খাদ্য তথ্যবিভ্রাট-১- চাল উৎপাদন ও ভোগের তথ্যে গোলমাল by ইফতেখার মাহমুদ
কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেখাচ্ছে, ভোগও দেখাচ্ছে কম। অথচ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঘোষণার তুলনায় উৎপাদন কম, ভোগ বেশি। আবার খাদ্য মন্ত্রণালয় উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য জেনেও উদ্বৃত্ত খাদ্য বেশি দেখিয়ে চাল রপ্তানিকে সমর্থন দিয়েছে।
সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) দেশের খাদ্য-পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে বলেছে, দেশে রপ্তানিযোগ্য উদ্বৃত্ত চাল নেই। অথচ ওই গবেষণার ফলাফলকে উদ্ধৃত করেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বর্তমানে ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে।
গত ডিসেম্বরে কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। পরে বৈঠকটি পিছিয়ে এ মাসেই করার কথা রয়েছে। বৈঠকের জন্য তৈরি কার্যপত্রে বিআইডিএসের ওই গবেষণার সূত্র উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সীমিত পরিমাণে চাল রপ্তানি করা যেতে পারে।
তবে, বিআইডিএসের গবেষকেরা বলছেন, দেশের চালের বাজারের সামগ্রিক কোনো ধারণা সরকারের কাছে নেই। এ কারণে সরকার তাদের এই গবেষণা করতে বলেছে। চালের বাজার নিয়ে আরও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তার আগে চাল রপ্তানি করার উদ্যোগ নিতে গেলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে স্থানীয় বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারেন।
খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক উত্তরে প্রথম আলোকে বলেন, সাত লাখ টন চাল থাকলেও সীমিত পরিমাণে রপ্তানি করলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। এতে যদি চালের দাম বেশি বেড়ে যায়, তাহলে খাদ্য বিভাগ তাদের হাতে মজুত থাকা চাল বিক্রি ও বিতরণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম।
তবে, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিআইডিএসের গবেষণায় সাত লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার যে হিসাব বের হয়েছে, তা বর্তমান সরকারের আমলে ধান উৎপাদনে ইতিবাচক অগ্রগতির কারণেই ঘটেছে। তাদের গবেষণাকে আমি শিরোধার্য মনে করি না। এটি আরও যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। তবে এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত নিয়ে আমি রপ্তানির পক্ষপাতী না। উৎপাদন আরও বাড়িয়ে চালের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই রপ্তানির চিন্তা হতে পারে।’
দেশের খাদ্য-পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে অসংগতি রয়েছে, এমন ধারণা থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় কৃষি ও খাদ্য-পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে বিআইডিএসকে গবেষণা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, চালের উৎপাদন ও ভোগের বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উদ্ঘাটন করে খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষকের স্বার্থে সঠিক নীতি ও কৌশল নেওয়া।
গবেষণায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (স্পারসো) ধানের উৎপাদন সম্পর্কে যে তথ্য দেয়, তার অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। আর খাদ্যনিরাপত্তায় সঠিক পদক্ষেপ কী হতে পারে, তার একটি ধারণাও দেওয়া হয়েছে। গবেষণার অন্যতম সমন্বয়কারী বিআইডিএসের মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো সমীক্ষার মতো এই গবেষণায়ও ৫ শতাংশ কম-বেশি প্রান্তিক ভুল (মার্জিন অব এরর) থাকতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সাত লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে একে প্রকৃতপক্ষে রপ্তানিযোগ্য উদ্বৃত্ত বলা যায় না। তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি বলে থাকে যে দেশে ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে, তাহলে ভুল বলেছে। কেননা, যে চাল বাজারে আছে বলে আমরা ধারণা করছি, তা ব্যবসায়ীদের আপৎকালীন মজুত। রপ্তানিযোগ্য চাল আছে কি না, তা বোঝা যাবে আগামী বোরো কাটার পর।’
‘বাংলাদেশে একটি সামগ্রিক ও কার্যকর খাদ্য বণ্টনব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্য সঠিক হিসাব’ নামের ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালকসহ আটজন জ্যেষ্ঠ গবেষক। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগবিষয়ক সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিআইডিএস নিজেরাও জরিপ চালিয়ে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
গোলমেলে তথ্য: বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে মোট তিন কোটি ৫৭ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আর নিট উৎপাদন ছিল তিন কোটি ২০ লাখ টন। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে মোট উৎপাদন তিন কোটি ৪৭ লাখ টন, নিট উৎপাদন দুই কোটি ৮৬ লাখ টন। সরকারি হিসাবে দেশে চালের মোট ভোগ বা বছরে বাংলাদেশের মানুষ মোট দুই কোটি ২০ লাখ টন চাল খায়। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে চাল ভোগের পরিমাণ দুই কোটি ৮৬ লাখ টন। বিবিএস এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছে, দেশে বড়জোর সাত লাখ থেকে আট লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিআইডিএসের গবেষণায় মাথাপিছু খাদ্য ভোগ এবং অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে মোট চালের উৎপাদন বাদ দিয়ে দেখা গেছে, মোট ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত হয়। সেই হিসাবটিই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বাড়িয়ে দেখানো হিসাব: বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি সংস্থাগুলো চালের উৎপাদন ৫ থেকে ৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেখায়। তারা মাথাপিছু খাদ্যের যে ভোগ দেখায়, তাতেও ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেখানো হয়। খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ মিলিয়ে যে হিসাব দাঁড়ায়, তাতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ চালের উৎপাদন ও ভোগের হিসাবে গরমিল রয়ে যায়।
বিআইডিএস বলছে, সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিট (এফপিএমইউ) ও বিবিএস মাথাপিছু চাল ও আটা ভোগের হিসাব কম দেখায়। আর এফপিএমইউর মাথাপিছু খাদ্য ভোগের হিসাব বাস্তবভিত্তিক গবেষণার আলোকে করা হয় না। অথচ এ তথ্যই নীতিনির্ধারক ও গবেষকেরা সব সময় ব্যবহার করে চলেছেন।
দেশের খাদ্যবিষয়ক সরকারের নীতি ও গবেষণা সংস্থা এফপিএমইউ মাথাপিছু ৪৬৪ গ্রাম চাল-গম ভোগ দেখায়। আরেক সরকারি সংস্থা বিবিএস দৈনিক গড়ে ৪৯০ গ্রাম চাল-গম ভোগ করা হয় বলে দেখায়। এই দুটি হিসাবকে আমলে নিয়েই সরকারের খাদ্যবিষয়ক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিআইডিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হিসাব সমস্যাযুক্ত। বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু দৈনিক কী পরিমাণ চাল-গম খায়, তার প্রকৃত চিত্র এর মাধ্যমে উঠে আসছে না। কারণ, বিআইডিএসের জরিপে দেখা গেছে, দেশে দৈনিক মাথাপিছু চাল ও আটার ভোগ ৫০৬ গ্রাম। অর্থাৎ একজন দিনে গড়ে ওই পরিমাণ চাল ও গম খায়। এর মধ্যে ৪৬৩ গ্রাম চাল ও ৪৬ গ্রাম আটা রয়েছে। আবার বিবিএস ২০১০ সালে খানা জরিপ করে মানুষ ঘরের বাইরে খায় এমন ১২ ধরনের খাবারকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে মোট ৩৬ ধরনের খাবার মানুষ ঘরের বাইরে খায়।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধান চাষের আবাদি জমির পরিমাণেও গরমিল রয়েছে। যেমন: ২০০৮ সালে আমন ধান চাষের এলাকার হিসাব বিষয়ে বিবিএসের নমুনা জরিপ ও কৃষিশুমারির মধ্যে পার্থক্য ৬০ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষক তাঁর নিজের জমির যে হিসাব দেন, তার ভিত্তিতে মোট চাষের জমির হিসাব করে। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণা দল কৃষকের দাবি করা চাষের জমি আমিন দিয়ে মাপজোখ করে দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জমির হিসাব কমপক্ষে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কাগজে-কলমে জমির হিসাব আরও ৫ শতাংশ বেশি দেখান। ফলে উৎপাদনও বাড়িয়ে দেখানো হয়।
