সময়ের কথা-সওয়ার যখন বাঘের পিঠে by অজয় দাশগুপ্ত

আজ ৬ জানুয়ারি রোববার মহাজোট সরকারের চার বছর পূরণ হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার জোট সঙ্গীরা আজ হরতাল আহ্বান করেছে দেশব্যাপী। তাদের প্রতিবাদের ইস্যু_ পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি।
বিএনপির এক বড় মাপের নেতা তরিকুল ইসলাম বলেছেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে_ যাতে পরের দিন শুক্রবার হরতাল দিতে না পারি। এ কারণেই রোববার হরতাল ডাকা হয়েছে।
বিএনপি বলেছিল, বিদ্যুতের দাম ফের বাড়ালেই হরতাল ডাকা হবে। সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ায়নি, পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে। এটা বিরোধী দলের জন্য বোনাস। তারা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য ফের আরেক দফা হরতাল ডাকতে পারবে। তবে লাভের ওপর যেমন ফাও থাকে, তেমনি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জন্য সুযোগ মিলেছে মহাজোট সরকারের চার বছর পূরণের দিনে হরতাল আহ্বানের। এতে আওয়ামী লীগের 'চার বছরের অনন্য সাফল্য' উদযাপনে তেমন সমস্যা হবে না। তারা আনন্দ মিছিল-শোভাযাত্রা ঠিকই বের করতে পারবে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনযাপনে সমস্যায় পড়বে সাধারণ মানুষ, যাদের দুঃখ-কষ্টে যারপরনাই ব্যথিত হয়ে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে হরতাল ডেকেছে বিএনপি এবং তার মিত্র দলগুলো।
পেট্রোল-ডিজেল বাংলাদেশ আমদানি করে। বিশ্ববাজারে যেমন দামে কেনা হয়ে থাকে, দেশে তেমন দামেই বিক্রি করতে হবে_ এ যুক্তি সরকারের। জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার কয়েক দফা শাসনামলে একই যুক্তিতে বিএনপি এ পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। তখন প্রতিবাদ করেছে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দল। এইচএম এরশাদের শাসনামলে প্রতিবাদ করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মিলিতভাবে। তখন আরও অনেক দলকে তারা সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি বিরোধী দলগুলোর কাছে হরতাল আহ্বানের ইস্যু হয়ে আছে।
বাংলাদেশ এখন বছরে ৫০০ কোটি ডলারের মতো পরিশোধিত ও অপরিশোধিত পেট্রোল-ডিজেল আমদানি করে। এখন চাল আমদানির প্রয়োজন নেই। মেশিন-যন্ত্রাংশ-শিল্পের কাঁচামাল এসব আমাদের আমদানি করতে হয়। তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান কাঁচামাল বস্ত্র-সুতা-তুলার সিংহভাগ আমদানি করা হয়। পোশাক শিল্প বাবদ যা আমদানি, পেট্রোল-ডিজেল-কেরোসিন আমদানির জন্য খরচ পড়ে তার কাছাকাছি, কখনও বা বেশি। ফুয়েল বলে কথা! পোশাকের কারখানা চালাতেও যে এটা চাই।
৫০০ কোটি ডলার বাংলাদেশের ৪২-৪৩ হাজার কোটি টাকার সমান। এই যে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি, কোন বছরে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ কেনা হয়, দরদাম কীভাবে ঠিক হয় সেটা পাবলিকের জানার উপায় নেই। সরকারের একাধিক দফতর এই হিসাব অবশ্যই জানে। কিন্তু তাতে কমিশন বা ঘুষ থাকে কতটা, সেটা পাবলিকের বিষয় নয়। সরকারি সব কেনাকাটা এবং সড়ক, সেতু, স্কুল, হাসপাতাল কিংবা এ ধরনের প্রকল্পের কাজ যারা পায় তাদের ভালো লাভ থাকে, এটা জানা কথা। যারা কাজের বিলি-বণ্টনে যুক্ত তারাও এ থেকে লাভবান হন। পদ্মা সেতু নির্মাণে যুক্ত প্রভাবশালীরাও এটা চেয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের মতো 'দাতা' প্রতিষ্ঠানের যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ঋণ অনুমোদন এবং বিল ছাড় করার সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তারাও নিজের আখের গুছিয়ে নিতে ছাড়েন না_ এমন অভিযোগ রয়েছে। তবে এটা প্রমাণ করা যায়, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধা সহজ নয়। বিশ্বব্যাংকের অনেক সহযোগী রয়েছে বাংলাদেশে, যারা সব জানেন কিন্তু বলেন কালেভদ্রে। ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে এবং বাইরে তাদের সমর্থক প্রভাবশালীদের মধ্যেও মাঝেমধ্যে সংঘাত-হানাহানি, তার পেছনেও থাকে এই সুবিধা কে বেশি ভোগ করবে, তার প্রতিযোগিতা।
