গহন গহীন-বসন্তের হাওয়া আর আগ্নেয়াস্ত্রের ধোঁয়া by ফখরুজ্জামান চৌধুরী

যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন অবস্থানকালে মাঝেমধ্যে ইন্টারনেট ও টেলিফোনে মতবিনিময়ের সুযোগ হতো জর্জ কাটসিয়া-ফিকাসের সঙ্গে। ওয়েন্টওয়ার্থ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ইন বস্টনের হিউম্যানিটিজের অধ্যাপক জর্জ মানুষ হিসেবে অত্যন্ত বিরল কিছু গুণাবলির অধিকারী।
মতপ্রকাশের ব্যাপারে তাঁর মধ্যে কোনো রকম আড়ষ্টতা দেখিনি। যা তিনি বিশ্বাস করেন, অকপটে তা প্রকাশ করেন।
নিজের সম্পর্কে তাঁর সাফ মন্তব্য, ধমনীতে যদিও তাঁর ইউরোপীয় বাবার রক্ত প্রবহমান, মিসরীয় মায়ের প্রভাবই তাঁর জীবনে সুগভীর। কায়রোর দুহিতা মায়ের কারণে জর্জ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার পরও প্রতিনিয়ত পশ্চিম এশিয়ার সুখ-দুঃখে প্রভাবিত হন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেও তিনি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব নিয়ে গবেষণা করছেন। সম্প্রতি তিনি সমাপ্ত করেছেন 'এশিয়া'স আননোন আপরাইজিংস- এশিয়ার অজানা সব অভ্যুত্থান নিয়ে গবেষণার কাজটি।
বাংলাদেশে সেনা শাসনের বিষয়টিও তাঁর গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য এই একাডেমীর হয়ে ২০১০ সালের শুরুতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও আসেন। প্রায় একই সময় সারা বিশ্বকে নাড়া দিয়ে শুরু হলো এমন এক ঘটনা, পরবর্তী সময়ে যা পরিচিতি লাভ করে আরব স্প্রিং- আরব বসন্ত নামে।
যে বিপ্লব সব সময় উত্তাপ ছড়ায়, সেই বিপ্লবকে বসন্ত হিসেবে নামকরণের মধ্যে প্রত্যাশার পারদ যে কত উঁচুতে থাকে, তা অতি সহজে অনুমেয়।
যে বিপ্লবে অগি্নশলাকাটি নিজের অজ্ঞাতেই সরবরাহ করেছিলেন অতিশয় নিরীহ 'চেহারাবিহীন' হাজার জনের একজন মোহামেদ বুআজিজি নামক এক সবজিবিক্রেতা- ইতিহাস তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে এমন নয়। জন্মাবধি বুআজিজির নিয়তি ছিল রাজপথের ফুটপাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে তুষ্ট করে টুকরির সবজি বিক্রি করা। কী যে ছিল সেদিন বিধাতার মনে। প্রতিদিনের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য তাদের 'ন্যায্য পাওনা' তোলা আদায় করতে গিয়ে হয়তো বুআজিজির মনের এমন কোনো সংবেদনশীল অংশে আঘাত করেছিল, বরাবরের মতো মূক পশুর মতো তা সহ্য করা সেদিন তাঁর জন্য ছিল অসম্ভব এবং মর্যাদাহানিকর। দুর্বল সবজি ফেরিওয়ালা প্রতিবাদ করলেন আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে। তাঁর শীর্ণ দেহ আর জীর্ণ পোশাকের আগুন ছড়িয়ে পড়ল প্রথমে রাজধানী তিউনিসে। এর পর অচিরেই গোটা দেশ তিউনিসিয়ায়। দীর্ঘদিন তিউনিসিয়ায় একনায়ক হিসেবে শাসনকর্তার ক্ষমতার আসন মুহূর্তে টলে উঠল। বিদেশি বন্ধু- এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সের সহায়তায় সপরিবারে গণ-আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সস্ত্রীক প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলি। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়াবাসীর কাঁধের ওপর চেপে বসা ২৩ বছরের জগদ্দল পাথরটি অপসৃত হলো।
এই পরিবর্তনের পর জনগণ যা প্রত্যাশা করেছিল, পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে জয়ী হয় কট্টরপন্থী ইসলামী পার্টি। কিন্তু নির্বাচন দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশজুড়ে চলছে রাজনৈতিক বিক্ষোভ আর অর্থনৈতিক অচলাবস্থা।
অবস্থা এখন এমনই জটিল ও সাধারণ মানুষ এতই আশাহত যে বলাবলি করতে শুরু করেছে- আগের জালিম শাসকের আমলের চেয়ে এখন আর এমন কী ভালো আছি!
তিউনিসিয়ার এক আগুনে আত্মাহুতির ঘটনার পরপর আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া ও মিসরে কমপক্ষে আটজন আগুনে আত্মাহুতি দেন। দূরবর্তী দেশ ইয়েমেনে তিন দশক ধরে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ এই ঘটনা-শৃঙ্খলে এতটাই বিচলিত হন যে, তিনি ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর আগাম ঘোষণা দিয়ে বসেন। অবশ্য এ কাজটি তিনি করেন অনেক পানি ঘোলা করে। ক্ষমতার মোহ এমনই প্রচণ্ড যে, বাধ্য না হলে কেউ তা ছাড়তে চান না।
তিউনিসিয়ার আন্দোলনের ঢেউ এসে নীল নদের তীরে পৌঁছে সামাজিক সম্পর্ক রক্ষাকারী ওয়েবসাইট ফেসবুকে আর টুইটারের মাধ্যমে। ইনফরমেশন টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ এক ব্যক্তি ওয়ায়েল ঘোনিম (২৯), মিসরব্যাপী জনগণের মধ্যে এই বাণী ছড়িয়ে দেন যে, মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের দিন শেষ। এখন জনগণের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখেই তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হবেন।
আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এসব দেশের শাসকবর্গ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী মনে করেন। কী রাজতন্ত্রে, কী গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে একই দৃশ্য।
আরব বসন্তের হাওয়া জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহকেও শঙ্কিত করে তোলে। তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন রকম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং মন্ত্রিসভা পরিবর্তন করেন।
আরব বিশ্বে এই আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে যেমন সরকারের ভেতর সৃষ্টি হলো ভীতি, তেমনি জনমনে সৃষ্টি হলো আশা। আর এসব দেশের ক্ষমতার নিয়ামক যে দেশটি, সেই যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা 'ধীরে চলো' নীতি অনুসরণ করাকেই আপাতত নিরাপদ মনে করলেন। আফগানিস্তান ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ার ফল তো দৃশ্যমান।
মিসরের দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসক হোসনি মুবারককে নিয়ে ওয়াশিংটনের পাওয়ার করিডরে সবচেয়ে বেশি দুঃশ্চিন্তা দেখা দেয়। এই ব্যক্তির ও পরিবারের দুর্নীতি এমন সর্বগ্রাসী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তাঁর সহায়তায় কোনোভাবে ওয়াশিংটন এগিয়ে আসার কথা চিন্তাও করতে পারেনি।
কায়রোর তাহরির স্কয়ারের জনসমুদ্রের রায়ে যে দেওয়াল লিখন দেখা গেল, তার ভাষা এতই স্পষ্ট যে কারো তা বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়।
জর্জ এই সময়ে যে পূর্বাভাসটি করেন, তাঁর প্রবন্ধ 'দি ইরোস ইফেক্ট কামস টু কায়রো'য় যা প্রকাশিত হয়, প্রভাবশালী দি ইজিপশিয়ান গেজেটে (প্রথম প্রকাশ : ১৮৮০) ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১১ সংখ্যায় আজ অক্ষরে অক্ষরে তা সত্য প্রতিপন্ন হচ্ছে। এমন বিপ্লব অতীতেও ব্যর্থ হওয়ার নজির উল্লেখ করেছেন জর্জ। ১৯৮৯ সালে কোনোরকম আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই পূর্ব ইউরোপে যে পরিবর্তনের ঢেউ খেলে যায়, তাতে কম্যুনিস্ট শাসনের পতন ঘটে একের পর এক দেশে। এর আগে আশির দশকে পূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবের ঢেউয়ের অভিঘাত লাগে এবং তা লাগে কোনোরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু বিপ্লব যা ছড়িয়ে পড়ে ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তিব্বত, চীন, তাইওয়ান, নেপাল, বাংলাদেশ এবং থাইল্যান্ডে।
কিন্তু ছয় বছরের মধ্যেই এসব বিপ্লবের অপনায়করা অপমান ও লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে কেউ নির্বাসিত হন, কেউ বা লাভ করেন কারাদণ্ড।
আরব বিশ্বে বর্তমানে যে বিপ্লবের ঢেউ লেগেছে, তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকার ফলে আশান্বিত হওয়ার কারণ রয়েছে বলে যদিও মনে করা হয়, বাস্তব চিত্র কিন্তু তা বলে না।
লিবিয়ায় বর্তমানে যা ঘটছে, তা ঘটবে এমনটা বিপ্লবের অগ্রনায়করা কখনো ভাবতে পারেননি। এখন সেখানে 'বন্দুক-সুখি' গোত্রের আধিপত্য। এমন যে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র, তার রাষ্ট্রদূতও বন্দুকধারীদের রাজধানী ত্রিপোলিতে গুলিতে নিহত হয়েছেন, যদিও দূত অবধ্য! এবং এই দুঃখজনক মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে একরকম 'নিশ্চিত' সুসান রাইসের ভাগ্যবিপর্যয়ের কারণও হয়ে দাঁড়াল।
আর ওদিকে মিসরে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কিছু দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে যে ডিক্রি জারি করলেন, এর ফলে মিসরজুড়ে আবার শুরু হয়েছে বিক্ষোভ-আন্দোলন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট মুরসি পিছু হটতে বাধ্য হন। এখন তিনি তাঁর সংস্কারসূচিকে গণভোটে দিয়েছেন। গণভোটের ফল যা-ই হোক, মোহাম্মদ মুরসির সামনের দিনগুলো যে বিশেষ সুখকর হবে না, তার আভাস ইতিমধ্যেই পাওয়া গেল।
মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়া নামক ভূখণ্ডের দেশগুলোর জনগণের নিয়তি প্রায় একসুতোয় গাঁথা। কেউ নিষ্পেষিত দীর্ঘকালীন বংশপরম্পরার রাজতন্ত্রের কিংবা আমিরতন্ত্রের যাঁতাকলে। কোনো কোনো দেশ গণতন্ত্রের নামে স্বৈরশাসনের নাগপাশে আবদ্ধ।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, যে প্রত্যাশা নিয়ে জনগণ একজনকে ক্ষমতাসীন করে, তা অতিদ্রুত হতাশায় রূপান্তরিত হয়।
মিসরের ভবিষ্যৎ কী হয়, তা অদূর-ভবিষ্যতে জানা যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর নিজের হাতে ছ্যাঁকা লাগাতে চায় না বলেই হয়তো কায়রোর পাওয়ার করিডরের আশপাশে হাঁটাচলা করলেও মূল সড়কে এখন পা রাখতে আগ্রহী নয়।
প্রেসিডেন্ট ওবামা জানেন, তাঁর শাসনের মেয়াদ কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। অনেক সমস্যা তার দেশে পুঞ্জীভূত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে এখন বিরাট বিস্ফোরকের মতো দেখা দিয়েছে 'ট্রিগার হ্যাপি' মার্কিন যুবসমাজ। অকারণে মানব নিধনের এমন নজির খুব কম দেশেই দেখা যায়। 'রেড নেকন্টেট' কানেকটিকাটের সাম্প্রতিক স্কুলের নারকীয় হত্যাকাণ্ড মার্কিন সমাজব্যবস্থার ভিত্তি নেড়ে দিয়েছে।
অস্ত্রের অধিকার আজ দেশটিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে তা ভেবে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন। অস্ত্র আইনের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে ওবামা-প্রশাসনকে। এর ফলে মৌলিক অধিকার খর্ব হলো। এখন বসন্তের বাতাসের সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্রের তপ্ত ধোঁয়া মিলে গোটা বিশ্বকে করে তুলেছে বিপন্ন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক।

No comments

Powered by Blogger.