গত ডিসেম্বরে কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। পরে বৈঠকটি পিছিয়ে এ মাসেই করার কথা রয়েছে। বৈঠকের জন্য তৈরি কার্যপত্রে বিআইডিএসের ওই গবেষণার সূত্র উল্লেখ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সীমিত পরিমাণে চাল রপ্তানি করা যেতে পারে।
তবে, বিআইডিএসের গবেষকেরা বলছেন, দেশের চালের বাজারের সামগ্রিক কোনো ধারণা সরকারের কাছে নেই। এ কারণে সরকার তাদের এই গবেষণা করতে বলেছে। চালের বাজার নিয়ে আরও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তার আগে চাল রপ্তানি করার উদ্যোগ নিতে গেলে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে স্থানীয় বাজারে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিতে পারেন।
খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক উত্তরে প্রথম আলোকে বলেন, সাত লাখ টন চাল থাকলেও সীমিত পরিমাণে রপ্তানি করলে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। এতে যদি চালের দাম বেশি বেড়ে যায়, তাহলে খাদ্য বিভাগ তাদের হাতে মজুত থাকা চাল বিক্রি ও বিতরণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম।
তবে, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিআইডিএসের গবেষণায় সাত লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার যে হিসাব বের হয়েছে, তা বর্তমান সরকারের আমলে ধান উৎপাদনে ইতিবাচক অগ্রগতির কারণেই ঘটেছে। তাদের গবেষণাকে আমি শিরোধার্য মনে করি না। এটি আরও যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে। তবে এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত নিয়ে আমি রপ্তানির পক্ষপাতী না। উৎপাদন আরও বাড়িয়ে চালের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই রপ্তানির চিন্তা হতে পারে।’
দেশের খাদ্য-পরিস্থিতি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যে অসংগতি রয়েছে, এমন ধারণা থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় কৃষি ও খাদ্য-পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে বিআইডিএসকে গবেষণা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, চালের উৎপাদন ও ভোগের বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উদ্ঘাটন করে খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষকের স্বার্থে সঠিক নীতি ও কৌশল নেওয়া।
গবেষণায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (স্পারসো) ধানের উৎপাদন সম্পর্কে যে তথ্য দেয়, তার অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। আর খাদ্যনিরাপত্তায় সঠিক পদক্ষেপ কী হতে পারে, তার একটি ধারণাও দেওয়া হয়েছে। গবেষণার অন্যতম সমন্বয়কারী বিআইডিএসের মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো সমীক্ষার মতো এই গবেষণায়ও ৫ শতাংশ কম-বেশি প্রান্তিক ভুল (মার্জিন অব এরর) থাকতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে সাত লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে একে প্রকৃতপক্ষে রপ্তানিযোগ্য উদ্বৃত্ত বলা যায় না। তিনি আরও বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি বলে থাকে যে দেশে ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত আছে, তাহলে ভুল বলেছে। কেননা, যে চাল বাজারে আছে বলে আমরা ধারণা করছি, তা ব্যবসায়ীদের আপৎকালীন মজুত। রপ্তানিযোগ্য চাল আছে কি না, তা বোঝা যাবে আগামী বোরো কাটার পর।’