সরকারি ব্যয়ের অডিট করেন যারা তাদের একাধিকবার জিজ্ঞেস করেছি_ পেট্রোল-ডিজেলের মতো বড় ধরনের কেনাকাটায় কোনো কমিশন গ্রহণ আছে কি-না, তার অনুসন্ধান কখনও হয়েছে কি? তেমন সদুত্তর পাইনি। বিএনপির হরতাল সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন, তাতেও উত্তর মিলবে না। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের ক্ষমতায় যারা বিভিন্ন সময়ে রয়েছে তাদের প্রভাবশালী অংশ কখনও এ ধরনের বিব্রতকর প্রশ্নের মীমাংসায় আগ্রহ দেখায় না।
সরকারের চার বছরের কথায় ফিরে আসি। এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আর বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়া সমান কথা। পিঠ থেকে নামতে গেলে বাঘে খেয়ে ফেলবে। সমস্যার ব্যাপকতা ও গভীরতা এত বেশি যে একটি দিনের জন্যও স্বস্তি মেলে না।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের সাফল্য নেই (যার কোনো কোনোটির মাত্রা বেশ বড়), এ কথা তার চরম শত্রুও বলবে না। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে, এমন কথা অনেকেই ভাবেনি। এখন খুব সস্তায় চাল মেলে। আশির দশকে এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় থাকার সময়ে কৃষক-ক্ষেতমজুররা মিলেমিশে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তখন অর্থনীতিবিদ ও আন্দোলনের নেতারা আলাপ করে দাবি করেছিলেন যে জমিতে যারা কাজ করে তাদের দিনে কমপক্ষে এমন মজুরি হওয়া উচিত, যাতে সাড়ে তিন কেজি চাল বাজার থেকে কিনে আনতে পারেন। এ দাবি আংশিক আদায় হয়েছিল। কিন্তু এখন ২-৩ দশক পর শহর ও গ্রামের দিনমজুররা যে মজুরি প্রতি দিনে পায় তাতে ৮-১০ কেজি চাল বাজার থেকে কিনে আনতে পারে। তাই বলে কি আমজনতা বলে বেড়াবে যে তারা খুব ভালো আছে? সেটা আশা করা যে কোনো সরকারের জন্য বোকামি হবে। কারণ, মানুষের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ে। দেশের যে কমবেশি উন্নতি ঘটছে, সেটা তারা জানে। বিশ্বের অনেক দেশেই পরিবর্তন ঘটছে ভালোর দিকে, সেটাও আর অজানা নেই। টেলিভিশন, ইন্টারনেট তো আছেই। বাংলাদেশেরও তো অন্তত দেড়-দুই কোটি লোক বিদেশ ঘুরে এসেছে। আগে কেবল বড় লোকরা বিদেশ যেত, এখন মজুরের পরিবারের ছেলেও সৌদি আরব বা মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পায়। বস্তির মেয়েরাও বাইরে চাকরি পেতে পারে। এমন একটি দেশে এক কোটি কৃষককে দশ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে দেওয়া কিংবা তার ছেলে বা মেয়েকে বিনামূল্যে বছরে একবার এক বা দেড় হাজার টাকার বই দিয়েই খুশিতে ডগমগ করে রাখা যাবে না। সমুদ্রসীমা বাড়ানোর মামলায় জয় ছিনিয়ে আনা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য বড় অর্জন। এ নতুন সীমানার ভেতরে অনেক সম্পদ রয়েছে, এমনই ধারণা। কিন্তু দ্রুত এ থেকে ফল মিলবে, তেমন আশা করা যায় না। তাই সমুদ্র জয়কে মহাজোট সরকারের নজরকাড়া সাফল্য হিসেবে তুলে ধরে ভোটের বাক্স ভরার রসদ পাওয়ার সম্ভাবনা আদৌ নেই।
বিদ্যুৎ উৎপাদন চার বছরে দ্বিগুণ করা হয়েছে_ এটা পাবলিক মানে। কিন্তু এখনও যে অর্ধেক গ্গ্নাস খালি নাকি অর্ধেক ভরা, এ প্রশ্ন সবাইকে আলোড়িত করে। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান বন্ধ রয়েছে। শহরে যে বাড়িতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নেই এবং যে বাড়িতে আছে, তার ভাড়ার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। যেসব বাড়িতে পুরনো বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ রয়েছে সেখানে ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। একই সঙ্গে রয়েছে নিয়মিত বিদ্যুতের দাম সরকারিভাবে বাড়িয়ে চলার প্রবণতা। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর সুফল ভোগ করা লোকজন সরকারকে বাহবা দেবে এমন লোক তেমন মিলবে না।
তাই তো দেখি, এসব সাফল্যে উল্লসিত হওয়ার পরিবর্তে হলমার্ক নামের একটি অখ্যাত গোষ্ঠী কর্তৃক সরকার নিয়ন্ত্রিত সোনালী ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা তাদের বেশি ক্ষুব্ধ করে। যতবার শীতের কুয়াশায় বরিশাল-পটুয়াখালীর লঞ্চ বা ফেরি আটকা পড়ে থাকে পদ্মা নদীতে, ততবার তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে পদ্মায় সেতু না হওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধনের সময় বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের পদ্মা সেতুর ডিজাইন করতে বলেছেন। এটা করা সম্ভব। কিন্তু পাবলিক খুব ভালো করেই বোঝে যে শেখ হাসিনা বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেও সেতুটি বানাতে পারেননি। এ দায়িত্ব তিনি ঘনিষ্ঠ লোকদের দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা দেশের স্বার্থও বোঝেনি, ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থও বোঝেনি।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগও এটা বোঝেনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাতে ভোটের দিনেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে। সেই রাত থেকেই যে অনিয়ম-অন্যায় দেশের সবচেয়ে পুরনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্তদের একটি অংশ শুরু করেছে, আজও তা সমানে চলছে। তাদের সামনে প্রতিপক্ষ নেই। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরকে প্রথমদিনেই তারা সব ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়েছে। তারা ক্যাম্পাসে থাকলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাজ করে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর তাগিদ থাকবে। কিন্তু পেশিশক্তি ব্যবহার করে ক্যাম্পাসে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তারা নির্বিঘ্নে মনোযোগী হতে পারছে ব্যবসা-বাণিজ্য-টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিতে। এ নিয়ে যা গণ্ডগোল, তা কেবল নিজেদের সংগঠনের মধ্যে_ কোন্দলের ইস্যু কোনো আদর্শ নয়, কেবলই বখরা।
সঙ্গত কারণেই ভালো হেরে যাচ্ছে মন্দের কাছে। সাফল্য ম্লান হচ্ছে ব্যর্থতায়। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের প্রতি দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘৃণা ও ক্ষোভ, তারপরও খালেদা জিয়ার দল বিএনপি গোলাম আযমের সঙ্গে ঐক্য করে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিতে পারছে। স্বপ্ন দেখছে পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে আসার।
আওয়ামী লীগ নামের দলটি কি তাহলে নিজের পায়ে কুড়াল মারছে? দেশ-ভাবনা কি বিদায় নিয়েছে সেইসব কর্মীর মধ্য থেকে, যারা ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা নিয়ে পল্টন এলাকা দখলে নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নির্বাচনী ওয়াক ওভারের স্বপ্ন নস্যাৎ করে দিয়েছিল?

অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.