রঘু দয়াল-বাংলাদেশের চিত্র
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হঠাৎ করে দৃশ্যত তিস্তার পানি বণ্টন প্রশ্নে বাংলাদেশ সফর বাতিল করায় বাংলাদেশের সঙ্গে চিরাচরিত সম্পর্ক পরিবর্তনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতে ভাটা পড়েছে। এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক উন্নয়নের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। চীন অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশে জ্বালানি, খাদ্য, পানি, খনিজ পদার্থ বিষয়ে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। আজ চীন ইউনানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে তাঁর একটি ব্যাপক প্রভাব গড়ে তুলেছে।
কিন্তু ঐতিহাসিক যোগাযোগ থাকা সত্ত্বেও ভারত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে তা করতে পারছে না। ব্রিটিশরা মিয়ানমারকে মনে করত চীন ও ফ্রান্সের বাফার স্টেট। তখন ফ্রান্স সায়গন থেকে মেকং নদী দিয়ে চলাফেরা করত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনী বিখ্যাত বার্মা সড়ক নির্মাণ করে। এরপর সুকঠিন স্টিলওয়েল রোড তৈরি করে। এখন নতুন করে রেলওয়ে ও সড়ক তৈরি করছে চীন। আরাকান উপকূলে রুমরি দ্বীপে তেল ও গ্যাস পাইপলাইনসহ গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করছে তারা। সীমান্তবর্তী রুইলির দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে ইয়াঙ্গুনের পথে একটি রেললাইন গড়ে তোলা হচ্ছে। এর একটি শাখা বিস্তৃত হয়েছে সমুদ্রবন্দরের রুমরি দ্বীপের দিকে। মান্দালয় হয়ে জনগণ ও কার্গো সোজা ইউনানে চলে যাবে। চীনের সীমান্ত থেকে কচি পাহাড় পর্যন্ত অরুণাচল সীমান্তে চীন ব্যাপকভাবে স্টিলওয়েল রোড সংস্কার করে চলেছে। অন্য কথায় বলা যায়, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের রেল সংযোগ দিনে দিনে ভারতের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত চলে আসতে পারবে। চীন ও বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে যে কুনমিং থেকে রুমরি পর্যন্ত রেলপথ চট্টগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এটা কি কলকাতা পর্যন্ত করিডর তৈরি হওয়ার একটি সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে না?
ইয়াঙ্গুনের শহরকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতাকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে। বাংলা ছিল ভৌগোলিকভাবে বার্মার নিকটবর্তী এবং একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বার্মার শত শত ছাত্র কলকাতা ও দার্জিলিংয়ে লেখাপড়া করত। একটি স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল কলকাতা থেকে ইরাবতী বদ্বীপ হয়ে পেনাং ও সিঙ্গাপুর পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালে তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, যা একটি সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। তিব্বত ও ইউনানের সীমান্ত ছিল বন্ধ এবং অপেক্ষাকৃত অগুরুত্বপূর্ণ উত্তর-পূর্ব ভারত কেবল দু-একটি ক্ষেত্রে সংযুক্ত হয়। কিন্তু উপনিবেশ ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চল চট্টগ্রাম ও কলকাতা বন্দরের কারণে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দেশভাগের পর বাজারের প্রতিবন্ধকতা, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং ঐতিহ্যবাহী পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থার ওপর দুঃখজনক প্রভাব পড়ে। দেশ বিভাগের পর আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব ৩৫০ কিলোমিটারের জায়গায় এক হাজার ৬৪৫ কিলোমিটার হয়ে যায়। আসাম থেকে চা কলকাতায় পেঁৗছতে এক হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। যদি চট্টগ্রাম বন্দরের সুবিধা পাওয়া যেত তাহলে দূরত্ব ৬০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল।
৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ রপ্তানি দ্রব্য ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্থলপথে, বেনাপোল-পেট্রাপোল দিয়ে এবং হিলি ও বাংলাবান্ধা দিয়ে। সীমান্ত দিয়ে অবাধ পণ্য ও যান চলাচলের কোনো সুযোগ নেই। যে পণ্য সড়কপথে যায়, তার বেশির ভাগই বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ট্রান্সশিপ করতে হয়। এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, একটি ট্রাক কলকাতায় লোড হয়ে তা বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত পার হয়ে খালাস হতে গড়ে ৬.২ দিন সময় প্রয়োজন হয় এবং পেট্রাপোলে ৯৫ কিলোমিটার পথে ফিরতে ৬.২ দিন সময় দরকার হয়। ভারতের বনগাঁ থেকে সীমান্ত পর্যন্ত সড়কটি খুব অপ্রশস্ত। একটি সিঙ্গেল লেনের রাস্তা ট্রাকের দ্বারা ব্লক হয়ে থাকে। ট্রাকগুলোকে একবারে ঘনবসতিপূর্ণ বসতবাড়ি ও বাজার পার হতে হয়। এর মধ্যে আবার পাঁচটি লেভেলক্রসিং রয়েছে। এই রাস্তাগুলো কমপক্ষে চার লেনে উন্নীত করা প্রয়োজন। রেলওয়ে ক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে ওভারব্রিজ প্রয়োজন। বনগাঁয় একটি বাইপাস সড়ক প্রয়োজন শহরের ট্রাফিক জট এড়াতে।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কোনো সরাসরি জলবন্দর যোগাযোগ নেই। সমুদ্রপথে রপ্তানি পণ্য কলম্বো, সালালা ও সিঙ্গাপুর হয়ে বাংলাদেশে পেঁৗছায়। বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ায় বহুমুখী ট্রান্সশিপমেন্টের পরিবর্তে সরাসরি স্থলপথে পরিবহনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সড়কপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার কারণে কনটেইনারভিত্তিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাধ্য হচ্ছে স্থল ও সমুদ্রপথে ঘুরে তারপর পণ্য খালাস করতে। ফলে যেমন সময় অধিক লাগছে, তেমনি পণ্য ব্যয়ও বেশি হচ্ছে।
দুই সপ্তাহ পর পর ছেড়ে যাওয়া মৈত্রী যাত্রীবাহী ট্রেনের ঢাকা-কলকাতা পথে ৪০৭ কিলোমিটার যেতে সময় ব্যয় হচ্ছে ১২.৫ ঘণ্টা। দুই পাশের সীমান্তে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস চেকিংয়ে সময় ব্যয় হচ্ছে পাঁচ ঘণ্টা। দুই পাশে আরো সহযোগিতা বিস্তৃত করতে সফট কাঠামোগুলো উন্নয়ন করা প্রয়োজন, যেমন_ডকুমেন্টে কম্পিউটার ব্যবহার ও কাস্টমসে ইলেকট্রিক্যাল ডকুমেন্ট আইডেনটিটির ব্যবস্থা করা।
বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি আঞ্চলিক পরিবহন প্রকল্পের সমর্থক। একটি হলো এশিয়ান হাইওয়ে, অন্যটি ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন ভেবে দেখতে পারেন, তিনি তাঁর ছেলেমানুষির মূল্য দিতে গিয়ে কতটা সুযোগ হারিয়েছেন। একটি গিভ অ্যান্ড টেক নীতি থাকা উচিত, যদি কখনো একটি বেশি দিয়েও হয়।
লেখক : কনটেইনার কো-অপারেশন অব ইন্ডিয়ার প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেস থেকে
ভাষান্তর : মহসীন হাবিব
No comments