বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-জননিরাপত্তা আর ঘুমপাড়ানির কথা by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
চারদলীয় জোটকে জনগণ কেন প্রত্যাখ্যান করে মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল এর কারণ সচেতন মানুষমাত্রই জানেন। অনেক কারণের মধ্যে মুখ্যত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, অর্থাৎ জননিরাপত্তা ভেঙে পড়া ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।
সব কিছু মিলিয়ে সার্বিক ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন চেয়ে মানুষ মহাজোটের পক্ষে প্রায় দুই বছর আগে রায় দিয়েছিল। এ দুই বছরের সার্বিক চিত্র নিয়ে আলোচনা এই ছোট্ট কলেবরে দুরূহ বটে; কিন্তু উলি্লখিত দুটি বিষয়ের কোনো একটিতেও মহাজোট সরকার সাফল্য দেখাতে পারেনি_এই বক্তব্য মোটা দাগে সত্য। দ্রব্যমূল্য নিয়ে নতুন করে আলোচনার কিছু নেই; ভুক্তভোগী মানুষ শুধু আশ্বাসে বিশ্বাস রেখেই চলেছে। মূল্য-সন্ত্রাসীরা সব কিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তাদের আখের গোছাচ্ছে। আর, আইনশৃঙ্খলা? এ তো গোদের ওপর এখন বিষফোঁড়া। অনস্বীকার্য যে মহাজোট সরকারের অর্জন অনেকখানি। কিন্তু উলি্লখিত দুটি বিষয় মানুষের স্বস্তি-শান্তি কেড়ে নিয়েছে। একেই বলে অর্জনের বিসর্জন। সংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয় কি এর দায় এড়াতে পারে? প্রায় নিত্য পত্র-পত্রিকায় জননিরাপত্তা বিঘি্নত হওয়ার যে চিত্র ফুটে উঠছে, তাতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষাসংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একটা বিষয় খুব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, সব ব্যাপারেই প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলতে হচ্ছে! কেন? যদি তা-ই হয়, তাহলে এতগুলো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কী করেন? সরকারের নির্বাহী প্রধান হিসেবে সব কিছুর দায় অবশ্যই সর্বাগ্রে প্রধানমন্ত্রীর ওপর বর্তায় বটে; কিন্তু তাঁকেই যদি সব দিকে দৃষ্টি রাখতে হয় তাহলে অবস্থা গিয়ে কোন পর্যায়ে ঠেকছে তাও সহজেই অনুমেয়। যানজটই বলি কিংবা বাজারই বলি অথবা জননিরাপত্তাজনিত বিষয়েই বলি_প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে, কথা বলতে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী তো নিশ্চয়ই দশভুজা নন।
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে এ দেশের মুক্তচিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে যিনি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিলেন সেই প্রথাবিরোধী লেখক, শিক্ষাবিদ, কবি, ঔপন্যাসিক, গবেষক প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদের কথা। অসামান্য মেধা এবং অপরিসীম সাহস নিয়ে ড. হুমায়ুন আজাদ এক রকম একাই লড়াই করে গেছেন। মৌলবাদী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর নির্ভীক উচ্চারণে ওরা ফুঁসে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই ক্রোধ, জিঘাংসা চরিতার্থ করতে তাঁর ওপর ওরা ঝাঁপিয়েও পড়ল। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হুমায়ুন আজাদ (আক্রান্ত হয়ে যিনি শেষ পর্যন্ত বৈরী সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই বর্বরতা-নৃশংসতার কোনো রহস্য উদ্ঘাটন এবং বিচারও হয়নি) দীর্ঘ সময় মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন একই রকম সাহসের সঙ্গে। মনে পড়ে, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বর্ধিত জীবন নিয়ে ফিরে এসে আরো তীব্র ও তীক্ষ্নভাবে তিনি কথা বলেছেন। শিরদাঁড়া টান করেই বলেছিলেন কারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। মৃত্যুগুহা থেকে ফেরার পর আর খুব বেশিদিন প্রথাবিরুদ্ধ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ওই মানুষটিকে আমরা আমাদের মাঝে পাইনি। ওই মর্মন্তুদ ঘটনা তাঁর আয়ুর অবশিষ্টাংশ কুরে কুরে খাচ্ছিল। আজকের মূল প্রসঙ্গ সেটা নয়। ড. হুমায়ুন আজাদের কথা মনে পড়ল তাঁর একটি বহুল আলোচিত বইয়ের নাম মনে আসার কারণে। সুলিখিত বইটির নাম 'সব কিছু ভেঙে পড়ে'। এ যে কতখানি সত্যি, কত ভয়ানক ও নিষ্ঠুরভাবেই সত্যি, তা আমাদের চারপাশে তাকালে বোঝা যায়। হ্যাঁ, সব কিছুই যেন ভেঙে পড়ছে। ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে মানুষের ভেতরকার বিশ্বাস, আত্মশক্তি, চৈতন্য, মূল্যবোধ। দানব-পাশব শক্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। এমতাবস্থায় শান্তিপ্রিয় মানুষ দাঁড়াবে কোথায়? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এরই মাঝে দায়িত্বশীলদের উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতি কিন্তু থেমে নেই।
'সব কিছু ভেঙে পড়ে' যখন ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন তখন এই সমাজচিত্র কেমন ছিল, তা না হয় নতুন করে আলোচনা না-ই করলাম। কিন্তু পরিবর্তনকামী মানুষ এখন নতুন করে এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন_প্রত্যাশায় আঘাত করে এখন সব কিছু ভাঙছে কেন? কোন অদৃশ্য শক্তি, কোন অশরীরী মায়াবী দানব মানুষের স্বস্তি, শান্তি, সমাজের শৃঙ্খলা গিলে ফেলছে? আমাদের বসবাস কি অদ্ভুত ঘুমপাড়ানির কোনো এক দেশে? মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা ঘুমন্তপুরীর বাসিন্দা। মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে চক্ষু নিমীলিত অবস্থায় যন্ত্রের মতোই করে যাচ্ছে যার যার কাজ এবং এর মধ্যেই করছে আত্মরক্ষার চেষ্টাও। এই ঘুমন্তপুরীর মাঝে কেবল জেগে আছে কিছু মুখোশধারী। ওরা ওদের মুখোশের আড়ালে দুটো তীক্ষ্ন চোখ দিয়ে খুঁজছে কোথায় কার তন্দ্রা ছুটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কথাগুলো হতাশার নয়। নয় ক্ষোভেরও। কিন্তু প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নসঞ্চারক তো বটেই। খুনি, ডাকাত, ছিনতাইকারী, ধর্ষক, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এই ক্ষমতাবানদের লাগাম কেউ টেনে ধরতে পারছে না। আইনি সংস্থার কতিপয় অদক্ষ, অযোগ্য, স্বেচ্ছাচারী আর অসাধু লোক যখন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তখন এই মুখোশধারীরা তত বেশি উন্মত্ত হয়ে ওঠে_এটাই আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। দানব-পাশব শক্তির যে প্রতিক্রিয়াহীন পরিবেশ কাম্য, পরিস্থিতি যেন তা-ই। কারণ, এ রকম পরিবেশে অনেক অপকর্ম অনায়াসে সম্পাদন করে ফেলা যায়।
আজ (৩১.১২.২০১০) যখন এ লেখাটি লিখছি তখন গত দিনের প্রায় সব কটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সামনে রয়েছে। প্রত্যেকটি পত্রিকা রাজধানীর তাঁতীবাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার (২৯.১২.২০১০) সংবাদটি সংগত কারণেই গুরুত্বসহকারে ছেপেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে নিজ ব্যবসাকেন্দ্রে ব্যবসায়ী আবুল কালামকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে হলো। এর পর অস্ত্রধারীরা বরাবরের মতোই নির্বিঘ্নে চলেও গেল। এ রকম ঘটনা তাঁতীবাজারে এ-ই যে প্রথম ঘটল তাও নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো একটি ঘটনার প্রতিকার হয়নি, বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় একজন তরুণ স্বর্ণ ব্যবসায়ী টেলিফোনে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানালেন, তাঁতীবাজারে চাঁদাবাজরা প্রায় প্রকাশ্যেই অস্ত্রের মহড়া দেয় এবং একেকটি স্বর্ণের দোকানের মালিকের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। দুর্মুখেরা বলে, এই চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা চলে যায় অনেক ওপরস্তর পর্যন্ত। কালাম যেদিন মারা গেল এর দুই দিন আগেও নাকি এমন ব্যাপারই পরিলক্ষিত হয়েছে। তরুণ ব্যবসায়ীটি যখন ফোনে এসব কথা জানাচ্ছিলেন তখন আমি বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকায় ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। খুব কোলাহল এবং ভিড়ের মধ্যে থাকলেও তখন ওই তরুণ ব্যবসায়ীর ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারিত মর্মকথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
শুধু তাঁতীবাজার কেন, ঢাকার অনেক এলাকায় এমন চিত্র বিদ্যমান। এর দুই দিন আগে মোহাম্মদপুরে সংশ্লিষ্ট থানায় একজন ব্যবসায়ী নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করে ফেরার পথে খবর পেলেন তাঁর কর্মচারীকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে দোকানেই হত্যা করেছে। ৩০ ডিসেম্বর ঝিনাইদহে যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একই স্থানে নিহত হলেন তিনজন। একই দিনের পত্রিকায় খবর বেরোল, রংপুর কারমাইকেল কলেজের এক ছাত্রীকে মেসে ঢুকে ধর্ষণ করেছে এক দুর্বৃত্ত! মেসের মধ্যে ঢুকে এমন ঘটনা হয়তো এটাই এ দেশে প্রথম। এখানেই শেষ নয়। সে আবার পুরো দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ক্যামেরাবন্দি করে মেয়েটিকে হুমকি দিয়েছে, ঘটনাটি কাউকে জানালে আরো বিপদ হবে। যদিও পরে ওই ছাত্রী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। ধারণা করা যায়, মেয়েটির ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো এবং থানা-পুলিশ অতীতের মতোই এ ক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতাই প্রদর্শন করবে। দেশে নারী নির্যাতন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। আরো খবর আছে ওই দিনের পত্রিকায়ই। ২৯ ডিসেম্বর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপির চট্টগ্রামের বাসাতে ১৫-১৬ জনের ডাকাত দল বাড়ির লোকজনকে জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে লুটে নিয়েছে বেশ কিছু মালামাল। তখন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বাসাতেই ঘুমাচ্ছিলেন। একজন সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের বাসায় যখন এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও হয়তো অবান্তর।
দেশে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে থানার সংখ্যা ক্রম-বাড়লেও জননিরাপত্তা কোথায়_এ প্রশ্নের জবাব মেলা ভার। নানা দোষে দুষ্ট পুলিশ কেবল অজুহাতই দাঁড় করাতে জানে। পুলিশের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি অসত্য নয় (যেমন_জনবল সংকট, আধুনিক অস্ত্র সংকট, দ্রুত যোগাযোগের জন্য গাড়ি সংকট ইত্যাদি)। কিন্তু মানুষ সীমাবদ্ধতা দেখবে কেন, শুনবেই বা কেন? এসব বিষয়ে দায় সরকারের। রাজধানীর আশপাশের গ্রামগুলোতে মানুষ রাত জেগে দলবেঁধে পাহারা দিয়ে সূর্যের আলো দেখে। মফস্বলের গ্রামের চিত্র তো আরো ভয়াবহ। সেখানে ক্ষমতাসীন মহলের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় ক্ষমতাবানরাই যেন সর্বেসর্বা। প্রতিদিন নৃশংসতা, বর্বরতা, মানুষের শান্তি হরণের কাজ চলছে অব্যাহত গতিতে। পত্র-পত্রিকায় এর প্রতিফলন ঘটছে আর সরকারের দায়িত্বশীলরা 'কঠোর প্রতিকার' শব্দযুগলের মধ্যে সব কিছু বন্দি রাখছেন। এভাবে কত দিন চলবে? লেখাটি প্রকাশের মাত্র চার দিন পর সরকার তার শাসনকালের দুই বছর অতিক্রম করবে। আগের সরকারগুলোর রেখে যাওয়া জঞ্জালের কথা শুনে শুনে আর কত সময় কাটাবে মানুষ। সচেতনরা অবশ্যই জানেন, তাঁদের রেখে যাওয়া জঞ্জাল কম নয়। কিন্তু মানুষ নিরাপদে বাস করতে না পারার কারণটা সবই ওই সব জঞ্জালজাত নয়। এই যে ছাত্রলীগের কিছু গুণধর সারা দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই জঞ্জালের ফল নয়। ক্ষমতাসীন মহলের ক্ষমতাবানরা (অভিযোগ আছে সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটেছে) যখন এমন উন্মত্ততা চালায় এবং বিষয়গুলো থাকে প্রায় প্রতিকারহীন, তখন চিহ্নিত সমাজবিরোধীরা তালি বাজায় এবং তারা তাদের দুষ্কর্মের পথটা সুগম করে। একইসঙ্গে তৎপর রয়েছে মৌলবাদী, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির চক্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে ওরা নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত_এ অভিযোগ অমূলক নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা অন্য যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে, এর সঙ্গে কি ক্ষমতাসীন মহলের বিপথগামীরা সম্পৃক্ত নয়? প্রধানমন্ত্রী নিজে ওই গুণধরদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়টি কি দলের নীতিনির্ধারকরা আমলে নিতে পেরেছেন? প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা, সদিচ্ছা নিয়ে দুর্মখেরাও হয়তো প্রশ্ন তুলবেন না, কিন্তু অন্য দায়িত্বশীলরা কি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ? এসব প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। এ দেশটা মায়াবী দৈত্যের ঘুমন্তপুরী হোক_এমনটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কারোরই কাম্য হতে পারে না। ভুলে না গেলেই মঙ্গল, আত্মসমালোচনা হচ্ছে নিজেকে পরিশীলিত করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। তাঁরাই আত্মসমালোচনায় আগ্রহী যাঁরা নিজেদের শোধরাতে চান। তবে হতাশার বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা সারা বিশ্বেই কম, বাংলাদেশে তো বটেই।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
এ মুহূর্তে মনে পড়ছে এ দেশের মুক্তচিন্তা এবং মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনে যিনি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিলেন সেই প্রথাবিরোধী লেখক, শিক্ষাবিদ, কবি, ঔপন্যাসিক, গবেষক প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদের কথা। অসামান্য মেধা এবং অপরিসীম সাহস নিয়ে ড. হুমায়ুন আজাদ এক রকম একাই লড়াই করে গেছেন। মৌলবাদী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর নির্ভীক উচ্চারণে ওরা ফুঁসে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত ওই ক্রোধ, জিঘাংসা চরিতার্থ করতে তাঁর ওপর ওরা ঝাঁপিয়েও পড়ল। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হুমায়ুন আজাদ (আক্রান্ত হয়ে যিনি শেষ পর্যন্ত বৈরী সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই বর্বরতা-নৃশংসতার কোনো রহস্য উদ্ঘাটন এবং বিচারও হয়নি) দীর্ঘ সময় মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন একই রকম সাহসের সঙ্গে। মনে পড়ে, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বর্ধিত জীবন নিয়ে ফিরে এসে আরো তীব্র ও তীক্ষ্নভাবে তিনি কথা বলেছেন। শিরদাঁড়া টান করেই বলেছিলেন কারা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। মৃত্যুগুহা থেকে ফেরার পর আর খুব বেশিদিন প্রথাবিরুদ্ধ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ওই মানুষটিকে আমরা আমাদের মাঝে পাইনি। ওই মর্মন্তুদ ঘটনা তাঁর আয়ুর অবশিষ্টাংশ কুরে কুরে খাচ্ছিল। আজকের মূল প্রসঙ্গ সেটা নয়। ড. হুমায়ুন আজাদের কথা মনে পড়ল তাঁর একটি বহুল আলোচিত বইয়ের নাম মনে আসার কারণে। সুলিখিত বইটির নাম 'সব কিছু ভেঙে পড়ে'। এ যে কতখানি সত্যি, কত ভয়ানক ও নিষ্ঠুরভাবেই সত্যি, তা আমাদের চারপাশে তাকালে বোঝা যায়। হ্যাঁ, সব কিছুই যেন ভেঙে পড়ছে। ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে মানুষের ভেতরকার বিশ্বাস, আত্মশক্তি, চৈতন্য, মূল্যবোধ। দানব-পাশব শক্তি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। এমতাবস্থায় শান্তিপ্রিয় মানুষ দাঁড়াবে কোথায়? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এরই মাঝে দায়িত্বশীলদের উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতি কিন্তু থেমে নেই।
'সব কিছু ভেঙে পড়ে' যখন ড. হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন তখন এই সমাজচিত্র কেমন ছিল, তা না হয় নতুন করে আলোচনা না-ই করলাম। কিন্তু পরিবর্তনকামী মানুষ এখন নতুন করে এ প্রশ্ন তুলতেই পারেন_প্রত্যাশায় আঘাত করে এখন সব কিছু ভাঙছে কেন? কোন অদৃশ্য শক্তি, কোন অশরীরী মায়াবী দানব মানুষের স্বস্তি, শান্তি, সমাজের শৃঙ্খলা গিলে ফেলছে? আমাদের বসবাস কি অদ্ভুত ঘুমপাড়ানির কোনো এক দেশে? মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা ঘুমন্তপুরীর বাসিন্দা। মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে চক্ষু নিমীলিত অবস্থায় যন্ত্রের মতোই করে যাচ্ছে যার যার কাজ এবং এর মধ্যেই করছে আত্মরক্ষার চেষ্টাও। এই ঘুমন্তপুরীর মাঝে কেবল জেগে আছে কিছু মুখোশধারী। ওরা ওদের মুখোশের আড়ালে দুটো তীক্ষ্ন চোখ দিয়ে খুঁজছে কোথায় কার তন্দ্রা ছুটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কথাগুলো হতাশার নয়। নয় ক্ষোভেরও। কিন্তু প্রশ্নের পিঠে প্রশ্নসঞ্চারক তো বটেই। খুনি, ডাকাত, ছিনতাইকারী, ধর্ষক, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এই ক্ষমতাবানদের লাগাম কেউ টেনে ধরতে পারছে না। আইনি সংস্থার কতিপয় অদক্ষ, অযোগ্য, স্বেচ্ছাচারী আর অসাধু লোক যখন নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে, তখন এই মুখোশধারীরা তত বেশি উন্মত্ত হয়ে ওঠে_এটাই আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। দানব-পাশব শক্তির যে প্রতিক্রিয়াহীন পরিবেশ কাম্য, পরিস্থিতি যেন তা-ই। কারণ, এ রকম পরিবেশে অনেক অপকর্ম অনায়াসে সম্পাদন করে ফেলা যায়।
আজ (৩১.১২.২০১০) যখন এ লেখাটি লিখছি তখন গত দিনের প্রায় সব কটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সামনে রয়েছে। প্রত্যেকটি পত্রিকা রাজধানীর তাঁতীবাজারে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার (২৯.১২.২০১০) সংবাদটি সংগত কারণেই গুরুত্বসহকারে ছেপেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে নিজ ব্যবসাকেন্দ্রে ব্যবসায়ী আবুল কালামকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে হলো। এর পর অস্ত্রধারীরা বরাবরের মতোই নির্বিঘ্নে চলেও গেল। এ রকম ঘটনা তাঁতীবাজারে এ-ই যে প্রথম ঘটল তাও নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো একটি ঘটনার প্রতিকার হয়নি, বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্য। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় একজন তরুণ স্বর্ণ ব্যবসায়ী টেলিফোনে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জানালেন, তাঁতীবাজারে চাঁদাবাজরা প্রায় প্রকাশ্যেই অস্ত্রের মহড়া দেয় এবং একেকটি স্বর্ণের দোকানের মালিকের কাছে নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। দুর্মুখেরা বলে, এই চাঁদার ভাগ-বাটোয়ারা চলে যায় অনেক ওপরস্তর পর্যন্ত। কালাম যেদিন মারা গেল এর দুই দিন আগেও নাকি এমন ব্যাপারই পরিলক্ষিত হয়েছে। তরুণ ব্যবসায়ীটি যখন ফোনে এসব কথা জানাচ্ছিলেন তখন আমি বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালে ঢাকায় ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। খুব কোলাহল এবং ভিড়ের মধ্যে থাকলেও তখন ওই তরুণ ব্যবসায়ীর ভয়ার্ত কণ্ঠে উচ্চারিত মর্মকথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
শুধু তাঁতীবাজার কেন, ঢাকার অনেক এলাকায় এমন চিত্র বিদ্যমান। এর দুই দিন আগে মোহাম্মদপুরে সংশ্লিষ্ট থানায় একজন ব্যবসায়ী নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করে ফেরার পথে খবর পেলেন তাঁর কর্মচারীকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে দোকানেই হত্যা করেছে। ৩০ ডিসেম্বর ঝিনাইদহে যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে একই স্থানে নিহত হলেন তিনজন। একই দিনের পত্রিকায় খবর বেরোল, রংপুর কারমাইকেল কলেজের এক ছাত্রীকে মেসে ঢুকে ধর্ষণ করেছে এক দুর্বৃত্ত! মেসের মধ্যে ঢুকে এমন ঘটনা হয়তো এটাই এ দেশে প্রথম। এখানেই শেষ নয়। সে আবার পুরো দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ক্যামেরাবন্দি করে মেয়েটিকে হুমকি দিয়েছে, ঘটনাটি কাউকে জানালে আরো বিপদ হবে। যদিও পরে ওই ছাত্রী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। ধারণা করা যায়, মেয়েটির ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন হলো এবং থানা-পুলিশ অতীতের মতোই এ ক্ষেত্রেও তাদের ব্যর্থতাই প্রদর্শন করবে। দেশে নারী নির্যাতন কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা নতুন করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। আরো খবর আছে ওই দিনের পত্রিকায়ই। ২৯ ডিসেম্বর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপির চট্টগ্রামের বাসাতে ১৫-১৬ জনের ডাকাত দল বাড়ির লোকজনকে জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে লুটে নিয়েছে বেশ কিছু মালামাল। তখন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বাসাতেই ঘুমাচ্ছিলেন। একজন সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের বাসায় যখন এমন ঘটনা ঘটতে পারে, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও হয়তো অবান্তর।
দেশে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে থানার সংখ্যা ক্রম-বাড়লেও জননিরাপত্তা কোথায়_এ প্রশ্নের জবাব মেলা ভার। নানা দোষে দুষ্ট পুলিশ কেবল অজুহাতই দাঁড় করাতে জানে। পুলিশের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি অসত্য নয় (যেমন_জনবল সংকট, আধুনিক অস্ত্র সংকট, দ্রুত যোগাযোগের জন্য গাড়ি সংকট ইত্যাদি)। কিন্তু মানুষ সীমাবদ্ধতা দেখবে কেন, শুনবেই বা কেন? এসব বিষয়ে দায় সরকারের। রাজধানীর আশপাশের গ্রামগুলোতে মানুষ রাত জেগে দলবেঁধে পাহারা দিয়ে সূর্যের আলো দেখে। মফস্বলের গ্রামের চিত্র তো আরো ভয়াবহ। সেখানে ক্ষমতাসীন মহলের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের স্থানীয় ক্ষমতাবানরাই যেন সর্বেসর্বা। প্রতিদিন নৃশংসতা, বর্বরতা, মানুষের শান্তি হরণের কাজ চলছে অব্যাহত গতিতে। পত্র-পত্রিকায় এর প্রতিফলন ঘটছে আর সরকারের দায়িত্বশীলরা 'কঠোর প্রতিকার' শব্দযুগলের মধ্যে সব কিছু বন্দি রাখছেন। এভাবে কত দিন চলবে? লেখাটি প্রকাশের মাত্র চার দিন পর সরকার তার শাসনকালের দুই বছর অতিক্রম করবে। আগের সরকারগুলোর রেখে যাওয়া জঞ্জালের কথা শুনে শুনে আর কত সময় কাটাবে মানুষ। সচেতনরা অবশ্যই জানেন, তাঁদের রেখে যাওয়া জঞ্জাল কম নয়। কিন্তু মানুষ নিরাপদে বাস করতে না পারার কারণটা সবই ওই সব জঞ্জালজাত নয়। এই যে ছাত্রলীগের কিছু গুণধর সারা দেশে তাণ্ডব চালাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই জঞ্জালের ফল নয়। ক্ষমতাসীন মহলের ক্ষমতাবানরা (অভিযোগ আছে সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের উপস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটেছে) যখন এমন উন্মত্ততা চালায় এবং বিষয়গুলো থাকে প্রায় প্রতিকারহীন, তখন চিহ্নিত সমাজবিরোধীরা তালি বাজায় এবং তারা তাদের দুষ্কর্মের পথটা সুগম করে। একইসঙ্গে তৎপর রয়েছে মৌলবাদী, জঙ্গি, জামায়াত-শিবির চক্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে ওরা নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত_এ অভিযোগ অমূলক নয়। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা অন্য যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে, এর সঙ্গে কি ক্ষমতাসীন মহলের বিপথগামীরা সম্পৃক্ত নয়? প্রধানমন্ত্রী নিজে ওই গুণধরদের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়টি কি দলের নীতিনির্ধারকরা আমলে নিতে পেরেছেন? প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা, সদিচ্ছা নিয়ে দুর্মখেরাও হয়তো প্রশ্ন তুলবেন না, কিন্তু অন্য দায়িত্বশীলরা কি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ? এসব প্রশ্ন কিন্তু উঠতে শুরু করেছে। এ দেশটা মায়াবী দৈত্যের ঘুমন্তপুরী হোক_এমনটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কারোরই কাম্য হতে পারে না। ভুলে না গেলেই মঙ্গল, আত্মসমালোচনা হচ্ছে নিজেকে পরিশীলিত করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি। তাঁরাই আত্মসমালোচনায় আগ্রহী যাঁরা নিজেদের শোধরাতে চান। তবে হতাশার বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা সারা বিশ্বেই কম, বাংলাদেশে তো বটেই।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments