সৌরম-লের আধুনিক দুই গ্রহ by নাদিরা মজুমদার
এই মুহূর্তে ইউরনাসকে ঘিরে কয়েকটি প্রশ্ন রয়ে গেছে। যেমনÑ (১) ইউরেনাস সূর্য থেকে যে পরিমাণ তাপ গ্রহণ করছে, তার চেয়ে কম তাপ কেন বিকিরণ করছে? অথচ অন্য সব গ্যাসীয় গ্রহ তো এমনটি করছে না? কেন?
তবে কি ইউরেনাসের ভেতরটি শীতল, ঠাণ্ডা? (২) কেনইবা তার অক্ষটি অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে রয়েছে? বিশাল, বৃহৎ ভারি কোন বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষের দরুন কি তা হয়েছে?(৩) দুই গ্যাসীয় গ্রহের বৃহস্পতি ও শনির তুলনায় ইউরেনাস ও নেপচুনের গঠন উপাদানে এত এত কম পরিমাণের হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম থাকার কারণটি কি? বা এই আধুনিক দুই গ্রহ সূর্য থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে বলেই কি এমনটি হয়েছে?
(৪) ইউরেনাসে ঋতু পরিবর্তন ঘটে; তাই তার আবহাওয়াটি কেমন হবে?
সৌরম-লের দ্বিতীয় আধুনিক গ্রহ, নেপচুনের কথা বলা যাক এবারে। সূর্য থেকে তার অবস্থান অষ্টম, এবং ব্যাসের হিসেব অনুযায়ী সৌরম-লের চতুর্থ বৃহত্তম গ্রহ সে। তার ব্যাসের পরিমাণ ৪৯৫৩২ কিলোমিটার (বিষুব রেখা বরাবব)। সরকারী সংজ্ঞা অনুযায়ী নেপচুন সৌরম-লের সর্বশেষ গ্রহও বটে। প্লুটোকে পূর্ণগ্রহের মর্যাদা থেকে সরিয়ে ‘বামন গ্রহ’ করাতেই তা সম্ভব হয়েছে।
ইউরেনাসের সন্ধান পাওয়ার পরে দেখা গেল যে, নিউটনের সূত্রাবলী অনুযায়ী তার কক্ষপথটি যেমন হওয়া উচিত তা নয় কিন্তু। অর্থাৎ, দূরে অনেক দূরে, ইউরেনাসকে ছাড়িয়ে দূরান্তরে নিশ্চয়ই আরেকটি গ্রহ রয়েছে। যে নাকি ইউরেনাসের কক্ষপথে বিঘœ ঘটাচ্ছে। অবশেষে ১৮৪৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গেইল (এঅখখঊ) ও ডি’এ্যারেস্ট (উ’অজজঊঝঞ) প্রথমবারের মতো নেপচুনকে মহাকাশে দেখতে পান। কিন্তু সমস্যা হলো যে এ্যাডামস ও লি ভেরিয়ের (খঊ ঠঊজজওঊজ) নামে দুই বিজ্ঞানী বৃহস্পতি, শনি ও ইউরেনাসের অবস্থানকে ভিত্তি করে নেপচুনের সম্ভাব্য অবস্থাননের যে একটি হিসাবনিকাশ করেন, প্রথমোক্ত দুই বিজ্ঞানী নেপচুনকে ওই হিসাব কষা অবস্থানের খুবই কাছে আবিষ্কার করেন। ফলে নতুন গ্রহ আবিষ্কারের ও নামকরণের আবিষ্কার অগ্রাধিকার ইত্যাদি কার হওয়া উচিত, তা নিয়ে ইংরেজ ও ফরাসীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কলহ-তর্কে নেমে পড়ে। আপাতদৃষ্টে, বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যেও ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়েননি বলে মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত আপোস-রফা হয় যে, দুই দেশের বিজ্ঞানীরাই কৃতিত্বের যুগ্ম ভাগীদার হবেন। অবশ্য পরবর্তীকালীন পর্যবেক্ষণগুলো থেকে দেখা যায় যে, নেপচুনের আসল কক্ষপথ এ্যাডামস ও লি ভেরিয়েরের কষা হিসাব থেকে আদতে বেশ অনেকটা দূরেই বিদ্যামান। অন্যভাবে বলা যায় যে, গেইল ও ডি’এ্যারেস্ট যদি আরও কয়েক বছর আগে কী করে নেপচুনের খোঁজ করতেন তো এ্যাডামস ও লা ভেরিয়েরের কষা হিসাব মতো স্থানে নেপচুনকে দেখা যেত না।
গ্যালিলিও আসলে ১৬১৩ সালে নেপচুনকে দেখেছিলেন; সেই বছর ঘুরতে ঘুরতে বৃহস্পতির বেশ কাছে চলে এসেছিল নেপচুন। গ্যালিলিওর কপাল মন্দ ছিল বলা যায়। প্রথম দর্শনে তিনি নেপচুনকে নক্ষত্র ভাবেন। পর পর দু’রাত তাকে অবলোকন করেন বটে, কিন্তু পরবর্তী রাতগুলোতে সে তাঁর দৃষ্টিক্ষেত্রের বাইরে চলে যায়। প্রথম যে দুই রাত গ্যালিলিও তাকে পর্যবেক্ষণ করেন, সেই দু’রাতের পূর্ববর্তী রাতগুলোতে আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। তাই টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে নেপচুনের গতিবিধি অবলোকনের কোন সুযোগ তিনি পাননি। যদি পেতেন তো গতিবিধি থেকেই নেপচুনকে তিনি ঠিকই চিনে নিতে পারতেন।
ইউরেনাসের মতো নেপচুনকেও ভয়েজার ২ দর্শন দেয়; কয়েক বছর বাদে, ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে। বর্তমানে নেপচুন সম্পন্ধে আমরা যা জানি, তার এক বিরাট অংশের কৃতিত্ব ভয়েজার ২-এর একমাত্র দর্শনটি। তবে আজকাল হাবল স্পেস টেলিস্কোপ (এইচএসটি) ও পৃথীবীভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও নেপচুন বিষয়ক আমাদের জ্ঞানের পরিধির প্রবৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। যেমনÑবামনগ্রহ প্লুটো আচরণে কিছুটা বা পাগলাটে, অদ্ভুতও বটে! কখনওবা সে নিজের কক্ষপথ ধরে নেপচুনের কক্ষপথকে এপার-ওপার করে পার হয়। ফলে কয়েক বছরের জন্য নেপচুন হয়ে পড়ে সূর্যের দূরতম গ্রহ। নেপচুনের গঠন উপাদান হয়তোবা ইউরেনাসের মতোই হবে। যেমনÑ নানা ধরনের বরফ, শিলা এবং মাত্র পনেরো শতাংশ হাইড্রোজেন ও সামান্য পরিমাণে হিলিয়াম নিয়ে সে গঠিত। একইভাবে, ইউরেনাসের মতোই অভ্যন্তরীণ স্তরগুলো সহজ দৃষ্ট না হলেও গঠন-উপাদানের বণ্টন ছিমছাম সুষমভাবে হয়েছে। বৃহস্পতি ও শনির সঙ্গে নেপচুনের পার্থক্যটি এখানেই। খুব সম্ভব শিলা ও শিলাজ বস্তু দিয়ে গঠিত ছোট্ট একটি মর্মবস্তু (কোর) তার রয়েছে, এবং ভরের পরিমাণ আমাদের পৃথিবীর ভরের প্রায় সমান হবে। বায়ুম-লটিও, ইউরেনাসের মতো, প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম এবং সামান্য পরিমাণের মিথেন গ্যাস দিয়ে তৈরি।
