মানসিকতা বদলানো প্রয়োজন by ডা. ওয়াহিদ নবি
অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলার মানুষ গোপালকে নির্বাচিত করেছিল দেশ শাসন করার জন্য। বাংলায় এই গণতন্ত্র চর্চার কথা ঐতিহাসিকরা লিপিবদ্ধ করেছেন গণতন্ত্রের ইতিহাসে। এই নির্বাচনের কারণ ছিল, দেশে অরাজকতা। মানুষ স্থিতিশীলতা চেয়েছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে দেশের অবস্থা ও পরিবেশ ওই দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গোপাল নির্বাচিত হলেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাল রাজবংশ। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছিল, যার রায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিয়েছিল আমলা-সেনা পরিচালিত সরকার। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের রায়কেও পাকিস্তানের সেনা সরকার মেনে নেয়নি। ১৯৭৫ সালে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে এবং নানা রকম কায়দা-কানুনের মাধ্যমে ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখে। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে একটানা গণতন্ত্র চলছে মাত্র ২০ বছর ধরে। একজন মানুষের জীবনে ২০ বছর অনেকটা সময় হলেও একটি জাতির জীবনে এ সময়টা কিছুই নয়। এ মন্তব্যটা আমরা করলাম পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গণতন্ত্র বিকাশের সময়কাল দেখে।
একজন পণ্ডিত ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন, অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষালাভ করা উচিত। কারণ শুধু নিজ অভিজ্ঞতা দ্বারা শিখতে গেলে আমাদের বহু বছর লেগে যাবে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য। কারণ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গণতন্ত্র অর্জন এবং তা বিকশিত করেছে। আমরা কয়েকটি দেশের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করব। আমাদের গণতন্ত্র বিকাশে এদের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে দেশের অবস্থা কী ছিল, সেই কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। অ্যাথেন্স, ব্রিটেন ও আমেরিকায় স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। ফ্রান্সের বিপ্লবের আগে সেখানে অবস্থা ভালো ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক এলেঙ্ িটকভিলের মতে, এ কথা ঠিক নয়। আমাদের দেশের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম বহু দিন। সেনা শাসনে নিষ্পেষিত হয়েছি অনেক দিন পাকিস্তানে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ নানা রকম অস্থিতিশীলতায় ভুগছি। এ দিক দিয়ে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অসুবিধাগ্রস্ত। 'জেভেডি বারবু' তাঁর 'ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডিক্টেটরশিপ' গ্রন্থে গণতান্ত্রিক মানসিকতার কথা উল্লেখ করেছেন। একটা পরিবর্তন যে এসেছে, তা জনগণ বোঝে গণতান্ত্রিক দেশে। এই পরিবর্তনটা এসেছে ব্যক্তির জীবনে এবং এসেছে জাতির জীবনে_এটা তারা বুঝতে পারে।
গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের মানসিক কাঠামোটা বদলে যায়। তারা মনে করে, এসব পরিবর্তন তারাই এনেছে। অ্যাথেন্সে গণতন্ত্র আসার আগে তারা 'পোলিস' গঠন করেছিল। পোলিসগুলো ছিল একেকটি ক্ষুদ্র জনপদ। এখানে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। সমন্বিত সামাজিক কার্যাবলিতে তারা অংশগ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন শখের কাজ ও অভিজ্ঞতা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। এসব কারণে তাদের নিজেদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে_সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, যারা সমাজে নানা রকম অবদান রেখেছিল। গণতান্ত্রিক দেশে কর্তাদের প্রতি মনোভাব বদলে যায়। ভন মার্টিন তাঁর 'সোসিওলজি অব রেনেসনচ' (ইউরোপীয়রা এভাবেই উচ্চারণ করে) গ্রন্থে লিখেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে সাধারণ মানুষ কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে বৈরী মনোভাব পোষণ করত। গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝতে পারল, কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। কাজেই বৈরী ভাব আর রইল না। সবাই বুঝতে পারল, গণতন্ত্রে আসল ক্ষমতা জনগণের হাতেই থাকে। সম্মতির মাধ্যমে সাময়িকভাবে ক্ষমতা প্রতিনিধির হাতে দেওয়া হয়।
গণতান্ত্রিক মানুষের যুক্তির প্রতি বিশ্বাস জন্মে। একটি সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু সমাজে কিছু নীতি সব সময়ই থাকে। গণতান্ত্রিক জাতি সর্বজনীন অভিপ্রায় ও ধারণা পছন্দ করে বলে টেকভিল মনে করতেন। একটি সদা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে হলে মানসিক নমনীয়তা প্রয়োজন। যুক্তিতে বিশ্বাস থাকলে মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতির মূল বিষয় বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নিতে পারে। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত মানসিকতা নিয়ে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। একদল মানুষের একই ধরনের চিন্তাধারা, অনুভূতি, আদর্শ, লক্ষ্য ইত্যাদি থাকলে তারা একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে, যা হয় গণতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি। গণতন্ত্রে কিছু কিছু স্ববিরোধিতা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো সত্যের বিরোধিতা নয়। গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে স্বাধীনতা ও সমতা। কিন্তু বাস্তবে তা দেখতে পাওয়া যায় না সমাজে। একজনের পূর্ণ স্বাধীনতা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সমতার অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত উপযুক্ততার কথা বলা হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, 'গণতন্ত্রে স্বাধীনতা হতে হবে আইনের গণ্ডির ভেতরে স্বাধীনতা।' গণতন্ত্রে যুক্তিভিত্তিক আইন হচ্ছে নির্বস্তুক। গণতন্ত্রে কর্তৃত্ব হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক। গণতন্ত্রে আইনের ভিত্তি হচ্ছে গণমানুষের সংস্কৃতি। গণতন্ত্রে আপস একরকম অপরিহার্য। অরটেগা গ্যাসেট ইমানুয়েল কান্টের দর্শনকে 'বণিকের দর্শন' হিসেবে পরিহাস করেছেন। কান্ট বহির্জগৎ এবং অন্তর্জগতের মধ্যে আপসের কথা বলেছেন। তিনি অলৌকিক ও পার্থিব জীবনের মধ্যে আপসের কথা বলেছেন। আসলে জ্ঞান হচ্ছে আদর্শিক ও বাস্তব জীবনের মধ্যে আপস।
ধর্মকে অনেকে গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল মনে করেন না। কারণ, ধর্ম পরিবর্তনের বিপক্ষে; এবং ধর্ম একচ্ছত্র ক্ষমতার পক্ষে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্মীয় নেতারা গণতন্ত্র মেনে নিয়েছেন। কট্টর রোমান ক্যাথলিকরা অনেক নমনীয় হয়েছেন রেনেসনচ ও রিফরমেশনের (প্রটেস্ট্যান্ট) কারণে। এখন রাষ্ট্র আর গির্জা আলাদা হয়ে গেছে। আধুনিক মানুষ এখন নিজ বিবেক ও যুক্তি দ্বারা পরিচালিত। মধ্যযুগে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব ছিল না; ছিল শুধু শ্রেণী। রোমান্টিসিজমের প্রবক্তারা ব্যক্তিমানুষের গুরুত্ব দিলেন অতি মাত্রায়। রেনেসনচ সৌন্দর্যবাদ নিয়ে এলেন। মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এল। পশ্চিমা জগতে মানুষ যেমন ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেয়, তেমনি তারা সমষ্টির সদস্য হওয়াকেও গুরুত্ব দেয়। গণতন্ত্রে মানুষে মানুষে যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। কথাবার্তায় কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন আছে। নম্রতা মানুষ পছন্দ করে। শোভন হলে অন্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ভালো হয়। রসিকতা অনেক জটিল পরিবেশকে সহজ করে দেয়। আশ্চর্য হতে হয়, এখনো যখন শুনি, কিছু মানুষ 'সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে' ধরনের কথা বলে। সহনশীলতা একটি বড় গুণ। উদার আদর্শ সহনশীলতা অর্জনে সাহায্য করে। সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতে গেলে সহনশীলতা অপরিহার্য। আবার সমাজ নানাভাবে সহনশীল ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। সমাজে নিরাপত্তাবোধ থাকলে এবং সমাজ স্থিতিশীল হলে মানুষও সহনশীল হয়। উদ্বেগপূর্ণ পরিবেশে কারো মনোভাব, অভ্যাস ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠলে মানসিকতা অনমনীয় হয়।
এখন আমাদের দেশের দিকে তাকানো যাক। আমাদের কিছু কিছু অসুবিধা রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের শান্তি বা স্থায়িত্ব ভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি গণতন্ত্র প্রচলনের আগে। আমরা পরাধীন ছিলাম বহু বছর। সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে বারবার। আমলারা এখনো গণতন্ত্রের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হয়ে ওঠেননি। আমাদের সমাজ এখনো কৃষিনির্ভর। তাই আমাদের মানসিকতা মোটের ওপর সামন্তবাদী। কল-কারখানা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো ভোট বেশি না পেলেও তাদের সংগঠন শক্তিশালী। আমাদের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ 'পার্থিবতা' হলেও খোলাখুলি আলোচনা হয় না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। এসব এবং অন্যান্য কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা গড়ে উঠতে সময় লাগছে।
গণতন্ত্রের বিকাশ লাভে সময় লাগে। পার্লামেন্ট গঠনের ৭০০ বছর পর ব্রিটেনে মহিলাদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত রাজনৈতিক সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে দেওয়া। মাঝেমধ্যেই অরাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপ গণতন্ত্র বিকাশের পথে অন্তরায় হচ্ছে। দেশে খারাপ একটা কিছু ঘটলেই এক শ্রেণীর মানুষকে বলতে শুনি, 'আমরা এখনো গণতন্ত্রের উপযুক্ত হইনি।' তাদের এবং আমাদের সবাইকে লর্ড মেকলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আজকের মতো শেষ করছি_'যাঁরা বলেন, একটি দেশ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত না হলে তাদের গণতন্ত্র দিতে নেই, তাঁরা আসলে বলতে চান, সাঁতার না শেখা পর্যন্ত কাউকে পানিতে নামতে দিতে নেই।'
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কলামিস্ট
একজন পণ্ডিত ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন, অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষালাভ করা উচিত। কারণ শুধু নিজ অভিজ্ঞতা দ্বারা শিখতে গেলে আমাদের বহু বছর লেগে যাবে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য। কারণ বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে গণতন্ত্র অর্জন এবং তা বিকশিত করেছে। আমরা কয়েকটি দেশের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করব। আমাদের গণতন্ত্র বিকাশে এদের অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাতে পারি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে দেশের অবস্থা কী ছিল, সেই কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। অ্যাথেন্স, ব্রিটেন ও আমেরিকায় স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। ফ্রান্সের বিপ্লবের আগে সেখানে অবস্থা ভালো ছিল না বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু ফ্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক এলেঙ্ িটকভিলের মতে, এ কথা ঠিক নয়। আমাদের দেশের কথা চিন্তা করলে দেখা যায়, আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম বহু দিন। সেনা শাসনে নিষ্পেষিত হয়েছি অনেক দিন পাকিস্তানে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডসহ নানা রকম অস্থিতিশীলতায় ভুগছি। এ দিক দিয়ে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অসুবিধাগ্রস্ত। 'জেভেডি বারবু' তাঁর 'ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডিক্টেটরশিপ' গ্রন্থে গণতান্ত্রিক মানসিকতার কথা উল্লেখ করেছেন। একটা পরিবর্তন যে এসেছে, তা জনগণ বোঝে গণতান্ত্রিক দেশে। এই পরিবর্তনটা এসেছে ব্যক্তির জীবনে এবং এসেছে জাতির জীবনে_এটা তারা বুঝতে পারে।
গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের মানসিক কাঠামোটা বদলে যায়। তারা মনে করে, এসব পরিবর্তন তারাই এনেছে। অ্যাথেন্সে গণতন্ত্র আসার আগে তারা 'পোলিস' গঠন করেছিল। পোলিসগুলো ছিল একেকটি ক্ষুদ্র জনপদ। এখানে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল। সমন্বিত সামাজিক কার্যাবলিতে তারা অংশগ্রহণ করেছিল। বিভিন্ন শখের কাজ ও অভিজ্ঞতা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল। এসব কারণে তাদের নিজেদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে_সামাজিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, যারা সমাজে নানা রকম অবদান রেখেছিল। গণতান্ত্রিক দেশে কর্তাদের প্রতি মনোভাব বদলে যায়। ভন মার্টিন তাঁর 'সোসিওলজি অব রেনেসনচ' (ইউরোপীয়রা এভাবেই উচ্চারণ করে) গ্রন্থে লিখেছেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে সাধারণ মানুষ কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে বৈরী মনোভাব পোষণ করত। গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝতে পারল, কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। কাজেই বৈরী ভাব আর রইল না। সবাই বুঝতে পারল, গণতন্ত্রে আসল ক্ষমতা জনগণের হাতেই থাকে। সম্মতির মাধ্যমে সাময়িকভাবে ক্ষমতা প্রতিনিধির হাতে দেওয়া হয়।
গণতান্ত্রিক মানুষের যুক্তির প্রতি বিশ্বাস জন্মে। একটি সমাজ সদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু সমাজে কিছু নীতি সব সময়ই থাকে। গণতান্ত্রিক জাতি সর্বজনীন অভিপ্রায় ও ধারণা পছন্দ করে বলে টেকভিল মনে করতেন। একটি সদা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে হলে মানসিক নমনীয়তা প্রয়োজন। যুক্তিতে বিশ্বাস থাকলে মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতির মূল বিষয় বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নিতে পারে। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত মানসিকতা নিয়ে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। একদল মানুষের একই ধরনের চিন্তাধারা, অনুভূতি, আদর্শ, লক্ষ্য ইত্যাদি থাকলে তারা একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে, যা হয় গণতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি। গণতন্ত্রে কিছু কিছু স্ববিরোধিতা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো সত্যের বিরোধিতা নয়। গণতন্ত্রের মূলকথা হচ্ছে স্বাধীনতা ও সমতা। কিন্তু বাস্তবে তা দেখতে পাওয়া যায় না সমাজে। একজনের পূর্ণ স্বাধীনতা অন্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সমতার অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত উপযুক্ততার কথা বলা হয়ে থাকে। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, 'গণতন্ত্রে স্বাধীনতা হতে হবে আইনের গণ্ডির ভেতরে স্বাধীনতা।' গণতন্ত্রে যুক্তিভিত্তিক আইন হচ্ছে নির্বস্তুক। গণতন্ত্রে কর্তৃত্ব হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক। গণতন্ত্রে আইনের ভিত্তি হচ্ছে গণমানুষের সংস্কৃতি। গণতন্ত্রে আপস একরকম অপরিহার্য। অরটেগা গ্যাসেট ইমানুয়েল কান্টের দর্শনকে 'বণিকের দর্শন' হিসেবে পরিহাস করেছেন। কান্ট বহির্জগৎ এবং অন্তর্জগতের মধ্যে আপসের কথা বলেছেন। তিনি অলৌকিক ও পার্থিব জীবনের মধ্যে আপসের কথা বলেছেন। আসলে জ্ঞান হচ্ছে আদর্শিক ও বাস্তব জীবনের মধ্যে আপস।
ধর্মকে অনেকে গণতন্ত্রের জন্য অনুকূল মনে করেন না। কারণ, ধর্ম পরিবর্তনের বিপক্ষে; এবং ধর্ম একচ্ছত্র ক্ষমতার পক্ষে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্মীয় নেতারা গণতন্ত্র মেনে নিয়েছেন। কট্টর রোমান ক্যাথলিকরা অনেক নমনীয় হয়েছেন রেনেসনচ ও রিফরমেশনের (প্রটেস্ট্যান্ট) কারণে। এখন রাষ্ট্র আর গির্জা আলাদা হয়ে গেছে। আধুনিক মানুষ এখন নিজ বিবেক ও যুক্তি দ্বারা পরিচালিত। মধ্যযুগে ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব ছিল না; ছিল শুধু শ্রেণী। রোমান্টিসিজমের প্রবক্তারা ব্যক্তিমানুষের গুরুত্ব দিলেন অতি মাত্রায়। রেনেসনচ সৌন্দর্যবাদ নিয়ে এলেন। মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এল। পশ্চিমা জগতে মানুষ যেমন ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেয়, তেমনি তারা সমষ্টির সদস্য হওয়াকেও গুরুত্ব দেয়। গণতন্ত্রে মানুষে মানুষে যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। কথাবার্তায় কৌশলী হওয়ার প্রয়োজন আছে। নম্রতা মানুষ পছন্দ করে। শোভন হলে অন্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ভালো হয়। রসিকতা অনেক জটিল পরিবেশকে সহজ করে দেয়। আশ্চর্য হতে হয়, এখনো যখন শুনি, কিছু মানুষ 'সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে' ধরনের কথা বলে। সহনশীলতা একটি বড় গুণ। উদার আদর্শ সহনশীলতা অর্জনে সাহায্য করে। সমাজে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করতে গেলে সহনশীলতা অপরিহার্য। আবার সমাজ নানাভাবে সহনশীল ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। সমাজে নিরাপত্তাবোধ থাকলে এবং সমাজ স্থিতিশীল হলে মানুষও সহনশীল হয়। উদ্বেগপূর্ণ পরিবেশে কারো মনোভাব, অভ্যাস ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠলে মানসিকতা অনমনীয় হয়।
এখন আমাদের দেশের দিকে তাকানো যাক। আমাদের কিছু কিছু অসুবিধা রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের শান্তি বা স্থায়িত্ব ভোগ করার সৌভাগ্য হয়নি গণতন্ত্র প্রচলনের আগে। আমরা পরাধীন ছিলাম বহু বছর। সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে বারবার। আমলারা এখনো গণতন্ত্রের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হয়ে ওঠেননি। আমাদের সমাজ এখনো কৃষিনির্ভর। তাই আমাদের মানসিকতা মোটের ওপর সামন্তবাদী। কল-কারখানা গড়ে ওঠেনি বললেই চলে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো ভোট বেশি না পেলেও তাদের সংগঠন শক্তিশালী। আমাদের সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ 'পার্থিবতা' হলেও খোলাখুলি আলোচনা হয় না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। এসব এবং অন্যান্য কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা গড়ে উঠতে সময় লাগছে।
গণতন্ত্রের বিকাশ লাভে সময় লাগে। পার্লামেন্ট গঠনের ৭০০ বছর পর ব্রিটেনে মহিলাদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত রাজনৈতিক সরকারকে দেশ পরিচালনা করতে দেওয়া। মাঝেমধ্যেই অরাজনৈতিক শক্তির হস্তক্ষেপ গণতন্ত্র বিকাশের পথে অন্তরায় হচ্ছে। দেশে খারাপ একটা কিছু ঘটলেই এক শ্রেণীর মানুষকে বলতে শুনি, 'আমরা এখনো গণতন্ত্রের উপযুক্ত হইনি।' তাদের এবং আমাদের সবাইকে লর্ড মেকলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আজকের মতো শেষ করছি_'যাঁরা বলেন, একটি দেশ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত না হলে তাদের গণতন্ত্র দিতে নেই, তাঁরা আসলে বলতে চান, সাঁতার না শেখা পর্যন্ত কাউকে পানিতে নামতে দিতে নেই।'
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কলামিস্ট
No comments