগুলো আলাদা করে যার যার চেয়ারের সামনে রাখছে। বৃষ্টি আজ ক্রিম কালারের শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে লাল বস্নাউজ পরেছে। বৃষ্টি এমনিতেই দেখতে সুন্দর। ক্রিম কালারের শাড়ি আর লাল বস্নাউজে ওর অভিজাত কমনীয়তা, ব্যক্তিত্ব আর সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে।
অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে এরই মধ্যে আমি স্নান করেছি। অফিসে যাওয়ার পোশাকও আলাদা করে রেখেছে বৃষ্টি। নাসত্মা খাওয়া হয়ে গেলে আমি সেগুলো পরে বেরিয়ে যাব। এটা প্রতিদিনের রম্নটিন, ছক বাঁধা। আজও রম্নটিন মতোই চলছিল সব।
হঠাৎ একটা জরম্নরী কথা মনে পড়ে যায়। নাসত্মা খেতে যাবার আগে আমি অফিসে ফোন করি। আমার অফিস বাণিজ্যিক অফিস। স্টাফদের মধ্যে আমার ব্যক্তিগত সহকারী অফিসের পিয়ন আর কিনার আটটার মধ্যেই অফিসে পেঁৗছে যায়। তাদের চাকরির নিয়মও সে রকম। তারা যায়ও সবার শেষে। আমার গাড়ির ড্রাইভার তাকেও আটটার মধ্যে আসতে হয়, যাবার ব্যাপারে তারও নির্দিষ্ট সময় নেই। কখনো কখনো তাকে গভীর রাত করেই ফিরতে হয়। যেহেতু আমি বাণিজ্যিক অফিস চালাই, ব্যবসায়ী মানুষ, আমাকে ব্যবসার প্রয়োজনেই কখনো কখনো কাবের আড্ডায় যেতে হয়। ব্যবসায়ী আর আমলাদের ব্যবসায়িক অাঁতাত কাবেই ভালো জমে।
অফিসে ফোন ধরে তরিকুল। আমার পিএ। আজ এলজিইডির প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের সঙ্গে আমার এ্যাপয়েনমেন্ট আছে এগারটায়। হিল ট্রাক্টটের কিছু ডকুমেন্টস গুছিয়ে রাখতে বললাম তরিকুলকে। ডাইনিং রম্নমের দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির নাসত্মার আয়োজন দেখছি কেবল, তখনই বুকের ভেতর ধুপ করে একটা শব্দ শুনলাম। তারপরই তীব্র যন্ত্রণা। বুকটা চেপে ধরলাম, ইচ্ছে করলো বুকের খাঁচাটা ভেঙ্গে বুকের ভেতরের ব্যথার জায়গাটা চেপে ধরি। কিন্তু পারছি না। আমি দরজার চৌকাঠ ধরে বসে পড়লাম। বৃষ্টি হয়ত তখনি আমাকে দেখে। বৃষ্টি দৌড়ে আসে। আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। উপর দিকে তুলতে চায়। কিন্তু ততৰণে আমার নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে। আমি যেন দ্রম্নতই তাকে বললাম, আমি চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো। বাচ্চাদের খেয়াল রেখো।
কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হয়নি। আমার কথাগুলো শুনতে পায়নি বৃষ্টি। আমার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখেছে কেবল। তবে চিরবিদায়ের আগে ৰণিকের আবেগে আমার দুচোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ে।
চৌহান আমার শ্যালক। বৃষ্টির ছোট ভাই। এখনও বিয়ে করেনি। লন্ডনে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা করে আমার ফার্মে যোগ দিয়েছে। একজন ৰমতাধর কর্মকর্তা হিসেবেই সে কাজ করে। আমার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমাকে অতটা ভয় পায়না, যতটা পায় চৌহানকে। চৌহানের কতর্ৃত্বকে আমি ভিন্ন কোনও অর্থ করিনি কোনদিন, তার যোগ্যতাতেই সে কাজ করে, তার প্রতি অন্যদের ভয় সেটা তার নিয়মশৃঙ্খলার কারণে। চৌহানের জন্য অফিস শুরম্নর সময় নয়টা। নয়টার অর্থ আটটা পঞ্চান্ন মিনিট হতে পারে, কিছুতেই নয়টা এক মিনিট নয়। আবার অফিসের ছুটির সময়ও কেউ পাঁচটার আগে চলে যাবে, সেটা হতে দেবে না। বাণিজ্যিক অফিস যেহেতু, সেহেতু কাউকে কাউকে অফিসের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত থাকতে হয়, সেজন্যে তাকে হিসেব করে ওভারটাইম দিয়ে দেয়। আর কাজ_ চুন থেকে পান খসতে পারে না। যার যা কাজ, তাকে তা করতেই হবে। চৌহানকে সবার ভয়, সে কারণেই।
