সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসের মুখে সমাজতন্ত্রের পদধ্বনি-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর

পুঁজিবাদ খতম করে মানুষ তো হাওয়ায় বসবাস করতে পারে না। তাহলে পুঁজিবাদের পর কী? এর জবাব নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের তো বটেই, এমনকি প্রগতিশীল ও বিপ্লবীদের মধ্যেও যতই দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাক এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত মূল দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত মালিকানা ও সামাজিক উৎপাদনের দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের নিয়ামক যে ব্যবস্থার মধ্যে হয় তার নামই সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের কোনো দেশ নেই, জাতি


নেই। সমাজতন্ত্র হলো সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদেরই ঐতিহাসিক পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদীরা বিশ্বজুড়ে তাদের প্রচারমাধ্যম ছড়িয়ে রেখে তথ্য নিয়ন্ত্রণের এমন এক জাল বিস্তার করে রেখেছে, যাতে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সব রকম তথ্য ধামাচাপা দিয়ে তাদের জন্য সুবিধাজনক নানা প্রচারণা এখনও পর্যন্ত অনায়াসেই চালিয়ে যেতে পারছে। ২০১১ সালে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে একের পর এক গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাকে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের উত্থান হিসেবে চিত্রিত করে তাকে 'আরব বসন্ত' নামে অভিহিত করলেও তাদের নিজেদের দেশে, ইউরোপ ও আমেরিকা, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে তুমুল আন্দোলন এখন সমান্তরালভাবে চলছে তার প্রকৃত চরিত্র নিয়ে কোনো কথা, রিপোর্ট বা আলোচনা তাদের প্রচারমাধ্যমে নেই বললেই চলে। উপরন্তু এই আন্দোলন থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখার জন্য 'আরব বসন্ত' নিয়েই তারা অনেক মাতামাতি করেছে। 'আরব বসন্তে'র সুযোগ নিয়ে তারা যেভাবে মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, সিরিয়াসহ সমগ্র উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর সরাসরি অথবা তাদের দালালদের মাধ্যমে হামলা ও হস্তক্ষেপ করছে তার প্রকৃত চরিত্র আড়ালে রেখে তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি কার্যকর করছে।
২০১১ সালজুড়ে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে 'আরব বসন্ত' নামে কথিত আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পাশাপাশি ইউরোপে গ্রিস, স্পেন, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশে ছাঁটাই, ব্যয় সংকোচন ইত্যাদি নিয়ে যে ব্যাপক ও জোরালো আন্দোলন চলেছে সেটা যে সরাসরি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সেই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় লক্ষ্যবস্তু যে এসব দেশের বড় বড় ব্যাংক, এর ওপর কোনো অর্থবহ আলোচনা পশ্চিমা গণমাধ্যমে দেখা যায় না। উপরন্তু এই আন্দোলনের প্রকৃত চরিত্র ধামাচাপা দিতেই তাদের দেশের উচ্চমার্গের বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকরা ব্যস্ত থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকগুলো যে সংকট সৃষ্টি করছে তার একটা চেহারা প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশের প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় মেয়াদে দেখা গিয়েছিল। সে সময় তিনি ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকারদের সাতশ' বিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। কিন্তু বুশের সেই সাহায্যের কণামাত্র সাধারণ মার্কিন জনগণের কাছে পেঁৗছায়নি। ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকাররাই জনগণের কোষাগার থেকে দেওয়া সাতশ' বিলিয়ন ডলার নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিল। তখনও এর বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ হয়েছিল। শ্রমিক ও ঋণগ্রস্ত লোকেরা হাজারে হাজারে পথে নেমেছিলেন। কিন্তু সেই বিক্ষোভকে সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের প্রচারমাধ্যমে এমনভাবে উপস্থিত করেছিল যাতে তার গুরুত্ব ঠিকমতো উপলব্ধি করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
২০১১ সালের শেষ দিক থেকে নিউইয়র্কে 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' আন্দোলনে যেভাবে হাজার হাজার শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ মানুষ নেমে এসেছে তার ব্যাপকতা অনেক বেশি। এটা বেশি বিশেষ করে এই অর্থে যে, এটা শুধু নিউইয়র্কে সীমাবদ্ধ না থেকে মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের ৭০টি শহরে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় যে কারণে এই আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশি তা হলো, এর লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেটের স্বচ্ছতা। কোনো লুকোচুরি অবকাশ না রেখে এই আন্দোলনের মুখ্য আওয়াজ হলো, 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো'। আসলে 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' আন্দোলন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে আরব বিশ্বে স্বৈরতান্ত্রিক ও ফ্যাসিস্ট শাসক চক্র উৎখাত করার মতোই ব্যাপার। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ পুঁজিবাদের মূল শোষণ-নির্যাতন ব্যাংকারদের স্বার্থেই হচ্ছে। তারাই সব অঘটনের মূল ঘটক। এ কারণে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো'র সঙ্গে সেখানে যুক্ত হয়েছে 'পুঁজিবাদ খতম করো' স্লোগান। সেখানে আওয়াজ তোলা হয়েছে, 'আমরাই ৯৯%।' অর্থাৎ দেশে যারা সংকট সৃষ্টি করছে, যারা দেশের শ্রমজীবীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে তারা মাত্র ১%! ওয়াল স্ট্রিটেই তাদের বসবাস। এ কারণে 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো', 'পুঁজিবাদ খতম করো' এবং 'আমরাই ৯৯%'-এর আওয়াজ পরস্পরের সঙ্গে একই সূত্রে গ্রথিত।
এ বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক কমিউনিস্ট ও বামপন্থি সংগঠন সামনে আনার চেষ্টা করলেও তাদের প্রচারমাধ্যমের আকার ও শক্তি ব্যাংকারদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রচারমাধ্যমের থেকে অনেক কম। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অন্য এক কারণে। এতদিন অগ্রসর পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো অন্যান্য পশ্চাৎপদ অনুন্নত ও তাদের ওপর নির্ভরশীল দেশের জনগণকে শোষণ ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের দেশের শ্রমজীবীসহ জনগণের একাংশকে তার ভাগ দিয়ে আসার জন্য তাদের নিজেদের দেশে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো আন্দোলন ছিল না। এখন এদিক দিয়েই পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের শোষণ-লুণ্ঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে পরিবর্তনের কারণে পুঁজিমালিক বা ব্যাংকাররা এখন আর তাদের নিজেদের দেশের শ্রমিকদের আগের সুবিধা দিতে পারছে না। সেখানে শ্রমিক ছাঁটাই, আর্থিক ও প্রকৃত মজুরি হ্রাস, বেকারত্ব এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যার বিরুদ্ধে সেখানকার জনগণই এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তারা এটা উপলব্ধি করছে যে, তাদের অবস্থার এই পরিবর্তন এবং অধঃগতির জন্য পুঁজিবাদই দায়ী এবং এই পুঁজিবাদীদের মধ্যমণি হচ্ছে ব্যাংকাররা। এই সত্য উপলব্ধি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, জার্মানি ইত্যাদি দেশে সরাসরি পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধছে। এই আন্দোলন ব্যাপক ও জোরদার হচ্ছে।
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার সিয়াটলে যে শ্রমিক ও গণবিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে তার ধারাবাহিকতাই বর্তমানে 'ওয়াল স্ট্রিট দখল করো' এবং 'পুঁজিবাদ খতম করো' আন্দোলনের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। এই আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করলেও এখনও পর্যন্ত এর কোনো সুনির্দিষ্ট ও সুসংগঠিত নেতৃত্ব নেই। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এর চরিত্র নেতিবাচক। কারণ 'পুঁজিবাদ খতম করো'র পর কী করা দরকার সে ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক ও সুনির্দিষ্ট বক্তব্য এই আন্দোলনের মধ্যে নেই। কিন্তু তা না থাকলেও কোনো আন্দোলনকে সম্পূর্ণ নেতিবাচক, ইতিবাচক দিকহীন বলে অভিহিত করা যায় না। দার্শনিক এবং তাত্তি্বকভাবেও প্রত্যেক 'না' কোনো না কোনো 'হ্যাঁ'-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত অথবা তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
বর্তমান পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদের ধ্বংসের পদধ্বনি। পুঁজিবাদ আজ আর সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে নিজের বৈশ্বিক অবস্থানই যে শুধু টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে চরম সংকটের মুখোমুখি তাই নয়; পুঁজিবাদ নিজের দেশেও তার অবস্থান যে আর আগের মতো টিকিয়ে রাখতে পারছে না, এটাই বর্তমানে পাশ্চাত্যে চলমান পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল বার্তা।
এই ভাঙনের বার্তাই ইতিহাসের শেষ কথা হতে পারে না; ভাঙনের পর গঠনও এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী অনুন্নত এবং পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে যেমন, ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতেও তেমনি গঠনের এক পদধ্বনি এখন শোনা যাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুড়ো বুশ ঘোষণা করেছিলেন যে, সমাজতন্ত্র শেষ হয়েছে। দুনিয়ার সামনে এখন শুধু সাম্রাজ্যবাদের 'নতুন বিশ্বব্যবস্থা'! কিন্তু ইতিমধ্যেই এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, বুশের সেই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা পুরনো বোতলে পুরনো মদ ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই পুরনো বোতল আজ বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী জনগণের আন্দোলনের ধাক্কায় চুরমার হওয়ার পথে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় থেকে মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানেই সাম্রাজ্যবাদের 'নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার' যে পরিণতি দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যেই শোনা যাচ্ছে সাম্রাজ্যিক ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিদায়ের ঘণ্টাধ্বনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশ্ব পুঁজিবাদের হৃৎপিণ্ডে এখন আওয়াজ উঠেছে 'পুঁজিবাদ খতম করো'। এই আওয়াজ এই মুহূর্তে যতই দুর্বল ও সম্ভাবনাবিহীন মনে হোক, এটাই আশু ভবিষ্যতে পরিণত হবে এক প্রবল ও প্রলয়ঙ্করী আওয়াজে। একই সঙ্গে এই আওয়াজের ইতিবাচক দিকও স্পষ্ট হবে। পুঁজিবাদ খতম করে মানুষ তো হাওয়ায় বসবাস করতে পারে না। তাহলে পুঁজিবাদের পর কী? এর জবাব নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের তো বটেই, এমনকি প্রগতিশীল ও বিপ্লবীদের মধ্যেও যতই দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাক এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত মূল দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত মালিকানা ও সামাজিক উৎপাদনের দ্বন্দ্বের কোনো সমাধান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের নিয়ামক যে ব্যবস্থার মধ্যে হয় তার নামই সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের কোনো দেশ নেই, জাতি নেই। সমাজতন্ত্র হলো সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদেরই ঐতিহাসিক পরবর্তী। পুঁজিবাদের পর মানবজাতি সমাজতন্ত্রের থেকে বাস্তব এবং উৎকৃষ্ট কোনো ব্যবস্থা আবিষ্কার করেনি। কাজেই সমাজতন্ত্র শুধু গরিব দেশগুলোর নয়, আমেরিকা-ইউরোপের মতো ধনী দেশগুলোরও অমোঘ এবং অবধারিত ভবিষ্যৎ।
৯.১.২০১২

No comments

Powered by Blogger.