সময়ের প্রতিধ্বনি-কষ্টের দিন শেষ হয় না by মোস্তফা কামাল
ছোট একটি খবর। অথচ খবরটি কাঁদিয়েছে আমাদের সবাইকে। আমি নিশ্চিত, একজন কঠিন হৃদয়ের মানুষও খবরটি পড়ে আবেগাপ্লুত হয়েছেন। আর যাঁরা পড়েননি, তাঁরা পড়ুন। খবরটি ২৫ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়। খবরের শিরোনাম ছিল 'কাঁদছে সোনাবরুর গ্রাম'।
খবরে বলা হয়, দারিদ্র্য মানতে না পেরে শিশু সোনাবরু আত্মহত্যা করায় এখন বিবেকের দংশনে পুড়ছে তার স্কুলের শিক্ষক ও গ্রামবাসী। বরগুনার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের জাকিরতবক গ্রামের সর্বত্র এখন শোকের আবহ। ১০ বছরের শিশু সোনাবরুর জন্য কাঁদছে তার স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকরা। চোখ মুছতে মুছতে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বললেন, 'সবাই যখন বলে, তোমরা থাকতে কী করে অতটুকু মেয়েটা ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যা করল? তখন কোনো উত্তর দিতে পারি না।'
সোনাবরুর ১৩ বছর বয়সী ভাই ফেরদৌস অভাবের তাড়নায় ঢাকা এসে কচুক্ষেতে একটি স্টুডিওতে কাজ নেয়। বোনের আবদার রক্ষা করতে গত ঈদের সময় সে তার জন্য একটি স্কুলব্যাগ কিনে নিয়েছিল। সেই ব্যাগ হাতে নিয়ে সোনাবরু বলেছিল, 'দেখিস দাদা, যদি বেঁচে থাকি, তবে কোনো দিনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হব না।' পিঠাপিঠি ভাই ফেরদৌস এখন সবাইকে সেই ব্যাগ দেখিয়ে শুধুই কাঁদছে।
শুধু বরগুনার এক সোনাবরু নয়, আরো কত সোনাবরু যে এভাবেই নীরবে-নিভৃতে চলে যাচ্ছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সব খবর পত্রিকার পাতায় আসেও না। অজানাই থেকে যায় হতদরিদ্র মানুষের কষ্টের কাহিনীগুলো। প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে মানুষ। কিন্তু এই লড়াই কত দিন চলবে? এই যুদ্ধের কি কোনো শেষ নেই! আমাদের স্বপ্নের অর্থনৈতিক মুক্তি কি অধরাই থেকে যাবে?
আমরা দেখছি, সরকার আসে-সরকার যায়। নির্বাচনের আগে মানুষকে অনেক আশার বাণী শোনানো হয়। সেই বাণী শুনে আমাদের দেশের সহজ সরল মানুষ নতুন করে আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা বেমালুম ভুলে যান। আর আশাভঙ্গের যাতনা বয়ে বেড়ায় সাধারণ মানুষ। আসলে সরকারে গিয়েই সবাই নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অতি অল্প সময়ে বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে যান। অভিজাত এলাকায় বাড়ি হয়, দামি গাড়ির মালিক হন তাঁরা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্যের চাকা কিছুতেই আর ঘোরে না। অথচ টিভিতে রাজনৈতিক নেতাদের বেশ গলাবাজি শোনা যায়। তাঁদের উন্নয়নের জোয়ারে নাকি দেশ ভেসে যাচ্ছে! কিন্তু তার বিন্দুমাত্র আঁচ লাগে না সাধারণ মানুষের গায়ে।
কী শাসকদল, কী বিরোধী দল_সবাই একযোগে উন্নয়নের বয়ান করতে থাকে। ক্ষমতায় বসেই বলতে শুরু করে, 'আগের সরকার কিছুই করেনি। দেশের যত ধরনের উন্নয়ন আছে সব আমরা করছি।' আবার বিরোধী দল বলে, 'সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ। তারা কোনো কাজই করছে না। আমরা পাঁচ বছর যে উন্নয়ন করে দিয়ে এসেছি, তা এক শ বছরেও কেউ করতে পারবে না।' এ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক, পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও শোনা যায়। তাদের এসব বিতর্কে জাতীয় সংসদের অধিবেশনকক্ষ উত্তপ্ত হয়। অপচয় হয় জাতীয় সম্পদের। সংসদে জাতীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বেশি প্রাধান্য পায়। কে বড় নেতা, কে ছোট নেতা, কে কোন দোষে আক্রান্ত, কে কতটুকু পড়াশোনা করেছে_এসব আলোচনা হরহামেশাই হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো নেতা কি কখনো একজন হতদরিদ্রের করুণ চিত্র সংসদে তুলে ধরেছেন? হতদরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিত্তবানদের আহ্বান জানিয়েছেন?
আমাদের জাতীয় সংসদে তো নির্বাচিত তিন শ এমপি রয়েছেন। তা ছাড়া দেশে লাখ লাখ কোটিপতি আছেন। তাঁরা সবাই যদি নিজ নিজ এলাকার হতদরিদ্র মানুষের পাশে অন্তত একবারও দাঁড়াতেন, তাহলে এ দেশের কোনো মানুষ না খেয়ে মরত না।
আমরা হয়তো দেখব, সোনাবরুকে নিয়ে রাজনীতি হবে। এক পক্ষ বলবে, খবরটি ডাহা মিথ্যা এবং অতিরঞ্জিত। সরকারকে বিপদে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে কাহিনীটি সাজানো হয়েছে। আরেক পক্ষ এ বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলবে। কিন্তু দারিদ্র্য দূর করতে সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করার কোনো উদ্যোগ দেখব না। অথচ আমরা দেখছি, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে বলে থাকেন, 'দারিদ্র্য বিমোচনে আমরা হেন করেছি, তেন করেছি!'
দরিদ্রদের নামে অসংখ্য এনজিও হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে নিয়ে আসছে। সেই অর্থে তারা নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করছে। দরিদ্রদের অর্থ দিয়ে বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ছে। নিজের, স্ত্রীর এবং ছেলেমেয়েদের জন্য দামি গাড়ি কিনছেন। ছেলেমেয়েদের বিদেশে রেখে পড়াচ্ছেন। অথচ যাদের নামে অর্থ আনা হচ্ছে, সেই দরিদ্র মানুষটির মুখে একমুঠো ভাত জুটছে না।
সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণেও যে কিভাবে মানুষকে দরিদ্র করে তুলছে, তার কিছু উদাহণ দিচ্ছি। এ বছর রমজান মাস শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। রমজান আসার পর পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সেই দাম আর কমেনি। রমজানের পরও পণ্যের দাম যেন আকাশ ছুঁইছুঁই করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জ্বালানি তেল ও সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি ছিল গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। এ সিদ্ধান্তটি সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে হয়। এর আগে গত মে মাসে সরকার সিএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। এরপর মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে আবার কেন জ্বালানির দাম বাড়ানো হলো_সে প্রশ্ন এখন সবাই করছে।
অনেকেই বলছেন, অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে জ্বালানির দাম বাড়িয়ে গেছেন। যাতে সেখানে গিয়ে তিনি বলতে পারেন, 'দেখো, তোমাদের শর্ত আমরা পূরণ করেছি। মানুষের কষ্ট হবে জেনেও তোমাদের কথামতো জ্বালানির দাম বাড়িয়ে এসেছি। এবার আমাদের সাহায্য দাও।'
পরে জানা গেল, অর্থমন্ত্রী নাকি যেকোনো শর্তে আইএমএফের সাহায্য পেতে আগ্রহী। কারণ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। কিছুতেই সরকার সামাল দিতে পারছে না। এ কারণেই অর্থমন্ত্রী দাতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। তাহলে কি দেশ দাতাদের কথামতোই চলবে? বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ যেভাবে বলবে সরকার সেভাবেই দেশ পরিচালনা করবে? তাহলে আর আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বুলি আওড়ে লাভ কী?
উন্নয়নশীল দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা কিংবা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডও উন্নত দেশ এবং দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সাহায্য নেয়। কিন্তু এমন শর্ত থাকে না, যা দেশের মানুষের জন্য অকল্যাণকর। শর্ত থাকে সুশাসনের। শর্ত থাকে সাহায্য যথাযথভাবে খরচ করার। যাতে দুর্নীতি না হয় সেদিকে লক্ষ রাখার কথা বলা হয়। এসব শর্ত বাংলাদেশও মানতে পারে। এমন শর্ত মানা যাবে না, যা দেশের আপামর মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। আমি মনে করি, কঠিন শর্তে যেকোনো ঋণই প্রত্যাখ্যান করা উচিত। অন্তত এই ইস্যুতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এক হতে পারে। উভয় দল দাতাদের জানিয়ে দিতে পারে, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণসহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কঠিন শর্ত না দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের কেন শর্তের বেড়াজালে বন্দি করে রাখা হবে?
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ২৬ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, দুর্নীতি কমান, তাহলে জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে না। তাঁর এই বক্তব্যটি খুবই যৌক্তিক বলে মনে হয়। সরকারের বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি কমাতে পারলে সেই অর্থ দিয়ে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। সরকারের নিজের স্বার্থেই এই ভর্তুকি দেওয়া উচিত বলে মনে করি।
এক বছরে পর পর দুবার সিএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে সর্বত্রই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মুটে-মজুর থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
জ্বালানির যন্ত্রণায় সীমিত আয়ের মানুষ রীতিমতো কাতর। প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের আয় তো আর বাড়ে না। তাহলে বাড়তি খরচ সংকুলান করবে কী দিয়ে! চিন্তায় চুল পাকে গৃহকর্তার।
সম্প্রতি পত্রিকায় রিপোর্ট বেরিয়েছে, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের ঋণের বোঝা বাড়ছে। পরিবারের ভরণপোষণের জন্যই তাদের প্রতি মাসে ঋণ করতে হচ্ছে। কিন্তু ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় নেই। আমি নিজেও দেখেছি, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই খরচ কমাতে বড় বাসা ছেড়ে ছোট বাসা নিচ্ছেন। খাবারের মেন্যুও পরিবর্তন হয়েছে অনেকের। অনেকে খাবারের অভ্যাস বদল করেছেন। যে শিশুরা মাংস খেতে অভ্যস্ত তাদের ডিম কিংবা অন্য কিছু দিয়ে বুঝ দেওয়া হচ্ছে। অনেকে মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। এই করুণ চিত্র রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে লক্ষ করা গেছে।
সরকার যদি সাধারণ মানুষের এই করুণ অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই নিত্যপণের দাম কমানোর উদ্যোগ নেবে। অন্যথায় তারা বলবে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি। তাই দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এ কথা বলার অর্থ দায় এড়ানো। দেশের অভিভাবক হিসেবে সরকার দায় এড়াতে পারে না।
আমার মনে হয়, সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। প্রতিটি ঘরে অন্তত একজন নারী কিংবা পুরুষের কর্মসংস্থান করতে পারলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ জন্য বাজারব্যবস্থার ওপর সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন খাতে যে অরাজক অবস্থা চলছে, তা কেবল অব্যবস্থাপনার কারণে। এর দায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamal1970@hotmail.com
No comments