নাসত্মার টেবিলে ঘড়িধরা সময়মতো চৌহান প্রতিদিন আসে। আজও আসে। অফিসের প্রস্তুতি নিয়ে সু্যট টাই পরে একবারেই আসে। বৃষ্টি তখন আমাকে টেনে তোলার অপচেষ্টা করছে।
হোয়াট হ্যাপেনড? উদ্বিগ্ন চৌহান ছুটে আসে।
বোনকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন করে না, সে বুঝে গেছে, হাসপাতালে নিতে হবে দুলাভাইকে।
ইন্টারকমে সে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলে। আমাকে এক রকম পাঁজা কোলা করেই নিচে নিয়ে আসে। তার পেছন পেছন আলুথালু বৃষ্টি।
আমাকে পাজেরোর পেছনের সিটে শুইয়ে দেয়। বৃষ্টি উঠতে চাইলে চৌহান বলে, তুমি ঘরে থাক। আমাকে একা নিয়েই ছোটে চৌহান। বারডেমের ইমার্জেন্সিতে আমাকে ট্রলিতে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়।
তরম্নণ ডাক্তার আমার নাড়ি টিপে ধরে, নাকে হাত দেয়, বুকে কান লাগায়, স্টেথো লাগায় আবার নাড়ি ধরে রাখে অনেকৰণ। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে সবজানত্মার মতো বলে_ নেই। তখন খুব অসহায়ের মতো চৌহান বলে, পিস্নজ! আর একবার দেখুন না। যেন বিজনেস ডিল করছে চৌহান। ছুটে যাওয়া কোন কন্ট্রাক্ট পেতে দরপত্রদাতা কর্মকর্তার কৃপা প্রার্থনা করছে।
তরম্নণ ডাক্তার তার দিকে তাকালেন, খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলণেন, বলেছিতো নেই।
সেই নেই আমাকেই নিয়ে আসে চৌহান।
আসলেই আমি আর নেই। সবাই এখন আমাকে বলছে, লাশ। শিৰিত ভদ্রলোকের বাড়ি। আত্মীয় পরিজন বন্ধু শুভাকাঙ্ৰীরা সবাই শিৰিত, ধনী। তারা লাশ বলছে না, লাশ শব্দটা বলতে ভালো দেখায় না, শুনতেও ভালো শোনায় না। তাই তারা বলছে, ডেড বডি।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আমার লাশ আর আমার ঘরে তোলা হয় না। ছয় ইঞ্চি পুরম্ন স্প্রিং আর কয়ার ফোমের ম্যাট্রেস, তার উপর নরম কুইল্ট, তার উপর ছড়ানো দামী প্রিন্টেড কটন চাদর, বার্ডস ফেদারের বালিশ সেখানে আমার আর শোবার অধিকার নেই। এ মুহূর্তে সেখানে বালিশ বুকে উপুড় হয়ে পড়ে আছে বৃষ্টি। থেকে থেকে কান্নার দমকে তার শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। আবার কখনো নিঃসাড় পড়ে থাকছে। তাকে ঘিরে আছে আত্মীয় পরিজনরা।
এ বাড়িটা একটা তিনতলা বাড়ি। এটা আমারই বাড়ি। দুই বিঘা জমির পূর্ব অংশ জুড়ে আধুনিক স্থাপত্যকলায় শোভিত করে বাড়িটা নির্মাণ করা হয়েছে। বাড়ির সামনে বিশাল সবুজ লন। চারদিকের দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে পবন বীথি। অন্যদিন বাড়িটা নিজস্ব গাম্ভীর্য নিয়ে চুপচাপ থাকে। আজ অন্যরকম, আমার জানাজা পড়তে অথবা শেষ দেখা দেখতে অনেক মানুষ এসেছে। বাড়ির সবুজ লন এখন পরিপূর্ণ মানুষজনে। একটা বড় সামিয়ানা টানানো হয়েছে। সেই সামিয়ানার নিচে আমার দুই ফুট বাই সাতফুট খাট। সামিয়ানা টানাবার বুদ্ধিটা যে কার আমি জানি না, এরকম একটা বিহ্বল সময়েও মানুষের যে কী করে এইসব বুদ্ধি খেলে। হতে পারে শেষ যাত্রায় কফিন আর শাদা কাফনর কাপড় কিনতে যে গিয়েছে সেই হয়তো বুদ্ধি করে ডেকোরেটরের কাছেও গিয়েছে। আমি জানি এ বাড়ির কেউ কফিনের কথা অথবা আমার নতুন খাটের কথা বলেনি। হয়ত আমার অফিসের কোন বয়স্ক কর্মচারী নিজ দায়িত্বে এগুলো নিয়ে এসেছে। একটা মাইকের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কফিনটা যেখানে রাখা আছে তার পাশেই স্ট্যান্ডে ঝোলানো ছোট্ট মাউথপিস। কেউ কথা বলছে না।
বিশাল সবুজ লন, বাড়ির সিঁড়ি আর ঘরগুলো লোকজনে ভরপুর হয়ে গেছে। অনর্গল কথা বলছে তারা। এই একটা আশ্চর্য সময়, আমি অবাক হয়ে শুনছি, সবাই আমার প্রশংসা করছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনও আছে। তারা অনেকটা নিশ্চল মানুষের মতো দেয়াল ঘেঁষে অথবা যেখানে মানুষের চলাচল কম সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মনের গতি প্রকৃতি জানা যায় না। হয়ত অপেৰায় আছে জানাজা হলে চলে যাবে। যারা প্রগলভ, তাদের শোক কাতরতা দেখি না, তবে কথায় প্রশংসার ফুল ফোটাচ্ছে তারা।
রিয়েলি হি ওয়াজ এ্যা ম্যান অব এমিয়েবল ক্যারেকটার। উই নেভার স হিম ইন এগ্রেসিভ মুড। হি ওয়াজ পোলাইট, জেন্টল।'
'আচ্ছা ওনার বয়স কতো হয়েছে ?'
'পঞ্চাশ টঞ্চাশ!'
'বলেন কী, এই বয়সেই! '
'ভাই, মৃতু্য কাউকে বলে কয়ে আসে না। এটা অবধারিত সত্য। বয়স কোন বিবেচনার বিষয় নয়। এই যে আমি আপনি এখানে এসেছি, এই বাড়ির গেট পেরম্ননোর ৰমতাও আমাদের নেই।'
'হঁ্যা, এই জীবন যিনি দিয়েছেন সময়ও তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি ইচ্ছা করলে এই দুনিয়ায় পাঁচ মিনিট রাখতে পারেন, চাইলে একশ পাঁচ বছরও রাখতে পারেন। তবে সঙ্গে কিছুই যাবে না, যাবে কর্মফল। কর্মফল কী ! এই যে আজকে সিরাজুর সাহেব চলে যাচ্ছেন, তিনি বেঁচে থাকতে স্রষ্টার আদেশ নিষেধ কতটা মেনেছেন, স্রষ্টার এই সৃষ্টির জন্য তিনি কতটা ভূমিকা রেখেছেন, মানুষের জন্য তিনি কি করেছেন, সেটাই তার কর্মফল হিসেবে তার সঙ্গে যাবে।'
'এটা ঠিক সিরাজুর সাহেব মানুষের জন্য অনেক কাজ করেছেন। আজকাল কী এটা দেখা যায়, বিজনেস ফার্মে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ওভার টাইম দেয়া হয়। তার অফিস কারখানায় কাজ করে অনত্মত তিন হাজার লোক। এদের ওপর নির্ভর করে বাঁচে অনত্মত বিশ হাজার লোক। এইসব মানুষের আত্মার দোয়া তিনি পাবেন।'
আমার জানাজায় আসা মানুষদের এইসব মনত্মব্যে আমি বিব্রত হচ্ছি। বিব্রত হচ্ছি এজন্য যে শ্রমিকদের ওভারটাইম যেটা চৌহান তাদের দিয়েছে সেটা তাদের প্রাপ্যই ছিল। অফিস বা কারখানায় শ্রমিক কর্মচারীরা যা পেয়েছে সেটা আমার বা চৌহানের দয়ার দান নয়, তাদের অধিকার। সেটা তাদের উপার্জিত অর্থ, তাদের শ্রমের মূল্য। আমার কী ভূমিকা। আমি বরং তাদের শ্রমের বিনিময়ে ব্যবসা করেছি। ব্যবসার টাকায় ফুলে ফেঁপে উঠেছি। রাজধানীর এই অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল বাড়ি করেছি। পালাক্রমে দিনরাতে পাহারায় থাকে