বিশ্বসভায় সার্বভৌম সত্তায় by সুভাষ সিংহ রায়
১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের একটি জরুরি বার্তা বঙ্গবন্ধুর হাতে পেঁৗছে দেওয়া হয়। বার্তায় বলা হয় : "আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, 'হার ম্যাজেস্টিস গভর্নমেন্ট' আপনার সরকার ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অনুগ্রহ করে আপনি আমার ব্যক্তিগত অভিনন্দন গ্রহণ করুন।... আমাদের দু'দেশের মধ্যে ইতিমধ্যে স্থাপিত সুসম্পর্ক আরও দৃঢ় করার জন্য আপনার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।" ৫ ফেব্রুয়ারি মি.
হিথের বার্তার উত্তরে প্রেরিত এক পত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন : "গতকাল প্রাপ্ত 'হার ম্যাজেস্টিস' সরকার কর্তৃক আমার সরকার ও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের বার্তাটি আমি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করছি। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসার আগে লন্ডনে আপনার সঙ্গে আলোচনার কথা আমি আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করছি। 'হার ম্যাজেস্টিস' সরকার স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন সম্পর্কে শুধু নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেননি, অন্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে জেনে আমি অত্যন্ত পরিতৃপ্তি লাভ করেছি।" রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং আমার অন্য সহকারীরাও আমাকে বলেছেন, 'স্বাধীনতা সংগ্রামকালে আমাদের বহুসংখ্যক নিপীড়িত নাগরিক যুক্তরাজ্যে আশ্রয় লাভ করে। ব্রিটেনের সর্বস্তরের জনগণ তাদের প্রতি যে বিপুল নৈতিক সমর্থন জানায়, সে কথাও তারা আমাকে অবহিত করেছেন। এসব কথা সর্বদা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমার নিজের ও আমার সহকর্মীদের স্মরণে থাকবে।' ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির বিকেলবেলা ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। বিমানবন্দর জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল । বিমান থেকে বঙ্গবন্ধু দেখলেন গোটা ঢাকা শহরের সব মানুষ যেন বিমানবন্দরকে ঘিরে আছে। একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর পাশেই বসা ছিলেন। তিনি দেখলেন, বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখন সেই সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনার তো আনন্দের দিন। আপনি কাঁদছেন কেন? বঙ্গবন্ধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, এত যে মানুষ আমার অপেক্ষায়। আমি ওদের খাওয়াব কী? পাকিস্তানিরা তো সব ধ্বংস করে গেছে।' জাতির পিতা না হলে ওই মুহূর্তে এ রকম কথা বলা যায় না। বঙ্গবন্ধুর উদ্বেগ ছিল খুব স্বাভাবিক। রাস্তা নেই, ব্রিজ নেই, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কোনো টাকা নেই। কানাডা সরকার তখন বঙ্গবন্ধুকে আড়াই মিলিয়ন ডলারের স্বর্ণের একটা উপহার দেয়। সেটাই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে শুরু করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বঙ্গবন্ধু যদি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করতেন তাহলে কী অবস্থা হতো আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি? ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির সেই বিকেলে তখনকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, "গত ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম 'দুর্গ গড়ে তোল'। আজ আবার বলছি, 'আপনারা একতা বজায় রাখুন'। আমি বলেছিলাম, 'বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব'। বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। 'গত ৯ মাসে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরান করেছে। বাংলার লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য লোক গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন।" বঙ্গবন্ধু অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাবান জাতিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয়। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে এসেছিলেন বলেই ভারতীয় সৈন্য অতি দ্রুত সময়ে প্রত্যাবর্তন করেছিল। পৃথিবীর কোনো দেশের স্বাধীনতার পর এত কম সময়ে মিত্রশক্তি সহজে দেশ ছাড়ে না।
চার-পাঁচ বছর আগে 'এই মাটি এই দেশ' নামে বই প্রকাশিত হয়েছিল । এই বইতে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা পাঁচটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। এই পাঁচটি প্রবন্ধের মধ্যে একটি লেখা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে । প্রবন্ধের শিরোনাম 'নেতাকে যেমন দেখিয়াছি'। এই প্রবন্ধের একটি উলেল্গখযোগ্য অংশ পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি_ "দেশ বিভাগের পর কলকাতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত থাকার সময় জনাব সোহরাওয়ার্দী গান্ধীজির সঙ্গে বেলিয়াঘাটার একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে অবস্থান করিতেন। তখনও কলকাতার মুসলিম নিধনযজ্ঞ পুরাদমে চলিতেছিল। একদিন প্রায় বিশ সহস্র লোকের একটি জনতা তাঁহাকে হত্যা করিতে আসিল। কিন্তু ভয় পাওয়ার পাত্র তিনি নন। তাই তিনিও বুক ফুলাইয়া তাহাদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, 'তোমরা যদি আমাকে হত্যা করিতে চাও, তবে এখনই কর। কিন্তু তৎপূর্বে আমাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে হইবে যে, আমার পরে তোমরা আর কোনো মুসলমানকে হত্যা করিবে না।' শোরগোল শুনিয়া গান্ধীজি বাহির হইয়া আসিয়া জনাব সোহরাওয়ার্দীর পাশে দাঁড়াইলেন এবং উন্মত্ত জনতাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, 'তোমরা যদি শহীদকে খুন করিতে চাও, তাহা হইলে আমাকে খুন কর।' এ কথা জনতার ওপর জাদুমন্ত্রের ন্যায় কাজ করিল এবং তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া চলিয়া গেল।" বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাত্মা গান্ধীর অহিংস রাজনীতির একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন। এই মহামানুষ দেশে প্রত্যাবর্তন না করলে ধবংসপ্রাপ্ত দেশের অবস্থা হতো ভয়াবহ। গোটা পৃথিবী এভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াত না। পৃথিবীর যেখানেই গেছেন সরকারপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানরা মুগ্ধ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ছিল খুবই স্বচ্ছ ও স্পষ্ট। আজকে পৃথিবীতে ধনী রাষ্ট্র ও দরিদ্র রাষ্ট্র বৈষম্যের বিরুদ্ধে অনেক বিশ্বনেতা সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু চার দশক আগে বঙ্গবন্ধু সেই কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। এখন অনেকে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের কথা বলছেন। কিন্তু সেই সময় বঙ্গবন্ধুর মতো করে অনেকে ভাবেননি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, 'আমি বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করে সে অর্থ দিয়ে দরিদ্র দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। বর্তমানে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় করা বিপুল অর্থের এক-দশমাংশও যদি জনগণের জন্য খরচ করা হয় তবে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য মুছে যাবে এবং তাতে বৃহৎ ব্যক্তিবর্গের মর্যাদাই বৃদ্ধি পাবে।' তার দৃঢ়কণ্ঠের সেই আত্মপ্রত্যয়ী উচ্চারণ সমগ্র বাঙালি জাতিকে সবসময় পথ দেখাবে। 'দেশ গড়ার কাজে কেউ সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিষ্কণ্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করবেন না, এটাই আমাদের কামনা।' বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই স্বাধীন বাংলাদেশ সার্বভৌম সত্তা নিয়ে বিশ্বসভায় জায়গা করে নিতে পেরেছিল।
সুভাষ সিংহ রায় :রাজনৈতিক বিশেল্গষক
suvassingho@gmail.com
No comments