গীতাঞ্জলির শতবর্ষ by মুস্তাফা মাসুদ
শতবর্ষেরও বেশি আগে ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২ ফাল্গুন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তাঁর ১৪০০ সাল কবিতায় শতবর্ষের পরের পাঠকদের উদ্দেশ করে নিবিড়, অন্তরঙ্গ ভাষায় স্বগতোক্তি করেছিলেনÑ ‘‘আজি হতে শতবর্ষ পরে/কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/কৌতূহলভরেÑ/আজি হতে শতবর্ষ পরে/আজি নববসন্তের প্রভাতের আনন্দের লেশমাত্র ভাগÑ/আজিকার কোনো ফুল,
বিহঙ্গের কোনো গান,/ আজিকার কোনো রক্তরাগ/অনুরাগে সিক্ত করি পারিব না পাঠাইতে/তোমাদের করে/আজি হতে শতবর্ষ পরে।’’ (চিত্রা)যে অফুরন্ত সৃজন-আনন্দসম্ভার যুগ-যুগান্তেরÑ অনাগতকালের বাঙালী পাঠকদের জন্য তিনি রেখে গেছেন তা আজও কোটি কোটি বাংলাভাষীকে সিক্ত করছে; আলোড়িত-আন্দোলিত করছে। কবিগুরু যে অপরিসীম প্রত্যয়ে উচ্চারণ করেছিলেনÑ‘কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে’Ñঅবশ্যই তার কবিতা পরম আগ্রহ, কৌতূহল আর ভালবাসা নিয়ে পড়ছে মানুষ। তাকে না পড়ে, তার রসধারায় স্নাত না হয়ে বাঙালীর যে উপায় নেই। কারণ, আমাদের হাসি-আনন্দ, কষ্ট-যাতনা, হতাশা-ব্যর্থতা; আমাদের আত্ম-উজ্জীবন, দুঃখে সান্ত¡না, আধ্যাত্মিকতা, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, ‘অবারিত মাঠ গগন-ললাট’Ñ কোথায় নেই তিনি? কবি দীনেশ দাশ যেমনটি বলেছেনÑ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা।’ জগতের সব শুভ আর কল্যাণপ্রসূ বিষয়কে তিনি ধারণ করেছেন এবং নিজের প্রতিভাস্পর্শে অপরূপ মহিমায় ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়। তিনি বিদ্রোহী নন; কিন্তু দ্রোহ, সাহস আর বরাভয়ের অনিঃশেষ ¯্রােতধারা। মানুষের সকল মানবিক অনুভূতি নানা রঙে, নানা প্রকরণে, নানা মাত্রা ও স্বাদে তার রচনায় বাঙময় হয়েছে। বাংলার চিরকালের মরমীবাদ বা ভক্তিবাদ অভূতপূর্ব এক শিল্পময় দ্যোতনায় তার কবিতা ও গানে প্রকাশিত হয়েছে, যা মানুষের মনকে নির্মল রসময়তায় আপ্লুত করে; নৈমিত্তিক ক্লেদ-কালিমা আর সংকটের উর্ধে এক অনির্বচনীয় আনন্দলোকের অভিসারী করে। তাঁর রচনার বিশ্বজনীনতা তাকে চিরকালের কবি হিসেবে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করেছেÑতিনি বিশ্বকবির সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
রবীন্দ্রসত্তার এই বিশালত্ব, এই পরিপূর্ণ বহুমাত্রিকতা অনুধাবন করতে বাংলাভাষীদের একটু সময় লেগেছিল। তবে তার নোবেলজয়ের পর বাঙালী যেন নতুন করে আবিষ্কার করল এক বিশ্বজয়ী মহাকবিকেÑ এক নতুন রবীন্দ্রনাথকে। তিনি বিশ্বের শীর্ষপুরস্কার নোবেল প্রাইজ পান আজ থেকে শতবর্ষ আগেÑ ১৯১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি। এদিন রবীন্দ্রনাথের জন্য যেমন গর্বের দিন, তেমনি বাংলাভাষী মানুষ ও বাংলাভাষার জন্যও এক চিরস্মরণীয় দিন। এদিনই তাকে বিশ্বের শীর্ষ পুরস্কার নোবেল প্রাইজ প্রদান করে নোবেল কমিটি। তিনি তার গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য প্রথম ভারতীয় এবং বাঙালী হিসেবে এ পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বস্বীকৃতির নিয়ামক তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যটি। গীতাঞ্জলির দুটি ভার্সনÑএকটি বাংলায় অন্যটি ইংরেজিতে। তবে দুটি ভার্সনের মধ্যে পার্থক্য আছে। বাংলা গীতাঞ্জলিতে সর্বমোট ১৫৭টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালের ১৪ আগস্ট। অন্যদিকে ইংরেজী গীতাঞ্জলি, যার অনূদিত নাম সং অফারিংস্Ñ সেটি তৈরি হয়েছে কবির লেখা দশটি কাব্যের মোট ১০৩টি কবিতার সমন্বয়ে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯১২ সালের নবেম্বর মাসে। মূলত এই ইংরেজী গীতাঞ্জলি (সং অফারিংস)ই নোবেল পুরস্কারের জন্য নোবেল কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়েছিল। ইংরেজী গীতাঞ্জলিতে যেসব কাব্যের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলো হলো : গীতাঞ্জলি-৫১টি, গীতিমাল্য ১৭টি, নৈবেদ্য-১৬টি, খেয়া-১১টি, শিশু-৩টি, চৈতালি-১টি, স্মরণ-১টি, কল্পনা-১টি, উৎসর্গ-১টি এবং অচলায়তন-১টি। এই দশটি কাব্যের ১০৩টি বাংলা গীতিকবিতা কবি অত্যন্ত সহজ, প্রাঞ্জল এবং হৃদয়স্পর্শী ভাষায় ইংরেজীতে অনুবাদ করেন; তবে ছন্দবদ্ধ অন্তঃমিলযুক্ত কবিতায় নয়, কবিতার আবেগ এবং মাধুর্যমাখা গদ্যে। সেই অনুবাদেও কবির অন্তরের মূল কথাটি, উদ্দিষ্ট ভাবটি স্বতঃপ্রবাহিত ঝরনার মতো এগিয়ে চলেছে; ভিনদেশী পাঠকদের হৃদয়-মন সিক্ত করেছে। এক সহজ, স্বচ্ছন্দ, অকৃত্রিম আর নতুনতর ভাবের সাথে পরিচিত হয়েছে পাশ্চাত্য, যা ভোগ ও বস্তুবাদী সমাজে সম্পূর্ণ নতুন এক মহিমা নিয়ে উপস্থিত হয়। একটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক:
I KNOW not how thou singest, my
master ! I ever listen in silent amaze-
ment.
The light of thy music illumines the
world. The life breath of thy music
runs from sky to sky. The holy stream
of thy music breaks through all stony
obstacles and rushes on.
My heart longs to join in thy song,
but vainly struggles for a voice. I
would speak, but speech breaks not into
song, and I cry out baffled. Ah, thou
hast made my heart captive in the end-
less meshes of thy music, my master ! I KNOW not how thou singest, my
master ! I ever listen in silent amaze-
ment.
The light of thy music illumines the
world. The life breath of thy music
runs from sky to sky. The holy stream
of thy music breaks through all stony
obstacles and rushes on.
My heart longs to join in thy song,
but vainly struggles for a voice. I
would speak, but speech breaks not into
song, and I cry out baffled. Ah, thou
hast made my heart captive in the end-
less meshes of thy music, my master !
এর সাথে বাংলা গীতাঞ্জলির মূল কবিতাটি এবার মিলিয়ে দেখা যাক:
তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী,
অবাক হয়ে শুনি কেবল শুনি।
সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে,
সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে,
পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে,
বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী।
মনে করি অমনি সুরে গাই,
কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই।
কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে;
হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে;
আমায় তুমি ফেলেছ কোন্ ফাঁদে
চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি!