বায়ুম-লের মিথেন গ্যাস লাল রঙকে শুষে নিচ্ছে বলে নেপচুনও দেখতে নীল বর্ণের। সেই সঙ্গে অজানা বাড়তি কোন ক্লোরোফরম নেপচুনের মেঘমালাকে উজ্জ্বল নীলের আভায় আরও সুন্দর বর্ণময় করে রেখেছে। গ্যাসীয় গ্রহের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য ও নেপচুনের মধ্যে প্রবল। যেমন- হঠাৎ দমকা হাওয়া কি বড়সড় আকারের ঝড় বা ঘূর্ণাবর্ত ঘটে চলেছে সেখানে। এগুলো গ্রহটিকে ঘিরে থাকা একাধিক বন্ধনীর চৌহদ্দিতেই সীমিত। অবশ্য সৌরম-লের বাকি সদস্যরাও যে ঝড়ো হাওয়ার সৃষ্টি করছে বেগের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে নেপচুনের হাওয়াই সবচেয়ে ক্ষিপ্ত ও দ্রুতগামী, ঘণ্টাপ্রতি এই গতিবেগ ২০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বৃহস্পতি ও শনির মতো নেপচুনেরও রয়েছে তাপের অভ্যন্তরীণ উৎস। ফলে সে সূর্য থেকে যতটুকু না তাপ শক্তি গ্রহণ করছে তার দ্বিগুণ পরিমাণ বিকিরণ করে দিচ্ছে। ভয়েজার-২ যখন নেপচুনে গিয়েছিল, সেই সময়ে নেপচুনের গায়ে বেশ বড়সড় গাঢ় এক দাগ বা স্পট দেখে সে যাকে গ্রেটডাক স্পট বলা হয়। স্পটটি আকারে বৃহস্পতির গ্রেট রেড স্পটের প্রায় অর্ধেক; অর্থাৎ আমাদের পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় সমান মাপের! নেপচুনের প্রবল ঝড়ো বাতাস পশ্চিমদিক বরাবর বৃহৎ গাঢ় স্পটের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ভয়েজার-২ দক্ষিণ গোলার্ধেও ছোট আরেকটি গাঢ় স্পট দেখে। এবং আরও দেখে অনিয়মিত সাদা মেঘ, যা নাকি প্রায় প্রতি ১৬ ঘণ্টা অন্তর অন্তর নেপচুনকে ঘিরে থাকছে। বর্তমানে মেঘটির নাম দেয়া হয়েছে ‘দ্য স্কুটার’। পুচ্ছ স্বরূপ মেঘটি সম্ভবত বায়ুম-লের নিম্নাংশ থেকে উঠে আসছে; তবে তার সত্যিকারের প্রকৃতি এখনও রহস্যই হয়ে রয়েছে।
কিন্তু ১৯৯৪ সালে এইচএসটির মাধ্যমে আবিষ্কার হয় যে, নেপচুনের বৃহৎ গাঢ় স্পটটি আর নেই, বা দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে সে! কারণ কি? জানি না আমরা। হলেও হতে পারে যে, বায়ুম-লের বিবিধ ধরনের ক্রিয়া কৌশল বা কার্যতৎপরতা স্পটটিকে মুখোশ পরিয়ে আড়াল করে রেখেছে। এই ১৯৯৪ সালেই, মাত্র কয়েকমাস বাদে এইচএসটি নেপচুনের উত্তর গোলার্ধে নতুন এক গাঢ় রঙের স্পট আবিষ্কার করে। ফলস্বরূপ আমরা হয়তো এটুকু বলতে পারি যে, গ্রহটিতে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে থাকে অত্যন্ত দ্রুত; এবং মেঘের উপরাংশ ও নিম্নাংশের মধ্যে তাপমাত্রার সামান্য কমবেশিই হয়তোবা তার জন্য দায়ী। এত এত ‘হয়তো’ আর ‘মনে হয়’-এর সমারোহ থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ উন্মুক্ত রয়েছে।
