সংস্কৃতি-তরুণ প্রজন্ম আশার আলো দেখায় by রামেন্দু মজুমদার
নাটকের দলগুলোর বেশিরভাগ কর্মী তরুণ। পহেলা বৈশাখের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে সামনে থাকে তরুণরা। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু করেছে এ প্রজন্মই। তারা সমাজকেও বদলাতে পারবে। অন্যায়-অনিয়ম তারা সহ্য করে না।
এ ক্ষেত্রে বাধা এলে লড়াই বাধাতে তারা পিছপা হয় না এবং ঘরে ফেরে জয়ী হয়েই। স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে অগ্রগতির মূল্যায়ন করতে বসে এ প্রজন্মের এগিয়ে আসার বিষয়টির প্রতিই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের শেষ লগ্নে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে জনগণ সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। এর প্রস্তুতি পর্যায়ে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ চলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংগ্রাম। বলা যায়, একাত্তরে বিজয় ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্তদের জন্য বড় অর্জন। তারা নিজেরাও এ জন্য লড়েছে সক্রিয়ভাবে। পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মের নামে বাঙালির সংস্কৃতির বিকাশকে নানাভাবে বিঘি্নত করে চলছিল। যা কিছু সুন্দর ও সুস্থ, তা ছিল শাসকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করতে চেষ্টা চালায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম বিকৃত করার জন্য স্থূল ও সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র আঁটে। ভাষার ওপর আঘাত হানে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশের যেমন নবযাত্রা শুরু হয়, তেমনি সংস্কৃতির বিকাশেরও সব পথ খুলে যায়। সংস্কৃতির অঙ্গনে যুক্ত সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন কিছু করার প্রেরণা লাভ করে। সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত ও নৃত্য সংস্কৃতির সব শাখাতেই আমরা এর প্রভাব দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে আসে তরুণ সমাজ। তিমিরবিদারী উদার অভ্যুদয়ের তারাই স্রষ্টা।
পাকিস্তান আমলে শুধু নয় তারও অনেক অনেক আগে থেকেই বাঙালির ছিল সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। আমি নিজে নাটকের একজন কর্মী। এ কারণে এ অঙ্গনে গত চার দশকে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটাই প্রথমে উল্লেখ করব। নাট্যাঙ্গনের অনেক কর্মী একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। একইসঙ্গে নাট্যকর্মীরা মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর জনগণকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এ শিল্পমাধ্যম কাজে লাগায়। সে সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাট্যকর্মী কলকাতার নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এ যোগাযোগ আরও বেড়ে যায়। ওই সময়েই বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। নাটকের দলগুলো টিকিটের বিনিময়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে শুরু করে এবং শোর পর শো মিলনায়তন দর্শকে পূর্ণ থাকে। তবে টিকিটের বিনিময়ে নাটকের প্রদর্শনী আমাদের এ ভূখণ্ডে মোটেই নতুন ছিল না। ১৮৫৭ সালেই ঢাকায় ছিল একটি স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ। বর্তমানে যেখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে নাটক প্রদর্শনীর জন্য গড়ে উঠেছিল পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি। ওই বছরের মার্চে সেখানে দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। একই বছরের ডিসেম্বরে যা শুরু হয় কলকাতা শহরে। মনে রাখতে হবে, সিপাহি বিদ্রোহ নামে অভিহিত ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল ওই বছরেই।
ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদের এখানে বাণিজ্যিকভাবে নাটক প্রদর্শনীর জন্য কয়েকটি মঞ্চ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে এর ধারাবাহিকতা থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আবার এ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। দলে দলে মানুষ নাটক দেখতে আসে। সময়মতো অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঘটনা তাদের জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। নাটকে দেখতে পায় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিফলন। প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার ছাপ বেশি ছিল। পরে সমসাময়িক বিষয়াদিও নাট্যকাররা তুলে ধরতে থাকেন। সমাজের অসঙ্গতিও গুরুত্ব পায়। প্রথমে কেবল রোববার ছুটির দিনে এ ধরনের নাটক মঞ্চায়িত হতো। পরে অন্যান্য দিনে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। আমাদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলের মঞ্চ। এক সময়ে মহিলা সমিতি মঞ্চের খোঁজ মেলে। নাটকের দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত সবাই_ অভিনেতা ও কর্মীরা টিকিট বিক্রি করতেন অনুনয়-বিনয়ে। আস্তে আস্তে দর্শকরা আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং নির্ধারিত স্থান থেকে অগ্রিম টিকিট কিনতে থাকে। সংবাদপত্রেরও উদার সহায়তা আমরা পেয়েছি। আমি বলব যে নাটকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বিপুল দর্শক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারা। এদের আমরা বলতে পারি রুচিশীল দর্শক। ক্রমে নিম্নবিত্তরাও নাটকের নিয়মিত দর্শক হতে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যমটি মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ায় এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয় এবং নাটক তা পূরণ করতে শুরু করে। নাটককে কেন্দ্র করেই বেইলি রোড এখন নাটক সরণি। আর এ সড়ককে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক বিপণি অঙ্গন।
নাটক সরণিতে দুটি মঞ্চ ছিল_ মহিলা সমিতি ও গার্লস গাইড মিলনায়তন। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমী। এখানে এখন তিনটি মিলনায়তন রয়েছে। পরিবেশ সুন্দর। মহড়ার জন্য রয়েছে পৃথক কক্ষ। সাত মসজিদ রোডের ছায়ানট ভবনেও একটি মঞ্চ রয়েছে। তবে রাজধানীতেই রয়েছে শতাধিক নাটকের দল। তাদের সবার স্থান সংকুলান হয় না এসব স্থানে। তাছাড়া রাজধানীও এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। মিরপুর বা সূত্রাপুর থেকে দর্শকরা সেগুনবাগিচা কিংবা নাটক সরণিতে নাটক দেখতে আসবে, এটা আশা করা যায় না। এ কারণে আমরা মিরপুর, সূত্রাপুর, গুলশান-বনানী, উত্তরা ও ধানমণ্ডিতে কয়েকটি স্থায়ী মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য দাবি তুলেছি। শুধু নাটক নয়, অন্যান্য অনুষ্ঠানও এসব স্থানে করা যাবে। নতুন নতুন নাটকের দাবিও জোরালো হচ্ছে। নাটকের দল অনেক এবং তারা নিয়মিত নাটক করতে চায়। টেলিভিশনেও নাটকের প্রচুর চাহিদা। সবার জন্যই মঞ্চসফল নাটক লিখতে হবে। পথনাটকেরও চাহিদা রয়েছে। অনেক গোষ্ঠী সাফল্যের সঙ্গে পথনাটক উপস্থাপন করছে।
গত চার দশক ধরেই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাট্যকর্মীদের মধ্যে সর্বদা কাজ করছে। ঘুরেফিরে আসছে বাঙালির আত্মদানের এ ঘটনা। অতীতে বাঙালি সংস্কৃতিকে যারা ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছে এবং এখনও নানা উপায়ে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের স্থায়ী বৈরিতা। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধ অপরাধে যুক্তদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবিতে দেশব্যাপী যে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছে, আমরাও তাতে রয়েছি সামনের সারিতে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের চিত্রশিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। প্রবীণ শিল্পীদের পাশাপাশি নবীনরাও নিজ নিজ ঘরানা সৃষ্টি করতে পারছেন। তবে তাদের জন্যও বড় সমস্যা প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যালারির অভাব। তবে আশার দিক হচ্ছে, ছবি কেনার মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর নাগালে ছবির বাজার আনা সম্ভব হলে এ মাধ্যম আরও বিকশিত হবে। এক সময়ে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। এখন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শিল্পী সৃষ্টির আয়োজন। আগামীতে এ ধারা আরও বেগবান হবে তাতে সন্দেহ নেই। চারুকলা শিল্পীদের অনুপ্রেরণার জন্য যথাযথ পরিবেশ গড়ে উঠছে। আমাদের নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে চারুকলা শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এ সুকুমার বৃত্তির চর্চা আরও বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
