দাতাদের মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে- খবরদারির পরিবর্তে সহযোগিতার কথা বলছে উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে by কাওসার রহমান
এবারের উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে দাতারা খবরদারির পরিবর্তে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। পাশাপাশি সেই পুরনো করণীয়গুলোই আবার নতুন করে করতে বলেছে।
তবে এবারে বলার ধরনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বলেছে, উন্নয়নের জন্য অর্থের কোন অভাব হবে না। বরং আগের চেয়ে আরও অধিক পরিমাণ সাহায্য প্রদান করা হবে। তবে সেই পুরনো করণীয়গুলো এ সরকারকে করতে হবে। ওই করণীয়গুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, দুনর্ীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও উন্নয়ন, সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করা, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকারকে শাক্তিশালী করা এবং রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। এগুলোকেই দাতারা সরকারের দুর্বল দিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বলেছে, সরকারের প্রশাসনিক সেবার মান উন্নত করতে না পারলে ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার উদ্যোগকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। তারা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য সরকারকে আট শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বলেছে। যা অর্জন করতে বৈঠকের প্রসত্মাবিত জয়েন্ট কোঅপারেশন স্ট্র্যাটেজি সহায়ক হবে।বৈঠকে যোগদানকারী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাতাদের মনোভাবে এবার ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তাদের সেই খবরদারির মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। তাদের মনোভাব ছিল তারা বাংলাদেশকে অধিক সাহায্য দিতে চায়। সেই সঙ্গে তারা উন্নয়নের স্বার্থেই কতগুলো কাজ করতে বলেছে। ওই কাজগুলো করলে প্রকল্প বাসত্মবায়নের জন্য সরকারের অর্থের অভাব হবে না। যদিও এ বৈঠকটি সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রম্নতির কোন বৈঠক ছিল না। তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, ডিএফআইডি, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ বৈঠকেই বর্ধিত পরিমাণ সাহায্য প্রদানের ইঙ্গিত দিয়েছে। সরকার তার প্রকল্প বাসত্মবায়নের দতা বাড়াতে পারলে আগামী এক বছরে বাংলাদেশের সাহায্যপ্রাপ্তির পরিমাণ তিন শ' কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ডক্টর কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দাতারা যে কাজগুলো করার জন্য তাগিদ দিয়েছে, সেগুলো করার জন্য আমরাও সরকারকে বলে আসছি। সরকারও মনে করছে, এ কাজগুলো করা উচিত। আমরাও চাইছি দুর্নীতি দমন কমিশন শক্তিশালী করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী করা। এগুলো সরকারকে করতে হবে। তবে এবার দাতাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। তারা সমালোচনাও যেমন করেছে, তেমনি প্রশংসাও করেছে। দ্বিতীয় দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল এবং জলবায়ু পরিবর্তন এ্যাকশন পস্ন্যানের ব্যাপারে তারা প্রশংসা করেছে। এবারের বৈঠকের আর একটি বিশেষত্ব ছিল সরকারী এ বৈঠকে বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণ। এই প্রথম বেসরকারী বিশেষজ্ঞদের সরকার উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং তারা স্বাধীনভাবে সরকারের উপস্থাপিত কর্মকা- পর্যালোচনা করেছে।
এবার দীর্ঘ সাড়ে চার বছর পর সরকার তার উন্নয়ন কর্মকা- নিয়ে দাতাদের মুখোমুখি হয়। আর নতুন সরকার মুখোমুখি হয় তাদের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পর। অর্থাৎ মহাজোট সরকার তাদের এক বছরের কর্মকা- নিয়ে দাতাদের সামনে হাজির হয়েছে। সরকার এবার আমলাদের সঙ্গে বেসরকারী খাতের বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে দাতাদের মুখোমুখি হয়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পর্যালোচনায় সরকার ও বেসরকারী খাতের এই অংশীদারিত্বকে সরকার খুব আনত্মরিকার সঙ্গেই গ্রহণ করেছে। যে কারণে তারা উন্নয়ন কাজের জন্য বেসরকারী খাতকে সম্পৃক্ত করতে সরকারের প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। দাতারাও এ উদ্যোগে অংশগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে বিদু্যত উৎপাদন ও রাসত্মা মেরামত তহবিল গঠনে তারা সরাসরি অংশগ্রহণের কথা বলেছে। সরকার ২০১৩ সাল নাগাদ বিদু্যত উৎপাদনের পরিমাণ সাত হাজার মেগাওয়াটে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এজন্য ৯৫০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রয়োজন হবে। বেসরকারী খাতের সঙ্গে এ অর্থের একটি অংশ প্রদানের ব্যাপারেও দাতারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এজন্য অবশ্য দাতারা বিদু্যতের দাম বৃদ্ধির কথা বলেছে। তবে সরকার তাদের প্রসত্মাব সরাসরি মেনে নেয়নি। গ্রাহকদের সামর্থ্য বিবেচনায় এ মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। পদ্মাসেতুতে দাতারা শর্তহীনভাবে বড় ধরনের অর্থায়নের অঙ্গীকার করেছে। সেই অঙ্গীকারের বিষয়টি পরিষ্কার করেছে এবারের বৈঠকে। ২৪০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক একাই এ প্রকল্পে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার প্রদানের প্রসত্মাব করেছে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক আগামী এক বছরে বাংলাদেশকে এক শ' কোটি ডলার প্রদানের কথা ঘোষণা দিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আগামী এক বছরে ১২০ কোটি ডলার প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে। জাপান ও নরওয়েও বাংলাদেশে সাহায্যের পরিমাণ আরও বৃদ্ধির কথা বলেছে।
এবারে আরও একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে তা হলো সরকারের সিদ্ধানত্ম বাসত্মবায়নের সঙ্গে সঙ্গে দাতাদের প্রতিশ্রম্নতি পূরণের বিষয়টিও। দাতারা আগামী এক বছর তাদের সুপারিশগুলোর বাসত্মবায়ন অবস্থা পর্যবেণ করবে। পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রম্নতির বাসত্মবায়নের বিষয়টিও মনিটর করা হবে। দাতাদের অর্থ যাতে দ্রম্নত ব্যবহার করা যায় সেজন্য সরকার ও দাতাদের সমন্বয়ে একটি জয়েন্ট কোঅপারেশন স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করা হবে। ওই স্ট্র্যাটেজির ভিত্তিতে অর্থ ব্যবহার করা হবে।
এবারের বৈঠকের বড় অর্জন হচ্ছে- বহুল আলোচিত মাল্টিডোনার ট্রাস্ট ফান্ডের কর্তৃত্ব সরকারের হাতে গ্রহণ। বৈঠকে দীর্ঘ দরকষাকষির পর এ ফান্ডের কতর্ৃত্ব বাংলাদেশ পেয়েছে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০০৮ সালে যুক্তরাজ্যে এ ফান্ড গঠন করা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিশ্বব্যাংকের হাতে তুলে দেয়। এ নিয়ে সুশীল সমাজ ও এনজিওদের প থেকে ব্যাপক আপত্তি ওঠে। মহাজোট সরকারও মতায় এসে এ ফান্ড পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের হাতে নেয়ার উদ্যোগ নেয়। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দাতাদের সঙ্গে সরকারের দরকষাকষি চলে। শেষ পর্যনত্ম তা সরকারের হাতে এসেছে। তবে এ ফান্ড ব্যবহারের ব্যাপারে সরকারকে কারিগরি সহায়তা দেবে বিশ্বব্যাংক।
No comments