ইংরেজী গীতাঞ্জলি থেকে আরও একটি দৃষ্টান্ত দেখুনÑ
LIGHT, my light, the world-filling light,
the eye-kissing light, heart-sweetening
light!
Ah, the light dances, my darling, at
the centre of my life; the light strikes,
my darling, the chords of my love; the
sky opens, the wind runs wild, laughter
passes over the earth.
The butterflies spread their sails on
the sea of light. Lilies and jasmines
surge up on the crest of the waves of
light
The light is shattered into gold on
every cloud, my darling, and it scatters
gems in profusion.
Mirth spreads from leaf to leaf, my
darling, and gladness without measure.
The heaven’s river has drowned its
banks and the flood of joy is abroad.
এই অনুবাদটির সাথে মূল রবীন্দ্রসঙ্গীতটি মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, ভাবের গভীরতা আর গতিচঞ্চল, নৃত্যশীল ব্যঞ্জনাকে কবি কী চমৎকারভাবেই না ফুটিয়ে তুলেছেনÑ
আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবন ভরা
আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা।
নাচে আলো নাচে ও ভাই, আমার প্রাণের কাছেÑ
বাজে আলো বাজে ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে।
জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা।
আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি
আলোর ঢেউয়ে উঠল মেতে মল্লিকা মালতী।
মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই যায় না মানিক গোনাÑ
পাতায় পাতায় হাসি ও ভাই পুলক রাশি রাশি।
সুরনদীর কূল ডুবেছে সুধা-নিঝর-ঝরা।
এই তুলনামূলক উপস্থাপনের মুখ্য উদ্দেশ্য কবির অনুবাদের উৎকর্ষ প্রমাণ করা নয়; বরং তিনি তাঁর প্রাচ্যভাবনা তথা আবহমান বাংলার ভক্তিবাদী মরমী ভাবনা-দর্শনকে বাংলা কবিতায় যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন, ইংরেজী অনুবাদেও তার মূল সুর কীভাবে সেই ঐশ্বর্যকে অক্ষুণœ রেখেছে তা দেখানো। অনুবাদের মাধ্যমে তিনি তার মূল বক্তব্যকে ভিনভাষীদের সামনে যথার্থভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলেন বলেই গীতাঞ্জলি নোবেল জয় করেছিল। তিনি যখন একান্ত নিবেদিতচিত্তে স্রষ্টার উদ্দেশে উচ্চারণ করেন : ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ-ধুলোর তলে’ অথবা ‘অন্তর মম বিকশিত কর/ অন্তরতর হে।’ কিংবা ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো/এ নহে মোর প্রার্থনা/বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ অথবা এমনি আরো আরো গীতিকবিতা তখন সেই সুর, সেই আত্মনিবেদন, সেই মরমীবাদের ফল্গুধারা ইউরোপসহ সমগ্র পাশ্চাত্যবিশ্বকে আলোড়িত, আন্দোলিত করবেÑএটাই ছিল প্রত্যাশিত। তাই তো খ্যাতিমান ইংরেজ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গীতাঞ্জলির ইংরেজী অনুবাদে এক দীর্ঘ ভূমিকা লেখেন। সেখানে তিনি গীতাঞ্জলির কবিতাগুলোকে ‘মৌলিক গীতিকবিতা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং এই বইয়ের রচনাগুলো তাকে যে প্রবলভাবে ‘আলোড়িত’ করেছেÑ তা তিনি অকপটে স্বীকার করেন। ইয়েটসের এই অকপট প্রশংসা যে কতখানি বস্তুনিষ্ঠ ছিল, শতবর্ষ পরেও গীতাঞ্জলির বাণী ও সুরের সর্বজনীন আবেদন তার প্রমাণ। নোবেলজয়ের শতবর্ষে আমরা বিশ্বকবিকে জানাই অশেষ শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
No comments