জননী সাহসিকা-মায়ের ভালোবাসাই আমাদের প্রাণ
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে হবে। স্বামী শহীদুল্লা কায়সারের কাছে বায়না ধরলেন পান্না কায়সার। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া কতটা নিরাপদ হবে তা একবার ভেবে নিলেন তিনি। কিন্তু স্ত্রীর তুমুল আগ্রহ দেখে গাড়িতে করেই তাঁকে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর অমর সেই কবিতা শুনতে। তাঁদের সঙ্গী হলো এক বছরের মেয়ে শমী কায়সার।
১০ মার্চ জন্ম নিল তাঁদের ছেলে অমিতাভ কায়সার।
১০ মার্চ জন্ম নিল তাঁদের ছেলে অমিতাভ কায়সার।
মা-বাবাকে রসিকতা করে বলতেন, ‘আমার দুই সন্তানই সাতই মার্চের ভাষণ শুনেছে। একজন শুনেছে সামনে থেকে আর অন্যজন পেটে থেকে!’
শমী কায়সারের মুখেই এই গল্প শোনা গেল।
সে সময় তাঁর বাবা শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক। পাকিস্তানি হায়েনাদের তাণ্ডব ও হত্যাযজ্ঞ পত্রিকায় তুলে ধরার জন্য তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নজরে পড়েন।
১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন পুরান ঢাকার কায়েতটুলি রোডের বাসায়। পান্না শমীকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন আর স্বামীর কথা শুনছেন। শহীদুল্লা কায়সার দেশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রচণ্ড রোমাঞ্চিত ছিলেন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। স্ত্রীকে বলছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে প্রথম পাতার হেডলাইন কী হবে? ছবির নিচে কোন ক্যাপশন যাবে।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। মুখে কালো কাপড় বাঁধা একজন এগিয়ে এল শহীদুল্লা কায়সারকে দেখে। তার পেছনেই ছিল পাকিস্তানি সৈনিক। দুধের শিশুকে রেখে পান্না কায়সার এগিয়ে গেলেন স্বামীকে বাঁচাতে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো তাঁকে। শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বোন দৌড়ে এসে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। মুখ বাঁধা লোকটির কাপড় টান দিয়ে দেখলেন সে রাজাকার খালেক মজুমদার, শহীদুল্লা কায়সারকে যে পাকিস্তানি সৈনিকদের চিনিয়ে দিয়েছিল।
মায়ের কাছে শোনা বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা বলে শমী কিছুটা থামলেন। ‘এই কথাগুলো মনে হলেই বুকটা যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠে আমার’, বললেন শমী।
শমীর বাবা আর কোনো দিনই ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীনের পরে পান্না সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন নিউ ইস্কাটন রোডের বাসায়।
স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে তাঁর তখনো অনেক দূরের পথ চলার বাকি। তখন মাত্র ২৪ বছর বয়স তাঁর। এক অল্প বয়সী বিধবা নারীর পক্ষে একা চলাটা তেমন সহজ ছিল না সে সময়। পান্না নিজের কর্মসংস্থানের জন্য কলেজে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি টিউশনিও করাতে লাগলেন। সন্তানদের ভালো রাখার জন্য অবসরের কথা চিন্তাই করতেন না কখনো।
মেয়েকে ভর্তি করালেন হলিক্রস স্কুলে আর ছেলেকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে।
‘বাবা সব সময় স্বপ্ন দেখতেন, আমি গান করি, সংগীতশিল্পী হই। বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মা নিজেই এগিয়ে এলেন, মা নিজেও গান শিখতেন। কিন্তু বিয়ের পর সংসারের চাপে যে হারমোনিয়াম তুলে রেখেছিলেন তা আবার আমার হাতে তুলে দিলেন। আমার গান শেখানোর জন্য মা তাঁর গানের ওস্তাদ গোপাল দাশগুপ্তকে বাসায় ডেকে নিয়ে এলেন।’ নিজের গান শেখার শুরুর কথা জানালেন শমী। শিল্প-সাংস্কৃতিক চর্চার অভ্যাস থাকায় তিনি মেয়েকেও এই দিকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। মায়ের উত্সাহতেই পরবর্তী সময়ে অভিনয়ের জগতে পা বাড়ান শমী কায়সার।
মা নিজের গয়না ও বাবার রেখে যাওয়া কিছু সম্পত্তি বেচে আমাদের মানুষ করার কাজ শুরু করেন। নিজেও করতেন প্রচুর পরিশ্রম। একটা সময়ে এসে হয়তো আমাদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে। কিন্তু আমাদের পরিবারের সামাজিক সমর্থন পাওয়া সে সময় কোনো সহজ বিষয় ছিল না। অনেকে মায়ের একা চলাটাকে সহজভাবে নেননি। কিন্তু মা সেদিকে নজর না দিয়ে আমাদের জন্য নিজের সবকিছু উত্সর্গ করে গেছেন। আমাদের কষ্ট হবে ভেবেই কি না কে জানে? মাকে আমাদের সামনে কখনো কাঁদতে দেখিনি! মায়ের ভালোবাসাই তো আমাদের প্রাণ, বলছিলেন শমী।
পান্না কায়সার কাজের ফাঁকে ফাঁকেই সময় দিয়েছেন স্বামীর ভালো লাগা সংগঠনগুলোর জন্য। খেলাঘর, উদীচীর বিকাশের জন্য কাজ করেছেন তিনি। যুক্ত হয়েছেন আন্তর্জাতিক সমিতির সঙ্গে, এখনো এই সংগঠনগুলোর পাশে আছেন। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পর মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। এরপর মা আমাকে একটা দামি পোশাক কিনে দেন। সেই পোশাক পাওয়ার পর আমার যে আনন্দ হয়েছিল, তা মনে পড়লে এখনো মনে মনে আনন্দ হয় আগের মতোই। মায়ের কথা বলতে গিয়ে এ ঘটনাটার কথা বিশেষভাবে বললেন শমী।
সন্তানদের নিয়ে পান্না কায়সারের কষ্ট বিফলে যায়নি। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়ছেন, তেমনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর ছেলেও এখন প্রতিষ্ঠিত।
শমী বলেন, মা সব সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেছেন। মা বলেন, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেন একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যেন তারা রেহাই না পায়। শমীর মায়ের এই কথাগুলো কি কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছাবে?
মোসাব্বের হোসেন
সংশোধনী: গতকাল ফিচারে শহীদ মুনীর চৌধুরী ও লিলি চৌধুরীর সন্তান আহমেদ মুনীর ভাষণকে মেজো ছেলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে তিনি এই পরিবারের বড় ছেলে। আশফাক মুনীর মিশুক মেজো ছেলে। দুঃখিত।
শমী কায়সারের মুখেই এই গল্প শোনা গেল।
সে সময় তাঁর বাবা শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক। পাকিস্তানি হায়েনাদের তাণ্ডব ও হত্যাযজ্ঞ পত্রিকায় তুলে ধরার জন্য তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নজরে পড়েন।
১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন পুরান ঢাকার কায়েতটুলি রোডের বাসায়। পান্না শমীকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছেন আর স্বামীর কথা শুনছেন। শহীদুল্লা কায়সার দেশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রচণ্ড রোমাঞ্চিত ছিলেন। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য। স্ত্রীকে বলছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে প্রথম পাতার হেডলাইন কী হবে? ছবির নিচে কোন ক্যাপশন যাবে।
এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। মুখে কালো কাপড় বাঁধা একজন এগিয়ে এল শহীদুল্লা কায়সারকে দেখে। তার পেছনেই ছিল পাকিস্তানি সৈনিক। দুধের শিশুকে রেখে পান্না কায়সার এগিয়ে গেলেন স্বামীকে বাঁচাতে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হলো তাঁকে। শহীদুল্লা কায়সারকে নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বোন দৌড়ে এসে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। মুখ বাঁধা লোকটির কাপড় টান দিয়ে দেখলেন সে রাজাকার খালেক মজুমদার, শহীদুল্লা কায়সারকে যে পাকিস্তানি সৈনিকদের চিনিয়ে দিয়েছিল।
মায়ের কাছে শোনা বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা বলে শমী কিছুটা থামলেন। ‘এই কথাগুলো মনে হলেই বুকটা যন্ত্রণায় কেঁপে ওঠে আমার’, বললেন শমী।
শমীর বাবা আর কোনো দিনই ফিরে আসেননি। দেশ স্বাধীনের পরে পান্না সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন নিউ ইস্কাটন রোডের বাসায়।
স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে তাঁর তখনো অনেক দূরের পথ চলার বাকি। তখন মাত্র ২৪ বছর বয়স তাঁর। এক অল্প বয়সী বিধবা নারীর পক্ষে একা চলাটা তেমন সহজ ছিল না সে সময়। পান্না নিজের কর্মসংস্থানের জন্য কলেজে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি টিউশনিও করাতে লাগলেন। সন্তানদের ভালো রাখার জন্য অবসরের কথা চিন্তাই করতেন না কখনো।
মেয়েকে ভর্তি করালেন হলিক্রস স্কুলে আর ছেলেকে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে।
‘বাবা সব সময় স্বপ্ন দেখতেন, আমি গান করি, সংগীতশিল্পী হই। বাবার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মা নিজেই এগিয়ে এলেন, মা নিজেও গান শিখতেন। কিন্তু বিয়ের পর সংসারের চাপে যে হারমোনিয়াম তুলে রেখেছিলেন তা আবার আমার হাতে তুলে দিলেন। আমার গান শেখানোর জন্য মা তাঁর গানের ওস্তাদ গোপাল দাশগুপ্তকে বাসায় ডেকে নিয়ে এলেন।’ নিজের গান শেখার শুরুর কথা জানালেন শমী। শিল্প-সাংস্কৃতিক চর্চার অভ্যাস থাকায় তিনি মেয়েকেও এই দিকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। মায়ের উত্সাহতেই পরবর্তী সময়ে অভিনয়ের জগতে পা বাড়ান শমী কায়সার।
মা নিজের গয়না ও বাবার রেখে যাওয়া কিছু সম্পত্তি বেচে আমাদের মানুষ করার কাজ শুরু করেন। নিজেও করতেন প্রচুর পরিশ্রম। একটা সময়ে এসে হয়তো আমাদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে। কিন্তু আমাদের পরিবারের সামাজিক সমর্থন পাওয়া সে সময় কোনো সহজ বিষয় ছিল না। অনেকে মায়ের একা চলাটাকে সহজভাবে নেননি। কিন্তু মা সেদিকে নজর না দিয়ে আমাদের জন্য নিজের সবকিছু উত্সর্গ করে গেছেন। আমাদের কষ্ট হবে ভেবেই কি না কে জানে? মাকে আমাদের সামনে কখনো কাঁদতে দেখিনি! মায়ের ভালোবাসাই তো আমাদের প্রাণ, বলছিলেন শমী।
পান্না কায়সার কাজের ফাঁকে ফাঁকেই সময় দিয়েছেন স্বামীর ভালো লাগা সংগঠনগুলোর জন্য। খেলাঘর, উদীচীর বিকাশের জন্য কাজ করেছেন তিনি। যুক্ত হয়েছেন আন্তর্জাতিক সমিতির সঙ্গে, এখনো এই সংগঠনগুলোর পাশে আছেন। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পর মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। এরপর মা আমাকে একটা দামি পোশাক কিনে দেন। সেই পোশাক পাওয়ার পর আমার যে আনন্দ হয়েছিল, তা মনে পড়লে এখনো মনে মনে আনন্দ হয় আগের মতোই। মায়ের কথা বলতে গিয়ে এ ঘটনাটার কথা বিশেষভাবে বললেন শমী।
সন্তানদের নিয়ে পান্না কায়সারের কষ্ট বিফলে যায়নি। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়ছেন, তেমনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর ছেলেও এখন প্রতিষ্ঠিত।
শমী বলেন, মা সব সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেছেন। মা বলেন, স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেন একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যেন তারা রেহাই না পায়। শমীর মায়ের এই কথাগুলো কি কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছাবে?
মোসাব্বের হোসেন
সংশোধনী: গতকাল ফিচারে শহীদ মুনীর চৌধুরী ও লিলি চৌধুরীর সন্তান আহমেদ মুনীর ভাষণকে মেজো ছেলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে তিনি এই পরিবারের বড় ছেলে। আশফাক মুনীর মিশুক মেজো ছেলে। দুঃখিত।
No comments