আমাদের সঙ্গীতশিল্পীরা স্বাধীনতার জন্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। তারা জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছেন এবং এ জন্য অনেকে পাকিস্তান আমলে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তারা এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের অনেক গান এখনও সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। এটা আশার দিক যে, তরুণ প্রজন্মও এসব গানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা বরাবরই ছিল সম্মুখসারিতে। জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বিশ্বকবির গান গাইবার অধিকার কায়েমের জন্য পাকিস্তান আমলে শিল্পীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে রাজপথে সোচ্চার হতে হয়েছে। শাসকরা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছে, কিন্তু জনগণ তার পরোয়া করেনি। এখন রবীন্দ্রচর্চা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ছায়ানট এ ক্ষেত্রে অগ্রণী সংগঠন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তারা। তাদের পাশাপাশি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে। আমাদের কয়েকজন শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গানের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। লোকসঙ্গীত এ ভূখণ্ডে বরাবরই জনপ্রিয় ছিল। আধুনিক গানের শিল্পীরা লোকগীতিকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনার জন্য সচেষ্ট রয়েছেন। আমাদের সঙ্গীতের প্রসারে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে পর্যাপ্ত অনুষ্ঠান স্থলের অভাব। একই সমস্যা নৃত্যশিল্পে। গান ও নাচ শেখার যে আয়োজন রয়েছে, তা পরিবেশনের জন্য ততটা স্থান নেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নাচ-গানের আয়োজন করা কঠিন কাজ। এ চাহিদা পূরণে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, আমাদের ঐতিহ্য হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায় সঙ্গীতচর্চা। এ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সামাজিক উদ্যোগ বিশেষভাবে কাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে ব্যান্ডসঙ্গীত তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়। এ নিয়ে শঙ্কার কারণ দেখি না। আগামীতে তা আরও প্রসারিত হবে বলেই আমার ধারণা। একইসঙ্গে তো পল্লীগীতি ও লালনের গানও জনপ্রিয়। গণসঙ্গীত আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। এখনও তা মানুষকে আকৃষ্ট করে।
আমাদের যাত্রাশিল্পও সমৃদ্ধ। অনেক বাধা মোকাবেলা করে এ শিল্প টিকে আছে। শিল্পীদের অনেকেই যাত্রাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কখনও কখনও অশ্লীলতার অভিযোগ এনে এ শিল্পকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। এতে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একইসঙ্গে অনেক শিল্পীর জীবিকাও বিপন্ন হয়। সময়ের বিবর্তনে যাত্রাপালা মধ্যরাতের পরিবর্তে সন্ধ্যায় শুরু করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। জনগণও এ শিল্পের মাধ্যমে শুভ ও সুন্দরের বার্তা পেতে চায়। এ কারণেই এ শিল্পকেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দিতে হবে পৃষ্ঠপোষকতা। যাত্রার গণ্ডি সীমিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে কালাকানুন প্রণীত হয়েছে। একইসঙ্গে তা থেকে শিল্পকে রক্ষার জন্যও চলেছে আন্দোলন। আমরা নিশ্চিত যে, শিল্পীদের উচ্চকণ্ঠ কখনও থামানো যাবে না।
আশার দিক হচ্ছে, আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এগিয়ে এসেছে। তাদের কাছে নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্য, চলচ্চিত্র ও চারুকলা_ সবকিছুই আকর্ষণীয়। কখনও কখনও মনে হয়, চলচ্চিত্র গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে কি-না। কিন্তু এ শিল্পে যুক্ত অনেকেই রয়েছেন যারা আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণে সফলতা দেখিয়েছেন। তরুণরা সুস্থধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় রয়েছেন। ফলে বিনোদনের এ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে যথেষ্ট।
আমরা যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত তাদের জন্য স্বস্তির খবর হচ্ছে নবীনদের মধ্য থেকে কর্মী বেরিয়ে আসছে। একটা সময় শঙ্কা ছিল, আমাদের যে প্রজন্ম একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিল, নবীন প্রজন্ম কি ওই গৌরবের অধ্যায়ের পতাকা আরও ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে এগিয়ে আসবে? তাদের ভুল ও বিকৃত ইতিহাস শেখানোর চেষ্টা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ও সরকারি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে দেখা গেল, তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যায়নি। বরং তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটিকেই প্রধান ইস্যুতে পরিণত করেছে। যারা ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে চেয়েছে, জনতা তাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনার কে পক্ষে আর কে বিপক্ষে সেটা তাদের বুঝতে সমস্যা হয়নি।
তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মতো করেই একাত্তরের চেতনা ধারণ করে। তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ চায়। এর অর্থ হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ এবং শিক্ষা শেষে কাজের নিশ্চয়তা। প্রযুক্তির বিকাশ এ জন্য অপরিহার্য। আর এ প্রযুক্তি নিয়ে আসতে হবে সবার আয়ত্তে। তারা স্বাধীনতার পতাকা ঊধর্ে্ব তুলে রাখবেই। একইসঙ্গে তাদের জন্য স্বাধীনতা অর্থবহ করে তুলতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠাও সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ। রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতা থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের পরস্পরের আচরণে অপরের মতকে গুরুত্ব দেওয়ার শিক্ষা চাই। দুর্নীতির কালান্তক ব্যাধি থেকেও সমাজকে মুক্ত করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
আমি বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আশাবাদী। নাটকের দলগুলোর বেশিরভাগ কর্মী তরুণ। পহেলা বৈশাখের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে সামনে থাকে তরুণরা। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু করেছে এ প্রজন্মই। তারা সমাজকেও বদলাতে পারবে। অন্যায়-অনিয়ম তারা সহ্য করে না। এ ক্ষেত্রে বাধা এলে লড়াই বাধাতে তারা পিছপা হয় না এবং ঘরে ফেরে জয়ী হয়েই। স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে অগ্রগতির মূল্যায়ন করতে বসে এ প্রজন্মের এগিয়ে আসার বিষয়টির প্রতিই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব। তারা সংস্কৃতির আরও বেশি চর্চায় নিয়োজিত হবে এবং তা রাজনীতিতেও সূচনা করবে ইতিবাচক ধারার।
রামেন্দু মজুমদার : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের শেষ লগ্নে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে জনগণ সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে। এর প্রস্তুতি পর্যায়ে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ চলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সংগ্রাম। বলা যায়, একাত্তরে বিজয় ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্তদের জন্য বড় অর্জন। তারা নিজেরাও এ জন্য লড়েছে সক্রিয়ভাবে। পাকিস্তানি শাসকরা ধর্মের নামে বাঙালির সংস্কৃতির বিকাশকে নানাভাবে বিঘি্নত করে চলছিল। যা কিছু সুন্দর ও সুস্থ, তা ছিল শাসকদের কাছে অগ্রহণযোগ্য। তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করতে চেষ্টা চালায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্ম বিকৃত করার জন্য স্থূল ও সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র আঁটে। ভাষার ওপর আঘাত হানে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশের যেমন নবযাত্রা শুরু হয়, তেমনি সংস্কৃতির বিকাশেরও সব পথ খুলে যায়। সংস্কৃতির অঙ্গনে যুক্ত সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে নতুন কিছু করার প্রেরণা লাভ করে। সাহিত্য, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত ও নৃত্য সংস্কৃতির সব শাখাতেই আমরা এর প্রভাব দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এগিয়ে আসে তরুণ সমাজ। তিমিরবিদারী উদার অভ্যুদয়ের তারাই স্রষ্টা।
পাকিস্তান আমলে শুধু নয় তারও অনেক অনেক আগে থেকেই বাঙালির ছিল সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। আমি নিজে নাটকের একজন কর্মী। এ কারণে এ অঙ্গনে গত চার দশকে যে পরিবর্তন ঘটেছে সেটাই প্রথমে উল্লেখ করব। নাট্যাঙ্গনের অনেক কর্মী একাত্তরের সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। একইসঙ্গে নাট্যকর্মীরা মুক্তিযোদ্ধা ও আপামর জনগণকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এ শিল্পমাধ্যম কাজে লাগায়। সে সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাট্যকর্মী কলকাতার নাট্য আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর এ যোগাযোগ আরও বেড়ে যায়। ওই সময়েই বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। নাটকের দলগুলো টিকিটের বিনিময়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করতে শুরু করে এবং শোর পর শো মিলনায়তন দর্শকে পূর্ণ থাকে। তবে টিকিটের বিনিময়ে নাটকের প্রদর্শনী আমাদের এ ভূখণ্ডে মোটেই নতুন ছিল না। ১৮৫৭ সালেই ঢাকায় ছিল একটি স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ। বর্তমানে যেখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে নাটক প্রদর্শনীর জন্য গড়ে উঠেছিল পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি। ওই বছরের মার্চে সেখানে দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। একই বছরের ডিসেম্বরে যা শুরু হয় কলকাতা শহরে। মনে রাখতে হবে, সিপাহি বিদ্রোহ নামে অভিহিত ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল ওই বছরেই।
ব্রিটিশ শাসনামলে আমাদের এখানে বাণিজ্যিকভাবে নাটক প্রদর্শনীর জন্য কয়েকটি মঞ্চ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে এর ধারাবাহিকতা থাকেনি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আবার এ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। দলে দলে মানুষ নাটক দেখতে আসে। সময়মতো অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার ঘটনা তাদের জন্য ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। নাটকে দেখতে পায় দৈনন্দিন জীবনের প্রতিফলন। প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনার ছাপ বেশি ছিল। পরে সমসাময়িক বিষয়াদিও নাট্যকাররা তুলে ধরতে থাকেন। সমাজের অসঙ্গতিও গুরুত্ব পায়। প্রথমে কেবল রোববার ছুটির দিনে এ ধরনের নাটক মঞ্চায়িত হতো। পরে অন্যান্য দিনে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। আমাদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিলের মঞ্চ। এক সময়ে মহিলা সমিতি মঞ্চের খোঁজ মেলে। নাটকের দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত সবাই_ অভিনেতা ও কর্মীরা টিকিট বিক্রি করতেন অনুনয়-বিনয়ে। আস্তে আস্তে দর্শকরা আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং নির্ধারিত স্থান থেকে অগ্রিম টিকিট কিনতে থাকে। সংবাদপত্রেরও উদার সহায়তা আমরা পেয়েছি। আমি বলব যে নাটকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে বিপুল দর্শক গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারা। এদের আমরা বলতে পারি রুচিশীল দর্শক। ক্রমে নিম্নবিত্তরাও নাটকের নিয়মিত দর্শক হতে থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যমটি মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়ায় এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয় এবং নাটক তা পূরণ করতে শুরু করে। নাটককে কেন্দ্র করেই বেইলি রোড এখন নাটক সরণি। আর এ সড়ককে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে আধুনিক বিপণি অঙ্গন।
নাটক সরণিতে দুটি মঞ্চ ছিল_ মহিলা সমিতি ও গার্লস গাইড মিলনায়তন। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে শিল্পকলা একাডেমী। এখানে এখন তিনটি মিলনায়তন রয়েছে। পরিবেশ সুন্দর। মহড়ার জন্য রয়েছে পৃথক কক্ষ। সাত মসজিদ রোডের ছায়ানট ভবনেও একটি মঞ্চ রয়েছে। তবে রাজধানীতেই রয়েছে শতাধিক নাটকের দল। তাদের সবার স্থান সংকুলান হয় না এসব স্থানে। তাছাড়া রাজধানীও এখন অনেক বড় হয়ে উঠেছে। মিরপুর বা সূত্রাপুর থেকে দর্শকরা সেগুনবাগিচা কিংবা নাটক সরণিতে নাটক দেখতে আসবে, এটা আশা করা যায় না। এ কারণে আমরা মিরপুর, সূত্রাপুর, গুলশান-বনানী, উত্তরা ও ধানমণ্ডিতে কয়েকটি স্থায়ী মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য দাবি তুলেছি। শুধু নাটক নয়, অন্যান্য অনুষ্ঠানও এসব স্থানে করা যাবে। নতুন নতুন নাটকের দাবিও জোরালো হচ্ছে। নাটকের দল অনেক এবং তারা নিয়মিত নাটক করতে চায়। টেলিভিশনেও নাটকের প্রচুর চাহিদা। সবার জন্যই মঞ্চসফল নাটক লিখতে হবে। পথনাটকেরও চাহিদা রয়েছে। অনেক গোষ্ঠী সাফল্যের সঙ্গে পথনাটক উপস্থাপন করছে।
গত চার দশক ধরেই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নাট্যকর্মীদের মধ্যে সর্বদা কাজ করছে। ঘুরেফিরে আসছে বাঙালির আত্মদানের এ ঘটনা। অতীতে বাঙালি সংস্কৃতিকে যারা ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছে এবং এখনও নানা উপায়ে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের স্থায়ী বৈরিতা। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধ অপরাধে যুক্তদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবিতে দেশব্যাপী যে প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছে, আমরাও তাতে রয়েছি সামনের সারিতে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের চিত্রশিল্পেরও ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। প্রবীণ শিল্পীদের পাশাপাশি নবীনরাও নিজ নিজ ঘরানা সৃষ্টি করতে পারছেন। তবে তাদের জন্যও বড় সমস্যা প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যালারির অভাব। তবে আশার দিক হচ্ছে, ছবি কেনার মতো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর নাগালে ছবির বাজার আনা সম্ভব হলে এ মাধ্যম আরও বিকশিত হবে। এক সময়ে কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। এখন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শিল্পী সৃষ্টির আয়োজন। আগামীতে এ ধারা আরও বেগবান হবে তাতে সন্দেহ নেই। চারুকলা শিল্পীদের অনুপ্রেরণার জন্য যথাযথ পরিবেশ গড়ে উঠছে। আমাদের নতুন শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে চারুকলা শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এ সুকুমার বৃত্তির চর্চা আরও বাড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
আমাদের সঙ্গীতশিল্পীরা স্বাধীনতার জন্য বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। তারা জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছেন এবং এ জন্য অনেকে পাকিস্তান আমলে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে এবং তারা এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের অনেক গান এখনও সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। এটা আশার দিক যে, তরুণ প্রজন্মও এসব গানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা বরাবরই ছিল সম্মুখসারিতে। জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা বিশ্বকবির গান গাইবার অধিকার কায়েমের জন্য পাকিস্তান আমলে শিল্পীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে রাজপথে সোচ্চার হতে হয়েছে। শাসকরা সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছে, কিন্তু জনগণ তার পরোয়া করেনি। এখন রবীন্দ্রচর্চা নতুন মাত্রা পেয়েছে। ছায়ানট এ ক্ষেত্রে অগ্রণী সংগঠন। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তারা। তাদের পাশাপাশি আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সক্রিয় রয়েছে। আমাদের কয়েকজন শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গানের জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। লোকসঙ্গীত এ ভূখণ্ডে বরাবরই জনপ্রিয় ছিল। আধুনিক গানের শিল্পীরা লোকগীতিকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনার জন্য সচেষ্ট রয়েছেন। আমাদের সঙ্গীতের প্রসারে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে পর্যাপ্ত অনুষ্ঠান স্থলের অভাব। একই সমস্যা নৃত্যশিল্পে। গান ও নাচ শেখার যে আয়োজন রয়েছে, তা পরিবেশনের জন্য ততটা স্থান নেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নাচ-গানের আয়োজন করা কঠিন কাজ। এ চাহিদা পূরণে সরকারের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, আমাদের ঐতিহ্য হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায় সঙ্গীতচর্চা। এ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সামাজিক উদ্যোগ বিশেষভাবে কাঙ্ক্ষিত। বর্তমানে ব্যান্ডসঙ্গীত তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়। এ নিয়ে শঙ্কার কারণ দেখি না। আগামীতে তা আরও প্রসারিত হবে বলেই আমার ধারণা। একইসঙ্গে তো পল্লীগীতি ও লালনের গানও জনপ্রিয়। গণসঙ্গীত আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। এখনও তা মানুষকে আকৃষ্ট করে।