আর সব গ্যাসীয় গ্রহের মতো নেপচুনেরও বন্ধনী বা রিং রয়েছে। পৃথিবীভিত্তিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় কেবল অতি অস্পষ্ট, অথচ অসম্পূর্ণ বক্ররেখা দেখা গেলেও ভয়েজার-২ কিন্তু গুচ্ছবাঁধা সম্পূর্ণ বন্ধনীর সুন্দর ছবি তুলেছে। বন্ধনীগুলোর একটি আবার অদ্ভুতভাবে পাকানো অবস্থায় থেকে দুর্লভ দর্শনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ইউরেনাস বা বৃহস্পতির মতো নেপচুনের বন্ধনীগুলোও অত্যন্ত গাঢ় রঙের, তবে তাদের গঠন উপাদান এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি।
নেপচুন আবিষ্কারের ক্রেডিট নিয়ে উদ্ভূত বাকবিতণ্ডার সমাধানের একটি উপায় দেখা যায় বন্ধনীগুলোর নামকরণে। একেবারে বাইরের দিকের বন্ধনীটির নাম দেয়া হয়েছে এ্যাডামস। এর আবার রয়েছে তিনটি সহজ লক্ষ্য রেখা, এবং দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো বাঁকা। বর্তমানে এই তিন রেখার নাম রাখা হয়েছে: লিবার্টি, ইকুয়ালিটি ও ফ্রেটারনিটি। এ্যাডামসের ঠিক পরের বন্ধনীটি নামহীন রয়ে গেছে। তবে নামহীনের ঠিক পরেরটিকে ডাকা হচ্ছে লেভিরিয়ের নামে। লেভিরিয়ের রয়েছে বাইরের দিকে সম্প্রসারিত দুটি অংশ এবং তাদের নাম দেয়া হয়েছে ল্যাসেল ও এ্যারাগোনাম। সর্বশেষে অস্বচ্ছ হলেও চওড়া বন্ধনীটির নাম হয়েছে গেইল। আপাতদৃষ্টে কোন বন্ধনীকে ডি’এ্যারেস্ট নাম দেয়া হয়নি। অন্যদিকে একটি বন্ধনী নামহীন হয়ে রয়েছে; নামকরণের আপোসরফায় নামহীন বন্ধনীর নাম পরিচয় কি ডি’এ্যারেস্ট হবে?
নেপচুনের চুম্বকীয় ক্ষেত্রটিও ইউরেনাসের ক্ষেত্রের মতোই অদ্ভুতভাবে অবস্থান করে আছে। হতে পারে যে, নেপচুনের মধ্যবর্তী স্তরে বা স্তরসমূহে রয়েছে কোন পরিচালন বস্তু-তা সে জলও হতে পারে; এবং এই পরিচালন বস্তুর গতিশীলতার কারণেই গ্রহটির চুম্বকীয় ক্ষেত্রও অদ্ভুত অবস্থান নিয়েছে। স্রেফ বাইনোকুলারের সাহায্যেও নেপচুনকে মহাকাশে দেখা সম্ভব। তবে মহাকাশের কোন দিকটাতে তাকাতে হবে, সেটি আগে জেনে নেয়ার দরকার হবে।
নেপচুনকে ঘিরে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। যেমন- (১) চুম্বকীয় ক্ষেত্রটি গ্রহের কেন্দ্রের সঙ্গে কেন্দ্রীভূত নয়, এবং তার ঘূর্ণন অক্ষও বৃহৎ কোণ করে ঘুরছে। নেপচুনের কি বা কোনসব অভ্যন্তরীণ কর্মপদ্ধতি এমন এক অদ্ভুত চুম্বকীয় ক্ষেত্রের জন্ম দিয়েছে? (২) গঠন উপাদানে, তুলনামূলকভাবে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের কমতি থাকার কারণ কি? (৩) সূর্য থেকে এত দূরে থাকা সত্ত্বেও, কম করে ৪৫০৪০০০০০০ কিলোমিটার দূরত্ব তো হবেই, নেপচুনের হাওয়ার এত দাপট কেন? অথচ তার ভেতরকার তাপ-উৎস তুলনামূলকভাবে বেশ দুর্বলই!
(৪) সৌরম-লের অষ্টম ও সর্বশেষ গ্রহটিকে সুলভ মূল্যে আবরও দর্শন দেয়া কি সম্ভব?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলো থেকে অনায়াসে বলা যায় যে, বিজ্ঞানীরা আরও বেশ কয়েকটি বছর নেপচুন বিষয়ক ধাঁধার জট খুলতে ব্যস্ত থাকবেন।
nadirahmajumdar@gmail.com
No comments