ইউনিফর্ম পরা গার্ড, নাইটগার্ড। ইউনিফর্ম পরা দারোয়ান থাকে সদর গেটে। তাদের অনুমতি ব্যতীত একটা পিঁপড়াও ঢুকতে পারে না এ বাড়িতে। কিন্তু আজ সকাল সাড়ে আটটায় আজরাইল আলায়হিস সালাম ঠিকই চলে এসেছেন। তিনি কারও অনুমতির ধার ধারেননি এমনকি তার আসটাকে নিয়ন্ত্রণ করার ৰমতাও কারো নেই। তিনি এলেন, অলৰ্যে দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলের দিকে আমার সতৃষ্ণ দৃষ্টিকে উপভোগ করলেন, হয়ত একটু মুচকি হাসলেন এবং তারপরই অদৃশ্য হাতটা বুকের পাজরে ঢুকিয়ে দুটো আঙ্গুল আমার হৃৎপি-ের ওপর রাখলেন। এই আলতো করে রাখা দুটো আঙ্গুলের ভার আমি সহ্য করতে পারলাম না। আমি কুঁকড়ে বসে পড়লাম মাটিতে। হয়ত তখন আর্টারির প্রবাহটা তিনি বন্ধ করে দিতেন, কিন্তু বৃষ্টির ওরকম জড়িয়ে ধরায় তিনি সুবিধা করতে পারছিলেন না। সেই সুযোগেই আমি বৃষ্টিকে কথাগুলো বলেছি। কিনত্মু বৃষ্টি আমার কোন কথাই শুনতে পায়নি। বৃষ্টি পরে বিলাপের সময় বলেছে, মৃতু্যর আগে কলেমা পড়েছে।
এই কলেমা পড়ার বিষয়টাও আলোচনার বিষয় হয়েছে। তারা আমার ভালো মানুষীকে অনেক উচ্চ মর্যাদায় স্থান দিয়েছে। বলেছে সিরাজুর সাহেব কখনো মিথ্যে কথা বলেননি, অপরের সম্পদ মেরে খাননি। অন্যের সম্পদের প্রতিও তার লোভ ছিল না। তার চরিত্রও ছিল ফুলের মতো পবিত্র। তিনি দেখতে যেমন সুন্দর মানুষ ছিলেন তার মনটাও ছিল তেমনই সুন্দর। এরকম একজন মানুষ যখন মহাপ্রভুর কাছ থেকে শেষ ডাক শুনলেন, তখন তিনি তাঁর নাম স্মরণ করবেন, তাঁর কলেমা পড়বেন, এটাইতো স্বাভাবিক। এই কলেমাই তাঁকে আখিরাতের পুলসিরাত পার করে দেবে।
চারদিকে আমার প্রশংসা শুনছি। আমি জানি, আমি এইসব প্রশংসার যোগ্য নই। সারা জীবন আমি আমার আর নিজের পরিবারের ভাবনা ছাড়া অন্যকিছু ভাবিনি। নিজের বৈষয়িক উন্নতির জন্য কাজ করা ছাড়া অন্য কোনও কাজ করিনি। মানুষের কাজে লাগে এরকম কোন সমাজসেবা মূলক কাজ আমি করিনি। স্কুল কলেজ মাদ্রাসা মক্তবে কোন দান-সদকা করিনি। একবার, বেশ আগে, আমার গ্রাম থেকে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় তরম্নণ এসেছিল। তারা গ্রামে একটা স্কুল প্রতিষ্ঠার আবেদন করে। গ্রামে সে সময় কোন হাইস্কুল ছিল না, সে বিবেচনায় তাদের দাবি ছিল যৌক্তিক। কিন্তু আমি সে পথে এগুলাম না। কথার ফুলঝুরিতে তাদের দাবির কথা ভুলিয়ে দিলাম। তারা আমার ইচ্ছার নিয়ন্ত্রণাধীন থেকে দুদিন ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াল পাজেরো গাড়িতে চড়ে। আমার খরচে ভাল হোটেলে থাকল, ভাল রেস্টুরেন্ট খাওয়া-দাওয়া করল। তাদের ব্যক্তিগত আর পারিবারিক দু'একটা সমস্যার সমাধান নগদ টাকায় নিয়ে খুশিমনে গ্রামে ফিরে গেল। যাবার সময় আমি তাদের আসা-যাওয়ার পথ খরচও দিয়ে দিলাম। তাদের বিবেচনায় আমি হয়ে উঠলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের একজন, তারাই গ্রামে ফিরে গিয়ে আমার ভালমানুষীর ওকালতিতে লেগে গেল। আমি আসলে যেভাবে আমার শ্রমিক নেতাদের টোপ দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করি, সেভাবেই কাজটা করেছি। গ্রামের তরম্নণগুলো কী যে বোকা, আমার চতুরতাকে বুঝতেই পারল না।