আমাদের যাত্রাশিল্পও সমৃদ্ধ। অনেক বাধা মোকাবেলা করে এ শিল্প টিকে আছে। শিল্পীদের অনেকেই যাত্রাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। কখনও কখনও অশ্লীলতার অভিযোগ এনে এ শিল্পকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। এতে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং একইসঙ্গে অনেক শিল্পীর জীবিকাও বিপন্ন হয়। সময়ের বিবর্তনে যাত্রাপালা মধ্যরাতের পরিবর্তে সন্ধ্যায় শুরু করার রেওয়াজ চালু হয়েছে। জনগণও এ শিল্পের মাধ্যমে শুভ ও সুন্দরের বার্তা পেতে চায়। এ কারণেই এ শিল্পকেও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দিতে হবে পৃষ্ঠপোষকতা। যাত্রার গণ্ডি সীমিত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে কালাকানুন প্রণীত হয়েছে। একইসঙ্গে তা থেকে শিল্পকে রক্ষার জন্যও চলেছে আন্দোলন। আমরা নিশ্চিত যে, শিল্পীদের উচ্চকণ্ঠ কখনও থামানো যাবে না।
আশার দিক হচ্ছে, আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে এগিয়ে এসেছে। তাদের কাছে নাটক, সঙ্গীত ও নৃত্য, চলচ্চিত্র ও চারুকলা_ সবকিছুই আকর্ষণীয়। কখনও কখনও মনে হয়, চলচ্চিত্র গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে কি-না। কিন্তু এ শিল্পে যুক্ত অনেকেই রয়েছেন যারা আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণে সফলতা দেখিয়েছেন। তরুণরা সুস্থধারার চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় রয়েছেন। ফলে বিনোদনের এ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে যথেষ্ট।
আমরা যারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত তাদের জন্য স্বস্তির খবর হচ্ছে নবীনদের মধ্য থেকে কর্মী বেরিয়ে আসছে। একটা সময় শঙ্কা ছিল, আমাদের যে প্রজন্ম একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিল, নবীন প্রজন্ম কি ওই গৌরবের অধ্যায়ের পতাকা আরও ঊধর্ে্ব তুলে ধরতে এগিয়ে আসবে? তাদের ভুল ও বিকৃত ইতিহাস শেখানোর চেষ্টা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ও সরকারি গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে দেখা গেল, তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে ভুলে যায়নি। বরং তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটিকেই প্রধান ইস্যুতে পরিণত করেছে। যারা ঐতিহ্যবাহী বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে চেয়েছে, জনতা তাদের ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনার কে পক্ষে আর কে বিপক্ষে সেটা তাদের বুঝতে সমস্যা হয়নি।
তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মতো করেই একাত্তরের চেতনা ধারণ করে। তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ চায়। এর অর্থ হচ্ছে উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ এবং শিক্ষা শেষে কাজের নিশ্চয়তা। প্রযুক্তির বিকাশ এ জন্য অপরিহার্য। আর এ প্রযুক্তি নিয়ে আসতে হবে সবার আয়ত্তে। তারা স্বাধীনতার পতাকা ঊধর্ে্ব তুলে রাখবেই। একইসঙ্গে তাদের জন্য স্বাধীনতা অর্থবহ করে তুলতে হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠাও সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ। রাজনীতিতে পরমতসহিষ্ণুতা থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের পরস্পরের আচরণে অপরের মতকে গুরুত্ব দেওয়ার শিক্ষা চাই। দুর্নীতির কালান্তক ব্যাধি থেকেও সমাজকে মুক্ত করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
আমি বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আশাবাদী। নাটকের দলগুলোর বেশিরভাগ কর্মী তরুণ। পহেলা বৈশাখের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে সামনে থাকে তরুণরা। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু করেছে এ প্রজন্মই। তারা সমাজকেও বদলাতে পারবে। অন্যায়-অনিয়ম তারা সহ্য করে না। এ ক্ষেত্রে বাধা এলে লড়াই বাধাতে তারা পিছপা হয় না এবং ঘরে ফেরে জয়ী হয়েই। স্বাধীনতার চার দশকে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে অগ্রগতির মূল্যায়ন করতে বসে এ প্রজন্মের এগিয়ে আসার বিষয়টির প্রতিই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব। তারা সংস্কৃতির আরও বেশি চর্চায় নিয়োজিত হবে এবং তা রাজনীতিতেও সূচনা করবে ইতিবাচক ধারার।
রামেন্দু মজুমদার : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments