বাজেটে জনশক্তি রপ্তানি এবং আগামীর প্রত্যাশা by হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

এই লেখার শুরুতেই অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। অভিনন্দন জানাচ্ছি বিদেশে কর্মরত হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিকের পক্ষ থেকে, যাঁরা প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কলকারখানা, দোকান, ফার্ম, হাসপাতাল ও বাড়িতে কর্মরত রয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন দেশের বড় বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর ধরে অমানুষিক পরিশ্রম আর ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।


প্রতিবছর এ জনগোষ্ঠী গায়ের রক্ত পানি করে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। দেশের অর্থনীতিকে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করতে ধারাবাহিকভাবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছেন অভিবাসী শ্রমিকরাই। অর্থমন্ত্রী এবারকার বাজেটে জনশক্তি রপ্তানিকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করে অন্তত এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ মূল্যায়নে অগ্রসর হয়েছেন। যদিও বাজেটে জনশক্তি খাতকেন্দ্রিক পুরো প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়নি, এর পরও বলব, অন্তত বাজেটে এ খাতকে সবার দৃষ্টিসীমার মধ্যে আনা হয়েছে।
এ খাতের একজন উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষক হিসেবে নির্বিবাদেই বলছি, দেশের অর্থনীতিতে জনশক্তি খাতের যে অবদান, বিপরীতে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে তার যথাযথ মূল্যায়ন সেভাবে কখনোই হয়নি। আমাদের অনেক খাত নিয়েই বাজেটে নানা কথাবার্তা হয়, নানা রকম স্বপ্ন রচনা করা হয়, নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে অনেক খাতকে শক্তিশালী ও অগ্রসর রাখতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু ওই নিরিখে এ খাত নিয়ে যতটা গর্ব করা হয়, সে তুলনায় জাতীয় বাজেটে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বিশেষ করে জাতীয় বাজেটে এ খাতটি বরাবরই উপেক্ষিত এক অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। অথচ আমাদের গর্ব ও অহংকারের এক শক্তিশালী খাত জনশক্তি রপ্তানি বা আমাদের প্রাপ্ত বৈদেশিক রেমিট্যান্স। আমরা গত কয়েক বছরে স্বচক্ষেই দেখেছি, দেশের অর্থনীতি যখনই প্রবল ধাক্কার সম্মুখীন বা মুখোমুখি হয়েছে, তখনই এ খাত প্রাচীর হিসেবে দাঁড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে।
এবারকার বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ খাত নিয়ে অনেক অর্জন ও সাফল্যের কথা বলার পাশাপাশি কিছু স্বপ্নের কথাও তুলে ধরেছেন। বলেছেন 'প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক'-এর সফল কার্যক্রম শুরুর কথা। একই সঙ্গে উল্লেখ করেছেন 'অভিবাসন ঋণ' এবং 'পুনর্বাসন ঋণ' সুবিধার কথাও। অর্থমন্ত্রী আরো উল্লেখ করেছেন, বর্তমান শ্রমবাজারের বাইরে নতুন নতুন শ্রমবাজারকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই এরই মধ্যে পোল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা ও কঙ্গোতে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। সে দেশে অবৈধভাবে বসবাসরত তিন লাখ বাংলাদেশির বৈধকরণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পথে। বাজেটে বিদেশের মিশনগুলোর শ্রম উইংয়ে জনবল বৃদ্ধি করা প্রসঙ্গে বলেছেন, নতুন আরো তিনটি দেশে শ্রম উইং খোলা হয়েছে। রেমিট্যান্স হাউস খোলা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, 'বাংলাদেশি নাগরিকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটিয়ে জনশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করতে চাই। এ লক্ষ্যে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, আবুধাবি, ওমান ও লস অ্যাঞ্জেলেসে রেমিট্যান্স হাউস খোলার পদক্ষেপ নিয়েছি।'
দক্ষতা উন্নয়ন প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, 'দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আয় বাড়ে, বাড়ে জীবনযাত্রার মান।' প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, 'জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে দক্ষতা উন্নয়ন, জনশক্তি ও রেমিট্যান্স সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা। ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল সচিবালয় স্থাপনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষতা উন্নয়নে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে ১৪০ কোটি টাকার এনডাউমেন্ট ফান্ড গঠনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসী প্রক্রিয়ায় যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু করার কথা বলা হয়েছে, সেটা সময়ের দাবি।'
