প্রতিক্রিয়া-নিয়োগ-প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবার সময় এসেছে by মো. আবদুস সাত্তার
গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে ড. তুহিন ওয়াদুদের ‘নিয়োগ ক্ষমতাশূন্য উপাচার্য চাই’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমার ভাবনার বেশ কিছু বিষয় ওই লেখায় উঠে আসায় আমি লেখককে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি দেখেছি উপাচার্যরা অধিকাংশ সময় নিয়োগসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হন। উপাচার্য হওয়ার পর আমি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কয়েকজন সদস্য এবং চেয়ারম্যানকে বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় কোনো পরিবর্তন আনা যায় কি না? কারণ এই নিয়োগসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে একজন উপাচার্যকে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। অনেক সময় তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতারও সৃষ্টি করে। ওই সময় তাঁরা বলেছিলেন, সব উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয় একমত হবে এমনটি আপনি ভাবছেন কেন? তখন মনে হয়েছিল আমি কি দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললাম? আর দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন তা সচেতন ও নিরপেক্ষভাবে পালন করা উচিত হবে। উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করার ২৬ দিন পর ৩ মে ২০০৯ আমার মা মারা যান। আগের দিন বিকেলে শিক্ষাভবনে অনুষ্ঠিত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের একটা মিটিংয়ে (টেন্ডারসংক্রান্ত) প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করি এবং সেই মিটিংয়ে পুনঃটেন্ডারের সিদ্ধান্ত হয়। রাতে মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনি এবং যশোরে রওনা দিই। সকাল নয়টার দিকে একটি টেলিফোন আসে, যারা কাজটি আশা করেছিল কিন্তু হয়নি তাদের থেকে। মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনেও তারা আমার সঙ্গে টেলিফোনে নিষ্ঠুর আচরণ করেছিল। একই বছরের ২৯ ডিসেম্বর আমার শাশুড়ি মারা যায়। পরদিন সকালে জানাজা শেষে শাশুড়ির লাশ কাঁধে নিয়ে কবরস্থানের দিকে যাচ্ছি, ঠিক তখনই দুদিক থেকে দুই আত্মীয় তাদের সন্তানের চাকরির সুপারিশ করতে থাকল। পরের বছর আমার খালার জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ একজন আত্মীয় আমার পাশে দাঁড়িয়ে তার ছেলের চাকরির কথা বলতে লাগল। এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটেছে। যার কারণে সচরাচর আমি কোনো অনুষ্ঠানে যেতে চাই না। আর গেলেও দ্রুত চলে আসার চেষ্টা করি। ওই তিনটি ঘটনায় আমি অত্যন্ত আহত হয়েছিলাম বলে উল্লেখ করলাম। আগে কেউ টেলিফোন করলে খুশি হতাম। এখন কেন জানি টেলিফোন এলে অস্বস্তি বোধ করি। আমার কাছে এখন কম লোকই আসেন দরকার ছাড়া। আগে আমি অবসরে বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতজনদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। এখন সেটা পারি না, সেখানেও সুযোগ পেলে তদবির।
একজন উপাচার্যকে প্রশাসনিক, একাডেমিক ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করতে হয়। বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তিনির্ভর ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নতুন ভিশন নিয়ে এগোতে হবে। অন্যথায় দক্ষ জনশক্তির অভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। আর এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ দাঁড়াবে কীভাবে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চাকরি দেওয়াই যেন একজন উপাচার্যের একমাত্র কাজ। আমি জানি, দেশে অনেক বেকার, চাকরি দিতে পারলে ভালো। যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দিন, এমন কথা খুব কম লোকে বলে। কেউ কোথাও চাকরি না পেলে তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি দিতে হবে, এমনটি আশা করে অনেকে। আর করতে না পারলে একজন উপাচার্যের মর্যাদার সঙ্গে মানায় না এমন কথাও শুনতে হয়। ফলে ড. তুহিন যেটা বলেছেন ‘নিয়োগ ক্ষমতাশূন্য উপাচার্য চাই’ বিষয়টি একেবারে অবান্তর নয়। এ বিষয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়ার যোগসূত্র কতটুকু, সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
যে বিষয়টি আমি বলতে চাই তা হলো নিয়োগ হলেই যেন সব দায়দায়িত্ব উপাচার্যের ওপর না আসে এমন একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন। নতুবা একজন উপাচার্য যত চেষ্টাই করুন, নিয়োগের সঙ্গে আত্মীয়তার যোগসূত্র খোঁজা হবে, নিয়োগের সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগ ওঠানো হবে, নিয়োগের সঙ্গে অর্থ লেনদেন ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠানো হবে। একজন উপাচার্য আকাশ থেকে সরাসরি মর্ত্যে নামেন না। তিনিও এই সমাজের একজন। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজন থাকা অস্বাভাবিক নয়। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরও কিছু দুর্বলতা থাকে। যেমন চতুর্থ শ্রেণীর কয়েকজন এতিম ও একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ছেলের চাকরি দেওয়ার জন্যও আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ড. তুহিন যেমন বলেছেন, অযোগ্য লোক নিয়োগের মাধ্যমে উপাচার্য পক্ষের লোক বাড়ান। পক্ষান্তরে যোগ্য লোক পক্ষের লোক হবেন না, এমন তো নয়। কিন্তু ড. তুহিন পদ্ধতির কারণে কথাটি বলার সুযোগ পেলেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অ্যাডহক নিয়োগ হয়নি। সব নিয়োগ উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ও আইনসম্মতভাবে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে হয়েছে। তার পরও কেউ কেউ এ নিয়োগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। কারণ অধিকাংশের বদ্ধমূল ধারণা একজন উপাচার্য ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারেন। কিন্তু তিনিও যে সবকিছু করতে পারেন না, তাঁরও ক্ষমতার একটা সীমা আছে, সে বিষয়টি অনেকে বুঝতে চান না। এই কারণে দুর্বলতাগুলোকে কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে প্রচলিত নীতিগুলো যখন হয়েছিল তখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কম ছিল, মানুষের কাছে তথ্যও তেমনটা পৌঁছাত না। আজকের অবস্থা ভিন্ন। তাই নতুন করে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। শুধু নিয়োগপ্রক্রিয়ার কারণে যেন ড. তুহিনসহ দেশের সচেতন নাগরিকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হন।
মো. আবদুস সাত্তার: উপাচার্য, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
sattar_ac@yahoo.com
একজন উপাচার্যকে প্রশাসনিক, একাডেমিক ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করতে হয়। বিশেষ করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রযুক্তিনির্ভর ও যুগোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নতুন ভিশন নিয়ে এগোতে হবে। অন্যথায় দক্ষ জনশক্তির অভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। আর এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ দাঁড়াবে কীভাবে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, চাকরি দেওয়াই যেন একজন উপাচার্যের একমাত্র কাজ। আমি জানি, দেশে অনেক বেকার, চাকরি দিতে পারলে ভালো। যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি দিন, এমন কথা খুব কম লোকে বলে। কেউ কোথাও চাকরি না পেলে তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি দিতে হবে, এমনটি আশা করে অনেকে। আর করতে না পারলে একজন উপাচার্যের মর্যাদার সঙ্গে মানায় না এমন কথাও শুনতে হয়। ফলে ড. তুহিন যেটা বলেছেন ‘নিয়োগ ক্ষমতাশূন্য উপাচার্য চাই’ বিষয়টি একেবারে অবান্তর নয়। এ বিষয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে নিয়োগপ্রক্রিয়ার যোগসূত্র কতটুকু, সেটাও বিবেচ্য বিষয়।
যে বিষয়টি আমি বলতে চাই তা হলো নিয়োগ হলেই যেন সব দায়দায়িত্ব উপাচার্যের ওপর না আসে এমন একটি ব্যবস্থার প্রবর্তন। নতুবা একজন উপাচার্য যত চেষ্টাই করুন, নিয়োগের সঙ্গে আত্মীয়তার যোগসূত্র খোঁজা হবে, নিয়োগের সঙ্গে অনিয়মের অভিযোগ ওঠানো হবে, নিয়োগের সঙ্গে অর্থ লেনদেন ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠানো হবে। একজন উপাচার্য আকাশ থেকে সরাসরি মর্ত্যে নামেন না। তিনিও এই সমাজের একজন। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজন থাকা অস্বাভাবিক নয়। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁরও কিছু দুর্বলতা থাকে। যেমন চতুর্থ শ্রেণীর কয়েকজন এতিম ও একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ছেলের চাকরি দেওয়ার জন্যও আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ড. তুহিন যেমন বলেছেন, অযোগ্য লোক নিয়োগের মাধ্যমে উপাচার্য পক্ষের লোক বাড়ান। পক্ষান্তরে যোগ্য লোক পক্ষের লোক হবেন না, এমন তো নয়। কিন্তু ড. তুহিন পদ্ধতির কারণে কথাটি বলার সুযোগ পেলেন। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অ্যাডহক নিয়োগ হয়নি। সব নিয়োগ উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তি ও আইনসম্মতভাবে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে হয়েছে। তার পরও কেউ কেউ এ নিয়োগকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। কারণ অধিকাংশের বদ্ধমূল ধারণা একজন উপাচার্য ইচ্ছা করলে সবকিছু করতে পারেন। কিন্তু তিনিও যে সবকিছু করতে পারেন না, তাঁরও ক্ষমতার একটা সীমা আছে, সে বিষয়টি অনেকে বুঝতে চান না। এই কারণে দুর্বলতাগুলোকে কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি। বর্তমানে প্রচলিত নীতিগুলো যখন হয়েছিল তখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কম ছিল, মানুষের কাছে তথ্যও তেমনটা পৌঁছাত না। আজকের অবস্থা ভিন্ন। তাই নতুন করে ভাবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। শুধু নিয়োগপ্রক্রিয়ার কারণে যেন ড. তুহিনসহ দেশের সচেতন নাগরিকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হন।
মো. আবদুস সাত্তার: উপাচার্য, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
sattar_ac@yahoo.com
No comments