‘বাংলাদেশে একটি সামগ্রিক ও কার্যকর খাদ্য বণ্টনব্যবস্থা পরিকল্পনার জন্য সঠিক হিসাব’ নামের ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন বিআইডিএসের মহাপরিচালকসহ আটজন জ্যেষ্ঠ গবেষক। খাদ্য উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগবিষয়ক সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্যের বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিআইডিএস নিজেরাও জরিপ চালিয়ে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে।
গোলমেলে তথ্য: বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে মোট তিন কোটি ৫৭ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আর নিট উৎপাদন ছিল তিন কোটি ২০ লাখ টন। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে মোট উৎপাদন তিন কোটি ৪৭ লাখ টন, নিট উৎপাদন দুই কোটি ৮৬ লাখ টন। সরকারি হিসাবে দেশে চালের মোট ভোগ বা বছরে বাংলাদেশের মানুষ মোট দুই কোটি ২০ লাখ টন চাল খায়। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে চাল ভোগের পরিমাণ দুই কোটি ৮৬ লাখ টন। বিবিএস এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছে, দেশে বড়জোর সাত লাখ থেকে আট লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বিআইডিএসের গবেষণায় মাথাপিছু খাদ্য ভোগ এবং অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে মোট চালের উৎপাদন বাদ দিয়ে দেখা গেছে, মোট ২৩ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত হয়। সেই হিসাবটিই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বাড়িয়ে দেখানো হিসাব: বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি সংস্থাগুলো চালের উৎপাদন ৫ থেকে ৮ শতাংশ বাড়িয়ে দেখায়। তারা মাথাপিছু খাদ্যের যে ভোগ দেখায়, তাতেও ১৫ শতাংশ কমিয়ে দেখানো হয়। খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ মিলিয়ে যে হিসাব দাঁড়ায়, তাতে কমপক্ষে ২০ শতাংশ চালের উৎপাদন ও ভোগের হিসাবে গরমিল রয়ে যায়।
বিআইডিএস বলছে, সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন ইউনিট (এফপিএমইউ) ও বিবিএস মাথাপিছু চাল ও আটা ভোগের হিসাব কম দেখায়। আর এফপিএমইউর মাথাপিছু খাদ্য ভোগের হিসাব বাস্তবভিত্তিক গবেষণার আলোকে করা হয় না। অথচ এ তথ্যই নীতিনির্ধারক ও গবেষকেরা সব সময় ব্যবহার করে চলেছেন।
দেশের খাদ্যবিষয়ক সরকারের নীতি ও গবেষণা সংস্থা এফপিএমইউ মাথাপিছু ৪৬৪ গ্রাম চাল-গম ভোগ দেখায়। আরেক সরকারি সংস্থা বিবিএস দৈনিক গড়ে ৪৯০ গ্রাম চাল-গম ভোগ করা হয় বলে দেখায়। এই দুটি হিসাবকে আমলে নিয়েই সরকারের খাদ্যবিষয়ক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বিআইডিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হিসাব সমস্যাযুক্ত। বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু দৈনিক কী পরিমাণ চাল-গম খায়, তার প্রকৃত চিত্র এর মাধ্যমে উঠে আসছে না। কারণ, বিআইডিএসের জরিপে দেখা গেছে, দেশে দৈনিক মাথাপিছু চাল ও আটার ভোগ ৫০৬ গ্রাম। অর্থাৎ একজন দিনে গড়ে ওই পরিমাণ চাল ও গম খায়। এর মধ্যে ৪৬৩ গ্রাম চাল ও ৪৬ গ্রাম আটা রয়েছে। আবার বিবিএস ২০১০ সালে খানা জরিপ করে মানুষ ঘরের বাইরে খায় এমন ১২ ধরনের খাবারকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু বিআইডিএসের হিসাবে মোট ৩৬ ধরনের খাবার মানুষ ঘরের বাইরে খায়।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ধান চাষের আবাদি জমির পরিমাণেও গরমিল রয়েছে। যেমন: ২০০৮ সালে আমন ধান চাষের এলাকার হিসাব বিষয়ে বিবিএসের নমুনা জরিপ ও কৃষিশুমারির মধ্যে পার্থক্য ৬০ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষক তাঁর নিজের জমির যে হিসাব দেন, তার ভিত্তিতে মোট চাষের জমির হিসাব করে। কিন্তু বিআইডিএসের গবেষণা দল কৃষকের দাবি করা চাষের জমি আমিন দিয়ে মাপজোখ করে দেখেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জমির হিসাব কমপক্ষে ২ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা কাগজে-কলমে জমির হিসাব আরও ৫ শতাংশ বেশি দেখান। ফলে উৎপাদনও বাড়িয়ে দেখানো হয়।
No comments