কফিনের পাশে মাইক স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ান আমাদের এই অভিজাত পাড়ার ওয়েলফেয়ার সমিতির সেক্রেটারি জনাব মাকসুদ আহমেদ। তিনি একটা মাঝারি সাইজের রাজনৈতিক দলের নেতা। কখন যে তিনি সেক্রেটারি হলেন আর কিভাবে যে এই সমিতির জন্ম হলো আমরা অনেকেই জানি না। তবে এটাকে আমরা মেনে নেই এজন্য যে এইসব 'বদারেশন' সামলানো আমাদের কাজ নয়।
মাকসুদ আহমেদের বক্তৃতা আমি কোনদিন শুনিনি। তবে রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে গলাবাজি করে বক্তৃতা করেন, সেভাবে নয়, ভেজা নরম কণ্ঠে মাকসুদ আহমেদ বললেন, আমাদের দীর্ঘদিনের সাথী, বিশিষ্ট শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী সিরাজুর রহমান চৌধুরী হার্ট এ্যাটাকে আক্রানত্ম হয়ে আজ সকালে আমাদের ছেড়ে গেছেন। ইন্নালিলস্নাহি অ-ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি ছিলেন দানবীর, বিশিষ্ট সমাজসেবক এবং মহান গুণের অধিকারী একজন মানুষ। আমরা তাঁর অকাল প্রয়াণে শোক বিহ্বল। যাই হোক, কিছুৰণের মধ্যেই তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। আপনারা জানাজা পড়ার জন্য বেজোড় লাইনে দাঁড়ান। নামাজে জানাজার আগে আপনাদের সামনে বক্তব্য রাখবেন মরহুমের বড় ছেলে রাশেদ রহমান চৌধুরী।
আমার বড়ছেলে রাশেদ রহমানকে চৌহান আর আমাদের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির জিএম আকমল সাহেব বগলদাবা করে নিয়ে এসে মাইকের সামেন দাঁড় করিয়ে দেয়।
রাশেদ রহমান সম্ভবত কিছুৰণ আগে সেভ করেছে। হয়ত বড় ছেলে হিসেবে বাবার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বাবার পৰ হয়ে সবার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেয়ার যে ধমর্ীয় অনুশাসন সেটা পালন করতে হবে, সে কারণে কেউ হয়তো তাকে সেভ করার পরামর্শ দিয়েছে। সময়ের গুরম্নত্বটি হয়ত সে অনুধাবন করেছে। কিন্তু তার অশ্রম্নসজল চোখ, কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের ফুলে ওঠা, এটাতো আর মিথ্যে নয়। এ মুহুর্তটা আমি উপভোগ করছি। একজন পিতার জন্য এ হলো এক গুরম্নত্বপূর্ণ মাহেন্দ্রৰণ। সনত্মান তার পিতার দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছে। এই পরম্পরাটা স্রষ্টা কৌশলে মানুষের মধ্যে জাগ্রত করেছেন। এভাবেই মানুষ পূর্বসূরিদের অসমাপ্ত কাজগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়।
দেবদূতের মতো আমাদের সুন্দর ছেলেটা মাইকের সামনে দাঁড়ায়। প্রবল বেগে তখন তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে, থুতনি কাঁপতে থাকে। কাছে পিঠে কোথাও দাঁড়ানো চৌহান এসে তার কাঁধে নির্ভরতার হাত রাখে। আমার বড় ছেলে-কান্নায় ভেঙে পড়ে তার মামার বুকের উপর। উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে এ সময় একটা গুঞ্জন ওঠে, জানাজার আগে মাইয়্যাতের মুখটা তারা দেখতে চান। মাইয়্যাতের মুখ দেখা-এটা তাদের অধিকার। এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। দ্রম্নত লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষের শরীরই সবচেয়ে পচনশীল শরীর। চামড়ার আবরণে অন্য প্রাণীদের শরীর থাকে ঘন পশম আবৃত, সে কারণে তাদের শরীরে পচন ধরতে সময় অপেৰাকৃত কম লাগে। সে কারণে মানুষের মৃতু্যর পর যত দ্রম্নত সম্ভব মৃতদেহের সৎকার (কবর বা দাহ) করার জন্য মানুষ সচেষ্ট হয়। আমার মৃতদেহের সৎকারের সময় নিয়ে কোন ত্রম্নটি হয়নি। দ্রম্নতই আমাকে গোসল করানো হয়েছে, যদিও এর মাত্র তিন ঘণ্টা আগে আমি আমেরিকান ডোব সাবান দিয়ে গোসল করেছি, ইউডি টয়েলেট্রিজ গায়ে মেখেছি। আমি নিশ্চিত শেষ গোসলের আগে যে ভদ্রলোক আমার গায়ের কাপড় ছাড়াচ্ছিলেন, তখন সেই সুগন্ধের ছোঁয়া তার নাকে এসে লেগেছে।
গোসল শেষে তিনি আমাকে চিরবিদায়ের পোশাকে সজ্জিত করলেন। আমার চিরবিদায়ের পোশাকের জন্য তিন গজ সাদা সুতি কাপড় আনা হয়েছে। সেটাকে তিন টুকরো করে ছেঁড়া হয় তারপর ধমর্ীয় অনুশাসন মতো সেলাইবিহীন অবস্থায় শেষ পোশাকটি পরিয়ে দেয়া হয়। এর নাম কাফন। শাদা ধবধবে কাফনের কাপড়। দাম অতি সামান্য। আমি যে কোটি কোটি টাকার মালিক আমার জন্য যে কাপড়, আজকের দিনে দরিদ্র-হতদরিদ্র যে মানুষরা আমার সহযাত্রী হয়েছেন, তাদের জন্যও এই কাপড়। মৃতু্য ধনী আর দরিদ্রের বৈষম্যকে দূর করে দেয়।
আমাকে ঘিরে নতুন আয়োজন চলতে থাকে। মাকসুদ আহমেদ মাইকে বলছেন। আর কিছুৰণের মধ্যেই জানাজার নামাজ শুরম্ন হবে। তার আগে আপনারা যারা মরহুমের মুখটি একনজর দেখতে চেয়েছেন তারা লাইন করে আসবেন।
এরই মধ্যে একজন আমার মাথার দিকের বাঁধনটা খুলে দিয়ে আলগোছে মুখের কাপড়টা সরিয়ে দেয়। আমি আমার মুখটা দেখার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। খুব ধীর পায়ে হাঁটছি। একটু ঝুঁকে একজন একজন করে আমার মুখটা দেখছে। দু একজন উদগত আবেগকে লুকোনোর জন্য মুখে হাত চাপা দেয়। এবার আমার পালা। আমি ঝুঁকে আমার মুখটা দেখলাম। ফর্সা, সুম্মিত নরম ভেজা চুলে সদ্য গোসলের ছাপ। আমার চোখ নির্মিলীত। নাক কান তুলোর গুলটি দিয়ে বন্ধ। আমার তো এমনিতেই পৃথিবীর সুগন্ধ নেবার মতা নেই, কান দিয়ে কিছু শোনার সুযোগ নেই। তবু গুলটি কেন? পৃথিবী থেকে কী আমার বিচ্ছিন্নতা শুরম্ন হয়ে গেছে। হয়েছে তো অবশ্যই। সেই সকাল বেলাতেই। আমার মন বিজ্ঞানের যুক্তি খোঁজে। সারাশরীরে আমার কপর্ুরের কুচি। আমার শরীরের কোষগুলো তখন থেকে শিথিল হতে শুরম্ন করেছে। পচন ধরে যাবে, দুর্গন্ধ ছড়াবে। সে জন্যেই কপর্ুর আর আতর মাখা হয়েছে। লোবান জ্বালিয়ে দিয়েছে আমার ছোট্ট খাটিয়ার কাছে। সকাল বেলাতেই শরীর নামক কাঠামোর ভেতর আট কুঠুরিতে চলমান রক্ত ও পানির যে প্রবাহ তা থেমে গেছে। ফলে নয়টি বিরাজমান দরোজা পথে রক্ত পানি বেরিয়ে যাবে দ্রম্নত। সে কারণেই দ্রম্নত নিঃসরণশীল দরোজার পথগুলো তুলো দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সবগুলো দরোজা একসঙ্গে খুলে যাবার আগেই আমাকে নিয়ে যেতে হবে আমার নতুন বাসস্থানে। নিজের যে জন্মগ্রামে একদিন স্কুল প্রতিষ্ঠার আবেদন নিয়ে এসেছিল গ্রামের মানুষ, সেই জন্মগ্রামে কবরগাহে তৈরি হচ্ছে আমার বাসস্থান। এরই মধ্যে গ্রামে খবর পাঠানো হয়েছে। সেখানে আমার কবর খোঁড়া হচ্ছে। খুব মিহি করে কবরের দেয়ালগুলো ছেঁচে দিচ্ছে গোরখোদক। পাশেই বাঁশ কাটা হচ্ছে। বাঁশের বেড়া বানানো হচ্ছে। মসজিদে বসে কোরআন পড়ছেন দশজন কোরানে হাফেজ।
আমার মুখটা আমি দেখলাম। আলতো হাতে নিজের কপালটা ছুয়ে দিলাম। বললাম, বিদায়।
