বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-রাষ্ট্র ও আইনের মধ্যেই সমস্যার শেকড় by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, তাঁর সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে সচেষ্ট রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ সমস্যা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই উচ্চারণ প্রশংসাযোগ্য এ কারণে, এ দেশে যাঁরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যান তাঁরা রাষ্ট্রের ক্ষত প্রত্যক্ষ করেও
সত্য উচ্চারণে বড় বেশি আড়ষ্ট থাকেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা হয়তো বলতে পারি, তিনি জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতার বিষয়টি বিস্মৃত হননি। তবে তাঁর বক্তব্যের মাঝেই আমরা বিস্ময় এবং হতাশার বীজও পাই। তিনি বলেছেন, ক্রসফায়ার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না! প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কিছু বিষয় আছে যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হয়। যেমন_এক সরকারের সময়ে বিদেশের সঙ্গে কোনো বাণিজ্যিক চুক্তি হলে কিংবা উভয় পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্য কোনো বিষয় হলে তা হঠাৎ পরিবর্তন করা যায় না। ক্রসফায়ার কি তেমন কোনো বিষয়? ক্রসফায়ার হচ্ছে রাষ্ট্রের বৈধ সংস্থাগুলোর সৃষ্ট গুরুতর অপরাধ। এত বড় অপরাধের শেকড় উপড়ে না ফেলে প্রধানমন্ত্রী গোটা সমাজকে অপরাধমুক্ত করবেন কিভাবে? যাঁরা এই মানবতাবিরোধী কাজ করছেন, তাঁরা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থার সদস্য এবং অবশ্যই দেশের আইনের ঊধর্ে্ব নন। তবে কেন এমন বেআইনি তৎপরতা বন্ধ করার কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি নয়?
আমাদের স্মরণে আছে ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, দেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটছে না! সত্যকে আড়াল করার এই প্রবণতা রাষ্ট্র ও সমাজ দেহের ক্ষতকেই যে বিস্তৃত করে তা তাঁরা বোঝেন না, এমন নয়। আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাটাই এমন, এখানে যিনি যত বেশি গলাবাজি করতে পারেন, সত্যকে চেপে রাখতে পারেন_তাঁরাই মনে করেন সাফল্যের ঝুড়িতে বুঝি কিছু ঢোকাতে পারলেন। কিন্তু এই পথ ভ্রান্ত। দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা আমাদের শাসকদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিকট-অতীতে উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ক্রসফায়ারের তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছিলেন। সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। এরপরের ঘটনাবলি সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। তাহলে এই যে অহরহ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের কথা শাসক মহল থেকেও বলা হচ্ছে, তা কি স্ববিরোধিতা নয়? তাদের মনে রাখা উচিত, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, তাদের অচেতন করে রাখার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও।
কোনো কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সার্বিক অবস্থার চালচিত্র ঝিলিক দিয়ে ওঠে এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কোথায় আছি। এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র পরিচালকদের কেউ কেউ যখন সত্য চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তাঁদের দায়ের দিকটিই আরো স্ফীত হয়। ক্রসফায়ার কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এমনই ঘটনা, যা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনকে পদদলিত করে অবিরত ঘটে চলেছে। নদীর পাড়ে, বিলের ধারে, জঙ্গলে, খোলা মাঠে, বাঁধের ওপর, সড়ক বা নর্দমার মাঝে গুলিবিব্ধ নিথর মনুষ্যদেহ এভাবে পড়ে থাকার চিত্র রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না, শাসকদের শাসনব্যবস্থাকে সুশাসন বলে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে পারে না। সরকারের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবেই যাঁর যাঁর মতো করে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করুন না কেন_চূড়ান্ত কথা হলো, এভাবে চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পথ সুগম না করে এ পথে সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত করা আদৌ সম্ভব নয়। যদি তা-ই হতো তাহলে এত দিনে অন্য চিত্র দেখা যেত। তা ছাড়া 'ক্রসফায়ার'-এর নামে যেসব নিত্যনতুন গল্পের অবতারণা করা হয়, তাও বড় বিস্ময়কর। 'ক্রসফায়ার' মানে উভয় পক্ষে গুলিবিনিময়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ঘটনাগুলো ঘটছে একতরফা। ইতিমধ্যে 'ক্রসফায়ারে' নিহতদের মধ্যে অনেকেরই নাম এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ ছিল না। আইনের শাসনের পথ পরিত্যাগ করে বিনা বিচারে কথিত অপরাধীদের ধরে ধরে মেরে ফেললেই সমাজ আলোকিত, সন্ত্রাসমুক্ত, নিরাপদ হয়ে যায় না। এমন নজির কোথাও নেই। যদি যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে কেউই অপরাধ করার সাহস পাবে না_এটিই হলো স্বতঃসিদ্ধ কথা। এমনটি নিশ্চিত করা যখন সম্ভব হবে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদেরও বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে আর আষাঢ়ে গল্প বলার প্রয়োজন হবে না। সমাজবিরোধী বা অপরাধী চক্রের মূলোৎপাটন শান্তিপ্রিয় সবারই চাওয়া। কিন্তু তা হোক বৈধ পন্থায়। অবৈধ পন্থায় এমনটি চললে স্বেচ্ছাচারীর সংখ্যাই শুধু বাড়বে, আখেরে কোনো ফল মিলবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। কথাটি অসত্য নয়। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কি অতি জরুরি নয়? আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, অগণতান্ত্রিক কিংবা সামরিক সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আমাদের এও স্মরণে আছে, ২০০৪ সালে অপারেশন ক্লিন হার্ট চালুর পর এই অভিযানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়মুক্তি আইন করে বিচার থেকে রেহাই দেওয়া হয়। অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান, কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নন_রাষ্ট্র পরিচালকদের এই অঙ্গীকারের ব্যত্যয় ঘটানো হলো। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে এবং তৎপরবর্তী সময়ে কারাগারে জাতীয় চার নেতার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সভ্যতা-মানবতাবিরোধী যে কুনজির স্থাপন করা হয়েছিল, তা ইতিহাসের কালো অধ্যায়। আইন করে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। দুঃখজনক কিন্তু সত্য, আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার অপক্রিয়া থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি_বিদ্যমান পরিস্থিতি এরই সাক্ষ্যবহ। অর্থাৎ সমস্যার শেকড় রাষ্ট্র ও আইনের মধ্যেই রয়েছে। কোনো বাহিনী কিংবা সংস্থার সদস্যদের যখন তাঁদের অপরাধের দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয় তখন তাঁরা আইনবহির্ভূত কাজ করতেই উৎসাহবোধ করবেন, এটিই তো স্বাভাবিক। এখানে হয়েছেও তাই। এলিট ফোর্স র্যাবের জন্মের পেছনে রয়েছে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অপরিসীম ব্যর্থতা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য তো আছেই। সে প্রসঙ্গে আজ আর আলোচনা করলাম না। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যখন একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছিল, তখন আজকের ক্ষমতাসীনরা এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম করার তাগিদ দিচ্ছিলেন। তাই এখন তাঁদের শাসনামলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী এই প্রেক্ষাপটে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে তাঁর সরকার সচেষ্ট রয়েছে বলে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মানুষ আশান্বিত হয়েছে এবং তাদের প্রত্যাশা, কেবল সদিচ্ছা নয়, সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে প্রমাণ করুক, কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নয়। কিন্তু তিনি যে বললেন ক্রসফায়ার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না, এর মধ্য দিয়ে তাঁর অসহায়ত্বও ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থাগুলোর সদস্যরা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের চেয়ে প্রতাপশালী হতে পারেন না।
সমস্যা চাপা দিয়ে রেখে কিংবা এড়িয়ে গিয়ে এর সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যখন বলেন, দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ক্ষমতাবান, স্বেচ্ছাচারী সদস্যরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং এর আলামত ইতিমধ্যে বহুবার মিলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের দায়িত্ব হলো অপরাধীদের শনাক্ত এবং পাকড়াও করে বিচারে সোপর্দ করা এবং কেউই যাতে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু তাঁদের কয়জন সততা-স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এ কাজটি করতে পারছেন? ধরে ধরে গুলি কিংবা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে ফেলা তাঁদের কাজ নয়। রাষ্ট্র কারো স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর ক্ষেত্র নয়। যদি তা-ই হয়, তাহলে আইন, সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীনতা একবার দেখা দিলে তার কত ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে, এমন নজির বিশ্বে আছে। মামলার তদন্ত যদি সুষ্ঠু হয়, মামলা যদি সততা-স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সাজানো হয়, তাহলে আইনের ফাঁক গলে কোনো অপরাধীই বেরিয়ে আসতে পারবে না। আগে ব্যবস্থার গলদ সারাতে হবে, তবেই অবস্থার পরিবর্তন হবে। কোন দল ক্ষমতায় আছে বিচার্য তো সেটা নয়, বিচার্য হলো আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে কি না_এ বিষয়টি যথাযথভাবে মনিটর করা। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে যে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, আমরা এর প্রতিফলন দেখতে চাইব। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় বিশ্বাস স্থাপন করে এটুকু আস্থা রাখি, ক্রসফায়ার তিনি মোটেই পছন্দ করেন না, তবুও তো প্রশ্ন আসেই_তাহলে তাঁর অনিচ্ছা, আপত্তি, বিরোধিতা সত্ত্বেও ক্রসফায়ার অব্যাহত আছে কী করে? তবে তিনি যথার্থই বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের যদি সাধারণ আদালতে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে অন্য সন্ত্রাসীদের কেন পাকড়াও করে বিচার করা যাবে না?
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতাই ফুটে উঠছে। রাষ্ট্র কেন বিচারবহির্ভূত হত্যা অনুমোদন করছে, এটিও জরুরি প্রশ্ন। জনগণের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের হত্যাকাণ্ড কি জাস্টিফায়েড? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে 'ভাগলপুর ব্লাইন্ডিং কেস'-এর কথা। ১৯৭৯-৮০ সালে ভারতের ভাগলপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। চলে ধরপাকড়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ হিমশিম খায়। হেফাজতে থাকাকালে তালিকাবদ্ধ ৩১ সন্ত্রাসীর চোখ অন্ধ করে দেয় পুলিশ। ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ওই বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে সমর্থন জোগায়নি বরং প্রতিকার করেছে। আমাদের আমলে নেওয়া দরকার, কেতাবি কথা দিয়ে আইনি সংস্থার সদস্যদের বেআইনি তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সংবিধান, মানবাধিকার, ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের লঙ্ঘন রোধ করা যাচ্ছে না। এও মনে রাখা দরকার, সমাজের নানা অসংগতি এবং রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়নের জন্যই অপরাধ বেড়ে চলেছে। বিচারব্যবস্থার সংস্কার, মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত, আইনের সংস্কার ভিন্ন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের অসংগতি দূর না করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ অন্য রকম। আইনি সংস্থার সদস্যদের বেআইনি কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা বহুবিধ ক্ষতের সৃষ্টি করেছেন_এটি তাঁরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল। সরকারের নীতিনির্ধারকরা কিংবা রাজনৈতিক নেতারা যদি এসব কর্মকাণ্ডের নীরব দর্শক হয়ে থাকেন কিংবা তাঁরা মত্ত থাকেন স্ববিরোধিতায়; তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ যে খুব অন্ধকার_এর বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
আমাদের স্মরণে আছে ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী জোর গলায় বলেছেন, দেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটছে না! সত্যকে আড়াল করার এই প্রবণতা রাষ্ট্র ও সমাজ দেহের ক্ষতকেই যে বিস্তৃত করে তা তাঁরা বোঝেন না, এমন নয়। আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাটাই এমন, এখানে যিনি যত বেশি গলাবাজি করতে পারেন, সত্যকে চেপে রাখতে পারেন_তাঁরাই মনে করেন সাফল্যের ঝুড়িতে বুঝি কিছু ঢোকাতে পারলেন। কিন্তু এই পথ ভ্রান্ত। দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলা আমাদের শাসকদের সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিকট-অতীতে উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ক্রসফায়ারের তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি রুল জারি করে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছিলেন। সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। এরপরের ঘটনাবলি সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। তাহলে এই যে অহরহ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের কথা শাসক মহল থেকেও বলা হচ্ছে, তা কি স্ববিরোধিতা নয়? তাদের মনে রাখা উচিত, মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, তাদের অচেতন করে রাখার সব রকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও।
কোনো কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সার্বিক অবস্থার চালচিত্র ঝিলিক দিয়ে ওঠে এবং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কোথায় আছি। এমন প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র পরিচালকদের কেউ কেউ যখন সত্য চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তাঁদের দায়ের দিকটিই আরো স্ফীত হয়। ক্রসফায়ার কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এমনই ঘটনা, যা ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনকে পদদলিত করে অবিরত ঘটে চলেছে। নদীর পাড়ে, বিলের ধারে, জঙ্গলে, খোলা মাঠে, বাঁধের ওপর, সড়ক বা নর্দমার মাঝে গুলিবিব্ধ নিথর মনুষ্যদেহ এভাবে পড়ে থাকার চিত্র রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না, শাসকদের শাসনব্যবস্থাকে সুশাসন বলে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে পারে না। সরকারের নীতিনির্ধারক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবেই যাঁর যাঁর মতো করে এই পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করুন না কেন_চূড়ান্ত কথা হলো, এভাবে চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের পথ সুগম না করে এ পথে সমাজকে সন্ত্রাসমুক্ত করা আদৌ সম্ভব নয়। যদি তা-ই হতো তাহলে এত দিনে অন্য চিত্র দেখা যেত। তা ছাড়া 'ক্রসফায়ার'-এর নামে যেসব নিত্যনতুন গল্পের অবতারণা করা হয়, তাও বড় বিস্ময়কর। 'ক্রসফায়ার' মানে উভয় পক্ষে গুলিবিনিময়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ঘটনাগুলো ঘটছে একতরফা। ইতিমধ্যে 'ক্রসফায়ারে' নিহতদের মধ্যে অনেকেরই নাম এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা অভিযোগ ছিল না। আইনের শাসনের পথ পরিত্যাগ করে বিনা বিচারে কথিত অপরাধীদের ধরে ধরে মেরে ফেললেই সমাজ আলোকিত, সন্ত্রাসমুক্ত, নিরাপদ হয়ে যায় না। এমন নজির কোথাও নেই। যদি যথাযথ বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে কেউই অপরাধ করার সাহস পাবে না_এটিই হলো স্বতঃসিদ্ধ কথা। এমনটি নিশ্চিত করা যখন সম্ভব হবে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদেরও বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে আর আষাঢ়ে গল্প বলার প্রয়োজন হবে না। সমাজবিরোধী বা অপরাধী চক্রের মূলোৎপাটন শান্তিপ্রিয় সবারই চাওয়া। কিন্তু তা হোক বৈধ পন্থায়। অবৈধ পন্থায় এমনটি চললে স্বেচ্ছাচারীর সংখ্যাই শুধু বাড়বে, আখেরে কোনো ফল মিলবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। কথাটি অসত্য নয়। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কি অতি জরুরি নয়? আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, অগণতান্ত্রিক কিংবা সামরিক সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, খুনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। আমাদের এও স্মরণে আছে, ২০০৪ সালে অপারেশন ক্লিন হার্ট চালুর পর এই অভিযানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়মুক্তি আইন করে বিচার থেকে রেহাই দেওয়া হয়। অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান, কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নন_রাষ্ট্র পরিচালকদের এই অঙ্গীকারের ব্যত্যয় ঘটানো হলো। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে এবং তৎপরবর্তী সময়ে কারাগারে জাতীয় চার নেতার বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সভ্যতা-মানবতাবিরোধী যে কুনজির স্থাপন করা হয়েছিল, তা ইতিহাসের কালো অধ্যায়। আইন করে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। দুঃখজনক কিন্তু সত্য, আইন করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেওয়ার অপক্রিয়া থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি_বিদ্যমান পরিস্থিতি এরই সাক্ষ্যবহ। অর্থাৎ সমস্যার শেকড় রাষ্ট্র ও আইনের মধ্যেই রয়েছে। কোনো বাহিনী কিংবা সংস্থার সদস্যদের যখন তাঁদের অপরাধের দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয় তখন তাঁরা আইনবহির্ভূত কাজ করতেই উৎসাহবোধ করবেন, এটিই তো স্বাভাবিক। এখানে হয়েছেও তাই। এলিট ফোর্স র্যাবের জন্মের পেছনে রয়েছে পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অপরিসীম ব্যর্থতা। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য তো আছেই। সে প্রসঙ্গে আজ আর আলোচনা করলাম না। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যখন একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছিল, তখন আজকের ক্ষমতাসীনরা এর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন এবং আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পথ সুগম করার তাগিদ দিচ্ছিলেন। তাই এখন তাঁদের শাসনামলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী এই প্রেক্ষাপটে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে তাঁর সরকার সচেষ্ট রয়েছে বলে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মানুষ আশান্বিত হয়েছে এবং তাদের প্রত্যাশা, কেবল সদিচ্ছা নয়, সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে প্রমাণ করুক, কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নয়। কিন্তু তিনি যে বললেন ক্রসফায়ার রাতারাতি বন্ধ করা যাবে না, এর মধ্য দিয়ে তাঁর অসহায়ত্বও ফুটে উঠেছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংস্থাগুলোর সদস্যরা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের চেয়ে প্রতাপশালী হতে পারেন না।
সমস্যা চাপা দিয়ে রেখে কিংবা এড়িয়ে গিয়ে এর সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা যখন বলেন, দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে না, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার ক্ষমতাবান, স্বেচ্ছাচারী সদস্যরা আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এবং এর আলামত ইতিমধ্যে বহুবার মিলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের দায়িত্ব হলো অপরাধীদের শনাক্ত এবং পাকড়াও করে বিচারে সোপর্দ করা এবং কেউই যাতে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে না পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু তাঁদের কয়জন সততা-স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এ কাজটি করতে পারছেন? ধরে ধরে গুলি কিংবা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে ফেলা তাঁদের কাজ নয়। রাষ্ট্র কারো স্বেচ্ছাচারিতা চালানোর ক্ষেত্র নয়। যদি তা-ই হয়, তাহলে আইন, সমাজ, রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণহীনতা একবার দেখা দিলে তার কত ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে, এমন নজির বিশ্বে আছে। মামলার তদন্ত যদি সুষ্ঠু হয়, মামলা যদি সততা-স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সাজানো হয়, তাহলে আইনের ফাঁক গলে কোনো অপরাধীই বেরিয়ে আসতে পারবে না। আগে ব্যবস্থার গলদ সারাতে হবে, তবেই অবস্থার পরিবর্তন হবে। কোন দল ক্ষমতায় আছে বিচার্য তো সেটা নয়, বিচার্য হলো আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে কি না_এ বিষয়টি যথাযথভাবে মনিটর করা। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে যে সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, আমরা এর প্রতিফলন দেখতে চাইব। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতায় বিশ্বাস স্থাপন করে এটুকু আস্থা রাখি, ক্রসফায়ার তিনি মোটেই পছন্দ করেন না, তবুও তো প্রশ্ন আসেই_তাহলে তাঁর অনিচ্ছা, আপত্তি, বিরোধিতা সত্ত্বেও ক্রসফায়ার অব্যাহত আছে কী করে? তবে তিনি যথার্থই বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের যদি সাধারণ আদালতে বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে অন্য সন্ত্রাসীদের কেন পাকড়াও করে বিচার করা যাবে না?
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্বলতাই ফুটে উঠছে। রাষ্ট্র কেন বিচারবহির্ভূত হত্যা অনুমোদন করছে, এটিও জরুরি প্রশ্ন। জনগণের স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর সদস্যদের হত্যাকাণ্ড কি জাস্টিফায়েড? এ মুহূর্তে মনে পড়ছে 'ভাগলপুর ব্লাইন্ডিং কেস'-এর কথা। ১৯৭৯-৮০ সালে ভারতের ভাগলপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। চলে ধরপাকড়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ হিমশিম খায়। হেফাজতে থাকাকালে তালিকাবদ্ধ ৩১ সন্ত্রাসীর চোখ অন্ধ করে দেয় পুলিশ। ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার ওই বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে সমর্থন জোগায়নি বরং প্রতিকার করেছে। আমাদের আমলে নেওয়া দরকার, কেতাবি কথা দিয়ে আইনি সংস্থার সদস্যদের বেআইনি তৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না। সংবিধান, মানবাধিকার, ফৌজদারি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনের লঙ্ঘন রোধ করা যাচ্ছে না। এও মনে রাখা দরকার, সমাজের নানা অসংগতি এবং রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়নের জন্যই অপরাধ বেড়ে চলেছে। বিচারব্যবস্থার সংস্কার, মানুষের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত, আইনের সংস্কার ভিন্ন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের অসংগতি দূর না করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ অন্য রকম। আইনি সংস্থার সদস্যদের বেআইনি কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা বহুবিধ ক্ষতের সৃষ্টি করেছেন_এটি তাঁরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল। সরকারের নীতিনির্ধারকরা কিংবা রাজনৈতিক নেতারা যদি এসব কর্মকাণ্ডের নীরব দর্শক হয়ে থাকেন কিংবা তাঁরা মত্ত থাকেন স্ববিরোধিতায়; তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ যে খুব অন্ধকার_এর বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments