মেলা শেষের ভাবনা by বাহাউদ্দীন চৌধুরী
ভাষার মাস চলে গেল। একুশের বইমেলাও শেষ হয়ে গেছে। বইমেলায় এবার ভাল বিক্রি হয়েছে। তাতে মনে হয়, মানুষ এখন বেশি বই পড়ছে। এটা খুব ভাল লৰণ।
হতাশাদীর্ণ, সমস্যাসঙ্কুল এই দেশে কদাচিত সুখবর পাওয়া যায়। বইমেলার সাফল্য অবশ্যই একটি সুখবর। আগের লেখায়, আমি বাংলা ভাষার বিকৃতি এবং সর্বৰেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার না করার প্রবণতার কথা লিখেছিলাম। সচিবালয়ে এখনও বাংলা ভাষার ব্যবহার কম হয়। সাধারণত ইংরেজী ভাষায়ই নথিপত্র লেখা হয়। উচ্চ আদালতে খুব কমই বাংলা ব্যবহার হয়। কয়েক বছর আগে বিচারপতি এবাদুল হক বাংলায় রায় লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ও বাংলায় লেখা হয়েছে। কিন্তু আর কেউ বাংলায় রায় লিখছেন না। আদালতে আইনজীবিগণও ইংরেজীতে সওয়াল জবাব করেন। কদাচিত বাংলা ব্যবহার করেন। এই প্রবণতা দূর করতে হবে। এখন থেকে সব বিচারকেরই বাংলায় রায় লেখার অভ্যাস করতে হবে। এই ফেব্রম্নয়ারি মাসেই বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ উচ্ছ্বাস থাকে। ফেব্রম্নয়ারি চলে গেলেই সবাই বাংলা ভাষার কথা ভুলে যায়। এবারে শপথ নিতে হবে সারা বছরই সর্বসত্মরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়টি মনে রাখতে হবে।আরও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। তা হলো আকাশ সংস্কৃতির কারণে হিন্দী ভাষার আগ্রাসন। এটা প্রতিহত করার কোন উপায়ের কথা বলিনি। এবারে সেটা বলছি। ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলসমূহ অবাধে আমাদের দেশে প্রদর্শিত হয়; অথচ আমাদের স্যাটেলাইট চ্যানেল ভারতে প্রদর্শিত হয় না। সরকারের এই বিষয়ে নজর দেয়া উচিত। আমাদের চ্যানেল না দেখালে ভারতীয় চ্যানেল দেখানোর বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপের কথা ভাবা যেতে পারে। এই সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটি বিষয় বর্ণনা করছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের নয়াদিলস্নীস্থ হাই কমিশনার ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির চুক্তি করেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে আমি এই আমদানির বিরোধিতা করি। আমি বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে দিলস্নী গিয়ে চুক্তিটি কিছুটা সংশোধনের প্রসত্মাব করি। আমরা যে টাকার ভারতীয় ছবি আনব সম পরিমাণ টাকার আমাদের ছবিও ভারতকে নিতে হবে। ভারত আমাদের কোন ছবি নেয়নি। কাজেই তাদের ছবিও আমদানি হয়নি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে আমাদের দেশে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি হতো। ১৯৭২ সালে সেই সব চলচ্চিত্রের নতুন সেন্সর সার্টিফিকেট চাওয়া হয়। আমি সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নতুন সেন্সর সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকার করি। কারণ অসম প্রতিযোগিতায় আমাদের শিশু চলচ্চিত্র শিল্পের নিদারম্নণ ৰতি হবে। আমাকে ভারতীয় মুদ্রায় কোটি টাকার উপরে ঘুষ প্রদানের প্রসত্মাব দেয়া হয়। আমি রাজি না হওয়ায় ভারতীয় ছবির পরিবেশকগণ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মারফৎ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ভারতীয় ছবির সেন্সর সার্টিফিকেটের আদেশ নিয়ে নেন। নথিটি আমার কাছে গেলে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে এই আদেশ প্রয়োগের বিরোধীতা করি। বঙ্গবন্ধুকে বোঝানো হয়েছিল ছবির অভাবে সিনেমা হলসমূহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই ভারতীয় ছবিগুলো দেখানোর অনুমতি দেয়া হোক। অনেক প্রমোদ কর পাওয়া যাবে। কোন সিনেমা হলই বন্ধ হয়নি। একটা বানোয়াট তথ্য বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিল। আমি তাকে সব বুঝিয়ে বললাম। তিনি বললেন, আমি তো অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। আমি তাকে নথিটি দেখালাম। তাতে আমি লিখেছি : আপাতত এই আদেশ প্রয়োগ স্থগিত রইল। বঙ্গবন্ধু নিচে স্বাৰর করলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বেঁচে গেল। আমি সচিবালয়ের টপ মহলে শত্রম্ন সৃষ্টি করলাম। তার জন্য অবশ্য পরবর্তী সময়ে আমাকে ভুগতে হয়েছে।
ভারতীয় পত্র-পত্রিকা নিয়েও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। স্বাধীনতার আগে আমাদের অবজারভার ও চিত্রালী পত্রিকা কলকাতায় বিক্রি হতো। তেমনি ভারতীয় আনন্দবাজার, দেশ ইত্যাদি পত্রিকা বাংলাদেশে আসত স্বাধীনতার স্বাধীনতার পরে আমাদের পত্রিকা ভারত আমদানি বন্ধ করে দেয়। আমিও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় পত্রিকা বিমানবন্দর থেকে বাজেয়াফত করি এবং আমদানি নিষিদ্ধ করি। পারস্পরিক বিনিময়ভিত্তিতেই এসব করা উচিত। এখনও আমাদের বই-পুসত্মক ভারত তেমন আমদানি করে না; অথচ ভারতীয় বইপত্র অবাধে বাংলাদেশে আসে। আমাদের সৃজনশীল সাহিত্য মানের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনীয়। কাজেই হীনন্মন্যতায় না ভুগে পশ্চিম বঙ্গে আমাদের বই রফতানি করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমার জানা মতে, ভারত সরকারের পৰ থেকে কোন বাধা নেই। যোগাযোগ করতে হবে পশ্চিমবঙ্গের পুসত্মক বিক্রেতাদের সঙ্গে। সেটা করার জন্য আমাদের সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা বইয়ের একটি বড় বাজার। সেখানে জায়গা করে নিতে পারলে অন্যান্য বাংলা ভাষী এলাকায়ও আমাদের বই বিক্রি হতে পারে। ভাষার মাসে এসব ভাবনা আমাকে আলোড়িত করেছে। হয়ত আরও অনেককেই করেছে। আশা করব, বাংলা একাডেমী ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
শিবগঞ্জের মসলা গবেষণা কেন্দ্র : বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ মসলা গবেষণা কেন্দ্র সম্পর্কে ইতোপূর্বেও লিখেছিলাম। নিম্ন বেতনভুক কয়েক কর্মচারীর দুঃখ-দুর্দশার কথা মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর গোচরে আনতে চেয়েছিলাম। কৃষিমন্ত্রী দয়া পরবশ হয়ে নিম্নপদস্থ দশ কর্মচারীকে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়মিত কর্মচারী হিসেবে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ করা হয়নি। তাদের বেতন-ভাতা 'আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে তারা সরকারী কর্মচারীদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই ব্যবস্থায় তারা পেনশন ও প্রভিডেন্ডত্ম ফান্ডের সুযোগ পাবেন না। আর পদগুলো প্রতি বছর নবায়ন করতে হবে। তাতে অত্যনত্ম অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদের দিন কাটাতে হবে। আমার আবেদন তাদের স্থায়ীভাবে নিয়মিত পদে আত্তীকরণ করা হোক। এটা করা খুবই সহজ। কেবল প্রয়োজন সহানুভূতি ও মানবিক দয়া।
বাংলাদেশে মসলার বাজারে আগুন লেগেছে। গত বছরের চাইতে কোন কোন মসলার দুইগুণ তিনগুণ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। আমদানিনির্ভর থাকলে চড়া দামেই মসলা কিনতে হবে। অথচ মসলা গবেষণা কেন্দ্রে উন্নত জাতের মসলার ফলন হচ্ছে। কিন্তু সারাদেশে এসব মসলার ফলন নেই। চাষীরা এই গবেষণার সুফল পাচ্ছে না। তাই মসলা গবেষণা কেন্দ্রের কর্মপরিধি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। গবেষণালব্ধ জ্ঞান চাষীদের দিতে হবে। ভাল বীজ ও চারা সরবরাহ করতে হবে। এসব করার জন্য অভিজ্ঞ কর্মী আবশ্যক যাদের আউট সোর্সিং-এর মাধ্যমে। বেতনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের সকলের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের স্থায়ীভাবে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ করা হলে কর্মস্পৃহা আরও বাড়বে। আমি এই বিষয়ে মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা
সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
No comments