আমি ঘুরে এসে আবার আমার দুই ফুট বাই সাতফুট খাটের সামনে দাঁড়ালাম। আমার মৃতদেহের মাথা উত্তর দিকে। আমাকে শেষবারের মতো মার্টির বিছানায় শুইয়েও দেয়া হবে উত্তর সিথানে। আমার মুখটা পশ্চিম দিকে, কাবার দিকে ফেরানো। শেষ বারের মতো আমাকে যারা দেখছেন তারা ছোট্ট খাটের পশ্চিম পাশ দিয়ে হেঁটে দণি দিকে যাচ্ছেন। এর ফলে আমার মুখটা দেখতে তাদের সুবিধে হচ্ছে। যারা দেখছেন তাদের এ মুহূর্তের আবেগ অবশ্যই অপার্থিব। জীবন এবং মৃতু্যর সীমানার মাঝখানে তারা অবস্থান করছেন। এ মুহূর্তে একটা মৌন গম্ভীর নীরবতার ভাব বজায় আছে।
হঠাৎ এই মৌনতার পাতলা আবরণটা ভেঙে যায়। একসঙ্গে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আসছে আমার চার ছেলেমেয়ে। ওরা এসে আমার ছোট্ট খাটটাকে অাঁকড়ে ধরে। আমি খুব অবাক হচ্ছি ওদের দেখে। ওরা কী সত্যি আমার সনত্মান। এরা এত ভাল, এত সুন্দর। আমার মেয়েটা কী সুন্দর করে ওড়না জড়িয়েছে ওর মাথায়। কী যে পবিত্র লাগছে ওকে দেখতে। আমিতো সকল আবেগ অনুভবের উর্ধে উঠে গেছি। অথচ এখন মন বলছে, আহা। আর কটা দিন যদি ওদের সঙ্গে কাটাতে পারতাম! আমি কী এতোদিন তা হলে এরকম সনত্মানের আকাঙ্ৰাতেই ছিলাম। মৃতু্যর মুখোমুখি অবস্থায় আমি বৃষ্টিকে বলেছিলাম, বাচ্চাদের দেখো। এটাই হয়তো সত্য যে, সনত্মানের সঙ্গে সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক পিতা এবং মাতার। পারিপাশ্বর্িকতার প্রভাবে ওদের সাময়িক বাহ্যিক পরিবর্তন দেখে আমরা বিরক্ত ছিলাম, কিনত্মু যেহেতু তারা আমার রক্তের উত্তরাধিকার সেহেতু হৃৎপি-ের প্রবাহের মধ্যে তারা বিরাজমান ছিল। আজরাইল আলায়হিস সালাম যখন আমার হৃৎপি-ে আঙ্গুল ছোঁয়ালেন তখন চোখের সামনে সনত্মানদের মুখগুলোই ভেসে উঠেছিলো।
আমার সনত্মানরা আমার ছোট্ট খাটের রেলিং ধরে কাঁদছে। দুবার চেষ্টা করেও কেউ তাদের নড়াতে পারে না। তাদের কান্না আপস্নুত করে অন্যদের। একটা হুহু কান্না সারা বাড়িটাকে আচ্ছন্ন করে।
একসময় আমার বড় ছেলে উঠে দাঁড়ায়। খুব আত্মনির্ভরতার সঙ্গেই সে বলে, পৃথিবীর কোন মানুষই পরিপূর্ণ মানবিক গুণাবলীতে সম্পূর্ণ নয়। সে বিবেচনায় আমার বাবাও সম্পূর্ণ পরিপূর্ণ মানুষ নয়। ভুল ত্রম্নটি তার হয়েছে। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন। তার কোন অন্যায় আচরণ আপনাদের কষ্টের কারণ হলে তাকে মা করে দেবেন। আমি অবিভূত হয়ে শুনছি আমার বড় ছেলের কথাগুলো। অবিভূত হয়ে দেখছি ভবিষ্যতের একজন সম্পূর্ণ মানুষকে। এই সম্পূর্ণ মানুষটি আমারই আত্মজ, আমারই রক্তের উত্তরাধিকার।
আমার জানাজা হলো। জানাজার আগে ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন সিরাজুর সাহেব কেমন লোক ছিলেন? সমস্বরে সবাই বললেন, ভালো লোক ছিলেন। এরকম তিনবার জানতে চাইলেন ইমাম সাহেব। আর সমবেতরা সমস্বরে বললেন, ভালো লোক ছিলেন।
ভালো মানুষ হিসেবে আমার একটা সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। এটা কেয়ামতের মাঠে বিচারের দিনে আমার গুনাহ মাফের একটা ডকুমেন্ট হিসেবে কাজ করবে।
জানাজা শেষ হলে দ্রম্নত লন খালি হতে থাকে। সবাই আবার ব্যসত্ম জীবনের দিকে ছুটছে। একটা এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ানো আছে আগে থেকেই। হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় আমাকে আর পাজেরোতে তোলা হয়নি। এই এ্যাম্বুলেন্সে করেই আমাকে আনা হয়েছিল। এটাতে করেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। কজন লোক ধরাধরি করে কফিনটা নিয়ে এলো আমার খাটের পাশে। আমার মাথা কোমর এবং পায়ের নিচে হাত রেখে আলগোছে উঠিয়ে আমাকে কফিনে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। তারপর উপরের ডালা বসিয়ে পেরেক ঠুকে দিল একজন। আমার পৃথিবী এখন দুই ফুট বাই সাত ফুট বাই দুই ফুট কাঠের বাক্স। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে পাশ ফেরার সুযোগ নেই। আমার প্রাসাদোপম বিশাল বাড়ির তুলনায় এ বাসস্থান ছোট, খুব ছোট।
এবার আমার যাবার পালা। আমার স্বপ্ন সাধের এই বাড়ি, চার পাশের শান শওকত, ঠাট, বাট, বাণিজ্য বসত সবকিছু ছেড়ে যাচ্ছি আমি। পেছনে পড়ে থাকছে আমার প্রিয় সনত্মানেরা, প্রিয়তমা স্ত্রী। আমি শূন্য রিক্ত হাতে চলে যাচ্ছি দূর এক অচেনা জগতের উদ্দেশে। কেউ জানি না সে জগৎ কেমন, কত কাল মহাকালের সময়ের ধারায় সে জগৎ প্রলম্বিত, জগৎ স্রষ্ঠা পৃথিবীতে আমাকে একান্ন বছরের জীবন দিয়েছিলেন। মনে হচ্ছে এ পুতুল খেলার বয়স, পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতেই জগৎ স্রষ্টার আহ্বান এসে গেল।
একে একে সবাই চলে গেছে। জনশূন্য বিশাল লন। তিনতলা বাড়িটাও শোক বিহ্বল, ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরের রোদ তেতে উঠছে। একটা কাক পীও নেই। সবকিছু শূন্য, সুনশান। এ বাড়ির সবকিছু যেন জীবনের অতীত হয়ে গেছে। হঠাৎ উর্দিপরা একজন লোক আমার সামনে দাঁড়ায়। তাকে দেখে আমি চমকে উঠি। উর্দি পরা বলল, স্যার আপনাকে অনেকণ থেকে ডাকছি, আপনি জবাব দিচ্ছেন না। কি হয়েছে স্যার!
আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কে ? অই যে সাদা কাফনে জড়িয়ে কফিনে ভরে নেয়া হলো, তাহলে সে কে ?
আমার ধন্দ কাটে না। আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি। আমি বেভোলার মতো বলি, আমি কে ?
আপনি আমাদের স্যারের বন্ধু। কোন স্যার?
আবুল কাশেম আজাদ। আজ সকালে তার মৃতু্য হয়েছে। আপনিতো জানাজাও পড়লেন। তাই নাকি! কিনত্মু আমিতো দেখলাম আমারই....
আমি কথা শেষ করলাম না। চারপাশের দৃশ্যপট আমার চোখের সামনে আবার অন্যভাবে খুলে যেতে থাকে। লনের সবুজ খাসগুলো রোদের উত্তাপ পেতে বেশ করে পাখা মেলে দিয়েছে। গাছের পাতাগুলো বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে। আমি লন পেরিয়ে খোলা গেট দিয়ে বের হয়ে এলাম। উর্দিপরা দারোয়ান সস্নাইড করা গেটের পালস্নাটা টেনে বন্ধ করছে। শব্দ হচ্ছে ধাতব। জীবন যেন চলমান হয়ে উঠছে।
আমার সামনে সবুজ রঙের ক্যাডিলাক এসে দাঁড়ায়। এটা আমার গাড়ি। আবুল হাশেম আজাদের মৃতু্য সংবাদ পাবার পর পরই আমি এ বাড়িতে ছুটে এসেছিলাম। আবুল হাশেম আজাদ আমার ছোট বেলার বন্ধু।
ড্রাইভার এতণ রাসত্মার পাশে গাড়ি রেখে আমার অপো করছিল। ড্রাইভার গাড়ির দরোজা মেলে ধরে। জীবনের চলমানতার সফরসঙ্গী হতে আমি গাড়িতে উঠে বসি। স্পিড মিটারের কাঁটা ডানদিকে ঘুরতে থাকে।
No comments