কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-দেয়ালে দেয়ালে আমার লিখন যত লিখিবার by রণজিৎ বিশ্বাস
কখনো কোনো দেয়ালে পাওয়া বাক্য পড়ে কি আপনার মনে হয়েছে, দেশের সর্বত্র তা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন?
: হয়েছে। একবার কাঁটাবন এলাকায় একটি বাক্য পেয়েছিলাম তেমন স্পিরিট-এর, তেমন মর্মতেজ-এর। 'মধ্যরাতে জেগে ওঠে স্বজনের হাড়/বলে_রাজাকার তুই বাংলা ছাড়।'
: হয়েছে। একবার কাঁটাবন এলাকায় একটি বাক্য পেয়েছিলাম তেমন স্পিরিট-এর, তেমন মর্মতেজ-এর। 'মধ্যরাতে জেগে ওঠে স্বজনের হাড়/বলে_রাজাকার তুই বাংলা ছাড়।'
: যদি আপনাকে বলা হতো_সারা দেশে স্থানে স্থানে পোস্টারে পোস্টারে ও সম্ভব হলে দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনি কিছু বাক্য নির্বাচন করুন, আপনি কী করতেন?
: আমি আমার সাধ্যের সব সীমাবদ্ধতার ওপর আন্তরিকভাবে ঠাঁই দিয়ে মহা আনন্দের সঙ্গে কাজটি গ্রহণ করতাম।
: লেখার জন্য আপনি কী কী বাক্য নির্বাচন করতেন?
: একটিও আমার বাক্য নয়। আমি লিখে দিতাম_'মরতে মরতে মরণটারে/শেষ করে দে এক্কেবারে।' আমি শুভ দাশগুপ্তের কবিতা থেকে আনতাম 'ঘুমুসনে মা ঘুমুসনে মা তুই, শুধু থাক জেগে/পোড়া দেশের ঘুম ভেঙে যাক তোর অভিশাপ লেগে।' আমি বড় বড়।
: কেন আনতেন এসব? দেশের মানুষ কি মরতে ভয় পায়? আর মরতেই বা হরফে সড়কের কোণে কোণে লিখে রাখতাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তিনজোড়া শব্দ, 'এক হলে পারি/একা হলে হারি'।
: শেষ?
: না শেষ হয়নি। আরো তিন-চারটি আছে। যারা মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ তাদের বাড়িতে বাড়িতে ও প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে আমি সাজিয়ে আসতাম 'ধর্মান্ধরা শোন/মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন' (নজরুল)।
জায়া জননী কন্যা ভগিনীদের কল্যাণে নিবেদিত যত প্রতিষ্ঠান আছে, তার তোরণে তোরণে প্রাকারে প্রকারে কিংবা স্তম্ভে স্তম্ভে আমি লিখে রাখতাম 'কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে/কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে/কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা/বীরের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা!' (নজরুল)
যাদের পরাজিত শুধু নয়, পরাজিত ও ভূমিপিষ্ট করে আমরা স্বাধীনতাকে উদ্ধার করেছি; কুসংস্কার ও শোষণ-পীড়নের যে পোষক-পৃষ্ঠপোষক অভিভাবকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেলায় অবহেলায় আমরা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করেছি তাদের উঠবোস করাতে করাতে, তাদের দিয়েই আমি লিখিয়ে রাখতাম 'লক্ষ লক্ষ জানের দাম/অনেক দিয়েছি উজাড় গ্রাম।/সুদে আসলে আজকে তাই/যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চাই।'
যারা স্বাধীনতার অর্থ বোঝে না, নেতা ও আরোপিত নেতার তফাত দেখে না, যারা বৃক্ষতল ও বহুতল-এর ফারাক চেনে না, যারা গোষ্পদে মহার্ণব দেখে এবং ঘোষণা ও পাঠকর্মের অর্থ বোঝে না, তাদের বুকে পিঠে সাজিয়ে দিতাম_"যদি রাত পোহালে শোনা যেতো/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো_'বঙ্গবন্ধু মরে নাই', বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা/আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।"
: আর কিছু করতেন না আপনি?
: করতাম! যমুনা পার হয়ে পাওয়া উত্তরের এক জেলা শহরের মোড়ে মোড়ে ইতিহাসের একজন মহাবীরের নামে নাম শিক্ষাবঞ্চিত ও সম্পদলুব্ধ এ নষ্ট বালকের বন্দনকাব্য পাথরে পাথরে উৎকীর্ণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল যেজন, তাকে তার 'হাইড-আউট' কিংবা 'হাইবারনেশান' থেকে খুঁজে এনে বলতাম_এ কাজ তুই কেন করেছিলি বালক? এ কাজ কেন করেছিলি তুই! কিসের তাগিদ ছিল তোর কিসের প্রয়োজন? দেশের প্রতিটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও টোল-মাদ্রাসার দেয়ালে দেয়ালে আমি বড় বড় অবয়বের সুুচারু অক্ষরে-আখরে লিখিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতাম বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
এবং, আপাতত সর্বশেষ, বাংলাদেশে ছাপা প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের প্রথম পাতায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের অবিস্মরণীয় চার পঙ্ক্তি মুদ্রণের ব্যবস্থা করতাম 'যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান। ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।' আর শেষ মলাটের আগের পাতায় রাখতাম_'বিশ্বকবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ' 'জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রম্যলেখক
: আমি আমার সাধ্যের সব সীমাবদ্ধতার ওপর আন্তরিকভাবে ঠাঁই দিয়ে মহা আনন্দের সঙ্গে কাজটি গ্রহণ করতাম।
: লেখার জন্য আপনি কী কী বাক্য নির্বাচন করতেন?
: একটিও আমার বাক্য নয়। আমি লিখে দিতাম_'মরতে মরতে মরণটারে/শেষ করে দে এক্কেবারে।' আমি শুভ দাশগুপ্তের কবিতা থেকে আনতাম 'ঘুমুসনে মা ঘুমুসনে মা তুই, শুধু থাক জেগে/পোড়া দেশের ঘুম ভেঙে যাক তোর অভিশাপ লেগে।' আমি বড় বড়।
: কেন আনতেন এসব? দেশের মানুষ কি মরতে ভয় পায়? আর মরতেই বা হরফে সড়কের কোণে কোণে লিখে রাখতাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তিনজোড়া শব্দ, 'এক হলে পারি/একা হলে হারি'।
: শেষ?
: না শেষ হয়নি। আরো তিন-চারটি আছে। যারা মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ তাদের বাড়িতে বাড়িতে ও প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে আমি সাজিয়ে আসতাম 'ধর্মান্ধরা শোন/মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন' (নজরুল)।
জায়া জননী কন্যা ভগিনীদের কল্যাণে নিবেদিত যত প্রতিষ্ঠান আছে, তার তোরণে তোরণে প্রাকারে প্রকারে কিংবা স্তম্ভে স্তম্ভে আমি লিখে রাখতাম 'কোন রণে কত খুন দিল নর লেখা আছে ইতিহাসে/কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর লেখা নাই তার পাশে/কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা/বীরের স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা!' (নজরুল)
যাদের পরাজিত শুধু নয়, পরাজিত ও ভূমিপিষ্ট করে আমরা স্বাধীনতাকে উদ্ধার করেছি; কুসংস্কার ও শোষণ-পীড়নের যে পোষক-পৃষ্ঠপোষক অভিভাবকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেলায় অবহেলায় আমরা বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করেছি তাদের উঠবোস করাতে করাতে, তাদের দিয়েই আমি লিখিয়ে রাখতাম 'লক্ষ লক্ষ জানের দাম/অনেক দিয়েছি উজাড় গ্রাম।/সুদে আসলে আজকে তাই/যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চাই।'
যারা স্বাধীনতার অর্থ বোঝে না, নেতা ও আরোপিত নেতার তফাত দেখে না, যারা বৃক্ষতল ও বহুতল-এর ফারাক চেনে না, যারা গোষ্পদে মহার্ণব দেখে এবং ঘোষণা ও পাঠকর্মের অর্থ বোঝে না, তাদের বুকে পিঠে সাজিয়ে দিতাম_"যদি রাত পোহালে শোনা যেতো/যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো_'বঙ্গবন্ধু মরে নাই', বিশ্ব পেতো এক মহান নেতা/আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।"
: আর কিছু করতেন না আপনি?
: করতাম! যমুনা পার হয়ে পাওয়া উত্তরের এক জেলা শহরের মোড়ে মোড়ে ইতিহাসের একজন মহাবীরের নামে নাম শিক্ষাবঞ্চিত ও সম্পদলুব্ধ এ নষ্ট বালকের বন্দনকাব্য পাথরে পাথরে উৎকীর্ণ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল যেজন, তাকে তার 'হাইড-আউট' কিংবা 'হাইবারনেশান' থেকে খুঁজে এনে বলতাম_এ কাজ তুই কেন করেছিলি বালক? এ কাজ কেন করেছিলি তুই! কিসের তাগিদ ছিল তোর কিসের প্রয়োজন? দেশের প্রতিটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও টোল-মাদ্রাসার দেয়ালে দেয়ালে আমি বড় বড় অবয়বের সুুচারু অক্ষরে-আখরে লিখিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতাম বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও সম্ভাবনাময় দেশ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
এবং, আপাতত সর্বশেষ, বাংলাদেশে ছাপা প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের প্রথম পাতায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের অবিস্মরণীয় চার পঙ্ক্তি মুদ্রণের ব্যবস্থা করতাম 'যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান। ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।' আর শেষ মলাটের আগের পাতায় রাখতাম_'বিশ্বকবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ' 'জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের যে তার নেইকো শেষ।'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রম্যলেখক
No comments