ব্রিটেনে মুসলিম ছাত্রছাত্রী ও ইডিএল কিংবা ভিন্ন ধারার জঙ্গি by ফারুক যোশী

ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারি ফরমান এসেছে নতুন করে। এই নির্দেশনা এসেছে একটু দৃঢ় করে আবারও। এই নির্দেশের মধ্য দিয়ে নতুন করে নজরদারিতে আসছে মুসলিম ছাত্ররা। কেন সেই নজরদারি? একটি উদ্ভট যুক্তি আছে। উগ্র জঙ্গি খুঁজতে সেই নজরদারি। শুধু জনবিচ্ছিন্ন ও বিষণ্ন মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের তারা রাখছে সন্দেহের তালিকায়। তাই এদের ওপর নজর রাখতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।


যুুক্তিটা কী হতে পারে? বিষণ্ন ছাত্রছাত্রীরাই যে উগ্র মুসলিম হবে, তার যুক্তিটা কোথায় কিংবা জনবিচ্ছিন্ন মুসলিম তরুণরাই রেলস্টেশন উড়িয়ে দেবে_তার নিশ্চয়তাটাই এল কোথা থেকে? এর আগে যারা সেভেন-সেভেন ঘটিয়েছে, তারা কি বিষণ্ন মুসলিম ছিল? এখনো যারা সারা বিশ্বেই মুসলিম উগ্রপন্থী হিসেবে পরিচিত, তারা কি বিষণ্ন কিংবা জনবিচ্ছিন্ন? আধুনিক দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদ চালাতে বিষণ্ন হলে চলে না। তাকে চৌকস হতে হয় এবং আক্ষরিক অর্থে যারাই সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারা মুসলিম হোক আর খ্রিস্টান হোক, সত্যিকার অর্থে চৌকসই থাকে। নতুন কিছু সৃষ্টি করতে গিয়ে তাদের কি উগ্র মুসলিম হতেই হবে_এ ধারণাটা এল কিভাবে ব্রিটেন সরকারের?
এই নজরদারির পরিকল্পনাটা এ সরকারের নয়, আগের সরকারের। অর্থাৎ ব্রিটেনের লেবার সরকারের এটি একটি পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনার আওতায় প্রিভেন্ট পলিসি নামের যে স্কিমটি হাতে নিয়েছিল তৎকালীন ব্লেয়ার সরকার, তা নিয়ে হয়েছিল ব্যাপক আলোচনা। কারণ এই স্কিমের আওতায় স্থানীয় মুসলিম বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার কিংবা ভলান্টারি সংগঠনগুলো পেয়েছে বড় বড় ফান্ডিং কিংবা অনুদান। এগুলো কাজের কাজ কী করেছে তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। এই স্কিমের আওতায় মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করলেও মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করা কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা আছেই। ব্লেয়ার সরকারের এই চাপিয়ে দেওয়া স্কিমকে এখন নাগালের মধ্যে পেয়ে বর্তমান ডেভিড ক্যামেরনের সরকার এই পরিকল্পনাকে আরো দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রিভেন্ট পলিসির আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে বিষণ্ন কিংবা একাকী থাকা ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ব্রিটেনের মূলধারার প্রতিবেদনে এ নিয়ে আলোচনা উঠে এসেছে। তারাই দেখিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা কর্মকর্তারা এ নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছেন। সাধারণ কিংবা সচেতন একজন মানুষের মতো তাঁরাও মনে করছেন, ঢালাওভাবে কোনো ছাত্রছাত্রীকে এ ধরনের সন্দেহ করা সেই ছাত্র কিংবা ছাত্রীটির নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার সমান। এ দেশে ছাত্রছাত্রীদের নির্জনতার অনেক কারণই থাকতে পারে। কিন্তু উগ্র জঙ্গি হতে হলে একজন তরুণ কিংবা তরুণীকে বিষণ্ন হতে হয় না। যার প্রমাণ হালের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রোশনারা চৌধুরী, ছাত্র রাজিব কিংবা রসায়নের ওপর পিএইচডি করা ফয়সাল। এরা হলো জঙ্গি-লিংক বাঙালি তরুণ-তরুণী। অন্যদিকে পাকিস্তানি কিংবা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক যাদের নাম ইতিমধ্যে গণমাধ্যমগুলোতে এসেছে, তারাও কিন্তু বিষণ্ন্নতায় ভোগেনি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক জীবন, আর কেউ কেউ স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনই নির্বাহ করেছে। আর সে জন্যই হয়তো বাঙালি এমপি রোশনারা আলী বলেছেন, সরকারের এ রকম পরিকল্পনা মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের ওপর কলঙ্ক চাপিয়ে দেবে এবং সে জন্যই, এমনকি এই পরিকল্পনার জন্যই, তিনি তাঁর দলেরও সমালোচনা করেছেন এবং করছেন।
২. ইংলিশ ডিফেন্স লীগ, সংক্ষেপে ইডিএল এখনকার সময়ে এক আলোচিত নাম ব্রিটেনে। উগ্র বর্ণবাদী হিসেবে এরা পরিচিতি পেয়েছে ইতিমধ্যে। ব্রিটেনের বর্ণবাদীদের ক্রম-ইতিহাসে ন্যাশনাল ফ্রন্ট কিংবা বিএনপির ধারাবাহিকতায়ই এই ইডিএলের উত্থান। ন্যাশনাল ফ্রন্ট কিংবা বিএনপির সদস্যদের মতো সাধারণত বিভিন্ন অপরাধপ্রবণতায় জড়িতরাই মূলত ইডিএলের সদস্য। দুই বছর ধরে ইডিএল যেভাবে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে, বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোতে, তাদের মার্চ কিংবা বিক্ষোভ চালিয়ে বর্ণবাদ উসকে দিচ্ছে, তাতে শান্তিপ্রিয় মানুষ শঙ্কিতই থেকেছে সময়ে সময়ে। তাই শুধু বাঙালি-পাকিস্তানি তথা শুধু মুসলিমই নয়, শ্বেতাঙ্গ মানুষও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই বর্বর ফ্যাসিস্টদের রুখে দাঁড়িয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেটসে গত ৩ সেপ্টেম্বরের ইডিএলের মার্চ সামনে রেখে যেভাবে ভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ রাস্তায় নেমেছে, হাতে হাত রেখে বর্ণবাদমুক্ত টাওয়ার হ্যামলেটসের যে স্লোগান তুলেছে, তাতে সারা ব্রিটেনের শান্তিকামী মানুষই যেন একটা নতুন আশা দেখেছে।
৩. উগ্রতা সব সমাজেই একটি রোগের মতো। উগ্র ফ্যাসিস্টরা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে রোগ ছড়ায়। উগ্র জঙ্গি শুধু মুসলমানদের মধ্যেই কি জন্ম নিচ্ছে_এ প্রশ্নটি আছে। সমাজবৈষম্যের কারণে ব্রিটেনের মতো এমনকি ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায় একটা উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, যাদের কেউ কেউ কিংবা কোনো গোষ্ঠী বিচ্ছিন্নভাবে হয়তো ঘটায় সেভেন-সেভেন কিংবা নাইন-ইলেভেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই এরা মুসলিম সমাজটাকেই পৃথিবীর বুকে কলঙ্কময় করেছে। আবার ইউরোপীয় সমাজব্যবস্থায়ই আইআরএর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে, যারা মুক্ত আয়ারল্যান্ডের স্বপ্নে তাদের সন্ত্রাসের উগ্রতায় বিগত প্রায় চার দশকে অন্তত তিন হাজার ৭০০ ইউরোপীয়কে হত্যা করেছে বোমার আঘাতে।
সে কারণেই বলতে হয়, এখন যদি নজরদারি করতেই হয়, তাহলে ওই জনবিচ্ছিন্ন কিশোর-তরুণদের দিকে নজর দিতে হবে। ওই কিশোর-তরুণ-তরুণী মুসলমান হতে পারে, হতে পারে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি_যেকোনো ধরনের মানুষ। তাইতো এই বৈভবময় সমাজব্যবস্থায় না পাওয়ার একটা হতাশার চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে গত মাসে লুটপাটে অংশ নেওয়া হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর বিচারের শুনানির মধ্য দিয়ে। মুসলিম তরুণ-তরুণীরা জঙ্গি হচ্ছে, ইডিএল বর্ণবাদের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে, ভিন্ন বর্ণের কিশোর-তরুণরা দেশব্যাপী লুটপাটে অংশ নিচ্ছে।
লেখক : লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক
Faruk.joshi@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.