বিশ্ব শ্রমবাজারে কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা এখন সবচেয়ে স্বীকৃত বিষয়। আনস্কিল্ড বা অদক্ষ শ্রমিক এখন কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা এই একটি জায়গায় বেশ পিছিয়ে আছি বললে ভুল হবে না। আমাদের শ্রমিকদের একাগ্রতা ও অঙ্গীকার নিয়ে বিশ্ব শ্রমবাজারে কোনো কথা নেই। কিন্তু শ্রমিক অদক্ষ হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যমান ক্ষতির শিকার হতে হয়। এ ক্ষতি কতটা নিষ্ঠুর, তা আমাদের শ্রমিকরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। বিভিন্ন সময় বেশি মুনাফা লাভের আশায় কিছু কথিত চক্র বিপুলসংখ্যক অদক্ষ শ্রমিক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নানা দেশে পাঠায়। ফলে এসব শ্রমিক সেসব দেশে দায়ে পড়ে এতটাই কম দামে নিজের শ্রম বিক্রি করছেন যে অভিবাসন ব্যয় ওঠাতে গিয়েই তাঁকে হিমশিম খেতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অদক্ষ শ্রমিক হওয়ায় নানা রকম ফাঁদে পড়ে তাঁকে জীবন বাঁচানোর দায়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন বেছে নিতে হয়। বিশেষ করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে একসময় বিপুলসংখ্যক অদক্ষ শ্রমিক পাড়ি জমান, যার জের আমাদের এখনো টানতে হচ্ছে। এখন প্রায় সব দেশেরই কঠিন শর্ত- অদক্ষ নয়, দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে হবে। দক্ষ শ্রমিক তৈরির ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থেই প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, আমাদের কমিটমেন্টের দুর্বলতার কারণেই আমরা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে আমাদের সাফল্যের অনেক কিছু হারিয়ে ফেলতে বসেছি। আমরা অনেক সময় নেপাল-ভারত-শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে ভালো করছে বলে উদাহরণ দিই। কিন্তু তারা কেন করছে, এর উত্তরও আমাদের কাছে রয়েছে। তারা করতে পারছে, যেহেতু তাদের কমিটমেন্ট পরিষ্কার। তারা এমন কিছু করছে না বা করে না, যাতে তাদের শ্রমবাজার নষ্ট হয় কিংবা বাজারে কোনো মন্দ প্রভাব পড়ে। উলি্লখিত দেশগুলোতে অভিবাসনকেন্দ্রিক সামগ্রিক পলিসি চমৎকার, সরকারের দেখভাল সঠিক। সরকার এও দেখে, কোনো শ্রমিক তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কি না। তাঁর বেতন-ভাতা, প্রাপ্য সুবিধাদি সঠিক আছে কি না। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টোটা। এক শ্রেণীর কথিত চক্র আমাদের শ্রমিকদের এতটাই বিশ্ববাজারে সহজলভ্য করেছে যে হালে কোনো শ্রমিকই অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের মতো মূল্যায়িত হন না বা পারিশ্রমিক পান না।
এবারকার বাজেটে কর্মসংস্থান, শ্রমিক রপ্তানি, শ্রমিককে দক্ষ করে গড়ে তোলা, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক আলোচনা করা হলেও বাজেটে জনশক্তি খাতকে আরো এগিয়ে নেওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও বরাদ্দ লক্ষ করা যায়নি। বর্তমান বাজেটে জনশক্তি খাত নিয়ে অনেক আবেগসর্বস্ব কথা বলা হলেও কার্যকর পরিকল্পনার কথা খুব একটা বলা হয়নি। বাজেটে যা বলা হয়েছে, তার অনেকাংশই গত বছরের পুনর্বয়ান। আমরা মনে করি, এই সেক্টর নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ সুস্পষ্ট করা উচিত ছিল। দক্ষ শ্রমিক তৈরির ক্ষেত্রে সরকার কতটা কিভাবে, কোন মাধ্যমে করবে, সেটাও স্পষ্ট করা উচিত ছিল। অন্যদিকে জনশক্তি রপ্তানিকারক, অভিবাসী শ্রমিক এবং তাঁদের পরিবারের জন্য কল্যাণমূলক বিষয়েও এ বাজেটে তেমন কোনো দিক নির্দেশনা লক্ষ করা যায়নি। আমরা বারবারই বলছি, প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু কার্যত সরকার তাদের জন্য কিছু করছে বলে মনে হয় না। এবারকার বাজেটে অন্তত দুটি বিষয় সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন ছিল- প্রথমত, জনশক্তি রপ্তানি বাড়াতে কী কী আধুনিক পরিকল্পনা নেওয়া দরকার; দ্বিতীয়ত, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিনিয়োগ। এ দুটি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলে এ খাত আরো শক্তিশালী হতো। কিন্তু বাজেটে এ দুটি বিষয় পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠেনি।
সরকারি হিসাবে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অভিবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। সাড়ে তিন কোটি মানুষ এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। সুতরাং এ খাতে সরকারের আরো মনোযোগ অবশ্যই প্রয়োজন। অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সব সময়ই একটি কথা বলেন এভাবে- বাংলাদেশের তুলনামূলক দারিদ্র্য বিমোচন দ্রুত ও স্থায়িত্বশীলভাবে সেখানেই হয়েছে, যেসব অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক বিদেশে অভিবাসী হয়েছে। আমিও আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেখানেই বেশি পরিবর্তনের ছাপ দেখা যায়, যে অঞ্চলে অভিবাসীর হার বেশি। এ খাতের মাধ্যমে দারিদ্র্য যত দ্রুত বিমোচন করা সম্ভব, অন্য খাতগুলো দিয়ে ততটা সম্ভব নয়। এটা প্রমাণিত সত্য। ভবিষ্যতে এ খাতে আরো বেশি বাজেট বরাদ্দ হোক- আমাদের প্রত্যাশার খাতায় এটা লেখা রইল।

লেখক : জনশক্তি বিশ্লেষক এবং চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondibate@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.